তিনি দুটি কৃষ্ণচূড়ার চারা লাগাবেন সেই দিন by মানসুরা হোসাইন
সাগর-রুনির একমাত্র ছেলে মেঘ |
সাগর-রুনি ও একমাত্র ছেলে মেঘ |
দুটি
কৃষ্ণচূড়া গাছের চারা লাগানোর অপেক্ষায় আছেন সালেহা মনির। একটি গাছ
থাকবে সাগরের আর আরেকটি থাকবে রুনির কবরের সিথানে। সালেহা প্রতিজ্ঞা
করেছেন, যেদিন তাঁর ছেলে ও বৌমার হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার পাবেন, সেদিনই
গাছ দুটি লাগাবেন। সেদিনই প্রথম যাবেন এই কবর দুটির কাছে। তবে অপেক্ষায়
পার হয়েছে তিন বছর। সালেহা জানেন না—তাঁকে আর কত বছর অপেক্ষা করতে হবে।
সাংবাদিক সাগর সরওয়ারের মা সালেহা। তাঁর ছেলের বউ আরেক সাংবাদিক মেহেরুন
রুনি। তাঁরা নৃশংসভাবে ঘরের ভেতর খুন হন ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। আজ
বুধবার তাঁদের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। এই হত্যাকাণ্ডের পর তখনকার
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের
গ্রেপ্তার করা হবে। এরপর সরকারের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ
ব্যক্তিরা অনেক আশ্বাস দিয়েছিলেন। তবে ফলাফল মেলেনি। সাগর একটি সুন্দর
বাড়ি করার স্বপ্ন দেখতেন । সেই বাড়ির সামনে থাকবে কৃষ্ণচূড়া গাছ। ছেলের
দেখা স্বপ্নই পূরণ করতে চান মা।
সালেহা মনির বলেন, ‘আমি সাগর আর রুনির কবরের কাছে এখন পর্যন্ত যাইনি। আমি তো বিচার পাইনি, ওদের কাছে কী জবাব দেব? আমি তোমাদের খুনি বা খুনিদের মুখ দেখতে পাইনি? ঘরের বঁটি–দা দিয়ে তোমাদের কেন খুন করল, তাও জানতে পারিনি।’ সালেহা মনির প্রথম আলোর প্রতিবেদকের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমরা সাংবাদিক। কত কিছু বের করতে পারো। আর আমার সাগর আর রুনির হত্যাকারীদের বের করতে পারো না? সরকার কত খুনের সুরাহা করছে, আর এটা করতে পারে না? আমরা পাব কী এ হত্যার বিচার? পারিবারিক দ্বন্দ্ব, অফিসিয়াল যে কারণেই আমার ছেলে আর ছেলের বউ খুন হোক, সেই কারণটি জানতে চাই।’
মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি দম্পতি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের নিজ বাসায় খুন হন। এ ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলম শেরেবাংলা থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে শেরেবাংলা নগর থানার পুলিশ। ঘটনার চার দিন পর এ মামলার তদন্তভার ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখাকে (ডিবি) দেওয়া হয়। দুই মাসেরও বেশি সময় তদন্ত করে ডিবি রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয় র্যাবকে। তারা ভিসেরা পরীক্ষার জন্য সাগর-রুনির লাশ কবর থেকে তোলে। তাঁদের কর্মস্থলে চলে তল্লাশি। ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী নিহত দম্পতির শিশুপুত্র মাহীর সরওয়ার মেঘের সঙ্গে দফায় দফায় কথা বলে। জিজ্ঞাসাবাদ করে শতাধিক ব্যক্তিকে। ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা সাগর-রুনির রক্তমাখা জামাকাপড় বঁটি, মোজা ইত্যাদি কিছু আলামত পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণাগারে পাঠায়। চলে অন্যান্য নানান প্রক্রিয়া।
সাগর-রুনি মারা যাওয়ার পর তাঁদের একমাত্র সন্তান মেঘ বড় হচ্ছে রুনির মা নুরুন নাহার মির্জার কাছে। নুরুন নাহার মির্জা হারিয়েছেন তাঁর একমাত্র মেয়ে ও মেয়ের জামাইকে। সালেহা মনির হারিয়েছেন একমাত্র ছেলে ও ছেলের বউকে।
র্যাবের পক্ষ থেকে এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. ওয়ারেছ আলী মিয়া টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলার তদন্ত চলছে। ডিএনএ প্রতিবেদনে অজ্ঞাতনামা দুই ব্যক্তির তথ্য পাওয়া গেছে। এ নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে। যে ল্যাপটপটি পাওয়া যাচ্ছে না, তা এখন কেউ ব্যবহার করছে কি না, তা জানার জন্য বিটিআরসি ও অন্যান্য ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। মামলায় এ পর্যন্ত মোট আটজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একজন ছাড়া অন্যরা কারাগারে আছেন। চলতি মাসেই আদালতে মামলার অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। তদন্ত শেষ হলে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।’
পুরান ঢাকার ৬ নম্বর নবাবপুর রোডের বাড়িটির এক চিলতে বারান্দায় ঝাপসা আলপনার ছাপ। তবে ঘরের দেওয়ালের নিচের জায়গার আলপনা এখনো স্পষ্ট। সালেহা মনির জানান, এগুলো সাগর ও রুনির বিয়ের চিহ্ন। একমাত্র ভাইয়ের বিয়েতে চার বোন সাজিয়েছিল। গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সালেহা মনিরের সঙ্গে এই বাড়িতেই কথা হয়। বসার ঘরের দেওয়ালে ছেলে, ছেলের বউ আর নাতির একটি ছবি বাঁধাই করে টানানো।
২০০৪ সালে সাগরের বাবা মনির হোসেন মণ্ডল মারা গেছেন। তিনি মন্ত্রি পরিষদ বিভাগে চাকরি করতেন। সরকারি চাকরির সূত্রে বর্তমান বাড়িটি বরাদ্দ পান সাগরের বাবা। এখন সালেহা মনিরের সম্বল বলতে এক কাঠা জায়গার দেড়তলা (ওপরে অর্ধেক পর্যন্ত করা) বাড়িটি। এ বাড়িতেই সাগরে বেড়ে ওঠা। তবে বাড়ির সব কাগজপত্র বুঝে পাননি সালেহা মনির। এতে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। ছেলে ও ছেলেবউ হত্যার বিচার না পাওয়া এই মায়ের দাবি, সরকার অন্ততপক্ষে যাতে এই বাড়িটি থেকে তাঁকে উচ্ছেদ না করে।
আর্থিক প্রাচুর্য না থাকলেও চার মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে সালেহা মনিরের ছিল সুখের সংসার। স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলে অবলম্বন ছিল। সাগর মারা যাওয়ার পর সালেহা মনিরের দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁর মেজো মেয়ে মঞ্জু আরা। এই মেয়ের প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে মুশফিক। সেই এখন সালেহা মনিরকে মা বলে ডাকে। অন্যদিকে মেঘ তার নানিকে ডাকে—‘আম্মা।’
কথা বলার সময় সালেহা মনির নিজেকে সামলাতে পারছিলেন না। একমাত্র ছেলে সাগরকে নিয়ে অনেক স্মৃতি, অনেক কথা। বিছানা দেখিয়ে বলেন, ‘এই খানে আমার ছেলে আমার গলা জড়িয়ে ধরে শুয়ে বলে মাথা ও পিঠ চুলকায় দিতে। এই সেদিনও মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দিলাম।’
সাগর-রুনির বিচারের প্রসঙ্গ আসতেই সালেহা মনিরের চোখের পানির সঙ্গে যোগ হয় ক্ষোভ। তিনি বলেন, ‘ ঘরের ভেতরের ঘটনা অথচ সরকার বের করতে পারছে না কার ইশারায় এ ঘটনা ঘটল। দিব্যি খুনিরা পার পাইয়া গেল। সরকার কি কিছু আড়াল করতে চাইছে? ৪৮ ঘণ্টা কেনো, ৪৮ বছরেও আমরা বিচার পাব কি না, তা জানি না।’
সালেহা মনিরের ক্ষোভের শেষ নেই। তিনি তাঁর ছেলে ও ছেলে বউকে শেষ বারের মতো একটু আদরও করতে পারেননি। মামলার স্বার্থে তাঁকে তাঁদের লাশের কাছে যেতে দেওয়া হয়নি। দূর থেকে শুধু দেখেছেন ছেলে ও ছেলের বউয়ের ক্ষতবিক্ষত লাশ।
সালেহা মনির বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা হয়। তখন তাঁকে শুধু বলেছিলাম, আপনার যেমন মাত্র একটি ছেলে, আমারও একটি মাত্র ছেলে ছিল। তাঁকে এর চেয়ে বেশি কিছু বলার দরকার নেই।’
রুনির মা–ও হতাশ হয়ে পড়েছেন। টেলিফোনে রুনির ভাই নওশের আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। এ ছাড়া একই কথা বারবার বলতে তাঁর আর ভালো লাগে না। আমরা বিচার তো পাইনি। মেঘ আগের চেয়ে ভালো আছে। তবে বুঝতে শিখেছে, এখন বাবা ও মায়ের জন্য কান্নাকাটি করে।’
গত বছর রুনির জন্ম দিনে তাঁর ভাই নওশের আলম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বিকালে আমার বোনের সঙ্গে আমি দেখা করতে যাই কবরস্থানে। মেঘ মায়ের জন্মদিনের জন্য কেক আনতে বলে, বন্ধুদের আসতে বলে, কেক কাটে। বাবা-মার কণ্ঠ শোনার জন্য পুরোনো ভিডিও খোঁজে, যেখানে মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে। আমি জানি, এটা আমাদের সারা জীবনের কষ্ট, সারা জীবন আজিমপুর গিয়ে কবর জিয়ারত করে পালন করব এই দিনটায়। ফেসবুকে কখনো রিপ্লাই আসবে না, ছোট বাবুটা মা ছাড়া কেক কেটে মায়ের বার্থডে সেলিব্রেট করে এক সময় অনেক বড় মানুষ হবে। কিন্তু আমরা বিচার তো পেতে পারি!’
সালেহা মনির বলেন, ‘আমি সাগর আর রুনির কবরের কাছে এখন পর্যন্ত যাইনি। আমি তো বিচার পাইনি, ওদের কাছে কী জবাব দেব? আমি তোমাদের খুনি বা খুনিদের মুখ দেখতে পাইনি? ঘরের বঁটি–দা দিয়ে তোমাদের কেন খুন করল, তাও জানতে পারিনি।’ সালেহা মনির প্রথম আলোর প্রতিবেদকের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমরা সাংবাদিক। কত কিছু বের করতে পারো। আর আমার সাগর আর রুনির হত্যাকারীদের বের করতে পারো না? সরকার কত খুনের সুরাহা করছে, আর এটা করতে পারে না? আমরা পাব কী এ হত্যার বিচার? পারিবারিক দ্বন্দ্ব, অফিসিয়াল যে কারণেই আমার ছেলে আর ছেলের বউ খুন হোক, সেই কারণটি জানতে চাই।’
মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি দম্পতি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের নিজ বাসায় খুন হন। এ ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলম শেরেবাংলা থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে শেরেবাংলা নগর থানার পুলিশ। ঘটনার চার দিন পর এ মামলার তদন্তভার ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখাকে (ডিবি) দেওয়া হয়। দুই মাসেরও বেশি সময় তদন্ত করে ডিবি রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয় র্যাবকে। তারা ভিসেরা পরীক্ষার জন্য সাগর-রুনির লাশ কবর থেকে তোলে। তাঁদের কর্মস্থলে চলে তল্লাশি। ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী নিহত দম্পতির শিশুপুত্র মাহীর সরওয়ার মেঘের সঙ্গে দফায় দফায় কথা বলে। জিজ্ঞাসাবাদ করে শতাধিক ব্যক্তিকে। ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা সাগর-রুনির রক্তমাখা জামাকাপড় বঁটি, মোজা ইত্যাদি কিছু আলামত পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণাগারে পাঠায়। চলে অন্যান্য নানান প্রক্রিয়া।
সাগর-রুনি মারা যাওয়ার পর তাঁদের একমাত্র সন্তান মেঘ বড় হচ্ছে রুনির মা নুরুন নাহার মির্জার কাছে। নুরুন নাহার মির্জা হারিয়েছেন তাঁর একমাত্র মেয়ে ও মেয়ের জামাইকে। সালেহা মনির হারিয়েছেন একমাত্র ছেলে ও ছেলের বউকে।
র্যাবের পক্ষ থেকে এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. ওয়ারেছ আলী মিয়া টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলার তদন্ত চলছে। ডিএনএ প্রতিবেদনে অজ্ঞাতনামা দুই ব্যক্তির তথ্য পাওয়া গেছে। এ নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে। যে ল্যাপটপটি পাওয়া যাচ্ছে না, তা এখন কেউ ব্যবহার করছে কি না, তা জানার জন্য বিটিআরসি ও অন্যান্য ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। মামলায় এ পর্যন্ত মোট আটজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একজন ছাড়া অন্যরা কারাগারে আছেন। চলতি মাসেই আদালতে মামলার অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। তদন্ত শেষ হলে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।’
পুরান ঢাকার ৬ নম্বর নবাবপুর রোডের বাড়িটির এক চিলতে বারান্দায় ঝাপসা আলপনার ছাপ। তবে ঘরের দেওয়ালের নিচের জায়গার আলপনা এখনো স্পষ্ট। সালেহা মনির জানান, এগুলো সাগর ও রুনির বিয়ের চিহ্ন। একমাত্র ভাইয়ের বিয়েতে চার বোন সাজিয়েছিল। গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সালেহা মনিরের সঙ্গে এই বাড়িতেই কথা হয়। বসার ঘরের দেওয়ালে ছেলে, ছেলের বউ আর নাতির একটি ছবি বাঁধাই করে টানানো।
২০০৪ সালে সাগরের বাবা মনির হোসেন মণ্ডল মারা গেছেন। তিনি মন্ত্রি পরিষদ বিভাগে চাকরি করতেন। সরকারি চাকরির সূত্রে বর্তমান বাড়িটি বরাদ্দ পান সাগরের বাবা। এখন সালেহা মনিরের সম্বল বলতে এক কাঠা জায়গার দেড়তলা (ওপরে অর্ধেক পর্যন্ত করা) বাড়িটি। এ বাড়িতেই সাগরে বেড়ে ওঠা। তবে বাড়ির সব কাগজপত্র বুঝে পাননি সালেহা মনির। এতে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। ছেলে ও ছেলেবউ হত্যার বিচার না পাওয়া এই মায়ের দাবি, সরকার অন্ততপক্ষে যাতে এই বাড়িটি থেকে তাঁকে উচ্ছেদ না করে।
আর্থিক প্রাচুর্য না থাকলেও চার মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে সালেহা মনিরের ছিল সুখের সংসার। স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলে অবলম্বন ছিল। সাগর মারা যাওয়ার পর সালেহা মনিরের দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁর মেজো মেয়ে মঞ্জু আরা। এই মেয়ের প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে মুশফিক। সেই এখন সালেহা মনিরকে মা বলে ডাকে। অন্যদিকে মেঘ তার নানিকে ডাকে—‘আম্মা।’
কথা বলার সময় সালেহা মনির নিজেকে সামলাতে পারছিলেন না। একমাত্র ছেলে সাগরকে নিয়ে অনেক স্মৃতি, অনেক কথা। বিছানা দেখিয়ে বলেন, ‘এই খানে আমার ছেলে আমার গলা জড়িয়ে ধরে শুয়ে বলে মাথা ও পিঠ চুলকায় দিতে। এই সেদিনও মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দিলাম।’
সাগর-রুনির বিচারের প্রসঙ্গ আসতেই সালেহা মনিরের চোখের পানির সঙ্গে যোগ হয় ক্ষোভ। তিনি বলেন, ‘ ঘরের ভেতরের ঘটনা অথচ সরকার বের করতে পারছে না কার ইশারায় এ ঘটনা ঘটল। দিব্যি খুনিরা পার পাইয়া গেল। সরকার কি কিছু আড়াল করতে চাইছে? ৪৮ ঘণ্টা কেনো, ৪৮ বছরেও আমরা বিচার পাব কি না, তা জানি না।’
সালেহা মনিরের ক্ষোভের শেষ নেই। তিনি তাঁর ছেলে ও ছেলে বউকে শেষ বারের মতো একটু আদরও করতে পারেননি। মামলার স্বার্থে তাঁকে তাঁদের লাশের কাছে যেতে দেওয়া হয়নি। দূর থেকে শুধু দেখেছেন ছেলে ও ছেলের বউয়ের ক্ষতবিক্ষত লাশ।
সালেহা মনির বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা হয়। তখন তাঁকে শুধু বলেছিলাম, আপনার যেমন মাত্র একটি ছেলে, আমারও একটি মাত্র ছেলে ছিল। তাঁকে এর চেয়ে বেশি কিছু বলার দরকার নেই।’
রুনির মা–ও হতাশ হয়ে পড়েছেন। টেলিফোনে রুনির ভাই নওশের আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। এ ছাড়া একই কথা বারবার বলতে তাঁর আর ভালো লাগে না। আমরা বিচার তো পাইনি। মেঘ আগের চেয়ে ভালো আছে। তবে বুঝতে শিখেছে, এখন বাবা ও মায়ের জন্য কান্নাকাটি করে।’
গত বছর রুনির জন্ম দিনে তাঁর ভাই নওশের আলম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বিকালে আমার বোনের সঙ্গে আমি দেখা করতে যাই কবরস্থানে। মেঘ মায়ের জন্মদিনের জন্য কেক আনতে বলে, বন্ধুদের আসতে বলে, কেক কাটে। বাবা-মার কণ্ঠ শোনার জন্য পুরোনো ভিডিও খোঁজে, যেখানে মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে। আমি জানি, এটা আমাদের সারা জীবনের কষ্ট, সারা জীবন আজিমপুর গিয়ে কবর জিয়ারত করে পালন করব এই দিনটায়। ফেসবুকে কখনো রিপ্লাই আসবে না, ছোট বাবুটা মা ছাড়া কেক কেটে মায়ের বার্থডে সেলিব্রেট করে এক সময় অনেক বড় মানুষ হবে। কিন্তু আমরা বিচার তো পেতে পারি!’
No comments