সংবিধান ও রাজনীতি- ছাগল ও সিংহ বাহিনীর বয়ান by সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক
আসলেই
কথাটা কে বলেছেন আমি নিশ্চিত নই, তবে আনুমানিক বিকেল ৫টা রোববার ৮
ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে জনৈক ফেসবুক বন্ধু তার টাইমলাইনে এই স্ট্যাটাসটি
দিয়েছেন বা এই কথাটি লিখেছেন। ওই ফেসবুক বন্ধুর নাম ইংরেজিতে লেখা আছে খান
এস খান। ফেসবুক বন্ধু খান সাহেব, আজ থেকে দুই হাজার ৩০০ বছর আগের গ্রিস বা
মেসিডোনিয়া রাজ্যের দিগি¦জয়ী শাসক ও সেনাপতি আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের উক্তি
বলেই এই কথাটি উল্লেখ করেছেন। কথাটি এই, অর্থাৎ আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট
বলছেন, “আমি ছাগলের নেতৃত্বে এক পাল সিংহকে যত না ভয় পাই, তার চেয়ে হাজার
গুণ ভয় পাই সিংহের নেতৃত্বে এক পাল ছাগলকে।” আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট,
নেতৃত্বে কে আছে সেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। এই কথাটার ভাবসম্প্রসারণ ও
তাৎপর্যের আলোচনা দিয়েই আজকের সংক্ষিপ্ত কলাম লেখার কাজ শুরু করলাম।
বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে ও সামাজিক অঙ্গনে, সিংহও আছেন ছাগলও আছেন।
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের কথাটার অনুকরণ করে আলেকজান্ডারের কথাটাকে বর্ধিত
করে বলতে চাই যে, ছাগলের নেতৃত্বে সিংহের বদলে যদি এক পাল ছাগল-বাহিনী
পাওয়া যায় অথবা সিংহের নেতৃত্বে এক পাল ছাগলের বদলে একটি সিংহ-বাহিনী যদি
সামনে পড়ে তাহলে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট কী করবেন?
একটি তাত্ত্বিক বা থিওরিটিক্যাল প্রশ্ন হলো, একজন রাজা সিংহের নেতৃত্বে আরো অনেক সিংহ কী, ওই দলে বা সৈন্য বাহিনীতে থাকবে? অথবা একদল ছাগলের নেতৃত্বে যদি আরেকটি ছাগল প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে ওই নেতা ছাগল ব্যতিক্রমী এমন কী করতে পারবে? প্রথমে সিংহের আলোচনা করি। আমরা আমাদের পাঠ্যবইয়ে পড়েছি যে, সিংহ বনের রাজা। আজকাল টেলিভিশনের বদৌলতে পৃথিবীর অনেক কিছু আমরা ঘরে বসে দেখতে পারি ও শিখতে পারি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক অথবা এনিম্যাল প্ল্যানেট নামক টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দেখলে জীবজন্তু সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। আসলেই মহান সৃষ্টিকর্তা সিংহকে রাজা করে সৃষ্টি করেছেন। এই টেলিভিশনগুলোর মাধ্যমে দেখেছি যে, বন্য মহিষ, জেবরা, হরিণ, বন্যগরু, বন্যশিয়াল, হাতি, গণ্ডার এই ধরনের বহু পশু বিশাল বিশাল আয়তনের বনে জঙ্গলে দলবদ্ধভাবে চলে। কিন্তু বাঘ অথবা সিংহ দলবদ্ধভাবে দেখা যায় না বরং প্রাকৃতিকভাবেই বনের একেকটি অংশ একেকটি সিংহ বা বাঘ ভাগ করে নেয়। একেকটি সিংহ বা বাঘের এলাকাতে অন্য সিংহ বা বাঘ সাধারণত এসে প্রাধান্য বিস্তার করে না। সম্ভবত প্রকৃতির এইরূপ প্রেক্ষাপটেই কথাটি প্রচলিত হয়েছে যে, সিংহ বনের রাজা। আমার উপসংহার হলো, একজন রাজা-সিংহ আরেকজন রাজা-সিংহকে কোনো স্পেইস বা সুযোগ বা অবকাশ দেবে না। আরেকটি প্রবাদ বাক্যের উদাহরণ দিয়েও এই উপসংহারকে শক্তিশালী করা যায়। প্রবাদ বাক্যটি নি¤œরূপ: ‘এক ঘরে দুই পীর হয় না’ অথবা দক্ষিণ এশিয়ার আরেকটি ভাষায় নি¤œরূপ: ‘এক ঘরমে দো পীর নেহি হোতা।’ পীরসংক্রান্ত এই প্রবাদ বাক্যটির কোনো ব্যাখ্যায় যাবো না, যেহেতু বিষয়টি তুলনামূলকভাবে অধিক সংবেদনশীল।
আমি ওপরের একটি বা দুইটি অনুচ্ছেদে যেই উদাহরণটি দিলাম বা প্রতীকী অর্থে বনের যেই গল্প করলাম, সেই উদাহরণটি বা প্রতীকটি পৃথিবীর যেকোনো দেশের রাজনীতি ও সামাজিক অঙ্গনে যদি ট্রান্সফার করি বা স্থাপন করি, তাহলেই বোঝা যাবে যে, মানুষরূপী সিংহরা অর্থাৎ রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনের প্রত্যেক নেতা তার জন্য একটি নির্দিষ্ট এলাকা নিশ্চিতরূপেই চায়। অপর ভাষায় বলা যায় যে, কোনো একজন নেতা-মানুষ তার নেতৃত্বের অথবা নেতৃত্বাধীন এলাকার ব্যাপারে গ্যারান্টি চান। কেউ যদি এখানে নাক গলায় অথবা কেউ যদি এখানে ভাগ বসাতে চায়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই দ্বন্দ্ব বা সঙ্ঘাত অপরিহার্য। দুই রাজা টিকবে না, যেকোনো এক রাজাকে বিদায় নিতে হবে। এখন সিংহের গল্পে পুনরায় ফেরত যাই। সিংহ বুদ্ধিমান কি বোকা সেটা তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যেটি সেটি হলো, তার বাহিনীতে অর্থাৎ রাজা-সিংহের প্রজাদের মধ্যে যেসব জ্ঞানী-গুণী বুদ্ধিমান পশু আছে, সেই জ্ঞানী-গুণী বুদ্ধিমান পশুগুলোকে রাজা-সিংহ কাজে লাগাতে পারে কি না। জ্ঞানী-গুণী বুদ্ধিমান পশুগুলোর মধ্যে কেউ যদি গোয়ার্তুমি করতে চায় বা ঘাড়-তেড়ামি করতে চায় বা গরিমা দেখাতে চায়, তাহলে রাজা-সিংহ তার সামনের পায়ের একটি দিয়ে এমন একটি থাপ্পড় দেবে যে, ত্যাড়া ঘাড় সোজা হওয়ার বদলে একদম নেতিয়ে পড়বে। এই ভয়ে রাজা-সিংহের অধীনস্থ কোনো জ্ঞানী-গুণী বুদ্ধিমান পশু ঘাড় ত্যাড়ামি বা অযাচিত মাতব্বরি করতে চায় না। উপরের আট-দশ লাইনে, দুইটি প্রশ্ন তুলেছি, একটি কম গুরুত্বপূর্ণ ও একটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয় প্রশ্নটি এই অনুচ্ছেদে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয় প্রশ্নটি হলো, রাজা সিংহ আদৌ জ্ঞানী-গুণী বুদ্ধিমান পশুকে তার বাহিনীতে চান কি না?
এখন ছাগলের নেতৃত্ব ও ছাগল বাহিনী নিয়ে আলোচনা করি। ছাগল নিরীহ প্রাণী, মুখের কাছে যা পায় তাতেই মুখ লাগায়। সেই জন্যই প্রবাদ বাক্য আছে যে, ‘ছাগলে কি না খায়!’ ছাগলে কামড় দেয়ার পর কোনো সবজির গাছ অথবা লতা আর বড় হয় না। ছাগল সম্প্রদায় সাধারণত নিরীহ। সাধারণত তারা স্ব উদ্যোগে কাউকে আক্রমণ করতে যায় না। কেউ তাদের আক্রমণ করলে প্রতিহতও করতে চায় না বরং ভ্যা ভ্যা চিৎকার করতে থাকে। অতএব ওই রূপ ছাগল বাহিনীর নেতৃত্বে যদি আরেকটি ছাগলই থাকে, তাহলে সে বাহিনী কিই বা করতে পারবে? অপর পক্ষে একটি ছাগল বাহিনীর সামনে যদি একজন সিংহ নেতা হিসেবে দাঁড়ায় তাহলে ওই সিংহের সাহস বুদ্ধি ইত্যাদির কারণে অনুসারী ছাগলেরা কতটুকু অনুপ্রাণিত হতে পারে? ওই ছাগলেরা, নেতা-সিংহের ভাষা অথবা ইশারা অথবা নড়াচড়ার ভাবভঙ্গি ইত্যাদি কি বুঝবে?
এখন বিপরীতমুখী একটি ঘটনা তুলে ধরি। যদি বাহিনীটি সিংহের হয় এবং তাদের নেতৃত্বে একজন ছাগল থাকে তাহলে কী হতে পারে? ছাগল নিরীহ প্রাণী, অতএব অনেক দুরভিসন্ধিমূলক বা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বা জটিল কোনো কিছু মাথায় আসবে না। ফলে সামনের দিকে যদি কোনো দুর্গম রাস্তা পাড়ি দিতে হয় অথবা বড় কোনো বাধা অতিক্রম করতে হয়, তাহলে সেটার কোনো পন্থা ছাগলের মাথায় আসবে না। সম্ভাবনা আছে যে, নেতা-ছাগল, তার অনুসারী সিংহদের বলবে যে, তোমরা একটা রাস্তা বের করো, আমাকে জানাও, তোমাদের প্রস্তাব মোতাবেক আমি আগে আগে যেতে রাজি আছি। এতক্ষণ যা আলোচনা করলাম একান্তভাবেই কাল্পনিক। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনের বড় মাঝারি ছোট নেতা ও অনুসারীদের কর্মকাণ্ডের সাথে নেতা-সিংহ এবং নেতা-ছাগলের অথবা অনুসারী সিংহ বাহিনী বা অনুসারী ছাগল বাহিনীর চিন্তা ও কর্মের মিল আছে বলে অনেকেই বলেন। এই মিল কোন কোন দিকে বা কতটুকু, সেটা আমরা আর ব্যাখ্যা করতে চাই না। কিন্তু আমরা মনে করি বাংলাদেশে এখন সিংহের মতো সাহসী নেতৃত্ব প্রয়োজন।
বর্তমান তরুণ প্রজন্ম, অনেকেই হয়তো জানেন না যে, ঢাকা মহানগরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যেখানে এখন দোয়েল চত্বর, তার কাছেই অবস্থিত আছে সাদামাটা স্থাপত্যে তিন নেতার মাজার। তিনজনের মধ্যে দুইজন নেতার নাম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল কাশেম ফজলুল হক তথা এ কে ফজলুল হক। জনাব সোহরাওয়ার্দীকে অভিষিক্ত করা হয়েছিল একটি উপাধিতে: যথা, গণতন্ত্রের মানসপুত্র। বরিশালের (চাখারের) সন্তান জনাব এ কে ফজলুল হককে অভিষিক্ত করা হয়েছিল একটি উপাধিতে: যথা, শের-এ বাংলা বা শেরেবাংলা। উর্দু ভাষায় শের মানে বাঘ। আশি বছর আগের ভারতবর্ষে, তৎকালীন বঙ্গ প্রদেশের বাইরের রাজনৈতিক নেতারা শ্রদ্ধায় ও আবেগে, অন্যতম বাঙালি ও মুসলিম রাজনৈতিক নেতা জনাব ফজলুল হককে এই উপাধি দিয়েছিলেন তার সাহসী নেতৃত্বের কারণে। উপাধি পাওয়ার ১৫ বছর পর, আজ থেকে ৬৩ বছর পূর্বে, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক আরো একবার আনুষ্ঠানিকভাবে তার সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। তার সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগেই আজ থেকে ৬৩ বছর আগের পাকিস্তানের অন্যতম প্রদেশ পূর্ব বঙ্গের সরকার, জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করেছিল। সেই আইনের নাম: ইস্ট বেঙ্গল স্টেইট একুইজিশন অ্যান্ড টিনেনসি অ্যাক্ট। সাধারণ বাংলায় বলা হতো প্রজাস্বত্ব আইন, অর্থাৎ জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত এবং প্রজাগণের স্বত্ব কায়েম হলো। বাংলায় প্রবাদ বাক্য আছে, ‘সেই রামও নাই সেই অযোধ্যায় নাই।’ অনুরূপ বলা যায়, সেই জমিদাররাও নেই, সেই প্রজারাও নেই। অনেক জমিদার ছিলেন প্রচণ্ড অত্যাচারী এবং প্রজাদের স্বার্থবিরোধী ও আর্থিকভাবে লোভী। অনেক জমিদার ছিলেন, প্রজাবান্ধব। ধনবাড়ীর জমিদারবাড়ি, নাটোরে উত্তরা গণভবন, করটিয়া জমিদারবাড়ি, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মুরাপাড়া জমিদারবাড়ি, লাকসাম নবাববাড়ি, গাজীপুরের জয়দেবপুরে ভাওয়াল রাজাদের রাজপ্রাসাদ, ময়মনসিংহের নান্দাইলের বাহাদুরপুর জমিদারবাড়ি ইত্যাদি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
একসময় কলকাতায় প্রচণ্ড রাজনৈতিক আন্দোলন হচ্ছিল। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ-ভারতীয় সরকারের পুলিশ বাহিনী রাজনৈতিক মিছিলে গুলি করার প্রবণতা লক্ষণীয়ভাবে ছিল। একদিন একটি মিছিল যখন সামনের দিকে যাচ্ছিল, তখন পুলিশ মিছিলে গুলি করতে উদ্যত হয়। শেরেবাংলা একে ফজলুল হক মিছিলের সামনে দাঁড়ান। তার দুইটি হাত দুই দিকে প্রসারিত করে বুকটি মেলে দিয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ান এবং পুলিশকে বলেন, ‘এই মিছিলের নেতা আমি। গুলি করতে হলে আগে আমাকে করবে।’ পুলিশ কাউকেউ গুলি করেনি। ব্রিটিশ পুলিশ নিশ্চয়ই চিন্তা করেছিল বাংলার বাঘ ফজলুল হককে পৃথিবী থেকে বিদায় দিতে একটি মাত্র বুলেট প্রয়োজন, কিন্তু তার পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে।
আবারো ইতিহাসে ফিরে যাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই ষাটের দশকের বাঙালি জাতি পাকিস্তানের নিকট থেকে মুক্তি বা স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের কথাগুলো প্রচণ্ড মানসিক সাহসের পরিচায়ক। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কেন জনাব তাজউদ্দীনকে বা ডক্টর কামাল হোসেনকে প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা লিখিতভাবে দেননি অথবা মৌখিকভাবেও কাউকে প্রকাশ্যে অনুমতি দেননি, সেটা নিয়ে আমি গবেষণায় যাবো না। প্রয়োজনের নিরিখে ২৭ মার্চ ১৯৭১ তারিখে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান প্রথমে নিজের নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। প্রয়োজনের নিরিখেই জিয়াউর রহমান পুনরায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একই স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। জিয়াউর রহমান সাহসী ছিলেন। রাষ্ট্রদোহিতা হচ্ছে জেনেও ২৫ মার্চ ১৯৭১ দিনের শেষে রাত সোয়া ১২টার দিকে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই নিজের অধীনস্থ সৈন্যদের নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং প্রকাশ্যে স্বাধীনতার ঘোষণার দেন। এতদসত্ত্বেও ঐতিহাসিক বাস্তবতা হলো মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নামে। সেই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে অভিযুক্ত করে আদালতের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে মেরে ফেলতে পারত। অথবা যেমনটি ১৯৬৮ সালে ঢাকা সেনানিবাসের অভ্যন্তরে সার্জেন্ট জহুরুল হককে করেছিল তেমনটি করেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারত। কিন্তু পাকিস্তানিরা হত্যা করেনি। না করার পেছনে অনেক সম্ভাব্য কারণের মধ্যে একটি সম্ভাব্য কারণ হলো পাকিস্তানিরা বিচার করে দেখল জীবিত শেখ মুজিবের তুলনায় মৃত শেখ মুজিব মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো অংশেই কম প্রেরণা দেবে না। অপর পক্ষে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব প্রসঙ্গে বলতে হয় যে তিনি ২৬ মার্চ এবং ২৭ মার্চ ১৯৭১-এ প্রত্যক্ষ শারীরিক ও মানসিক সাহস দেখিয়েছেন, তিনি ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে প্রত্যক্ষভাবে শারীরিক ও মানসিক সাহস দেখিয়েছেন এবং ২৯-৩০ মে ১৯৮১ তারিখেও প্রচণ্ড সাহসী মনোবল দেখিয়েই চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন এবং সার্কিট হাউজে থেকেছিলেন। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদাহরণ দিয়ে আমি বুঝাতে চাচ্ছি যে, জাতিকে নেতৃত্ব দিতে গেলে বা জনগোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দিতে গেলে শারীরিক ও মানসিক সাহস উভয়টি লাগে।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মাননীয় শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান রাজনৈতিক বিরোধীদলীয় নেত্রী মাননীয় খালেদা জিয়া উভয়েই সাহস দেখিয়ে চলছেন। সাহসের কতটুকু অংশ ইতিবাচক ও যুক্তিসঙ্গত এবং কতটুকু অংশ নেতিবাচক ও পরিহার্য অংশ সেই দীর্ঘ আলোচনায় এখানে যাওয়ার সুযোগ নেই। রাজনৈতিকভাবে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময় পার করছেন প্রধানমন্ত্রী মাননীয় শেখ হাসিনা। তার সব সিদ্ধান্ত দেশবাসী পছন্দ করবে না। সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের বিভিন্ন অঙ্গনে বা অংশে, তার প্রতি বিক্ষুব্ধ অংশ সৃষ্টি হতেই পারে। বিক্ষুব্ধ অংশ বিভিন্ন মাত্রার প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। এশিয়া-আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে প্রতিক্রিয়াগুলো অনেক সময় দুঃখজনক হয়। অপর পক্ষে মাননীয় খালেদা জিয়ার এইম মুহূর্তের (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০১৫) রাজনৈতিক সঙ্কল্প এবং সেই সঙ্কল্পের বাস্তবায়ন, অতি উচ্চমার্গের সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। একটা বাড়িতে (অর্থাৎ অফিস ভবনে), মাত্র তিন-চার জন নারী সহকর্মী এবং আট-দশ জন পুরুষ সহকর্মীকে নিয়ে সরকারকর্তৃক সৃষ্ট বা সরকারকর্তৃক পৃষ্ঠপোষকতা করা বিবিধ প্রকারের হুমকি বা থ্রেটের মুখে অনড় ও অবিচল থাকাটাই অসাধারণ সাহস ও দৃঢ় মনোবলের পরিচয় প্রদান করে। বস্তুত নীল স্বচ্ছ আকাশে গভীর রাতে মরুভূমিতে পথহারা পথিকের জন্য উত্তর আকাশের ধ্রুব তারা (ইংরেজি পরিভাষায় পোল স্টার) যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনই সাম্প্রতিককালের বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের বিভিন্নপর্যায়ের নেতাকর্মীদের জন্য বেগম খালেদা জিয়ার অবস্থানও ওই রূপ। পোল স্টার বা ধ্রুব তারা যদি হঠাৎ আকাশে আসা মেঘে ঢেকে যায় তাহলে মরুভূমির পথিক বিভ্রান্ত বা ভুলপথগামী হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের কোনো একজন টেলিভিশন দর্শক যদি সপ্তাহের যেকোনো একটি কার্যদিবসে যেকোনো একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সারা দিনের প্রোগ্রাম বিশেষ করে সংবাদগুলো খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন যে ২৪ ঘণ্টায় মোট ১৫ থেকে ২০ মিনিট সময় প্রধানমন্ত্রী মাননীয় শেখ হাসিনাকে দেখানো হয়েছে এবং তার মুখের কথা দেশবাসীকে শোনানো হয়েছে। এইরূপ ২০টি চ্যানেলে মোট সময় ২০ পূরণ ২০ সমান ৪২০ মিনিট সময় দেশবাসীকে দেখানো হচ্ছে। কেউ যদি একটু কম হিসাব করেন তাহলে সেটা অন্ততপক্ষে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ মিনিট অবশ্যই হয়। ৪২০ মিনিটকে ৬০ মিনিট দিয়ে ভাগ দিলে হয় সাত ঘণ্টা। ৩০০ মিনিটকে ৬০ মিনিট দিয়ে ভাগ দিলে হয় পাঁচ ঘণ্টা। এই অঙ্ক যদি পছন্দ না হয় তাহলে বাদ দেন; শুধু ২০ মিনিটই হিসাবে নেন। অপর পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর তুলনায় মাননীয় বেগম খালেদা জিয়া এভারেজ দিনে পান শূন্য মিনিট। অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ সরকার একতরফাভাবে ইলেকট্রনিক মাধ্যমের সুযোগ নিয়ে বিএনপি এবং ২০ দলীয় জোটের বিরুদ্ধে মানুষের মনকে বিষাক্ত করে তুলছে। অন্য কথায় বলা যায় যে এটা একটা মিডিয়া ট্রায়াল। বেগম খালেদা জিয়া মর্যাদা ও সাহসের সাথে এটা মোকাবিলা করছেন। বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে এই মৌন সাহসী মোকাবিলা মাঠপর্যায়ের কর্মীদের জন্য অভিনব প্রেরণা সৃষ্টিকারী। এটাও নেতৃত্ব। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে ২০ দলীয় জোটের দুর্বলতা থাকতে পারে বা আছে। সার্বিক বা বিস্তৃত নেতৃত্বের পর্যায়েও দুর্বলতা থাকতে পারে বা আছে। সব কিছু মেনেই আন্দোলন চলছে। সমগ্র বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সিংহ এবং ছাগল এবং এই উভয়ের পারস্পরিক অবস্থান কি রকম ও কোন মাত্রায় আছে সেটা চিন্তার বিষয়। আজ যদি চিন্তা করতে দেরি করি কাল সময় না-ও পেতে পারি।
লেখক : মেজর জেনারেল অব:, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com
একটি তাত্ত্বিক বা থিওরিটিক্যাল প্রশ্ন হলো, একজন রাজা সিংহের নেতৃত্বে আরো অনেক সিংহ কী, ওই দলে বা সৈন্য বাহিনীতে থাকবে? অথবা একদল ছাগলের নেতৃত্বে যদি আরেকটি ছাগল প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে ওই নেতা ছাগল ব্যতিক্রমী এমন কী করতে পারবে? প্রথমে সিংহের আলোচনা করি। আমরা আমাদের পাঠ্যবইয়ে পড়েছি যে, সিংহ বনের রাজা। আজকাল টেলিভিশনের বদৌলতে পৃথিবীর অনেক কিছু আমরা ঘরে বসে দেখতে পারি ও শিখতে পারি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক অথবা এনিম্যাল প্ল্যানেট নামক টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দেখলে জীবজন্তু সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। আসলেই মহান সৃষ্টিকর্তা সিংহকে রাজা করে সৃষ্টি করেছেন। এই টেলিভিশনগুলোর মাধ্যমে দেখেছি যে, বন্য মহিষ, জেবরা, হরিণ, বন্যগরু, বন্যশিয়াল, হাতি, গণ্ডার এই ধরনের বহু পশু বিশাল বিশাল আয়তনের বনে জঙ্গলে দলবদ্ধভাবে চলে। কিন্তু বাঘ অথবা সিংহ দলবদ্ধভাবে দেখা যায় না বরং প্রাকৃতিকভাবেই বনের একেকটি অংশ একেকটি সিংহ বা বাঘ ভাগ করে নেয়। একেকটি সিংহ বা বাঘের এলাকাতে অন্য সিংহ বা বাঘ সাধারণত এসে প্রাধান্য বিস্তার করে না। সম্ভবত প্রকৃতির এইরূপ প্রেক্ষাপটেই কথাটি প্রচলিত হয়েছে যে, সিংহ বনের রাজা। আমার উপসংহার হলো, একজন রাজা-সিংহ আরেকজন রাজা-সিংহকে কোনো স্পেইস বা সুযোগ বা অবকাশ দেবে না। আরেকটি প্রবাদ বাক্যের উদাহরণ দিয়েও এই উপসংহারকে শক্তিশালী করা যায়। প্রবাদ বাক্যটি নি¤œরূপ: ‘এক ঘরে দুই পীর হয় না’ অথবা দক্ষিণ এশিয়ার আরেকটি ভাষায় নি¤œরূপ: ‘এক ঘরমে দো পীর নেহি হোতা।’ পীরসংক্রান্ত এই প্রবাদ বাক্যটির কোনো ব্যাখ্যায় যাবো না, যেহেতু বিষয়টি তুলনামূলকভাবে অধিক সংবেদনশীল।
আমি ওপরের একটি বা দুইটি অনুচ্ছেদে যেই উদাহরণটি দিলাম বা প্রতীকী অর্থে বনের যেই গল্প করলাম, সেই উদাহরণটি বা প্রতীকটি পৃথিবীর যেকোনো দেশের রাজনীতি ও সামাজিক অঙ্গনে যদি ট্রান্সফার করি বা স্থাপন করি, তাহলেই বোঝা যাবে যে, মানুষরূপী সিংহরা অর্থাৎ রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনের প্রত্যেক নেতা তার জন্য একটি নির্দিষ্ট এলাকা নিশ্চিতরূপেই চায়। অপর ভাষায় বলা যায় যে, কোনো একজন নেতা-মানুষ তার নেতৃত্বের অথবা নেতৃত্বাধীন এলাকার ব্যাপারে গ্যারান্টি চান। কেউ যদি এখানে নাক গলায় অথবা কেউ যদি এখানে ভাগ বসাতে চায়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই দ্বন্দ্ব বা সঙ্ঘাত অপরিহার্য। দুই রাজা টিকবে না, যেকোনো এক রাজাকে বিদায় নিতে হবে। এখন সিংহের গল্পে পুনরায় ফেরত যাই। সিংহ বুদ্ধিমান কি বোকা সেটা তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যেটি সেটি হলো, তার বাহিনীতে অর্থাৎ রাজা-সিংহের প্রজাদের মধ্যে যেসব জ্ঞানী-গুণী বুদ্ধিমান পশু আছে, সেই জ্ঞানী-গুণী বুদ্ধিমান পশুগুলোকে রাজা-সিংহ কাজে লাগাতে পারে কি না। জ্ঞানী-গুণী বুদ্ধিমান পশুগুলোর মধ্যে কেউ যদি গোয়ার্তুমি করতে চায় বা ঘাড়-তেড়ামি করতে চায় বা গরিমা দেখাতে চায়, তাহলে রাজা-সিংহ তার সামনের পায়ের একটি দিয়ে এমন একটি থাপ্পড় দেবে যে, ত্যাড়া ঘাড় সোজা হওয়ার বদলে একদম নেতিয়ে পড়বে। এই ভয়ে রাজা-সিংহের অধীনস্থ কোনো জ্ঞানী-গুণী বুদ্ধিমান পশু ঘাড় ত্যাড়ামি বা অযাচিত মাতব্বরি করতে চায় না। উপরের আট-দশ লাইনে, দুইটি প্রশ্ন তুলেছি, একটি কম গুরুত্বপূর্ণ ও একটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয় প্রশ্নটি এই অনুচ্ছেদে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয় প্রশ্নটি হলো, রাজা সিংহ আদৌ জ্ঞানী-গুণী বুদ্ধিমান পশুকে তার বাহিনীতে চান কি না?
এখন ছাগলের নেতৃত্ব ও ছাগল বাহিনী নিয়ে আলোচনা করি। ছাগল নিরীহ প্রাণী, মুখের কাছে যা পায় তাতেই মুখ লাগায়। সেই জন্যই প্রবাদ বাক্য আছে যে, ‘ছাগলে কি না খায়!’ ছাগলে কামড় দেয়ার পর কোনো সবজির গাছ অথবা লতা আর বড় হয় না। ছাগল সম্প্রদায় সাধারণত নিরীহ। সাধারণত তারা স্ব উদ্যোগে কাউকে আক্রমণ করতে যায় না। কেউ তাদের আক্রমণ করলে প্রতিহতও করতে চায় না বরং ভ্যা ভ্যা চিৎকার করতে থাকে। অতএব ওই রূপ ছাগল বাহিনীর নেতৃত্বে যদি আরেকটি ছাগলই থাকে, তাহলে সে বাহিনী কিই বা করতে পারবে? অপর পক্ষে একটি ছাগল বাহিনীর সামনে যদি একজন সিংহ নেতা হিসেবে দাঁড়ায় তাহলে ওই সিংহের সাহস বুদ্ধি ইত্যাদির কারণে অনুসারী ছাগলেরা কতটুকু অনুপ্রাণিত হতে পারে? ওই ছাগলেরা, নেতা-সিংহের ভাষা অথবা ইশারা অথবা নড়াচড়ার ভাবভঙ্গি ইত্যাদি কি বুঝবে?
এখন বিপরীতমুখী একটি ঘটনা তুলে ধরি। যদি বাহিনীটি সিংহের হয় এবং তাদের নেতৃত্বে একজন ছাগল থাকে তাহলে কী হতে পারে? ছাগল নিরীহ প্রাণী, অতএব অনেক দুরভিসন্ধিমূলক বা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বা জটিল কোনো কিছু মাথায় আসবে না। ফলে সামনের দিকে যদি কোনো দুর্গম রাস্তা পাড়ি দিতে হয় অথবা বড় কোনো বাধা অতিক্রম করতে হয়, তাহলে সেটার কোনো পন্থা ছাগলের মাথায় আসবে না। সম্ভাবনা আছে যে, নেতা-ছাগল, তার অনুসারী সিংহদের বলবে যে, তোমরা একটা রাস্তা বের করো, আমাকে জানাও, তোমাদের প্রস্তাব মোতাবেক আমি আগে আগে যেতে রাজি আছি। এতক্ষণ যা আলোচনা করলাম একান্তভাবেই কাল্পনিক। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনের বড় মাঝারি ছোট নেতা ও অনুসারীদের কর্মকাণ্ডের সাথে নেতা-সিংহ এবং নেতা-ছাগলের অথবা অনুসারী সিংহ বাহিনী বা অনুসারী ছাগল বাহিনীর চিন্তা ও কর্মের মিল আছে বলে অনেকেই বলেন। এই মিল কোন কোন দিকে বা কতটুকু, সেটা আমরা আর ব্যাখ্যা করতে চাই না। কিন্তু আমরা মনে করি বাংলাদেশে এখন সিংহের মতো সাহসী নেতৃত্ব প্রয়োজন।
বর্তমান তরুণ প্রজন্ম, অনেকেই হয়তো জানেন না যে, ঢাকা মহানগরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যেখানে এখন দোয়েল চত্বর, তার কাছেই অবস্থিত আছে সাদামাটা স্থাপত্যে তিন নেতার মাজার। তিনজনের মধ্যে দুইজন নেতার নাম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল কাশেম ফজলুল হক তথা এ কে ফজলুল হক। জনাব সোহরাওয়ার্দীকে অভিষিক্ত করা হয়েছিল একটি উপাধিতে: যথা, গণতন্ত্রের মানসপুত্র। বরিশালের (চাখারের) সন্তান জনাব এ কে ফজলুল হককে অভিষিক্ত করা হয়েছিল একটি উপাধিতে: যথা, শের-এ বাংলা বা শেরেবাংলা। উর্দু ভাষায় শের মানে বাঘ। আশি বছর আগের ভারতবর্ষে, তৎকালীন বঙ্গ প্রদেশের বাইরের রাজনৈতিক নেতারা শ্রদ্ধায় ও আবেগে, অন্যতম বাঙালি ও মুসলিম রাজনৈতিক নেতা জনাব ফজলুল হককে এই উপাধি দিয়েছিলেন তার সাহসী নেতৃত্বের কারণে। উপাধি পাওয়ার ১৫ বছর পর, আজ থেকে ৬৩ বছর পূর্বে, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক আরো একবার আনুষ্ঠানিকভাবে তার সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। তার সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগেই আজ থেকে ৬৩ বছর আগের পাকিস্তানের অন্যতম প্রদেশ পূর্ব বঙ্গের সরকার, জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করেছিল। সেই আইনের নাম: ইস্ট বেঙ্গল স্টেইট একুইজিশন অ্যান্ড টিনেনসি অ্যাক্ট। সাধারণ বাংলায় বলা হতো প্রজাস্বত্ব আইন, অর্থাৎ জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত এবং প্রজাগণের স্বত্ব কায়েম হলো। বাংলায় প্রবাদ বাক্য আছে, ‘সেই রামও নাই সেই অযোধ্যায় নাই।’ অনুরূপ বলা যায়, সেই জমিদাররাও নেই, সেই প্রজারাও নেই। অনেক জমিদার ছিলেন প্রচণ্ড অত্যাচারী এবং প্রজাদের স্বার্থবিরোধী ও আর্থিকভাবে লোভী। অনেক জমিদার ছিলেন, প্রজাবান্ধব। ধনবাড়ীর জমিদারবাড়ি, নাটোরে উত্তরা গণভবন, করটিয়া জমিদারবাড়ি, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মুরাপাড়া জমিদারবাড়ি, লাকসাম নবাববাড়ি, গাজীপুরের জয়দেবপুরে ভাওয়াল রাজাদের রাজপ্রাসাদ, ময়মনসিংহের নান্দাইলের বাহাদুরপুর জমিদারবাড়ি ইত্যাদি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
একসময় কলকাতায় প্রচণ্ড রাজনৈতিক আন্দোলন হচ্ছিল। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ-ভারতীয় সরকারের পুলিশ বাহিনী রাজনৈতিক মিছিলে গুলি করার প্রবণতা লক্ষণীয়ভাবে ছিল। একদিন একটি মিছিল যখন সামনের দিকে যাচ্ছিল, তখন পুলিশ মিছিলে গুলি করতে উদ্যত হয়। শেরেবাংলা একে ফজলুল হক মিছিলের সামনে দাঁড়ান। তার দুইটি হাত দুই দিকে প্রসারিত করে বুকটি মেলে দিয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ান এবং পুলিশকে বলেন, ‘এই মিছিলের নেতা আমি। গুলি করতে হলে আগে আমাকে করবে।’ পুলিশ কাউকেউ গুলি করেনি। ব্রিটিশ পুলিশ নিশ্চয়ই চিন্তা করেছিল বাংলার বাঘ ফজলুল হককে পৃথিবী থেকে বিদায় দিতে একটি মাত্র বুলেট প্রয়োজন, কিন্তু তার পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে।
আবারো ইতিহাসে ফিরে যাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই ষাটের দশকের বাঙালি জাতি পাকিস্তানের নিকট থেকে মুক্তি বা স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের কথাগুলো প্রচণ্ড মানসিক সাহসের পরিচায়ক। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কেন জনাব তাজউদ্দীনকে বা ডক্টর কামাল হোসেনকে প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা লিখিতভাবে দেননি অথবা মৌখিকভাবেও কাউকে প্রকাশ্যে অনুমতি দেননি, সেটা নিয়ে আমি গবেষণায় যাবো না। প্রয়োজনের নিরিখে ২৭ মার্চ ১৯৭১ তারিখে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান প্রথমে নিজের নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। প্রয়োজনের নিরিখেই জিয়াউর রহমান পুনরায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একই স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। জিয়াউর রহমান সাহসী ছিলেন। রাষ্ট্রদোহিতা হচ্ছে জেনেও ২৫ মার্চ ১৯৭১ দিনের শেষে রাত সোয়া ১২টার দিকে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই নিজের অধীনস্থ সৈন্যদের নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং প্রকাশ্যে স্বাধীনতার ঘোষণার দেন। এতদসত্ত্বেও ঐতিহাসিক বাস্তবতা হলো মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নামে। সেই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে অভিযুক্ত করে আদালতের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে মেরে ফেলতে পারত। অথবা যেমনটি ১৯৬৮ সালে ঢাকা সেনানিবাসের অভ্যন্তরে সার্জেন্ট জহুরুল হককে করেছিল তেমনটি করেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারত। কিন্তু পাকিস্তানিরা হত্যা করেনি। না করার পেছনে অনেক সম্ভাব্য কারণের মধ্যে একটি সম্ভাব্য কারণ হলো পাকিস্তানিরা বিচার করে দেখল জীবিত শেখ মুজিবের তুলনায় মৃত শেখ মুজিব মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো অংশেই কম প্রেরণা দেবে না। অপর পক্ষে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব প্রসঙ্গে বলতে হয় যে তিনি ২৬ মার্চ এবং ২৭ মার্চ ১৯৭১-এ প্রত্যক্ষ শারীরিক ও মানসিক সাহস দেখিয়েছেন, তিনি ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে প্রত্যক্ষভাবে শারীরিক ও মানসিক সাহস দেখিয়েছেন এবং ২৯-৩০ মে ১৯৮১ তারিখেও প্রচণ্ড সাহসী মনোবল দেখিয়েই চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন এবং সার্কিট হাউজে থেকেছিলেন। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদাহরণ দিয়ে আমি বুঝাতে চাচ্ছি যে, জাতিকে নেতৃত্ব দিতে গেলে বা জনগোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দিতে গেলে শারীরিক ও মানসিক সাহস উভয়টি লাগে।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মাননীয় শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান রাজনৈতিক বিরোধীদলীয় নেত্রী মাননীয় খালেদা জিয়া উভয়েই সাহস দেখিয়ে চলছেন। সাহসের কতটুকু অংশ ইতিবাচক ও যুক্তিসঙ্গত এবং কতটুকু অংশ নেতিবাচক ও পরিহার্য অংশ সেই দীর্ঘ আলোচনায় এখানে যাওয়ার সুযোগ নেই। রাজনৈতিকভাবে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময় পার করছেন প্রধানমন্ত্রী মাননীয় শেখ হাসিনা। তার সব সিদ্ধান্ত দেশবাসী পছন্দ করবে না। সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের বিভিন্ন অঙ্গনে বা অংশে, তার প্রতি বিক্ষুব্ধ অংশ সৃষ্টি হতেই পারে। বিক্ষুব্ধ অংশ বিভিন্ন মাত্রার প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। এশিয়া-আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে প্রতিক্রিয়াগুলো অনেক সময় দুঃখজনক হয়। অপর পক্ষে মাননীয় খালেদা জিয়ার এইম মুহূর্তের (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০১৫) রাজনৈতিক সঙ্কল্প এবং সেই সঙ্কল্পের বাস্তবায়ন, অতি উচ্চমার্গের সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। একটা বাড়িতে (অর্থাৎ অফিস ভবনে), মাত্র তিন-চার জন নারী সহকর্মী এবং আট-দশ জন পুরুষ সহকর্মীকে নিয়ে সরকারকর্তৃক সৃষ্ট বা সরকারকর্তৃক পৃষ্ঠপোষকতা করা বিবিধ প্রকারের হুমকি বা থ্রেটের মুখে অনড় ও অবিচল থাকাটাই অসাধারণ সাহস ও দৃঢ় মনোবলের পরিচয় প্রদান করে। বস্তুত নীল স্বচ্ছ আকাশে গভীর রাতে মরুভূমিতে পথহারা পথিকের জন্য উত্তর আকাশের ধ্রুব তারা (ইংরেজি পরিভাষায় পোল স্টার) যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনই সাম্প্রতিককালের বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের বিভিন্নপর্যায়ের নেতাকর্মীদের জন্য বেগম খালেদা জিয়ার অবস্থানও ওই রূপ। পোল স্টার বা ধ্রুব তারা যদি হঠাৎ আকাশে আসা মেঘে ঢেকে যায় তাহলে মরুভূমির পথিক বিভ্রান্ত বা ভুলপথগামী হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের কোনো একজন টেলিভিশন দর্শক যদি সপ্তাহের যেকোনো একটি কার্যদিবসে যেকোনো একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সারা দিনের প্রোগ্রাম বিশেষ করে সংবাদগুলো খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন যে ২৪ ঘণ্টায় মোট ১৫ থেকে ২০ মিনিট সময় প্রধানমন্ত্রী মাননীয় শেখ হাসিনাকে দেখানো হয়েছে এবং তার মুখের কথা দেশবাসীকে শোনানো হয়েছে। এইরূপ ২০টি চ্যানেলে মোট সময় ২০ পূরণ ২০ সমান ৪২০ মিনিট সময় দেশবাসীকে দেখানো হচ্ছে। কেউ যদি একটু কম হিসাব করেন তাহলে সেটা অন্ততপক্ষে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ মিনিট অবশ্যই হয়। ৪২০ মিনিটকে ৬০ মিনিট দিয়ে ভাগ দিলে হয় সাত ঘণ্টা। ৩০০ মিনিটকে ৬০ মিনিট দিয়ে ভাগ দিলে হয় পাঁচ ঘণ্টা। এই অঙ্ক যদি পছন্দ না হয় তাহলে বাদ দেন; শুধু ২০ মিনিটই হিসাবে নেন। অপর পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর তুলনায় মাননীয় বেগম খালেদা জিয়া এভারেজ দিনে পান শূন্য মিনিট। অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ সরকার একতরফাভাবে ইলেকট্রনিক মাধ্যমের সুযোগ নিয়ে বিএনপি এবং ২০ দলীয় জোটের বিরুদ্ধে মানুষের মনকে বিষাক্ত করে তুলছে। অন্য কথায় বলা যায় যে এটা একটা মিডিয়া ট্রায়াল। বেগম খালেদা জিয়া মর্যাদা ও সাহসের সাথে এটা মোকাবিলা করছেন। বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে এই মৌন সাহসী মোকাবিলা মাঠপর্যায়ের কর্মীদের জন্য অভিনব প্রেরণা সৃষ্টিকারী। এটাও নেতৃত্ব। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে ২০ দলীয় জোটের দুর্বলতা থাকতে পারে বা আছে। সার্বিক বা বিস্তৃত নেতৃত্বের পর্যায়েও দুর্বলতা থাকতে পারে বা আছে। সব কিছু মেনেই আন্দোলন চলছে। সমগ্র বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সিংহ এবং ছাগল এবং এই উভয়ের পারস্পরিক অবস্থান কি রকম ও কোন মাত্রায় আছে সেটা চিন্তার বিষয়। আজ যদি চিন্তা করতে দেরি করি কাল সময় না-ও পেতে পারি।
লেখক : মেজর জেনারেল অব:, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com
No comments