দেশীয় গণমাধ্যম, ইটিভি এবং আব্দুস সালাম by গোলাম মাওলা রনি
আব্দুস
সালামের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে। আমি তখন সবে
সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। তখনো পর্যন্ত কোনো টকশোতে যাইনি এবং মিডিয়ার
জগৎ সম্পর্কে অতটা ওয়াকিবহালও নই। বঙ্গবন্ধু কনভেনশন হলের ছোট্ট একটি
কামরায় ৩০-৪০ জন শীর্ষ ব্যবসায়ীর সাথে একটি মতবিনিময় সভা। সম্ভবত
বাংলাদেশ-মিয়ানমার অথবা বাংলাদেশ-ভুটান চেম্বারের অনুষ্ঠান ছিল সেটি। আমি
সালাম সাহেবের নামধাম জানতাম এবং আরো জানতাম যে তিনি আমাদের দলীয় লোক এবং
নেত্রীর সাথে ভালো খাতির। কাজেই পাশাপাশি বসে আমরা অতি অল্পক্ষণের মধ্যেই
খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম। তিনি অবলীলায় তার দুঃখের কথা এবং একুশে টিভি নিয়ে
মর্মান্তিক সংগ্রামের সময় আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সাথে একান্ত আলাপচারিতার
কথা বললেন। এই ঘটনার পর সালাম সাহেবের সাথে বহুবার দেখা হয়েছে এবং
প্রতিবারই মনে হয়েছে তিনি মিডিয়া রাজনীতির কবলে পড়ে আওয়ামী লীগ এবং
প্রধানমন্ত্রী থেকে বহু দূরে চলে যাচ্ছেন। আমার ভয় হলো- তিনি হয়তো বিপদে
পড়বেন ঠিক আমারই মতন। কারণ আগবাড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে নিজের কষ্ট,
অপমান এবং অসুবিধার কথা বলার অভ্যাস যেমন তার নেই তেমনি ক্ষমতার শীর্ষের
চার দিকের দেয়াল টপকানোর কৌশলও তিনি হয়তো জানেন না। ফলে শেষমেশ যা হওয়ার
তাই হলো- একুশে টিভির চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম জেলে গেলেন।
একুশে টিভিসহ আরো তিনটি টিভি বর্তমান সরকারের রোষানলে পড়েছে। প্রথমে চ্যানেল ওয়ান, তারপর দিগন্ত, ইসলামিক টিভি এবং সবশেষে ইটিভি। প্রথম তিনটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং শেষটি বন্ধ করা না হলেও এক দুর্বিষহ অপমানজনক অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখা হয়েছেÑ এর চেয়ে বন্ধ করে দিলেই হয়তো ভালো হতো। টিভি অর্থাৎ ইলেকট্রনিক মিডিয়ার পাশাপাশি একটি বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিকও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আব্দুস সালামের মতো পত্রিকাটির সম্পাদক মাহমুদুর রহমানও কারাবন্দী হয়ে আছেন দীর্ঘদিন ধরে। বিএনপিপন্থী সাংবাদিক এবং দলটির নেতাকর্মীরা মাঝে মধ্যে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে দেশবাসীকে মাহমুদুর রহমানের অস্তিত্ব স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু বেচারা আব্দুস সালামের হয়েছে মরণদশা। কেউ তার নাম মুখে আনছে নাÑ পাছে প্রধানমন্ত্রী যদি রাগ করে বসেন!
যেকোনো দেশের সরকারের জন্য জাতীয় গণমাধ্যমগুলো নিঃসন্দেহে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। আজকের উত্তাপ ছড়ানো রাজপথ এবং অনিশ্চিত রাজনীতির গতিপথের প্রান্তসীমায় দাঁড়ানো সরকারি কর্তাদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয় কাজগুলো কি ভালো হয়েছিল? তারা যে যা-ই বলুক না কেনÑ আমি বলব একদম ঠিক হয়নি। কেন ঠিক হয়নি সে ব্যাপারে বিস্তারিত বলার আগে বলে নিই সরকারি দলের বা সরকারের অভ্যন্তরের ভেতরকার কিছু কাহিনী। ক্ষমতায় যাওয়ার আগে যেকোনো রাজনৈতিক নেতা একজন সাধারণ রিপোর্টার বা মফস্বল সংবাদদাতাকে ফেরেশতার মতো সমীহ করে। কিন্তু ক্ষমতা লাভের পর সেই লোকটিই রাতারাতি পাল্টে গিয়ে পুরো গণমাধ্যমকেই তার তল্পিবাহক মনে করতে থাকে। এর অবশ্য কিছু যৌক্তিক কারণও রয়েছে। কিছু কিছু মিডিয়া মালিক এবং বয়োজ্যেষ্ঠ সংবাদকর্মী ক্ষমতাসীনদের পদলেহন করার জন্য এমনভাবে তাদের দরজায় বসে থাকে যা প্রকৃতির কোনো প্রভুভক্ত প্রাণীও করে না। ফলে এই সেক্টরের স্বল্পসংখ্যক আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন মানুষ সম্পর্কে চিন্তা করার ফুরসৎ ক্ষমতাসীনেরা পায় না। অথবা প্রয়োজন অনুভব করে না।
প্রায় ৩০টি বছর ধরে আমি সংবাদপত্র এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাথে জড়িত। কাজ করেছি রিপোর্টার হিসেবেÑ আবার কখনো সহসম্পাদক বা বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে। কিছু দিন সম্পাদক ছিলাম এবং মালিক হিসেবে পরিচালনার অভিজ্ঞতাও রয়েছে। এর বাইরে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, টকশোর অতিথি এবং কলাম লেখক হিসেবে ভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্নভাবে পুরো মিডিয়াকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আমার রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছিল মিডিয়া থেকে। অনুরূপভাবে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিগুলোও এসেছিল মিডিয়া থেকে। নিজের সম্পর্কে এতটুকু বলার অর্থ হলোÑ অন্য সব রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী বা কলাম লেখকের মতো আমি এই জগৎ সম্পর্কে কেবল খণ্ডিত ধারণা পোষণ করি না। আমার ধারণাÑ বাস্তবসম্মত এবং জীবন থেকে জীবন্ত ইতিহাসের মতো।
আমার মতে, পুরো মিডিয়া জগৎ হলো একটি চলন্ত ও দুরন্ত পাগলা ঘোড়ার মতো। এর পিঠে চড়ে বেশিক্ষণ বসে থাকা যায় না। আবার লাগাম ধরে পাগলা ঘোড়াটিকে বশেও আনা সম্ভব নয়। বড়জোরÑ রাগ করে ঘোড়াটিকে মেরে ফেলা যায়। কোনো মালিক, কোনো সম্পাদক কিংবা কোনো পরিচালনা পরিষদ আজ অবধি কোনো সংবাদপত্র বা টেলিভিশন পরিপূর্ণভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। বরং নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার ফলে সব সময় হিতে বিপরীত হয়েছে। সরকারি দলের বা সরকারের যেসব লোক মিডিয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত তারা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সম্পর্কে হালনাগাদ ওয়াকিবহাল নন। এমনকি তাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে কিনা একজন নামকরা সাংবাদিক হিসেবে দু-চারটে কলাম লিখে দেশব্যাপী জনপ্রিয় হয়েছেন কিংবা একজন সফল সম্পাদক হিসেবে কোনো একটি জনপ্রিয় পত্রিকা দীর্ঘ দিন পরিচালনা করেছেন।
যেসব টিভি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সেসবে কর্মরত সাংবাদিক ও কর্মচারীদের বেশির ভাগই অন্য কোনো স্টেশনে গিয়ে নতুনভাবে চাকরি নিয়েছেন। সেখানে গিয়ে তারা তাদের মনোবেদনার সব ভাণ্ডার উজাড় করে দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সুযোগ পেলেই বিষোদগার করছেন। ফলে কট্টরপন্থী এবং একান্ত লেজুড়বৃত্তি করা বিটিভি মার্কা বেসরকারি টেলিভিশনের একটি প্রোগ্রামে হয়তো সরকারের পক্ষে নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব করার চেষ্টা করা হচ্ছেÑ অন্য দিকে দশটা প্রোগ্রামে কর্তৃপক্ষের অজান্তে মহা বাঁশ ঢুকিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটছে। ফলে জনগণের যা বোঝার তা ঠিকই বুঝছেÑ আর সরকারি পণ্ডিতরা মহা সুখে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে।
সরকার যদি গণমাধ্যমের সর্বজনীন স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারত এবং এসব মাধ্যমে প্রকাশিত অপ্রিয় কথাগুলো সঠিকভাবে মূল্যায়ন করত তবে আখেরে সরকারের জন্য মহা কল্যাণ হতে পারত। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে একেবারে উল্টোটা। সরকার প্রথমত, মিডিয়া রাজনীতির একাংশের লোকদের দিয়ে প্রভাবিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, মিডিয়ার মেধাহীন এবং নাচনকুদনসর্বস্ব লোকদের দিয়ে পরিচালিত হয়েছে। টিভি মালিকদের একটি সংগঠন আছে। এটি মূলত নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান যাকে কাগুজে বাঘ বললেও কম বলা হবে। এই সংগঠনের সদস্যরা বলতে সবাই বিভিন্নমুখী ব্যবসায়ের সাথে জড়িত। নিজেদের মানমর্যাদা ও খেয়ালখুশির বিনোদনের জন্য তারা এই ভুবনে পা বাড়ায়। চরম বাস্তবতা এবং নিজেদের টিভিকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য তারা প্রায়ই বিজ্ঞাপন, বিজ্ঞাপনের রেট, অনুষ্ঠান, সাংবাদিক ও কলাকুশলীদের নিয়ে নিজেদের মধ্যে সীমাহীন প্রতিযোগিতা করে থাকে। এ ক্ষেত্রে তাদের জন্য নতুন ফ্যাসাদ হলো টিআরপি। একটি টিভি কিংবা টিভি অনুষ্ঠান কতজন লোক দেখল তা নিরূপণ করে একটি কোম্পানি এবং সেই কোম্পানির জরিপ বা টিআরপি প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞাপনদাতারা টিভি স্টেশনগুলোতে বিজ্ঞাপন দেয় এবং বিজ্ঞাপনের রেট নির্ধারণ করে।
মূলত, টিআরপি জরিপে এগিয়ে থাকার জন্যই টিভিগুলো টকশো, রোডশো, ক্রাইম রিপোর্ট, ইসলামি সওয়াল-জওয়াবের মতো বাহারি অনুষ্ঠানমালা চালু করে। কোনো একটি অনুষ্ঠান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়ে গেলে প্রতিদ্বন্দ্বীরা সরকারের কান ভারী করতে শুরু করে সেই অনুষ্ঠান, অনুষ্ঠানের সঞ্চালক এবং টিভি মালিকের বিরুদ্ধে। অন্য দিকে সরকারের মেধাহীন কর্তারা মুহূর্তের মধ্যেই মিডিয়া রাজনীতির প্রপাগান্ডায় গা ভাসিয়ে দিয়ে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন এবং হালুম বলে রণহুঙ্কার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এর বাইরে অন্য ঘটনাও আছে। কিছু মালিক সকাল-সন্ধ্যায় সরকারের কর্তাব্যক্তিদের দরবারে হাজিরা দেন। তাদের টুকটাক প্রয়োজন ও মনস্কামনার খোঁজখবর নেন। অন্যরা যখন একই কর্ম করতে না পারেন তখন স্পষ্টতই বিষয়টিকে বেয়াদবি ও স্পর্ধার বিষয় হিসেবে ধরে নিয়ে বলা হয়Ñ ওকে বলে দিও আমি কিন্তু মাইন্ড করেছি।
আমার আন্দাজ মতে ‘একুশের রাত’ এবং ‘জনতার কথা’ নামক জনপ্রিয় দু’টি অনুষ্ঠান নিয়ে সরকারঘনিষ্ঠ লোকদের ভীষণ আপত্তি ছিল বহু দিন থেকে। সালাম সাহেব কোনো দিনই সেসব আপত্তি শোনেননি। আসলে শোনার প্রয়োজন অনুভব করেননি অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে। তার ধারণা ছিলÑ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সাথে যেহেতু তার ব্যক্তিগত জানাশোনা, সেহেতু তার কার্যালয়ের অধস্তন কর্তাদের পাত্তা না দিলেও চলবে। এভাবেই সমস্যার শুরুÑ যা পরে গ্রেফতার পর্যন্ত গড়ায়। দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি ও চ্যানেল ওয়ান নিয়ে সরকারকে একধরনের সমালোচনা ভোগ করতে হয়। অন্য দিকে একুশে টিভি নিয়ে সমালোচনাটা একটু ভিন্ন আঙ্গিকের হয়। কারণ টিভিটির জন্ম, বেড়ে ওঠা, মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাওয়া ও পুনঃপ্রচার সব কিছুর সাথেই আওয়ামী লীগের একটি নৈতিক যোগাযোগ ছিল। সবার একই কথাÑ সালাম সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী ডেকে সরাসরি নির্দেশ দিলেই তো চলত।
টিভিগুলো বন্ধ হওয়ায় মালিকপক্ষ ও সংবাদকর্মীদের ক্ষতি নিশ্চয়ই হয়েছে এবং তারা তা কাটিয়েও উঠতে পারবেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে যে ক্ষত সৃষ্টি হলোÑ তা কোনো দিন কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। প্রতিটি টিভিরই ২-৪টা করে জনপ্রিয় অনুষ্ঠানমালা ছিল যা কিনা দলমত নির্বিশেষে সবাই উপভোগ করতেন। যেমনÑ ইসলামিক টিভির ডা: জাকির নায়েকের অনুষ্ঠান। দিগন্ত টিভির ইসলামি সওয়াল-জবাব প্রভৃতি। টিভিগুলো বন্ধ হওয়ায় ওই ধরনের অনুষ্ঠান থেকে বঞ্চিত হয়ে কোটি কোটি দর্শক কিন্তু সরকারকেই দোষ দিচ্ছেন। তারা হয়তো টিভিগুলো বন্ধ হওয়ার নেপথ্য কাহিনী জানেন না কিংবা জানতেও চান না।
সরকারের প্রতি অতিরিক্ত ভক্তিশ্রদ্ধা দেখানো নেতাকর্মী, আমলা-কামলা ও গণমাধ্যম কর্মীদের জন্যই কিন্তু সরকার বারবার বিভ্রান্ত হয়েছে এবং আগামী দিনগুলোতেও হবে। সরকারের একটি বিষয় ধর্তব্যের মধ্যে এনে বিবেচনা করা উচিত যে, ভিুকের হাত কোনো দিন কর্মীর হাত হয় না। সারা সকাল-বিকেল করুণা, দয়া ও স্বার্থের ধান্ধায় যে সরকারের কাছে হাত পাতে সেই হাত কোনো দিন সরকারের প্রয়োজনে কাজে লাগবে না। অন্য দিকে সবাই যদি তল্পিবাহক হয়ে যায় তবে দর্পণ হবে কারা! কিছু অতিউৎসাহী কর্তাব্যক্তির জন্য আজ দেশের জাতীয় গণমাধ্যমগুলো ইতিহাসের সবচেয়ে সঙ্কটময় মুহূর্ত অতিক্রম করছে। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। সরকারের সার্বিক কর্মকাণ্ড যেমন মেধাদীপ্তময় উপস্থাপনায় পরিবেশন করা যায় তেমনি ত্রুটিগুলোও লুকিয়ে ফেলা সম্ভব। আর এই কাজের জন্য দরকার দক্ষ, অভিজ্ঞ, শিক্ষিত নেতৃত্বগুণ সম্পন্ন, সৎ ও জনপ্রিয় গণমাধ্যম কর্মীর। সরকার যদি তাদের খুঁজে পেত তা হলে কোনো টিভিই বন্ধ করতে হতো না, কিংবা সালাম সাহেবদেরকে গ্রেফতার করার দরকার পড়ত না।
আমি কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করিÑ আল্লাহ যেন সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সুমতি দান করেন। তারা যেন দেশের গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা- শক্তিশালী করার জন্য উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণের পাশাপাশি ইতিবাচক ভূমিকা পালনের তৌফিকপ্রাপ্ত হন। তারা যেন ধৈর্যহারা না হয়ে গণতন্ত্রমনা হতে পারেন এবং কথায় কথায় নিজেদের কুয়্যাত প্রদর্শনের জন্য একের পর এক গণমাধ্যম বন্ধ না করেন কিংবা ভিন্নমতের মানুষজনকে জেলে না ঢোকান। তারা যেন হেদায়েতপ্রাপ্ত হন এবং নিজেদের কৃত ভুল থেকে সঠিক পথে ফিরে আসতে পারেন। তাদের দিয়ে এরই মধ্যে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সেসব লোকের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার মতি যেন কর্তাব্যক্তিরা ফিরে পান।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
একুশে টিভিসহ আরো তিনটি টিভি বর্তমান সরকারের রোষানলে পড়েছে। প্রথমে চ্যানেল ওয়ান, তারপর দিগন্ত, ইসলামিক টিভি এবং সবশেষে ইটিভি। প্রথম তিনটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং শেষটি বন্ধ করা না হলেও এক দুর্বিষহ অপমানজনক অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখা হয়েছেÑ এর চেয়ে বন্ধ করে দিলেই হয়তো ভালো হতো। টিভি অর্থাৎ ইলেকট্রনিক মিডিয়ার পাশাপাশি একটি বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিকও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আব্দুস সালামের মতো পত্রিকাটির সম্পাদক মাহমুদুর রহমানও কারাবন্দী হয়ে আছেন দীর্ঘদিন ধরে। বিএনপিপন্থী সাংবাদিক এবং দলটির নেতাকর্মীরা মাঝে মধ্যে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে দেশবাসীকে মাহমুদুর রহমানের অস্তিত্ব স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু বেচারা আব্দুস সালামের হয়েছে মরণদশা। কেউ তার নাম মুখে আনছে নাÑ পাছে প্রধানমন্ত্রী যদি রাগ করে বসেন!
যেকোনো দেশের সরকারের জন্য জাতীয় গণমাধ্যমগুলো নিঃসন্দেহে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। আজকের উত্তাপ ছড়ানো রাজপথ এবং অনিশ্চিত রাজনীতির গতিপথের প্রান্তসীমায় দাঁড়ানো সরকারি কর্তাদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয় কাজগুলো কি ভালো হয়েছিল? তারা যে যা-ই বলুক না কেনÑ আমি বলব একদম ঠিক হয়নি। কেন ঠিক হয়নি সে ব্যাপারে বিস্তারিত বলার আগে বলে নিই সরকারি দলের বা সরকারের অভ্যন্তরের ভেতরকার কিছু কাহিনী। ক্ষমতায় যাওয়ার আগে যেকোনো রাজনৈতিক নেতা একজন সাধারণ রিপোর্টার বা মফস্বল সংবাদদাতাকে ফেরেশতার মতো সমীহ করে। কিন্তু ক্ষমতা লাভের পর সেই লোকটিই রাতারাতি পাল্টে গিয়ে পুরো গণমাধ্যমকেই তার তল্পিবাহক মনে করতে থাকে। এর অবশ্য কিছু যৌক্তিক কারণও রয়েছে। কিছু কিছু মিডিয়া মালিক এবং বয়োজ্যেষ্ঠ সংবাদকর্মী ক্ষমতাসীনদের পদলেহন করার জন্য এমনভাবে তাদের দরজায় বসে থাকে যা প্রকৃতির কোনো প্রভুভক্ত প্রাণীও করে না। ফলে এই সেক্টরের স্বল্পসংখ্যক আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন মানুষ সম্পর্কে চিন্তা করার ফুরসৎ ক্ষমতাসীনেরা পায় না। অথবা প্রয়োজন অনুভব করে না।
প্রায় ৩০টি বছর ধরে আমি সংবাদপত্র এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাথে জড়িত। কাজ করেছি রিপোর্টার হিসেবেÑ আবার কখনো সহসম্পাদক বা বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে। কিছু দিন সম্পাদক ছিলাম এবং মালিক হিসেবে পরিচালনার অভিজ্ঞতাও রয়েছে। এর বাইরে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, টকশোর অতিথি এবং কলাম লেখক হিসেবে ভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্নভাবে পুরো মিডিয়াকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আমার রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছিল মিডিয়া থেকে। অনুরূপভাবে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিগুলোও এসেছিল মিডিয়া থেকে। নিজের সম্পর্কে এতটুকু বলার অর্থ হলোÑ অন্য সব রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী বা কলাম লেখকের মতো আমি এই জগৎ সম্পর্কে কেবল খণ্ডিত ধারণা পোষণ করি না। আমার ধারণাÑ বাস্তবসম্মত এবং জীবন থেকে জীবন্ত ইতিহাসের মতো।
আমার মতে, পুরো মিডিয়া জগৎ হলো একটি চলন্ত ও দুরন্ত পাগলা ঘোড়ার মতো। এর পিঠে চড়ে বেশিক্ষণ বসে থাকা যায় না। আবার লাগাম ধরে পাগলা ঘোড়াটিকে বশেও আনা সম্ভব নয়। বড়জোরÑ রাগ করে ঘোড়াটিকে মেরে ফেলা যায়। কোনো মালিক, কোনো সম্পাদক কিংবা কোনো পরিচালনা পরিষদ আজ অবধি কোনো সংবাদপত্র বা টেলিভিশন পরিপূর্ণভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। বরং নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার ফলে সব সময় হিতে বিপরীত হয়েছে। সরকারি দলের বা সরকারের যেসব লোক মিডিয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত তারা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সম্পর্কে হালনাগাদ ওয়াকিবহাল নন। এমনকি তাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে কিনা একজন নামকরা সাংবাদিক হিসেবে দু-চারটে কলাম লিখে দেশব্যাপী জনপ্রিয় হয়েছেন কিংবা একজন সফল সম্পাদক হিসেবে কোনো একটি জনপ্রিয় পত্রিকা দীর্ঘ দিন পরিচালনা করেছেন।
যেসব টিভি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সেসবে কর্মরত সাংবাদিক ও কর্মচারীদের বেশির ভাগই অন্য কোনো স্টেশনে গিয়ে নতুনভাবে চাকরি নিয়েছেন। সেখানে গিয়ে তারা তাদের মনোবেদনার সব ভাণ্ডার উজাড় করে দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সুযোগ পেলেই বিষোদগার করছেন। ফলে কট্টরপন্থী এবং একান্ত লেজুড়বৃত্তি করা বিটিভি মার্কা বেসরকারি টেলিভিশনের একটি প্রোগ্রামে হয়তো সরকারের পক্ষে নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব করার চেষ্টা করা হচ্ছেÑ অন্য দিকে দশটা প্রোগ্রামে কর্তৃপক্ষের অজান্তে মহা বাঁশ ঢুকিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটছে। ফলে জনগণের যা বোঝার তা ঠিকই বুঝছেÑ আর সরকারি পণ্ডিতরা মহা সুখে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে।
সরকার যদি গণমাধ্যমের সর্বজনীন স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারত এবং এসব মাধ্যমে প্রকাশিত অপ্রিয় কথাগুলো সঠিকভাবে মূল্যায়ন করত তবে আখেরে সরকারের জন্য মহা কল্যাণ হতে পারত। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে একেবারে উল্টোটা। সরকার প্রথমত, মিডিয়া রাজনীতির একাংশের লোকদের দিয়ে প্রভাবিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, মিডিয়ার মেধাহীন এবং নাচনকুদনসর্বস্ব লোকদের দিয়ে পরিচালিত হয়েছে। টিভি মালিকদের একটি সংগঠন আছে। এটি মূলত নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান যাকে কাগুজে বাঘ বললেও কম বলা হবে। এই সংগঠনের সদস্যরা বলতে সবাই বিভিন্নমুখী ব্যবসায়ের সাথে জড়িত। নিজেদের মানমর্যাদা ও খেয়ালখুশির বিনোদনের জন্য তারা এই ভুবনে পা বাড়ায়। চরম বাস্তবতা এবং নিজেদের টিভিকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য তারা প্রায়ই বিজ্ঞাপন, বিজ্ঞাপনের রেট, অনুষ্ঠান, সাংবাদিক ও কলাকুশলীদের নিয়ে নিজেদের মধ্যে সীমাহীন প্রতিযোগিতা করে থাকে। এ ক্ষেত্রে তাদের জন্য নতুন ফ্যাসাদ হলো টিআরপি। একটি টিভি কিংবা টিভি অনুষ্ঠান কতজন লোক দেখল তা নিরূপণ করে একটি কোম্পানি এবং সেই কোম্পানির জরিপ বা টিআরপি প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞাপনদাতারা টিভি স্টেশনগুলোতে বিজ্ঞাপন দেয় এবং বিজ্ঞাপনের রেট নির্ধারণ করে।
মূলত, টিআরপি জরিপে এগিয়ে থাকার জন্যই টিভিগুলো টকশো, রোডশো, ক্রাইম রিপোর্ট, ইসলামি সওয়াল-জওয়াবের মতো বাহারি অনুষ্ঠানমালা চালু করে। কোনো একটি অনুষ্ঠান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়ে গেলে প্রতিদ্বন্দ্বীরা সরকারের কান ভারী করতে শুরু করে সেই অনুষ্ঠান, অনুষ্ঠানের সঞ্চালক এবং টিভি মালিকের বিরুদ্ধে। অন্য দিকে সরকারের মেধাহীন কর্তারা মুহূর্তের মধ্যেই মিডিয়া রাজনীতির প্রপাগান্ডায় গা ভাসিয়ে দিয়ে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন এবং হালুম বলে রণহুঙ্কার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এর বাইরে অন্য ঘটনাও আছে। কিছু মালিক সকাল-সন্ধ্যায় সরকারের কর্তাব্যক্তিদের দরবারে হাজিরা দেন। তাদের টুকটাক প্রয়োজন ও মনস্কামনার খোঁজখবর নেন। অন্যরা যখন একই কর্ম করতে না পারেন তখন স্পষ্টতই বিষয়টিকে বেয়াদবি ও স্পর্ধার বিষয় হিসেবে ধরে নিয়ে বলা হয়Ñ ওকে বলে দিও আমি কিন্তু মাইন্ড করেছি।
আমার আন্দাজ মতে ‘একুশের রাত’ এবং ‘জনতার কথা’ নামক জনপ্রিয় দু’টি অনুষ্ঠান নিয়ে সরকারঘনিষ্ঠ লোকদের ভীষণ আপত্তি ছিল বহু দিন থেকে। সালাম সাহেব কোনো দিনই সেসব আপত্তি শোনেননি। আসলে শোনার প্রয়োজন অনুভব করেননি অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে। তার ধারণা ছিলÑ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সাথে যেহেতু তার ব্যক্তিগত জানাশোনা, সেহেতু তার কার্যালয়ের অধস্তন কর্তাদের পাত্তা না দিলেও চলবে। এভাবেই সমস্যার শুরুÑ যা পরে গ্রেফতার পর্যন্ত গড়ায়। দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি ও চ্যানেল ওয়ান নিয়ে সরকারকে একধরনের সমালোচনা ভোগ করতে হয়। অন্য দিকে একুশে টিভি নিয়ে সমালোচনাটা একটু ভিন্ন আঙ্গিকের হয়। কারণ টিভিটির জন্ম, বেড়ে ওঠা, মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাওয়া ও পুনঃপ্রচার সব কিছুর সাথেই আওয়ামী লীগের একটি নৈতিক যোগাযোগ ছিল। সবার একই কথাÑ সালাম সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী ডেকে সরাসরি নির্দেশ দিলেই তো চলত।
টিভিগুলো বন্ধ হওয়ায় মালিকপক্ষ ও সংবাদকর্মীদের ক্ষতি নিশ্চয়ই হয়েছে এবং তারা তা কাটিয়েও উঠতে পারবেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে যে ক্ষত সৃষ্টি হলোÑ তা কোনো দিন কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। প্রতিটি টিভিরই ২-৪টা করে জনপ্রিয় অনুষ্ঠানমালা ছিল যা কিনা দলমত নির্বিশেষে সবাই উপভোগ করতেন। যেমনÑ ইসলামিক টিভির ডা: জাকির নায়েকের অনুষ্ঠান। দিগন্ত টিভির ইসলামি সওয়াল-জবাব প্রভৃতি। টিভিগুলো বন্ধ হওয়ায় ওই ধরনের অনুষ্ঠান থেকে বঞ্চিত হয়ে কোটি কোটি দর্শক কিন্তু সরকারকেই দোষ দিচ্ছেন। তারা হয়তো টিভিগুলো বন্ধ হওয়ার নেপথ্য কাহিনী জানেন না কিংবা জানতেও চান না।
সরকারের প্রতি অতিরিক্ত ভক্তিশ্রদ্ধা দেখানো নেতাকর্মী, আমলা-কামলা ও গণমাধ্যম কর্মীদের জন্যই কিন্তু সরকার বারবার বিভ্রান্ত হয়েছে এবং আগামী দিনগুলোতেও হবে। সরকারের একটি বিষয় ধর্তব্যের মধ্যে এনে বিবেচনা করা উচিত যে, ভিুকের হাত কোনো দিন কর্মীর হাত হয় না। সারা সকাল-বিকেল করুণা, দয়া ও স্বার্থের ধান্ধায় যে সরকারের কাছে হাত পাতে সেই হাত কোনো দিন সরকারের প্রয়োজনে কাজে লাগবে না। অন্য দিকে সবাই যদি তল্পিবাহক হয়ে যায় তবে দর্পণ হবে কারা! কিছু অতিউৎসাহী কর্তাব্যক্তির জন্য আজ দেশের জাতীয় গণমাধ্যমগুলো ইতিহাসের সবচেয়ে সঙ্কটময় মুহূর্ত অতিক্রম করছে। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। সরকারের সার্বিক কর্মকাণ্ড যেমন মেধাদীপ্তময় উপস্থাপনায় পরিবেশন করা যায় তেমনি ত্রুটিগুলোও লুকিয়ে ফেলা সম্ভব। আর এই কাজের জন্য দরকার দক্ষ, অভিজ্ঞ, শিক্ষিত নেতৃত্বগুণ সম্পন্ন, সৎ ও জনপ্রিয় গণমাধ্যম কর্মীর। সরকার যদি তাদের খুঁজে পেত তা হলে কোনো টিভিই বন্ধ করতে হতো না, কিংবা সালাম সাহেবদেরকে গ্রেফতার করার দরকার পড়ত না।
আমি কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করিÑ আল্লাহ যেন সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সুমতি দান করেন। তারা যেন দেশের গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা- শক্তিশালী করার জন্য উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণের পাশাপাশি ইতিবাচক ভূমিকা পালনের তৌফিকপ্রাপ্ত হন। তারা যেন ধৈর্যহারা না হয়ে গণতন্ত্রমনা হতে পারেন এবং কথায় কথায় নিজেদের কুয়্যাত প্রদর্শনের জন্য একের পর এক গণমাধ্যম বন্ধ না করেন কিংবা ভিন্নমতের মানুষজনকে জেলে না ঢোকান। তারা যেন হেদায়েতপ্রাপ্ত হন এবং নিজেদের কৃত ভুল থেকে সঠিক পথে ফিরে আসতে পারেন। তাদের দিয়ে এরই মধ্যে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সেসব লোকের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার মতি যেন কর্তাব্যক্তিরা ফিরে পান।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
No comments