জীবনের হাতে সঁপে দেওয়া জীবন by মনজুরুল হক
জাপানি
সাংবাদিক কেনজি গোতোর পরিচিতি নতুন করে তুলে ধরার দরকার নেই। ১০ দিন ধরে
বিশ্বের সংবাদমাধ্যম তাঁর ভাগ্যের ওপর নজর রেখে যাওয়ায় তিনি কম-বেশি
পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। যদিও সেই পরিচিতি পারেনি করুণ পরিণতির হাত থেকে
তাঁকে রক্ষা করতে, পারেনি বর্বরতার ছোবল থেকে ছিনিয়ে এনে জীবনের হাতে
তাঁকে আবার ফিরিয়ে দিতে। তাঁর মৃত্যু আমাদের কাছে আদৌ মৃত্যু হিসেবে গণ্য
নয়। বরং এই মৃত্যু হচ্ছে সেই মৃত্যু, যা আমাদের শিখিয়ে দেয় আত্মত্যাগের
মহিমা, শিখিয়ে দেয় মৃত্যুকে তুচ্ছ গণ্য করার দুর্লভ সাহসিকতা। এই
শোকগাথা আমি যখন লিখছি, ২৪ ঘণ্টাও তখন পর্যন্ত অতিক্রান্ত হয়নি, ঘাতকের
ধারালো ছুরির আঘাতে কেনজি গোতোর ধড় দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার সেই চরম
মুহূর্ত থেকে। এর আগে ঠিক কী ঘটেছে, আমরা অনেকেই তা দেখেছি ইন্টারনেটে
ঘাতকদের আপলোড করা ভিডিওতে। কেনজি গোতো হাঁটু মুড়ে বসে আছেন জীবনের
স্পর্শহীন এক বিরানভূমিতে। ঘাতক উঁচিয়ে ধরে আছে ছুরি, আর অন্য হাতে কেনজি
গোতোর গলার দিকটা পেছন থেকে শক্ত হাতে চেপে ধরে ঘোষণা করছে কেন জীবন দিতে
হচ্ছে এই জাপানি সাংবাদিককে। সেই ঘাতক নিজের পরিচয় তুলে ধরেছে জিহাদি জন
হিসেবে এবং তার ত্রুটিহীন বিলেতি ইংরেজি উচ্চারণ আমাদের আভাস দিচ্ছে তার
উৎসের। এর বাইরে ঠিক কী ঘটেছে তার সবটাই এখন আমরা কল্পনায় এঁকে নিতে পারি।
আমাদের তাবৎ ঘৃণা এখন প্রবাহিত সেই জিহাদি জন ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের প্রতি,
যে ঘৃণার আগুনে একদিন তারা দগ্ধ হবে।
কেনজি গোতোকে এভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে শুভ কোনো বার্তা জিহাদি জনরা বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিতে পারেনি। বরং উল্টো আমরা দেখেছি এক কাপুরুষকে, যাকে পৃথিবীর প্রতিটি শান্তিকামী মানুষ দেখবে করুণা ও ঘৃণার চোখে। আমি নিশ্চিত কেনজি গোতোর মনেও সেই ক্রান্তিলগ্নে একই অনুভূতি ছিল, যিনি জীবনের হাতে জীবনকে সঁপে দিয়ে উন্নত শিরে বিদায় নিয়েছেন, কান্না বা হতাশার যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে নয়। তাঁর মৃত্যু এই শিক্ষাই দিয়েছে যে, অসহায় মানুষের প্রাণ বধ করার ঘৃণ্য খেলায় যারা নিয়োজিত, তাদের প্রতি করুণার দৃষ্টিতে তাকানো হচ্ছে অনেক বেশি যুক্তিসংগত। করুণা এ কারণে যে জননীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করলেও এরা মানুষ হতে পারেনি, মানবিক কোনো গুণই তাদের স্পর্শ করেনি। আর এখানেই আমরা খুঁজে পাই কাপুরুষ জিহাদি জনের সঙ্গে সাহসী কেনজি গোতোর পার্থক্য।
কেনজি গোতো মহান ব্রত নিয়ে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর সেই ব্রত ছিল বিশ্বের যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলগুলোর সবচেয়ে দুর্বল ও বঞ্চিত অংশ নারী আর শিশুদের কথা জাপানের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। ফলে প্রায় দুই দশক ধরে আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতময় ও সমস্যাসংকুল সব অঞ্চলই ভিডিও ক্যামেরা হাতে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন আর সেই ক্যামেরায় বন্দী করা মানুষের দুঃখ আর যন্ত্রণার ছবি পৌঁছে দিয়েছেন জাপানের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে। ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে বাড়তি যে সুবিধা কেনজি গোতো ভোগ করে আসছিলেন তা হলো, কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ বা নিষেধাজ্ঞা ছাড়াই সংকট যেখানে গভীর, তার কাছাকাছি জায়গায় পৌঁছে গিয়ে প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করে নেওয়া। এই নিষ্ঠা আর একাগ্রতা যেমন তাঁর জন্য নিয়ে এসেছিল পেশাগত স্বীকৃতি, তেমনি বিস্তৃত হয়েছিল উঠেছিল সংঘাতময় অঞ্চলজুড়ে তাঁর পরিচিতির নেটওয়ার্ক। এ কারণেই সিরিয়ার সংকট ঘনীভূত হতে থাকা অবস্থায় জাপানের বেশ কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল নিজেদের সাংবাদিককে না পাঠিয়ে কেনজি গোতোর পাঠানো বার্তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল।
পরিচিতির নেটওয়ার্ক সম্প্রসারিত হয়ে ওঠা কেনজি গোতোর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। গত বছর আগস্ট মাসে সিরিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে যাওয়া জাপানি নাগরিক হারুনা ইয়ুকাওয়া অপহরণকারীদের হাতে আটক হলে গোতোর ওপর দায়িত্ব পড়েছিল দোভাষী হিসেবে কাজ করার। সেই কাজ আর পরিচিতির সূত্র ধরে সে যাত্রায় ইয়ুকাওয়াকে মুক্ত করতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। তবে ইয়ুকাওয়া এরপর আর বেশি বিপজ্জনক স্থান হিসেবে গণ্য ইসলামিক স্টেট সন্ত্রাসবাদীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় গিয়ে আটক হওয়ার পর অনেকটা পরিচিত হয়ে ওঠা আরেক দেশি ভাইকে মুক্ত করার ইচ্ছা নিয়ে গোতো নিজেও সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন। তবে ভাগ্য এবার তাঁর প্রতি সদাশয় হয়নি এবং অক্টোবর মাস থেকে নিখোঁজ থাকার পর অবশেষে এক সপ্তাহের ব্যবধানে তাঁদের দুজনকেই ঘাতকের ছুরিতে প্রাণ হারাতে হয়।
কেনজি গোতো মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে সংঘাতময় অঞ্চলে দায়িত্ব পালনরত সাংবাদিককে সংবাদ সংগ্রহে নিয়োজিত হওয়ার বাইরেও আরও অনেক কিছুতে জড়িত হতে হয়। প্রতিনিয়ত আতঙ্কের মধ্যে বসবাসকারী নারী আর শিশুদের হতাশায় ভরা জীবনের মধ্যেও আশার আলো দেখিয়ে দেওয়া, তাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা সৎ একজন সাংবাদিকের পেশাগত দায়িত্বের অংশ বলেই তিনি মনে করতেন। তাই আমরা যখন দেখি যুদ্ধের গোলাগুলির মধ্যেও নিজের ক্যামেরার মনিটরে ধারণ করা ছবি দেখে এক বালকের মুখে তৃপ্তির চিহ্ন ফুটে ওঠা লক্ষ করে সাংবাদিক কেনজি গোতোর মুখে প্রশান্তির হাসি খেলে যেতে। নিজের বিশ্বাসকে কেবল কথার মধ্যে সীমিত না রেখে বাস্তবেও এর প্রয়োগে কুণ্ঠিত হননি জাপানের এই সাহসী সাংবাদিক। ফলে জীবনের জয়গান গাওয়া তাঁর কাছে ছিল যুদ্ধ আর হানাহানির মধ্যেও সর্বাগ্রে বিবেচিত এমন এক বিষয়, যার সঙ্গে আপস করতে নেই।
কেনজি গোতোকে কেন এতটা অসহায়ভাবে জীবন দিতে হলো, তা নিয়ে নানা রকম বিতর্ক আর আলোচনা-সমালোচনা এখন জাপানজুড়ে চলছে। সময়মতো পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য কেউ কেউ দায়ী করছেন দেশের প্রধানমন্ত্রীকে, কেউ আবার মাত্রাতিরিক্ত সাহসী হওয়ার জন্য কেনজি গোতোকেই। কিন্তু তাঁর এই আত্মত্যাগ বৃথা যাওয়ার নয়। তিনি দেখিয়ে গেছেন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও জীবনের ওপর আস্থা হারাতে নেই। এ যেন শার্লি এবদোর শিক্ষার ঠিক বিপরীত। ফলে ঘাতকের কাপুরুষোচিত আচরণের প্রতি ধিক্কার জানিয়ে বলতে দ্বিধা নেই যে আমরাই হচ্ছি কেনজি গোতোর অনুসারী।
টোকিও থেকে
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক৷
কেনজি গোতোকে এভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে শুভ কোনো বার্তা জিহাদি জনরা বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিতে পারেনি। বরং উল্টো আমরা দেখেছি এক কাপুরুষকে, যাকে পৃথিবীর প্রতিটি শান্তিকামী মানুষ দেখবে করুণা ও ঘৃণার চোখে। আমি নিশ্চিত কেনজি গোতোর মনেও সেই ক্রান্তিলগ্নে একই অনুভূতি ছিল, যিনি জীবনের হাতে জীবনকে সঁপে দিয়ে উন্নত শিরে বিদায় নিয়েছেন, কান্না বা হতাশার যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে নয়। তাঁর মৃত্যু এই শিক্ষাই দিয়েছে যে, অসহায় মানুষের প্রাণ বধ করার ঘৃণ্য খেলায় যারা নিয়োজিত, তাদের প্রতি করুণার দৃষ্টিতে তাকানো হচ্ছে অনেক বেশি যুক্তিসংগত। করুণা এ কারণে যে জননীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করলেও এরা মানুষ হতে পারেনি, মানবিক কোনো গুণই তাদের স্পর্শ করেনি। আর এখানেই আমরা খুঁজে পাই কাপুরুষ জিহাদি জনের সঙ্গে সাহসী কেনজি গোতোর পার্থক্য।
কেনজি গোতো মহান ব্রত নিয়ে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর সেই ব্রত ছিল বিশ্বের যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলগুলোর সবচেয়ে দুর্বল ও বঞ্চিত অংশ নারী আর শিশুদের কথা জাপানের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। ফলে প্রায় দুই দশক ধরে আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতময় ও সমস্যাসংকুল সব অঞ্চলই ভিডিও ক্যামেরা হাতে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন আর সেই ক্যামেরায় বন্দী করা মানুষের দুঃখ আর যন্ত্রণার ছবি পৌঁছে দিয়েছেন জাপানের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে। ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে বাড়তি যে সুবিধা কেনজি গোতো ভোগ করে আসছিলেন তা হলো, কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ বা নিষেধাজ্ঞা ছাড়াই সংকট যেখানে গভীর, তার কাছাকাছি জায়গায় পৌঁছে গিয়ে প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করে নেওয়া। এই নিষ্ঠা আর একাগ্রতা যেমন তাঁর জন্য নিয়ে এসেছিল পেশাগত স্বীকৃতি, তেমনি বিস্তৃত হয়েছিল উঠেছিল সংঘাতময় অঞ্চলজুড়ে তাঁর পরিচিতির নেটওয়ার্ক। এ কারণেই সিরিয়ার সংকট ঘনীভূত হতে থাকা অবস্থায় জাপানের বেশ কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল নিজেদের সাংবাদিককে না পাঠিয়ে কেনজি গোতোর পাঠানো বার্তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল।
পরিচিতির নেটওয়ার্ক সম্প্রসারিত হয়ে ওঠা কেনজি গোতোর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। গত বছর আগস্ট মাসে সিরিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে যাওয়া জাপানি নাগরিক হারুনা ইয়ুকাওয়া অপহরণকারীদের হাতে আটক হলে গোতোর ওপর দায়িত্ব পড়েছিল দোভাষী হিসেবে কাজ করার। সেই কাজ আর পরিচিতির সূত্র ধরে সে যাত্রায় ইয়ুকাওয়াকে মুক্ত করতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। তবে ইয়ুকাওয়া এরপর আর বেশি বিপজ্জনক স্থান হিসেবে গণ্য ইসলামিক স্টেট সন্ত্রাসবাদীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় গিয়ে আটক হওয়ার পর অনেকটা পরিচিত হয়ে ওঠা আরেক দেশি ভাইকে মুক্ত করার ইচ্ছা নিয়ে গোতো নিজেও সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন। তবে ভাগ্য এবার তাঁর প্রতি সদাশয় হয়নি এবং অক্টোবর মাস থেকে নিখোঁজ থাকার পর অবশেষে এক সপ্তাহের ব্যবধানে তাঁদের দুজনকেই ঘাতকের ছুরিতে প্রাণ হারাতে হয়।
কেনজি গোতো মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে সংঘাতময় অঞ্চলে দায়িত্ব পালনরত সাংবাদিককে সংবাদ সংগ্রহে নিয়োজিত হওয়ার বাইরেও আরও অনেক কিছুতে জড়িত হতে হয়। প্রতিনিয়ত আতঙ্কের মধ্যে বসবাসকারী নারী আর শিশুদের হতাশায় ভরা জীবনের মধ্যেও আশার আলো দেখিয়ে দেওয়া, তাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা সৎ একজন সাংবাদিকের পেশাগত দায়িত্বের অংশ বলেই তিনি মনে করতেন। তাই আমরা যখন দেখি যুদ্ধের গোলাগুলির মধ্যেও নিজের ক্যামেরার মনিটরে ধারণ করা ছবি দেখে এক বালকের মুখে তৃপ্তির চিহ্ন ফুটে ওঠা লক্ষ করে সাংবাদিক কেনজি গোতোর মুখে প্রশান্তির হাসি খেলে যেতে। নিজের বিশ্বাসকে কেবল কথার মধ্যে সীমিত না রেখে বাস্তবেও এর প্রয়োগে কুণ্ঠিত হননি জাপানের এই সাহসী সাংবাদিক। ফলে জীবনের জয়গান গাওয়া তাঁর কাছে ছিল যুদ্ধ আর হানাহানির মধ্যেও সর্বাগ্রে বিবেচিত এমন এক বিষয়, যার সঙ্গে আপস করতে নেই।
কেনজি গোতোকে কেন এতটা অসহায়ভাবে জীবন দিতে হলো, তা নিয়ে নানা রকম বিতর্ক আর আলোচনা-সমালোচনা এখন জাপানজুড়ে চলছে। সময়মতো পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য কেউ কেউ দায়ী করছেন দেশের প্রধানমন্ত্রীকে, কেউ আবার মাত্রাতিরিক্ত সাহসী হওয়ার জন্য কেনজি গোতোকেই। কিন্তু তাঁর এই আত্মত্যাগ বৃথা যাওয়ার নয়। তিনি দেখিয়ে গেছেন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও জীবনের ওপর আস্থা হারাতে নেই। এ যেন শার্লি এবদোর শিক্ষার ঠিক বিপরীত। ফলে ঘাতকের কাপুরুষোচিত আচরণের প্রতি ধিক্কার জানিয়ে বলতে দ্বিধা নেই যে আমরাই হচ্ছি কেনজি গোতোর অনুসারী।
টোকিও থেকে
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক৷
No comments