ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের আহাজারি by উৎপল রায়
চিরচেনা
সেই ফুটপাথ আর নেই। নেই বিক্রেতাদের হাঁকডাক। ক্রেতা নেই, বিক্রিও নেই।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দিন চলছে ধার-কর্জ করে। পুঁজি হারিয়ে অনেকে পথে
বসেছেন, হয়ে পড়েছেন দেনাগ্রস্ত। টানা অবরোধ, হরতালে ব্যবসায়িক মন্দায় কেউ
কেউ ইতিমধ্যে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছেন। অনেকে গুটানোর চিন্তায় আছেন। যারা
এখনও কোনমতে টিকে আছেন তাদের চোখে শুধুই অন্ধকার। রাজধানীর ফার্মগেট, নিউ
মার্কেট, পুরানা পল্টন, গুলিস্তান, জিপিও, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, মহাখালী
এলাকার বিভিন্ন ফুটপাথ ঘুরে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে
এমন চিত্র। ফুটপাথের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ভাষায় এমন দুর্দিন আর আসেনি।
ফার্মগেট পশ্চিম পাশ এলাকার ফুটওভার ব্রিজের নিচে নজরুল ইসলাম জানালেন, আগে
যেখানে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০টি জামা বিক্রি করতেন এখন তা নেমে এসেছে ১৫
থেকে ২০টিতে। অবরোধ, হরতাল শুরু হওয়ার পর থেকেই এ অবস্থা চলছে বলে জানালেন
তিনি। আরও জানালেন, ক্রেতা নেই, তাই এখন আর নিয়মিত দোকান নিয়ে বসেন না। গত
এক মাসে তার ব্যবসায় প্রায় লাখ টাকার লোকসান হয়েছে। দেনার দায়ে তিনি
একপ্রকার পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ফার্মগেট ইন্দিরা রোডের ফুটপাথের রেডিমেট শার্ট
বিক্রেতা মো. ইউনুস জানান, টানা অবরোধ, হরতালে তার ব্যবসা লাটে উঠেছে। আগে
যেখানে প্রতিদিন ৮০ থেকে ১০০টি শার্ট বিক্রি করতেন এখন ২০ থেকে ৩০টির বেশি
বিক্রি হয় না। তিনি বলেন, চারদিকে আতঙ্ক। তাই ক্রেতা আসে না। প্রায় একই
কথা শোনালেন, ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের সামনের ফুটপাতের জুতা ও স্যান্ডেল
বিক্রেতা বাবুল, মানিব্যাগ বিক্রেতা ফাহিম, ইন্দিরা রোডের ভ্যানিটি ব্যাগ
বিক্রেতা ওমর ফারুক, স্যান্ডেল বিক্রেতা আমিনুলসহ আরও অনেক ক্ষুদ্র
ব্যবসায়ী। তারা জানান, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় তারা সবাই আর্থিকভাবে
মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কেউ কেউ পুঁজি হারিয়ে দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
ফুটপাথের এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এদের প্রায়
সবাই বিভিন্ন এনজিও ও ঋণসংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করেন। প্রতিদিন লাভের
একটা অংশ দিতে হয় এসব সংস্থাকে। কিন্তু অনেকেই তা দিতে পারছেন না। খরছ
যোগাতে পারছেন না পরিবারেরও। কয়েকজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জানান, ফুটপাথের
সবচেয়ে বেশি ক্রেতা রাজধানীর বাইরের মানুষ। কিন্তু অবরোধ হরতাল শুরু হওয়ার
পর থেকে ঢাকার বাইরে থেকে মানুষ আসছে না। তাই ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়েছে
ফুটপাথগুলো। বায়তুল মোকাররম দক্ষিণগেট এলাকার পাঞ্জাবি বিক্রেতা মো. ইউনুস ও
গেঞ্জি বিক্রেতা মোতালেব হতাশ কণ্ঠে জানান, এভাবে চললে ক’দিন পর তাদের না
খেয়ে থাকতে হবে। এখানকার জায়নামাজ বিক্রেতা ইব্রাহিম মিয়া জানান, আগের
বিক্রির চার ভাগের এক ভাগও এখন আর নেই। তিনি বলেন, আইজ মাসখানেকের বেশি
হইলো গণ্ডগোল চলতাছে। মার্কেটে মানুষই আসে না, বিক্রি করমু কার কাছে। তাই
সারা দিন বইসা মাছি মারি। টুপি ব্যবসায়ী ইমরান জানান, ব্যবসা নেই, তাই
গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশালে টাকা পাঠাতে পারছেন না। তিনি বলেন, এহন
চলতাছি ধারকর্জ কইরা। ক’দিন পর না খাইয়া থাকমো। জিপিও এলাকার কম্বল
ব্যবসায়ী ষাটোর্ধ্ব আনোয়ার হোসেন বলেন, ব্যবসায় লাভ-ক্ষতি থাকে। অনেক
দুঃসময় পার করেছি। কিন্তু এমন দুর্দিন আর আসেনি। একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছি।
আতঙ্কের কারণে মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। সারা দিনে কোন ক্রেতা নেই।
বিক্রি নেই। প্রতিদিনই দেনার পরিমাণ বাড়ছে। এর থেকে কি কোন নিস্তার নেই?
বায়তুল মোকাররম পশ্চিম পাশের স্যান্ডেল ব্যবসায়ী রনি জানান, বেলা ২টা
পর্যন্ত মাত্র দুজোড়া স্যান্ডেল বিক্রি করতে পেরেছেন তিনি। একই এলাকার
শিশুদের পোশাক বিক্রেতা সুলতান আহমেদ, মহিলাদের ইমিটেশন গহনা বিক্রেতা
শামসুল হুদা জানান, এক মাসের বেশি সময় চলছে, সকালে দোকান খুললে ক্রেতার
দেখা মেলে না। অথচ কিছুদিন আগেও ক্রেতার ভিড়ে এখান দিয়ে হাঁটা যেত না।
এখানকার শিশুদের খেলনা বিক্রেতা মিজানুর রহমান বলেন, প্রায় ১২ বছর ধরে এ
পুরানা পল্টন ও বায়তুল মোকাররম এলাকার ফুটপাথে দোকান নিয়ে বসি। ভাল মন্দ সব
সময়ই দেখেছি। কিন্তু এমন দিন দেখিনি। সারা দিনে ক্রেতা নেই। বিক্রিও নেই।
পরিবারের খরচ আছে, এনজিওর লোন আছে। কিন্তু দিন দিন দেনার পরিমাণ কেবলই
বাড়ছে। রাজনৈতিক সমস্যার দ্রুত সমাধান হবে তারও কোন আশা দেখছি না। পুরানা
পল্টনের ফুটপাতের প্যান্ট বিক্রেতা মহিউদ্দিনকে ‘বিক্রি কেমন? জিজ্ঞাসা
করতেই তার ক্ষোভ মেশানো উত্তর ‘দেখতেই পাইতাছেন, বইসা বইসা মাছি মারতেছি’।
এখানকার রেডিমেট শার্ট বিক্রেতা আবুল বাশার, আন্ডার গার্মেন্ট বিক্রেতা
জামাল মিয়া জানান, কিছুদিন আগেও এ ফুটপাত দিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতাদের কারণে
হাঁটা যেত না। আর এখন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্রেতার দেখা মেলে না।
পুরানা পল্টন মুক্তি ভবনের নিচের ফুটপাতের বই বিক্রেতা অনিল বিশ্বাস বলেন,
সকাল থেকে দোকান খুলে বসে থাকি কিন্তু বই কেনার লোক নেই। এভাবে চললে সামনের
দিন চলবে কি করে সেই চিন্তায় অস্থির থাকি। একই এলাকার বই বিক্রেতা মজিদ
জানান, বেশ কিছুদিন ধরেই ব্যবসার অবস্থা খারাপ। ধার-কর্জ করে চলছি। ২ মাসের
বাসা ভাড়া বাকি পড়েছে। পরিবারের খরচও ঠিকমতো দিতে পারছি না। এভাবে আর
কতদিন চলবে তাও জানিনা। এর থেকে কি কোন নিস্তার নেই?
No comments