সাগর-রুনি হত্যার ৩ বছর সেই তিমিরেই মামলার তদন্ত by নুরুজ্জামান লাবু
সাংবাদিক
দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। কিন্তু এই তিন
বছরেও হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি। মামলার তদন্তের কোন অগ্রগতি হয়নি।
থানা পুলিশ, ডিবি ঘুরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্ত করছে এলিট
ফোর্স র্যাব। অনেককে ধরপাকড়, অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও কোনও আশার বাণী
শোনাতে পারেনি মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এককথায়, মামলার তদন্তে
কোন অগ্রগতি নেই। পুরোটাই থমকে আছে তদন্ত। এদিকে অন্তহীন অপেক্ষায় পরিবারের
সদস্যরা। ন্যায় বিচারের আশা ছাড়েননি এখনও। আশার প্রহর গুনছেন তারা।
পরিবারের সদস্যদের এখনও বিশ্বাস, কোন একদিন হয়তো এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য
উন্মোচিত হবে। খুনিরা ধরা পড়বে। তাদের বিচার হবে। সেই দিনের দিকে চেয়ে আছেন
তারা। ২০১২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া
বাসা থেকে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরোয়ার ও এটিবাংলার
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা
রাতের কোন এক সময়ে সাগরু-রুনিকে ছুরিকাঘাতে নির্মমভাবে হত্যা করে। ওই দিনই
তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে
খুনিদের গ্রেপ্তারের ঘোষণা দেন। এর দু’দিনের মাথায় ১৩ই ফেব্রুয়ারি পুলিশ
সদর দপ্তরের সাংবাদিক সম্মেলনে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ‘প্রণিধানযোগ্য
অগ্রগতি’ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ
খন্দকার। কিন্তু একে একে হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পূর্ণ হলেও সেই
‘প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি’র কথা জানতে পারেনি কেউ। খুনের মোটিভ জানা যায়নি।
ধরা পড়া তো দূরের কথা, খুনিদের চিহ্নিতও করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর
সদস্যরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মামলটি প্রথমে তদন্ত শুরু করে শেরেবাংলানগর থানা পুলিশ। একদিনের মাথায় তা স্থানান্তর করা হয় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে। একপর্যায়ে উচ্চ আদালতে ব্যর্থতা স্বীকার করলে আদালত মামলাটি র্যাবকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। বতর্মানে মামলাটির তদন্ত করছেন র্যাব ইনভেস্টিগেশন সেলের এএসপি ওয়ারেছ। তদন্তের দায়িত্ব নেয়ার পর আদালতের নির্দেশে ২০১২ সালের ২৬শে এপ্রিল হত্যাকাণ্ডের ৭৫ দিন পর কবর থেকে লাশ তুলে ভিসেরা পরীক্ষা করা হয়। ভিসেরা রিপোর্টে এই সাংবাদিক দম্পতিকে হত্যার আগে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল কিনা তা জানার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এমন আলামতও পাওয়া যায়নি। সূত্র জানায়, সাগর-রুনি ও হত্যাকাণ্ডের ব্যবহৃত ছুরি ও হাত-পা বাঁধার রশিসহ বিভিন্ন আলামত পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফরেনসিক গবেষণাগারে। এসব আলামত থেকে পৃথক দু’টি পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়ার কথাও ঘোষণা দেয় র্যাব। পরবর্তীতে এসব নমুনার সঙ্গে মিলিয়ে দেখার জন্য সন্দেহভাজন আরও ২১ জনের ডিএনএ নমুনাও পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রে। সেই রিপোর্ট হাতে পেয়েছে র্যাব। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন হয়নি। কারও সঙ্গে সেই ডিএনএ নমুনা মিলেনি। র্যাব কর্মর্তারা অবশ্য বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো পরীক্ষার প্রতিবেদনগুলো নিয়ে র্যাব কাজ করছে। তবে এখন পর্যন্ত বলার মতো কোন অগ্রগতি নেই। র্যাব’র আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, মামলাটি প্রথম থেকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। রহস্য উন্মোচনে চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। ডিএনএ প্রতিবেদন, বিভিন্ন জনকে জিজ্ঞাসাবাদসহ নানা বিষয় নিয়ে র্যাব কাজ করে যাচ্ছে। মামলাটির রহস্য উন্মোচনে র্যাব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই গ্রিলকাটা চোরসহ কয়েকটি বিষয় নিয়ে তদন্ত করে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। ঘটনার পর ডিবি পুলিশ এক ছিঁচকে চোরকে নিয়ে রাজাবাজারে সাগর-রুনির বাসায় গিয়ে জানালা দিয়ে ভেতরে প্রবেশও করায়। কিন্তু পরে গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে লেখালেখির কারণে তা নিয়ে আর এগোয়নি পুলিশ। ঘটনার বাসার দুই দারোয়ান রুদ্র পলাশ ও এনামুলকে নিয়ে রহস্য তৈরি হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের ছেড়ে দিলে এনামুল পালিয়ে যায়। পরে এনামুলকে ধরিয়ে দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দশ লাখ টাকা পুরস্কার হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু এনামুলকে র্যাব গ্রেপ্তার করেও কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে কোন তথ্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি। সর্বশেষ গত নভেম্বরে পলাশ ও এনামুলকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সূত্র জানায়, মামলার একপর্যায়ে তদন্ত কর্মকর্তা সাগর-রুনি হত্যা মামলায় পাঁচ ডাকাতকে গ্রেপ্তার দেখায়। তারা হলো- রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, সাঈদ, মিন্টু, কামরুল হাসান ওরফে অরুণ। এই পাঁচজন মহাখালীর ডা. নিতাই হত্যাকাণ্ডের আসামি। তাদেরও কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোন তথ্য পায়নি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তাদের কেউ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেননি। এ ঘটনায় বর্তমানে দুই দারোয়ানসহ সাতজন কারাবন্দি রয়েছে। সূত্র জানায়, সাগর-রুনি হত্যকাণ্ডে সন্দেহভাজন হিসেবে তাদের পারিবারিক বন্ধু তানভীর নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তার কাছ থেকে কোন তথ্য উদ্ধার করতে পারেনি র্যাব। বর্তমানে তানভীর জামিনে রয়েছেন।
তদন্ত সূত্র জানায়, উচ্চ আদালতের নির্দেশে প্রতি মাসেই একবার তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত কর্মকর্তা। এ পর্যন্ত আদালতে ৩২টি অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ প্রতিবেদন দেয়া হয় গত ২রা ফেব্রুয়ারি। আগামী ১লা এপ্রিল পরবর্তী অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। তবে প্রতিটি প্রতিবেদনের ভাষাই এক। তাতে রহস্য উদ্ঘাটনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে বলে বলা হয়েছে।
এদিকে হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ তিন বছর পার হয়ে গেলেও খুনিদের শনাক্ত করতে না পারায় ক্ষোভ আর হতাশা ব্যক্ত করেছেন পরিবারের সদস্যরা। মামলার বাদী ও নিহত রুনির ভাই নওশের আলম রোমান বলেন, তদন্তে কোন অগ্রগতি নেই। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা তাদের কিছু জানানও না। এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন হবে না এমন মন্তব্য করে নওশের আলম রোমান বলেন, আশা পুরোপুরি ছেড়ে দিলেও অপেক্ষায় আছি, কোন একদিন হয়তো এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য ঠিকই উন্মোচন হবে। ন্যায় বিচার হবে। রোমান বলেন, সাগর-রুনি দম্পতির একমাত্র সন্তান মেঘ যতই বড় হচ্ছে তত বাবা-মাকে হারানোর কষ্ট অনুভব করতে পারছে। মেঘ মাঝে-মধ্যেই মা-বাবার কথা মনে করে কান্না করে। তাকে কেউ কোন সান্ত্বনা দিতে পারে না। রোমান জানান, তাদের মা নুরুন্নাহার বেগমের বয়স হয়েছে। তিনিও তার জীবদ্দশায় মেয়ে-জামাই হত্যার বিচার দেখে যেতে চান।
মানববন্ধন: সাংবাদিক দম্পতির হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে আজ বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) চত্বরে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়েছে। ডিআরইউ’র আয়োজনে এতে নিহতদের পরিবারের সদস্য ও গণমাধ্যম নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন।
No comments