সংকট সমাধানে সংলাপ ও সমঝোতা by সৈয়দ আবুল মকসুদ
কোনো
জাতির ইতিহাসে দুটি সংকট কখনো একই রকম হয় না। যদি এক রকম হয়ও তার
সমাধানের উপায় এক রকম হয় না। কোনো সংকটের সমাধান একাধিক উপায়ে সম্ভব।
আশির দশকে সামরিক স্বৈরশাসকের সঙ্গে দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর সংঘাতে
সৃষ্টি হয়েছিল একধরনের রাজনৈতিক সংকট। কয়েক বছরব্যাপী সেই সংকটের ফয়সালা হয়
১৯৯০-এর ডিসেম্বরে এক পন্থায়। একানব্বইতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের
মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি গণতান্ত্রিক সরকার। ক্ষমতাসীন দল জনপ্রিয় কাজের
মাধ্যমে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার আশা না করে চাতুর্যের মাধ্যমে পুনরায়
‘নির্বাচিত’ হয়ে ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার পরিকল্পনা করে। গায়ের জোরে
একটি নির্বাচন করেও নেয় ’৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি। নির্বাচনটি বিশ্বাসযোগ্য
হয়নি কারও কাছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দল দুর্বার
সহিংস আন্দোলন অব্যাহত রাখে। তবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে
ইতিহাস মার্জনা করে দিয়েছে তাঁর শুভবুদ্ধি উদয় হওয়ার কারণে। বিরোধী দলের
দাবি মেনে নিয়ে তিনি তিন সপ্তাহের মধ্যেই পদত্যাগ করেন। নতুন নির্বাচনের
জন্য একটি অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
পরবর্তী নির্বাচনে তাঁর দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়ে প্রধান বিরোধী দলের
মর্যাদা পায়। ওই নির্বাচনে তাঁর দলের পরাজয় কিছুমাত্র অগৌরবের ছিল না।
গণতন্ত্রে ওটাই স্বাভাবিক।
২০০১-এ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির উদ্ভাবিত পদ্ধতিতেই যে নির্বাচন হয়, তাতে খালেদা জিয়া সগৌরবে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেন। অব্যবহিত পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচনে পরাজিত হয়। ওই পরাজয় শেখ হাসিনার জন্য বিন্দুমাত্র অগৌরবের ছিল না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তা হতেই পরে। কিন্তু গোলটা বাধে তখন, যখন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার ফন্দি আঁটেন, যার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। একটি গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনকে দিয়ে নির্বাচন করিয়ে বিজয়ী দলকে সরকার গঠনে তিনি সহায়তা দিতে পারতেন। বিরোধী দলের নেতা হিসেবে অতি শান্তিতে ঝামেলামুক্ত জীবনযাপন করতে পারতেন। সংসদে ও সংসদের বাইরে নয়াপল্টনের রাস্তায় হোক বা সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে হোক, সরকারের ভুলভ্রান্তির কড়া সমালোচনা করলে জনগণের উপকার হতো। দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি টেকসই হতো।
এখন এক পক্ষ বলছে নির্দলীয় ব্যবস্থায় প্রধান সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। সরকারপক্ষ বলছে ২০১৯-এর এক দিন আগেও নির্বাচন হবে না। যত বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা যায়, সেটা যেকোনো সরকারই চাইবে। যত তাড়াতাড়ি—পারলে আগামীকালই—যদি ক্ষমতায় যাওয়া যায়, সেটা বিরোধী দল চাইবে। কিন্তু দেশটা শুধু সরকারি দল ও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বাসস্থান নয়। এখানে আরও বহু ধরনের মানুষ বাস করে, বহু মতের মানুষ বাস করে এবং সংখ্যার দিক থেকে তারাই বেশি। তাদের আবেগ-অনুভূতি, ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্যটাই বেশি। তাদের মনের অবস্থা পাঠ করা প্রধান দলগুলোর অবশ্যকর্তব্য। এবং সেটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি।
বাংলাদেশের বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে, বিশেষ করে দুই প্রধান নেতার মধ্যে সরাসরি আলোচনা বা রাজনৈতিক পরিভাষায় ‘সংলাপ’ হোক, সেটা সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। নাগরিক সমাজের একশ্রেণির প্রতিনিধি এবং পশ্চিমা দাতাদেশগুলোর প্রতিনিধিরা সংলাপের কথা অব্যাহতভাবে বলছেন। তবে তাঁদের এই বলাটা তোতা পাখির বুলির মতো শোনায়। তাঁরা জানেন ওই বলায় কাজ হবে না, তবু বলার জন্যই বলে যাচ্ছেন। নাগরিক সমাজের কারও কারও কথা শুনে মনে হয় তাঁরা আধ্যাত্মিক জগতে বাস করছেন। তাঁরা মরমি ভাববাদী। বাস্তবতার বহু ঊর্ধ্বে তাঁদের অবস্থান। অবশ্য রূঢ় বাস্তববাদী তাঁরা তখনই, যখন কোর্ট-কাছারিতে যান বা এনজিও কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকেন। বর্তমান সংকটের দুই দল সংলাপে বসলেই সমাধান হবে, তা বালক-বালিকারাও বিশ্বাস করবে না। তা সত্ত্বেও মানুষ সান্ত্বনা বা মনের শান্তির জন্য চায় সংলাপ হোক।
আশির দশকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট যখন যুগপৎ আন্দোলন করছিল তাদের পাঁচ দফা দাবি এবং কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১০ দফা, আইনজীবীদের ১৭ দফা প্রস্তাব এবং ছয় দফা দাবিনামা এবং শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য জোটের চার দফা দাবিতে, তখনো দুই নেত্রীর সরাসরি বসার একটি সর্বজনীন দাবি ছিল। তাঁদের সামনাসামনি বসার ব্যবস্থা করতে শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক ও শিশুতোষ লেখক ফয়েজ আহমদ উদ্যোগ নেন। আমরাও তাঁর সহযোগী হিসেবে কাজ করি। ফয়েজ আহমদ সফল হন। একাধিকবার দুই নেত্রীর মধ্যে বৈঠক হয়।
প্রথমবার তাঁদের দুজনের মধ্যে রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয় ১৯৮৭ সালের ২৮ অক্টোবর মহাখালীস্থ আণবিক শক্তি কমিশনের অতিথিশালায়। পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার বাসভবনে বৈঠকটি শুরু হয় রাত ৯টা ৪৪ মিনিটে এবং শেষ হয় ১০টা ৩৫ মিনিটে। বৈঠক শেষে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার পক্ষে একটি যৌথ ঘোষণা প্রচার করা হয়। তাতে তাঁরা বলেছিলেন: ‘...সকল কর্মসূচি ঐক্যবদ্ধভাবে সফল করব। দেশে গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই আমাদের লক্ষ্য।’ [সংবাদ, ২৯ অক্টোবর ’৮৭]
দলমত-নির্বিশেষে মানুষ দুই নেত্রীর বৈঠককে স্বাগত জানায়। পরদিন তাঁরা দ্বিতীয় দফা বৈঠকে মিলিত হন। রাত সাড়ে ১০টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে তাঁরা গুলশানের একটি বাড়িতে বৈঠকে বসেন। এ দিনের বৈঠকে সাহায্যকারী হিসেবে আট দল এবং সাত দলের কয়েকজন নেতাও উপস্থিত ছিলেন। ‘বৃহত্তর গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে দুই নেত্রীর এই বৈঠক এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ঘোষণা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন প্রাণ ও গতির সঞ্চার করে। কেন্দ্রীয় এবং জেলা পর্যায়ের রাজনৈতিক কর্মী, সংগঠকদের মধ্যে তা বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। পাঁচ বছরে যা হয়নি, হঠাৎ করে তা ঘটে যাওয়ায় সরকারের অনেক মন্ত্রীর মধ্যেও প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে।’ [দৈনিক খবর]
এদিকে সরকারের দমন-পীড়ন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। মিটিং-মিছিলে সারা দেশে পুলিশের গুলিতে মানুষ নিহত হচ্ছিল প্রতিদিন। সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় কিন্তু তার মধ্যেই হরতাল এবং সভা-সমাবেশ-মিছিল হচ্ছিল। ৮ নভেম্বর ’৮৭ দুপুরে খালেদা জিয়ার বড় বোন খুরশীদ জাহানের বনানীর বাসভবনে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া এক ঘণ্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। সেখানে দুই নেত্রীর যুক্ত বিবৃতি সবাইকে পড়ে শোনানো হয়।
আন্দোলন জোরদার হয়। মানুষ মরতে থাকে পাখির মতো। শুধু সচিবালয়ের কাছেই নিহত হন নূর হোসেন, নূরুল হক, সাইদুর রহমান, তাজুল ইসলাম প্রমুখ। ১১ নভেম্বর আমেরিকান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে আগুন ধরিয়ে দেয় জনতা। দুই নেত্রীকে গ্রেপ্তার করে শেখ হাসিনাকে ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনে এবং খালেদা জিয়াকে তাঁর মইনুল হোসেন রোডের বাসভবনে অন্তরীণ রাখা হয়। বিএনপির মহাসচিব ওবায়দুর রহমান, আওয়ামী লীগের নেতা তোফায়েল আহমেদ, সুপ্রিম কোর্ট বার সমিতির সভাপতি ও এরশাদবিরোধী আন্দোলনের আপসহীন নেতা শামসুল হক চৌধুরীসহ ৩০০ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। দুই নেত্রীর গ্রেপ্তারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কোর্টে রিট করতে যান শেখ হাসিনার পক্ষে বিএনপির নেতা মির্জা গোলাম হাফিজ এবং খালেদা জিয়ার পক্ষে আওয়ামী লীগের নেতা কামাল হোসেন। লেখক-বুদ্ধিজীবীরাও রাজপথে নামেন। বিবিসিকে রাষ্ট্রপতি এরশাদ বলেন: ‘আমার অথরিটির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ আমি সহ্য করব না।’
সেই দিনগুলো ছিল এ রকম। অতীতের স্মৃতি ঝালাই করা দরকার, বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রয়োজনে। ১৯৯০-এর ইংরেজি নববর্ষে আমি সপরিবারে কক্সবাজার যাচ্ছিলাম। সকালে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের পথে গাড়িতে যাচ্ছি, দেখি পথে দোকানপাটে মানুষের ভিড়। কোনো গন্ডগোল নয়, মানুষ অস্বাভাবিক উল্লাস করছে। মিষ্টি-মণ্ডা খাচ্ছে। হঠাৎ ব্যাপার কী? এক বাজারে থামলাম। জানলাম গত রাতে শেখ হাসিনার বাসভবনে খালেদা জিয়া এসেছিলেন। তাঁরা মুড়ি, নাড়ু ইত্যাদি একসঙ্গে খেয়েছেন। তাঁদের সেই সৌজন্য সাক্ষাতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন জোরদার হয়। ১১ মাস পর একনায়কত্বের অবসান ঘটে।
আজ দুই নেত্রী দুই দিকে। তাঁদের সংলাপে বসতে হাতে-পায়ে ধরছেন অনেকেই। জনগণও চায়। সরকারি নেতারা বলছেন, কোনো সংলাপ ও নির্বাচন হবে না ২০১৯-এর আগে। তা-ই যদি হয়, তাহলে বর্তমান হারে মারা গেলে আগামী চার বছরে ক্রসফায়ারে ও পেট্রলবোমায় পুড়ে মারা যাবে ১৫ হাজার সাধারণ মানুষ। ওই সব মৃত্যুর দায় কে নেবে? কেন তারা মরবে?
ঘোর শত্রুর সঙ্গেও মানুষ বসে বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে। গেরিলা নেতাদের সঙ্গেও সরকারকে বসতে হয়। রাজনীতিতে বিরোধ থাকে, স্থায়ী শত্রুতা বলে কিছু নেই। বর্তমান সংকট সমাধানে সংলাপের যে কথা বলা হচ্ছে, তা এই মুহূর্তে দুই নেত্রীর মধ্যেই হতে হবে, তা-ও নয়। আশির দশকে যেমন লিয়াজোঁ কমিটি ছিল, তেমনই লিয়াজোঁ কমিটির মধ্যেও হতে পারে। পরে বসবেন দুই নেত্রী। তা ছাড়া, রাজনৈতিক সংলাপ সব সময় প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিক হতে হবে, তাও নয়, পর্দার আড়ালেও হতে পারে।
যেকোনো সমস্যার একাধিক উপায়ে সমাধান করা যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট পক্ষ কোন উপায়টি বেছে নেবে, তার ওপর নির্ভর করে সমাধানটি সুষ্ঠু হবে কি না। গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে, কিংবা গায়ের জোরে কিছু সমস্যা অল্প সময়ের জন্য ঠেকিয়ে রাখা যায়, তাতে জোর প্রয়োগকারীরই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা। বঙ্গবন্ধু আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য মীমাংসায় পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। ইয়াহিয়া-টিক্কার সরকার চাইল শক্তি প্রয়োগে সমাধান। ফলে নয় মাসের মধ্যেই ৯৩ হাজার সৈন্যের এক দুর্ধর্ষ বাহিনী মাথা নিচু করে বিদায় নেয়। বলপ্রয়োগ না করে বুদ্ধি, বিশেষ করে সুবুদ্ধি প্রয়োগ করে সংকটের সমাধান সংশ্লিষ্ট সবার জন্যই কল্যাণকর। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যত তাড়াতাড়ি বিষয়টি অনুধাবন করবেন, তত দ্রুত দেশে শান্তি ফিরে আসবে। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে দেশ এগিয়ে যাবে। যার সুফল কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা দল নয়; দল–মত–ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে ভোগ করবে সব নাগরিক।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
২০০১-এ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির উদ্ভাবিত পদ্ধতিতেই যে নির্বাচন হয়, তাতে খালেদা জিয়া সগৌরবে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেন। অব্যবহিত পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচনে পরাজিত হয়। ওই পরাজয় শেখ হাসিনার জন্য বিন্দুমাত্র অগৌরবের ছিল না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তা হতেই পরে। কিন্তু গোলটা বাধে তখন, যখন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার ফন্দি আঁটেন, যার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। একটি গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনকে দিয়ে নির্বাচন করিয়ে বিজয়ী দলকে সরকার গঠনে তিনি সহায়তা দিতে পারতেন। বিরোধী দলের নেতা হিসেবে অতি শান্তিতে ঝামেলামুক্ত জীবনযাপন করতে পারতেন। সংসদে ও সংসদের বাইরে নয়াপল্টনের রাস্তায় হোক বা সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে হোক, সরকারের ভুলভ্রান্তির কড়া সমালোচনা করলে জনগণের উপকার হতো। দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি টেকসই হতো।
এখন এক পক্ষ বলছে নির্দলীয় ব্যবস্থায় প্রধান সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। সরকারপক্ষ বলছে ২০১৯-এর এক দিন আগেও নির্বাচন হবে না। যত বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা যায়, সেটা যেকোনো সরকারই চাইবে। যত তাড়াতাড়ি—পারলে আগামীকালই—যদি ক্ষমতায় যাওয়া যায়, সেটা বিরোধী দল চাইবে। কিন্তু দেশটা শুধু সরকারি দল ও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বাসস্থান নয়। এখানে আরও বহু ধরনের মানুষ বাস করে, বহু মতের মানুষ বাস করে এবং সংখ্যার দিক থেকে তারাই বেশি। তাদের আবেগ-অনুভূতি, ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্যটাই বেশি। তাদের মনের অবস্থা পাঠ করা প্রধান দলগুলোর অবশ্যকর্তব্য। এবং সেটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি।
বাংলাদেশের বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে, বিশেষ করে দুই প্রধান নেতার মধ্যে সরাসরি আলোচনা বা রাজনৈতিক পরিভাষায় ‘সংলাপ’ হোক, সেটা সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। নাগরিক সমাজের একশ্রেণির প্রতিনিধি এবং পশ্চিমা দাতাদেশগুলোর প্রতিনিধিরা সংলাপের কথা অব্যাহতভাবে বলছেন। তবে তাঁদের এই বলাটা তোতা পাখির বুলির মতো শোনায়। তাঁরা জানেন ওই বলায় কাজ হবে না, তবু বলার জন্যই বলে যাচ্ছেন। নাগরিক সমাজের কারও কারও কথা শুনে মনে হয় তাঁরা আধ্যাত্মিক জগতে বাস করছেন। তাঁরা মরমি ভাববাদী। বাস্তবতার বহু ঊর্ধ্বে তাঁদের অবস্থান। অবশ্য রূঢ় বাস্তববাদী তাঁরা তখনই, যখন কোর্ট-কাছারিতে যান বা এনজিও কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকেন। বর্তমান সংকটের দুই দল সংলাপে বসলেই সমাধান হবে, তা বালক-বালিকারাও বিশ্বাস করবে না। তা সত্ত্বেও মানুষ সান্ত্বনা বা মনের শান্তির জন্য চায় সংলাপ হোক।
আশির দশকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট যখন যুগপৎ আন্দোলন করছিল তাদের পাঁচ দফা দাবি এবং কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১০ দফা, আইনজীবীদের ১৭ দফা প্রস্তাব এবং ছয় দফা দাবিনামা এবং শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য জোটের চার দফা দাবিতে, তখনো দুই নেত্রীর সরাসরি বসার একটি সর্বজনীন দাবি ছিল। তাঁদের সামনাসামনি বসার ব্যবস্থা করতে শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক ও শিশুতোষ লেখক ফয়েজ আহমদ উদ্যোগ নেন। আমরাও তাঁর সহযোগী হিসেবে কাজ করি। ফয়েজ আহমদ সফল হন। একাধিকবার দুই নেত্রীর মধ্যে বৈঠক হয়।
প্রথমবার তাঁদের দুজনের মধ্যে রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয় ১৯৮৭ সালের ২৮ অক্টোবর মহাখালীস্থ আণবিক শক্তি কমিশনের অতিথিশালায়। পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার বাসভবনে বৈঠকটি শুরু হয় রাত ৯টা ৪৪ মিনিটে এবং শেষ হয় ১০টা ৩৫ মিনিটে। বৈঠক শেষে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার পক্ষে একটি যৌথ ঘোষণা প্রচার করা হয়। তাতে তাঁরা বলেছিলেন: ‘...সকল কর্মসূচি ঐক্যবদ্ধভাবে সফল করব। দেশে গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই আমাদের লক্ষ্য।’ [সংবাদ, ২৯ অক্টোবর ’৮৭]
দলমত-নির্বিশেষে মানুষ দুই নেত্রীর বৈঠককে স্বাগত জানায়। পরদিন তাঁরা দ্বিতীয় দফা বৈঠকে মিলিত হন। রাত সাড়ে ১০টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে তাঁরা গুলশানের একটি বাড়িতে বৈঠকে বসেন। এ দিনের বৈঠকে সাহায্যকারী হিসেবে আট দল এবং সাত দলের কয়েকজন নেতাও উপস্থিত ছিলেন। ‘বৃহত্তর গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে দুই নেত্রীর এই বৈঠক এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ঘোষণা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন প্রাণ ও গতির সঞ্চার করে। কেন্দ্রীয় এবং জেলা পর্যায়ের রাজনৈতিক কর্মী, সংগঠকদের মধ্যে তা বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। পাঁচ বছরে যা হয়নি, হঠাৎ করে তা ঘটে যাওয়ায় সরকারের অনেক মন্ত্রীর মধ্যেও প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে।’ [দৈনিক খবর]
এদিকে সরকারের দমন-পীড়ন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। মিটিং-মিছিলে সারা দেশে পুলিশের গুলিতে মানুষ নিহত হচ্ছিল প্রতিদিন। সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় কিন্তু তার মধ্যেই হরতাল এবং সভা-সমাবেশ-মিছিল হচ্ছিল। ৮ নভেম্বর ’৮৭ দুপুরে খালেদা জিয়ার বড় বোন খুরশীদ জাহানের বনানীর বাসভবনে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া এক ঘণ্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। সেখানে দুই নেত্রীর যুক্ত বিবৃতি সবাইকে পড়ে শোনানো হয়।
আন্দোলন জোরদার হয়। মানুষ মরতে থাকে পাখির মতো। শুধু সচিবালয়ের কাছেই নিহত হন নূর হোসেন, নূরুল হক, সাইদুর রহমান, তাজুল ইসলাম প্রমুখ। ১১ নভেম্বর আমেরিকান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে আগুন ধরিয়ে দেয় জনতা। দুই নেত্রীকে গ্রেপ্তার করে শেখ হাসিনাকে ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনে এবং খালেদা জিয়াকে তাঁর মইনুল হোসেন রোডের বাসভবনে অন্তরীণ রাখা হয়। বিএনপির মহাসচিব ওবায়দুর রহমান, আওয়ামী লীগের নেতা তোফায়েল আহমেদ, সুপ্রিম কোর্ট বার সমিতির সভাপতি ও এরশাদবিরোধী আন্দোলনের আপসহীন নেতা শামসুল হক চৌধুরীসহ ৩০০ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। দুই নেত্রীর গ্রেপ্তারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কোর্টে রিট করতে যান শেখ হাসিনার পক্ষে বিএনপির নেতা মির্জা গোলাম হাফিজ এবং খালেদা জিয়ার পক্ষে আওয়ামী লীগের নেতা কামাল হোসেন। লেখক-বুদ্ধিজীবীরাও রাজপথে নামেন। বিবিসিকে রাষ্ট্রপতি এরশাদ বলেন: ‘আমার অথরিটির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ আমি সহ্য করব না।’
সেই দিনগুলো ছিল এ রকম। অতীতের স্মৃতি ঝালাই করা দরকার, বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রয়োজনে। ১৯৯০-এর ইংরেজি নববর্ষে আমি সপরিবারে কক্সবাজার যাচ্ছিলাম। সকালে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের পথে গাড়িতে যাচ্ছি, দেখি পথে দোকানপাটে মানুষের ভিড়। কোনো গন্ডগোল নয়, মানুষ অস্বাভাবিক উল্লাস করছে। মিষ্টি-মণ্ডা খাচ্ছে। হঠাৎ ব্যাপার কী? এক বাজারে থামলাম। জানলাম গত রাতে শেখ হাসিনার বাসভবনে খালেদা জিয়া এসেছিলেন। তাঁরা মুড়ি, নাড়ু ইত্যাদি একসঙ্গে খেয়েছেন। তাঁদের সেই সৌজন্য সাক্ষাতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন জোরদার হয়। ১১ মাস পর একনায়কত্বের অবসান ঘটে।
আজ দুই নেত্রী দুই দিকে। তাঁদের সংলাপে বসতে হাতে-পায়ে ধরছেন অনেকেই। জনগণও চায়। সরকারি নেতারা বলছেন, কোনো সংলাপ ও নির্বাচন হবে না ২০১৯-এর আগে। তা-ই যদি হয়, তাহলে বর্তমান হারে মারা গেলে আগামী চার বছরে ক্রসফায়ারে ও পেট্রলবোমায় পুড়ে মারা যাবে ১৫ হাজার সাধারণ মানুষ। ওই সব মৃত্যুর দায় কে নেবে? কেন তারা মরবে?
ঘোর শত্রুর সঙ্গেও মানুষ বসে বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে। গেরিলা নেতাদের সঙ্গেও সরকারকে বসতে হয়। রাজনীতিতে বিরোধ থাকে, স্থায়ী শত্রুতা বলে কিছু নেই। বর্তমান সংকট সমাধানে সংলাপের যে কথা বলা হচ্ছে, তা এই মুহূর্তে দুই নেত্রীর মধ্যেই হতে হবে, তা-ও নয়। আশির দশকে যেমন লিয়াজোঁ কমিটি ছিল, তেমনই লিয়াজোঁ কমিটির মধ্যেও হতে পারে। পরে বসবেন দুই নেত্রী। তা ছাড়া, রাজনৈতিক সংলাপ সব সময় প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিক হতে হবে, তাও নয়, পর্দার আড়ালেও হতে পারে।
যেকোনো সমস্যার একাধিক উপায়ে সমাধান করা যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট পক্ষ কোন উপায়টি বেছে নেবে, তার ওপর নির্ভর করে সমাধানটি সুষ্ঠু হবে কি না। গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে, কিংবা গায়ের জোরে কিছু সমস্যা অল্প সময়ের জন্য ঠেকিয়ে রাখা যায়, তাতে জোর প্রয়োগকারীরই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা। বঙ্গবন্ধু আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য মীমাংসায় পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। ইয়াহিয়া-টিক্কার সরকার চাইল শক্তি প্রয়োগে সমাধান। ফলে নয় মাসের মধ্যেই ৯৩ হাজার সৈন্যের এক দুর্ধর্ষ বাহিনী মাথা নিচু করে বিদায় নেয়। বলপ্রয়োগ না করে বুদ্ধি, বিশেষ করে সুবুদ্ধি প্রয়োগ করে সংকটের সমাধান সংশ্লিষ্ট সবার জন্যই কল্যাণকর। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যত তাড়াতাড়ি বিষয়টি অনুধাবন করবেন, তত দ্রুত দেশে শান্তি ফিরে আসবে। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে দেশ এগিয়ে যাবে। যার সুফল কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা দল নয়; দল–মত–ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে ভোগ করবে সব নাগরিক।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments