সহিংস অবরোধে মূল্যস্ফীতি ভাবনা by হাসান মামুন
জানুয়ারি
মাসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্টম্ফীতি বেড়েছে বলে যে তথ্য দিয়েছেন
পরিকল্পনামন্ত্রী, সেটা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিবেশিত।
আরেকটি মূল্যস্টম্ফীতি রয়েছে, যা খাদ্যবহির্ভূত। সেটি কিন্তু কমেছে। দুটি
মিলিয়ে সার্বিক মূল্যস্টম্ফীতি আবার কমে এসেছে। শহর ও গ্রাম উভয় ক্ষেত্রেই
দেখতে পাওয়া যাচ্ছে অভিন্ন প্রবণতা। মিডিয়ায় খাদ্য মূল্যস্টম্ফীতি বেড়ে
যাওয়াটাই হেডলাইন হয়েছে অবশ্য। সরকারের পক্ষ থেকেও সেটা ফোকাস করতে চাওয়া
হয়েছে মনে হলো। পরিকল্পনামন্ত্রী স্পষ্ট করেই বলেছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতায়
পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় খাদ্য মূল্যস্টম্ফীতি বেড়েছে। বৃদ্ধির হার হয়তো
অত বেশি নয়; কিন্তু এক মাসেই মূল্যস্টম্ফীতি বেড়ে যাওয়াটা বড় খবর নিশ্চয়ই।
খাদ্য মূল্যস্টম্ফীতি দেখিয়ে দেয়_ একটি দেশের সাধারণ মানুষ খেয়েদেয়ে কেমন
আছে। এর সঙ্গে পুষ্টি পরিস্থিতিও সরাসরি সম্পর্কিত। খাদ্য মূল্যস্টম্ফীতি
বেড়ে গেলে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের মধ্যে চেষ্টা শুরু হয়ে যায় অপ্রয়োজনীয় বা
কম প্রয়োজনীয় ব্যয় কাটছাঁট করে খাদ্য গ্রহণ পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক রাখার।
হরতাল-অবরোধের মতো পরিস্থিতিতে এবং অবস্থা যদি সহিংস হয়ে পড়ে, তবে এদের
পরিবহন ব্যয়ও বেড়ে যেতে দেখা যায়। তাতে সঞ্চয়ের সুযোগ কমে যায় নিম্নবিত্তের
মধ্যে। খোঁজ নিয়ে দেখা যেতে পারে, ডিপোজিট পেনশন স্কিমে (ডিপিএস) মাসে
মাসে টাকা জমা রাখার প্রক্রিয়াটি এরই মধ্যে ব্যাহত হয়েছে কিনা। সংবাদপত্রে
প্রকাশ, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে নেওয়া ক্ষুদ্র ঋণের কিস্তি ফেরত দিতে
অনেকেই সংকটে পড়ে গেছে, তারা কাজ হারিয়েছে বা আয় কমে গেছে বলে। সরকারি বা
বেসরকারি খাতে নির্দিষ্ট বেতনে চাকরি করে না, বরং দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করে,
এদের আয় কিন্তু এর মধ্যে কমে গেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। এটা কেবল শহরাঞ্চলে নয়,
গ্রামেও। যেসব অঞ্চলে কড়া অবরোধ হচ্ছে, সেখানে চালকল শ্রমিক, মুটে-মজুর,
রিকশা-ভ্যান ও স্কুটারচালকের আয় কমে গেছে। সঞ্চয় ভেঙে খাওয়ার মতো অবস্থা
আছে ক'জনের? সহজে এরা ধারকর্জও পাবে না। খাদ্য মূল্যস্টম্ফীতি বেড়ে গিয়ে
থাকলে এরা কীভাবে পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলছে, তা সহজেই বোধগম্য।
গত এক মাসে এ বিরাট জনগোষ্ঠী কি খাদ্য পরিভোগ কমিয়ে দেয়নি? আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির তলায় যিনি স্টেশনারি দোকান চালান, তিনিও বলছেন বেশ কিছু খাদ্যপণ্যের বিক্রি কমে যাওয়ার কথা। পরিচিত লোকজনের মাঝে বাকিতে কেনার প্রবণতাও বাড়ছে, যেটা তার স্বল্প পুঁজির ব্যবসার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বেশ কিছু অঞ্চলে ওষুধের দোকানেও বিক্রি নাকি কমে গেছে। আয় কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সচেতনতার ঘাটতিও একটা কারণ হয়তো। তা ছাড়া চিকিৎসার জন্য গ্রাম থেকে কম লোকজন আসছে শহরে।
খাদ্য মূল্যস্টম্ফীতি পরিমাপে আমাদের দেশে যেসব পণ্যের দাম বড় ভূমিকা রাখে, তার মধ্যে চালই মুখ্য। বিশেষত উত্তরবঙ্গের চালকলগুলো থেকে সরবরাহ বিঘি্নত হওয়ায় বা পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীসহ এদিকটায় পণ্যটির দাম এরই মধ্যে বেড়ে গেছে। নৌপথ সচল থাকায় অবশ্য ঘুরপথে বা অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসছে চাল। না হলে পরিস্থিতির হয়তো বড় রকম অবনতি ঘটত। নৌপথে অবরোধকারীরা সুবিধা করতে না পারায় দেশের কেন্দ্রস্থলে মাছ-মুরগির সরবরাহও খুব বিঘি্নত হয়নি। তবে গরু-ছাগলের জোগান ব্যাহত হওয়ায় মাংসের দাম বেড়ে গেছে দ্রুত। বিশেষত গোমাংসের দাম সহনীয় না থাকলে আমরা আমিষের সহজ একটি উৎস হারাব।
রাজধানীতে সবজির সরবরাহও কমেনি, যেহেতু আশপাশ থেকেই যথেষ্ট সবজি আসছে সাম্প্রতিক বছরগুলোয়। আতঙ্ক থাকলেও এ অঞ্চলটা সচল রয়েছে। অবশ্য পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধিকে অজুহাত হিসেবে কম ব্যবহার করা হচ্ছে না। ভাড়া দ্বিগুণ হলেও প্রতি কেজি পণ্যে দাম কত বাড়তে পারে, সেটা কেউ হিসাব কষে দেখছে না অস্থিরতার সময়। আমাদের ট্যারিফ কমিশন এ ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে। গ্রামগঞ্জে কিছু পণ্যের দাম এ পরিস্থিতিতে কিন্তু কমার কথা। এর মধ্যে রয়েছে সবজি, মাছ-মুরগি, এমনকি চাল। টানা অবরোধ-হরতালে এগুলো বিভিন্ন জায়গায় আটকা পড়ায় দাম কমে যাওয়াই স্বাভাবিক। এর মধ্যে বিপুল সংখ্যক মানুষের আয় কমে যাওয়ায় তাদের মধ্যে ভোগের চাহিদা বা কেনার প্রবণতাও নিশ্চয় কমেছে? এরও প্রভাব পড়বে দামের ওপর।
কাঁচাবাজারের বিক্রেতারা অভিযোগ করছেন, তাদের বিক্রি কমে গেছে। বিক্রি আগের মতো থাকলে এবং সরবরাহ কমে গেলে নিত্যপণ্যের দাম নিশ্চয়ই আরও কিছুটা বাড়ত। তাতে হিসাব কষে দেখা যেত, মূল্যস্টম্ফীতি আরও বেড়েছে। তবে রাজধানী দিয়ে গোটা দেশের পরিস্থিতি বুঝতে চাওয়া ঠিক হবে না। মুখে 'খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ' বললেও আমরা কিন্তু অনেক ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে এখনও অনেকখানি আমদানিনির্ভর। সব ধরনের পণ্যের আমদানিই এখন ব্যাহত হচ্ছে। বন্দর সচল থাকলেও সেখান থেকে পণ্য খালাস করে ভোক্তার কাছে পেঁৗছে দেওয়ার কাজটা তো বিঘি্নত। এটা অন্তত পড়ে গেছে ঝুঁকির মধ্যে। এতে পণ্যবাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়াটা স্বাভাবিক। নানা ধরনের ডালের দাম বেড়ে যাওয়ার মধ্যে এ পরিস্থিতি প্রতিফলিত। আন্তর্জাতিক বাজারের কারণেই ভোজ্যতেলের দাম কমে আসার প্রবণতাটা সাম্প্রতিককালে ছিল বড় স্বস্তির বিষয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এটা আরও কমে আসত বৈকি। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম গত কয়েক মাসে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসায় আন্তর্জাতিক খাদ্যপণ্যের বাজারেও এর সুফল দেখা দিচ্ছিল। বেশ কিছু দেশ মন্দা মোকাবেলা করায় তাদের ভোগের চাহিদা কমে আসাতেও দেখা দিয়েছিল ওই পরিস্থিতি। কিন্তু দেশে হঠাৎ করেই রাজনৈতিক অবস্থা প্রতিকূল হয়ে পড়ায় এর সুফলটা আমরা তুলে নিতে পারছি না। অপেক্ষাকৃত সস্তায় আনা এসব পণ্যের পরিবহন দেশে তো বিঘি্নত।
আমদানি পণ্যের দাম গ্রামের দিকে আবার বেশি থাকার প্রবণতা রয়েছে। কারণ এটা বন্দর থেকে নগরীর পাইকারি বাজার হয়ে গ্রামে যায়। দেশে উৎপাদিত খাদ্যসামগ্রীর দামের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। পাহারা দিয়ে পণ্য বা কনটেইনারবাহী ট্রাক গন্তব্যে পেঁৗছে দেওয়া স্বভাবতই সম্ভব হচ্ছে না সব ক্ষেত্রে। এর মধ্যেও কিছু দুঃসাহসিক হামলার ঘটনা ঘটছে। এ নিয়ে আবার চলছে পারস্পরিক দোষারোপ। এতে পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকারের ওপর আস্থার জায়গাটা দুর্বল হচ্ছে বললে ভুল হবে না। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে টানা অবরোধ চললেও পরিস্থিতি উন্নয়নের আশা দুর্বল হচ্ছে। দুর্ভাবনার চাপেও খাদ্য মূল্যস্টম্ফীতি বাড়ছে বললে কি ভুল হবে? অথচ এটি কমে আসার একটা স্থায়ী প্রবণতা দেখাচ্ছিল। দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ও মজুদ পরিস্থিতি ছিল ভালো। সরকার তো কিছু সিদ্ধ চাল রফতানি করেছিল শ্রীলংকায়। বিয়ে-শাদি ও পিকনিক মৌসুমে সুগন্ধি চালের দাম কমে আসা ছিল ব্যতিক্রমী ঘটনা। শীতে চা পাতার দামও কমে গিয়েছিল এবার। খাদ্যপণ্যের আমদানিও ছিল মোটের ওপর ভালো। সরকারের কর-রাজস্ব নীতিও এতে সহায়তা জোগাচ্ছিল। প্রধানত রাজনৈতিক অস্থিরতায় পরিস্থিতিটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রতিকূল। এক মাসেই মূল্যস্টম্ফীতির হিসাবে সেটা প্রতিফলিত হচ্ছে।
এদিকে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্টম্ফীতি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে জ্বালানি পণ্যের দাম হ্রাসকে নির্দেশ করা হলেও এর দেশীয় কারণ রয়েছে। সেটা হলো বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা। আবাসন খাতে কার্যক্রম এমনিতেই কমে গিয়েছিল_ টানা অবরোধে সেটা আরও বিঘি্নত। এ খাতের কাঁচামাল উৎপাদন ও পরিবহন ব্যাহত হওয়ার খবর কম মিলছে না। সরকারি অর্থে পরিচালিত অবকাঠামো উন্নয়ন এ পরিস্থিতিতে ব্যাহত হলে সেখানেও কর্মসংস্থান কমবে। সবচেয়ে বড় শিল্প উপখাত গার্মেন্টে নতুন করে ক্রয়াদেশ প্রাপ্তি ব্যাহত হলে অবাক হওয়া যাবে না। তাতে নারী শ্রমজীবীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক অভিঘাত হবে কঠিন। সেবা খাতের মধ্যে পর্যটন পরপর দুটি বড় ধাক্কা খেল দুই অর্থবছরে। এদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিক ও দোকান কর্মচারীদের কতজন ক্ষতিগ্রস্ত হলো, তা বের করতে একটু সময় লাগবে অবশ্য।
বলতে চাইছি, এ ক্ষেত্রে কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার কারণেও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্টম্ফীতি কমেছে। সূচকে এ ধরনের হ্রাস অর্থনীতির জন্য ভালো ইঙ্গিত দেয় না। আবাসন, গার্মেন্টসহ শিল্প ও সেবা খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্য অবশ্য রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত মুদ্রানীতিতে। সেটি অর্জনে যে রাজনৈতিক পরিবেশ প্রয়োজন, সরকার ও বিরোধী দল মিলে তা নিশ্চিত করতে পারবে বলে তো মনে হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে এমন হতে পারে, খাদ্য মূল্যস্টম্ফীতি আরও কিছুটা বেড়ে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্টম্ফীতি আরও কমে এলো। সেটা একই সঙ্গে হবে স্বল্প আয়ের মানুষ ও শ্রমজীবীদের জন্য দুর্ভোগপূর্ণ এবং কর্মসংস্থানের দিক থেকে হতাশাব্যঞ্জক।
পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে এলে অবশ্য খাদ্য মূল্যস্টম্ফীতি কিছুটা কমিয়ে আনার সুযোগ পাবে সরকার। আন্তর্জাতিক বাজার বিবেচনায় দেশে জ্বালানি পণ্যের দাম কমানোর পদক্ষেপ সীমিতভাবে হলেও এখন নিতে পারবেন তারা। এতে পরিবহন ভাড়া, সেচ-বিদ্যুৎ ও শিল্প উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনা গেলে ভোগ্যপণ্য ও সেবার দাম কমিয়ে সাধারণ মানুষকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেওয়া যাবে। তারা তো দীর্ঘদিন ধরে মূল্যস্টম্ফীতির আগুনে পুড়ছে। টানা ও নাশকতাময় অবরোধে সে সুযোগটাও কি হাতছাড়া হচ্ছে না?
খাদ্য মূল্যস্টম্ফীতি কমে আসার পাশাপাশি খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্টম্ফীতি একটু বাড়লেও ক্ষতি নেই। সার্বিক মূল্যস্টম্ফীতি এতে নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। অব্যাহত রাজনৈতিক সহিংসতায় আরও বেশি মানুষ আয় হারিয়ে ফেললে আর তাতে ভোগের চাহিদা বা এ সংক্রান্ত ব্যয় কমে গেলে প্রবৃদ্ধি বরং বাধাগ্রস্ত হবে। সার্বিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম কমে গিয়ে রাজস্ব আহরণ ব্যাহত হলে ব্যাংক ও বিদেশি ঋণের ওপর বেশি করে নির্ভরশীল হতে হবে সরকারকে। এর বিরূপ প্রভাব থাকবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায়।
সাংবাদিক ও কলাম লেখক
গত এক মাসে এ বিরাট জনগোষ্ঠী কি খাদ্য পরিভোগ কমিয়ে দেয়নি? আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির তলায় যিনি স্টেশনারি দোকান চালান, তিনিও বলছেন বেশ কিছু খাদ্যপণ্যের বিক্রি কমে যাওয়ার কথা। পরিচিত লোকজনের মাঝে বাকিতে কেনার প্রবণতাও বাড়ছে, যেটা তার স্বল্প পুঁজির ব্যবসার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বেশ কিছু অঞ্চলে ওষুধের দোকানেও বিক্রি নাকি কমে গেছে। আয় কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সচেতনতার ঘাটতিও একটা কারণ হয়তো। তা ছাড়া চিকিৎসার জন্য গ্রাম থেকে কম লোকজন আসছে শহরে।
খাদ্য মূল্যস্টম্ফীতি পরিমাপে আমাদের দেশে যেসব পণ্যের দাম বড় ভূমিকা রাখে, তার মধ্যে চালই মুখ্য। বিশেষত উত্তরবঙ্গের চালকলগুলো থেকে সরবরাহ বিঘি্নত হওয়ায় বা পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীসহ এদিকটায় পণ্যটির দাম এরই মধ্যে বেড়ে গেছে। নৌপথ সচল থাকায় অবশ্য ঘুরপথে বা অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসছে চাল। না হলে পরিস্থিতির হয়তো বড় রকম অবনতি ঘটত। নৌপথে অবরোধকারীরা সুবিধা করতে না পারায় দেশের কেন্দ্রস্থলে মাছ-মুরগির সরবরাহও খুব বিঘি্নত হয়নি। তবে গরু-ছাগলের জোগান ব্যাহত হওয়ায় মাংসের দাম বেড়ে গেছে দ্রুত। বিশেষত গোমাংসের দাম সহনীয় না থাকলে আমরা আমিষের সহজ একটি উৎস হারাব।
রাজধানীতে সবজির সরবরাহও কমেনি, যেহেতু আশপাশ থেকেই যথেষ্ট সবজি আসছে সাম্প্রতিক বছরগুলোয়। আতঙ্ক থাকলেও এ অঞ্চলটা সচল রয়েছে। অবশ্য পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধিকে অজুহাত হিসেবে কম ব্যবহার করা হচ্ছে না। ভাড়া দ্বিগুণ হলেও প্রতি কেজি পণ্যে দাম কত বাড়তে পারে, সেটা কেউ হিসাব কষে দেখছে না অস্থিরতার সময়। আমাদের ট্যারিফ কমিশন এ ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে। গ্রামগঞ্জে কিছু পণ্যের দাম এ পরিস্থিতিতে কিন্তু কমার কথা। এর মধ্যে রয়েছে সবজি, মাছ-মুরগি, এমনকি চাল। টানা অবরোধ-হরতালে এগুলো বিভিন্ন জায়গায় আটকা পড়ায় দাম কমে যাওয়াই স্বাভাবিক। এর মধ্যে বিপুল সংখ্যক মানুষের আয় কমে যাওয়ায় তাদের মধ্যে ভোগের চাহিদা বা কেনার প্রবণতাও নিশ্চয় কমেছে? এরও প্রভাব পড়বে দামের ওপর।
কাঁচাবাজারের বিক্রেতারা অভিযোগ করছেন, তাদের বিক্রি কমে গেছে। বিক্রি আগের মতো থাকলে এবং সরবরাহ কমে গেলে নিত্যপণ্যের দাম নিশ্চয়ই আরও কিছুটা বাড়ত। তাতে হিসাব কষে দেখা যেত, মূল্যস্টম্ফীতি আরও বেড়েছে। তবে রাজধানী দিয়ে গোটা দেশের পরিস্থিতি বুঝতে চাওয়া ঠিক হবে না। মুখে 'খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ' বললেও আমরা কিন্তু অনেক ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে এখনও অনেকখানি আমদানিনির্ভর। সব ধরনের পণ্যের আমদানিই এখন ব্যাহত হচ্ছে। বন্দর সচল থাকলেও সেখান থেকে পণ্য খালাস করে ভোক্তার কাছে পেঁৗছে দেওয়ার কাজটা তো বিঘি্নত। এটা অন্তত পড়ে গেছে ঝুঁকির মধ্যে। এতে পণ্যবাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়াটা স্বাভাবিক। নানা ধরনের ডালের দাম বেড়ে যাওয়ার মধ্যে এ পরিস্থিতি প্রতিফলিত। আন্তর্জাতিক বাজারের কারণেই ভোজ্যতেলের দাম কমে আসার প্রবণতাটা সাম্প্রতিককালে ছিল বড় স্বস্তির বিষয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এটা আরও কমে আসত বৈকি। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম গত কয়েক মাসে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসায় আন্তর্জাতিক খাদ্যপণ্যের বাজারেও এর সুফল দেখা দিচ্ছিল। বেশ কিছু দেশ মন্দা মোকাবেলা করায় তাদের ভোগের চাহিদা কমে আসাতেও দেখা দিয়েছিল ওই পরিস্থিতি। কিন্তু দেশে হঠাৎ করেই রাজনৈতিক অবস্থা প্রতিকূল হয়ে পড়ায় এর সুফলটা আমরা তুলে নিতে পারছি না। অপেক্ষাকৃত সস্তায় আনা এসব পণ্যের পরিবহন দেশে তো বিঘি্নত।
আমদানি পণ্যের দাম গ্রামের দিকে আবার বেশি থাকার প্রবণতা রয়েছে। কারণ এটা বন্দর থেকে নগরীর পাইকারি বাজার হয়ে গ্রামে যায়। দেশে উৎপাদিত খাদ্যসামগ্রীর দামের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। পাহারা দিয়ে পণ্য বা কনটেইনারবাহী ট্রাক গন্তব্যে পেঁৗছে দেওয়া স্বভাবতই সম্ভব হচ্ছে না সব ক্ষেত্রে। এর মধ্যেও কিছু দুঃসাহসিক হামলার ঘটনা ঘটছে। এ নিয়ে আবার চলছে পারস্পরিক দোষারোপ। এতে পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকারের ওপর আস্থার জায়গাটা দুর্বল হচ্ছে বললে ভুল হবে না। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে টানা অবরোধ চললেও পরিস্থিতি উন্নয়নের আশা দুর্বল হচ্ছে। দুর্ভাবনার চাপেও খাদ্য মূল্যস্টম্ফীতি বাড়ছে বললে কি ভুল হবে? অথচ এটি কমে আসার একটা স্থায়ী প্রবণতা দেখাচ্ছিল। দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ও মজুদ পরিস্থিতি ছিল ভালো। সরকার তো কিছু সিদ্ধ চাল রফতানি করেছিল শ্রীলংকায়। বিয়ে-শাদি ও পিকনিক মৌসুমে সুগন্ধি চালের দাম কমে আসা ছিল ব্যতিক্রমী ঘটনা। শীতে চা পাতার দামও কমে গিয়েছিল এবার। খাদ্যপণ্যের আমদানিও ছিল মোটের ওপর ভালো। সরকারের কর-রাজস্ব নীতিও এতে সহায়তা জোগাচ্ছিল। প্রধানত রাজনৈতিক অস্থিরতায় পরিস্থিতিটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রতিকূল। এক মাসেই মূল্যস্টম্ফীতির হিসাবে সেটা প্রতিফলিত হচ্ছে।
এদিকে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্টম্ফীতি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে জ্বালানি পণ্যের দাম হ্রাসকে নির্দেশ করা হলেও এর দেশীয় কারণ রয়েছে। সেটা হলো বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা। আবাসন খাতে কার্যক্রম এমনিতেই কমে গিয়েছিল_ টানা অবরোধে সেটা আরও বিঘি্নত। এ খাতের কাঁচামাল উৎপাদন ও পরিবহন ব্যাহত হওয়ার খবর কম মিলছে না। সরকারি অর্থে পরিচালিত অবকাঠামো উন্নয়ন এ পরিস্থিতিতে ব্যাহত হলে সেখানেও কর্মসংস্থান কমবে। সবচেয়ে বড় শিল্প উপখাত গার্মেন্টে নতুন করে ক্রয়াদেশ প্রাপ্তি ব্যাহত হলে অবাক হওয়া যাবে না। তাতে নারী শ্রমজীবীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক অভিঘাত হবে কঠিন। সেবা খাতের মধ্যে পর্যটন পরপর দুটি বড় ধাক্কা খেল দুই অর্থবছরে। এদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিক ও দোকান কর্মচারীদের কতজন ক্ষতিগ্রস্ত হলো, তা বের করতে একটু সময় লাগবে অবশ্য।
বলতে চাইছি, এ ক্ষেত্রে কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার কারণেও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্টম্ফীতি কমেছে। সূচকে এ ধরনের হ্রাস অর্থনীতির জন্য ভালো ইঙ্গিত দেয় না। আবাসন, গার্মেন্টসহ শিল্প ও সেবা খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্য অবশ্য রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত মুদ্রানীতিতে। সেটি অর্জনে যে রাজনৈতিক পরিবেশ প্রয়োজন, সরকার ও বিরোধী দল মিলে তা নিশ্চিত করতে পারবে বলে তো মনে হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে এমন হতে পারে, খাদ্য মূল্যস্টম্ফীতি আরও কিছুটা বেড়ে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্টম্ফীতি আরও কমে এলো। সেটা একই সঙ্গে হবে স্বল্প আয়ের মানুষ ও শ্রমজীবীদের জন্য দুর্ভোগপূর্ণ এবং কর্মসংস্থানের দিক থেকে হতাশাব্যঞ্জক।
পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে এলে অবশ্য খাদ্য মূল্যস্টম্ফীতি কিছুটা কমিয়ে আনার সুযোগ পাবে সরকার। আন্তর্জাতিক বাজার বিবেচনায় দেশে জ্বালানি পণ্যের দাম কমানোর পদক্ষেপ সীমিতভাবে হলেও এখন নিতে পারবেন তারা। এতে পরিবহন ভাড়া, সেচ-বিদ্যুৎ ও শিল্প উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনা গেলে ভোগ্যপণ্য ও সেবার দাম কমিয়ে সাধারণ মানুষকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেওয়া যাবে। তারা তো দীর্ঘদিন ধরে মূল্যস্টম্ফীতির আগুনে পুড়ছে। টানা ও নাশকতাময় অবরোধে সে সুযোগটাও কি হাতছাড়া হচ্ছে না?
খাদ্য মূল্যস্টম্ফীতি কমে আসার পাশাপাশি খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্টম্ফীতি একটু বাড়লেও ক্ষতি নেই। সার্বিক মূল্যস্টম্ফীতি এতে নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। অব্যাহত রাজনৈতিক সহিংসতায় আরও বেশি মানুষ আয় হারিয়ে ফেললে আর তাতে ভোগের চাহিদা বা এ সংক্রান্ত ব্যয় কমে গেলে প্রবৃদ্ধি বরং বাধাগ্রস্ত হবে। সার্বিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম কমে গিয়ে রাজস্ব আহরণ ব্যাহত হলে ব্যাংক ও বিদেশি ঋণের ওপর বেশি করে নির্ভরশীল হতে হবে সরকারকে। এর বিরূপ প্রভাব থাকবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায়।
সাংবাদিক ও কলাম লেখক
No comments