রোহিঙ্গা-বাঙালি বিতর্ক ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক by সোহরাব হাসান
ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে
প্রত্যেক জায়গার মানুষকে নিয়ে ভাবতে হবে এবং তাদের অনুভব করতে হবে।
বস্তুগত বিষয়ের বাইরে মানুষের জীবনের যে অর্থবহ অস্তিত্ব থাকতে পারে, তা
গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে।
অং সান সু চি
মিয়ানমারের গণতন্ত্রের নেত্রী অং সান সু চি সম্পর্কে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের একটি ভুল ধারণা আছে যে তিনি রোহিঙ্গা মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে যথেষ্ট সংবদেনশীল নন। রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার সরকারের অমানবিক আচরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে অনেক সময়ই তিনি এড়িয়ে যান। কখনো কখনো মিয়ানমারে গণতন্ত্র এলে সব নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে বলে তাঁকে দায়সারা মন্তব্য করতে দেখা যায়।
কিন্তু গত মাসে ইয়াঙ্গুনে বাংলাদেশি বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে ঠিক বিপরীত চিত্রটিই পেলাম। ফেসবুকে অং সান সু চির বিরুদ্ধে অব্যাহত অপপ্রচারের বেশ কিছু তথ্য-প্রমাণ হাজির করলেন তাঁরা। একটি স্ট্যাটাসে সু চিকে বৌদ্ধবিরোধী ও মুসলমানহিতৈষী হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করতে গিয়ে তাঁর মাথায় হিজাব পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। একটি ছবিতে দেখা যায়, তিনি হিজাব পরে মিয়ানমারের মুসলমান নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন। যেহেতু অং সান সুচি মুসলমান নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন, সেহেতু তিনি মুসলমানদের দালাল। এ ধরনের রাজনৈতিক অপপ্রচার কেবল মিয়ানমারের নয়, বাংলাদেশের নেতা-নেত্রীদের নামেও প্রতিপক্ষ করে থাকে।
আমাদের স্মরণ থাকার কথা, ১৯৮৮ সালে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ছাত্ররাই মিয়ানমারে আন্দোলন শুরু করেছিলেন এবং অং সান সু চিকে তাঁরা নেত্রী হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সামরিক সরকার বৌদ্ধ ভিক্ষু ও সু চির সমর্থকদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালায়। গণতন্ত্রের আন্দোলন করতে গিয়ে অং সান সু চিকে ১৬ বছরের বেশি সময় অন্তরীণ থাকতে হয়েছে। আমাদের এ-ও মনে রাখা দরকার যে মিয়ানমারের ৯০ শতাংশ মানুষ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী, যার মধ্যে ৬৪ শতাংশ বার্মিজ। সু চি ক্ষমতায় যেতে চান। ফলে তাঁকে ভোটের রাজনীতি করতে হয়। দেশে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠের জাত্যভিমান এতই প্রকট যে সহজে ঝেড়ে ফেলা যায় না (বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রবক্তাও পাহাড়িদের বাঙালি হয়ে যেতে বলেছিলেন)। তার পরও মিয়ানমারের মুসলমান এবং অন্যান্য ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী মনে করে, সু চিই শেষ ভরসা। আসলে নভেম্বরের নির্বাচনকে ঘিরে একটি মহল প্রচারণা চালাচ্ছে যে সু চি সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের সঙ্গে নেই। এই প্রচারণা তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ অর্থাৎ ক্ষমতাসীনদের সুবিধা এনে দেবে। তাই তাঁকে প্রতিটি কথা বলতে হয় হিসাব করে।
সন্দেহ নেই, মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা খুবই দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে আছে। যারা নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দিতে অস্বীকার করছে, তারা এখন নিজ দেশে পরবাসী। কোনো রকম নাগরিক–সুবিধা পায় না। যেসব বিদেশি সাহায্য সংস্থা রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছে, তাদেরও নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
সম্প্রতি জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার ইয়াংহি লি রাখাইন রাজ্য পরিদর্শন করে সেখানকার পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। অনেক রোহিঙ্গা তাঁকে বলেছেন, ‘আমাদের বাঙালি বা রোহিঙ্গা যা-ই বলা হোক না কেন, আমরা নাগরিকত্ব কার্ড চাই।’ ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গারা মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কেউ ক্যাম্পের বাইরে যেতে পারে না। যাঁরা বাঙালি পরিচয়কে মেনে নিয়েছে, তাঁরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে সীমিত সুযোগ-সুবিধা পেলেও কখনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে কিংবা রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারবেন না।
রোহিঙ্গারা ইতিহাসের শিকার। যেমনটির শিকার বাংলাদেশে বসবাসকারী বিহারিরা। বাংলাদেশে ৪৩ বছর ধরে কয়েক লাখ বিহারি রেড ক্রিসেন্ট ক্যাম্পে আছে, কেউ বা বস্তিতে। তাদের প্রতি রাষ্ট্রের আচরণ চরম বৈরী ও বৈষম্যমূলক। আমরা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে যতটা সোচ্চার, বিহারিদের প্রশ্নে ততটাই নীরব। এটাও বাঙালি মুসলমানের স্ববিরোধিতা।
মিয়ানমারে ১৯৬২ সালে সামরিক শাসক প্রণীত আইনে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার হরণ বা খর্ব করা হয়েছে। কিন্তু এই জনগোষ্ঠী এতটাই দুর্বল ও দরিদ্র যে তারা এর বিরুদ্ধে কার্যকর আন্দোলন করতে পারেনি। বরং দারিদ্র্যের সুযোগে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী সংগঠন নানাভাবে তাদের প্ররোচিত করে চলেছে, যে কারণে রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আরও বেশি বিদ্বিষ্ট। আর বৌদ্ধ রাখাইনদের সঙ্গে রোহিঙ্গা মুসলমানদের যুদ্ধটা কয়েক শ বছরের পুরোনো। ব্রিটিশ আমলে যেসব রাখাইন বাংলাদেশ বা তৎকালীন অবিভক্ত ভারত থেকে গিয়েছে বা যেতে বাধ্য হয়েছে, মাতৃভূমি হারানোর কষ্ট কিন্তু তাদেরও কম নয়।
ইয়াঙ্গুনের বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি, মিয়ানমারের সরকার ও প্রশাসন রোহিঙ্গাদের থেকে অন্য মুসলমানদের আলাদাভাবে দেখে। অর্থাৎ শত্রু ভাবে না। ইয়াঙ্গুন, মান্দালেসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী মুসলমানরা মোটামুটি সচ্ছল। অধিকাংশই ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। পুরোনো ইয়াঙ্গুনে বেশ কজন মুসলমান নারী-পুরুষের সঙ্গে আলাপ হলো। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা হলেও মিয়ানমারের ভাষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিকে আত্মস্থ করে নিয়েছেন। প্রত্যেকের দুটি নাম—একটি ধর্মীয় বা পারিবারিক, আরেকটি বার্মিজ। প্রতিবেশীদের সঙ্গে তঁারা বর্মি ভাষায়ই কথা বলেন। প্রতিবেশীরাও তাঁদের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলে। কিন্তু মিয়ানমারের কোথাও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দিলে কিংবা অঘটন ঘটলেই তার রেশ এসে তাঁদের ওপরও পড়ে। তখন আতঙ্কে থাকতে হয়। সংখ্যালঘুর এই যাতনা কোথায় নেই?
সরকার ‘হোয়াইট কার্ড’ নামে রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী পরিচয়পত্র দিয়েছে। যাঁরা অস্থায়ী কার্ড নেননি, তাঁদের ক্যাম্পেই প্রায় বন্দিজীবন কাটাতে হয়। সবচেয়ে অমানবিক হলো বিয়ে করতে বা সন্তান নিতেও রোহিঙ্গাদের সরকারের অনুমতি নিতে হয়। তাঁরা দুটির বেশি সন্তান নিতে পারেন না। কিন্তু মিয়ানমারের অন্য কোনো জনগোষ্ঠীর ওপর এ নিষেধাজ্ঞা নেই।
মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মিজরা মনে করে, রাখাইন মুসলমানরা বহিরাগত। অথচ ইতিহাস তাদের এই দাবি সমর্থন করে না। উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, অষ্টম ও নবম শতকে যখন আরবরা এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আসে, তখনই পশ্চিম মিয়ানমারে মুসলমানরা বসতি শুরু করে। রাখাইন প্রদেশের ৪০ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ৩০ লাখ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, যারা রাখাইন নামে পরিচিত। বাকি ১০ লাখ মুসলমান ধর্মাবলম্বী এবং বেশির ভাগই বাংলাভাষী। অারও নির্দিষ্ট করে বললে, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে।
রোহিঙ্গারা এখন নিজ দেশে কেবল পরবাসী নয়, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রান্তিক ও নির্যাতিত জনগোষ্ঠীগুলোর একটি। অথচ ঐতিহাসিকভাবে তারা শুধু মিয়ানমারের অবিচ্ছেদ্য অংশই নয়, দেশটির স্বাধীনতাসংগ্রামেও অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। ১৯৪৭ সালে অং সানের সঙ্গে যে কজন স্বাধীনতাসংগ্রামী নিহত হন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন রোহিঙ্গা মুসলমান।
১৯৮৮ সালে অং সান সু চিকে রাজনীতিতে আনার ক্ষেত্রেও রোহিঙ্গা মুসলিম লেখক ও রাজনীতিক মং থু কার (মুসলিম নাম নূর মোহাম্মদ) ভূমিকা ছিল। তিনি পরে এনএলডির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মিজ শাসকেরা এসব মনে রাখেননি। তাঁরা জাতিবিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মিয়ানমারের বহুজাতিক ও গণতান্ত্রিক চরিত্র। মিয়ানমারে ১৩৫টি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী আছে, কিন্তু তাদের মধ্যে রোহিঙ্গা নেই।
রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাটি দীর্ঘদিনের। এর সমাধানে যে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করার প্রয়োজন ছিল, বাংলাদেশ তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। মাঝেমধ্যে পশ্চিমা নেতারা তাঁদের বক্তৃতা–বিবৃতিতে বুড়ি ছোঁয়ার মতো রোহিঙ্গাদের বিষয়টি ছুঁয়ে যান। কোনো কাজ হয় না।
এখন প্রশ্ন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না? আমরা কি পূর্বদিকের দরজা বন্ধ করে রাখব? ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্তবিরোধ আছে। বিরোধ আছে তিব্বত নিয়েও। তাই বলে তো তারা একে অপরের দরজা বন্ধ করে রাখেনি। বিরোধ মেনে নিয়েই ভারত–চীন ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াচ্ছে। বিনিয়োগ করছে।
গত বছরের মার্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বিমসটেকের শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে মিয়ানমারে গিয়েছিলেন, তখন তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট থেইন সিয়েনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জবাবে থিয়েন সিয়েন শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যার সমাধানের কথা বলেছিলেন। তবে আগের ও পরের কিছু ঘটনা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে বাধা হয়ে আছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন। ২০১২ সালে বাংলাদেশে রামু ট্র্যাজেডির পর মিয়ানমারেও কয়েক দফা মুসলমানবিরোধী দাঙ্গা হয়। দ্বিতীয়ত, দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক পর্যায়ে যেসব সিদ্ধান্ত হয়, তার বাস্তবায়নে আমলাতন্ত্র গড়িমসি করে থাকে।
ইয়াঙ্গুনে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা দুই দেশের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর ওপর জোর দিলেন। বর্তমানে যেটুকু যোগাযোগ আছে, সরকারিভাবে। দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক লেনদেন হওয়া প্রয়োজন বলেও তাঁরা জানান। এখানকার লেখক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, শিল্পীরা যদি ওখানে যান; আর ওখানকার লেখক, শিক্ষাবিদ, শিল্পীরা যদি এখানে আসেন, পরস্পরকে জানতে পারবেন। ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটবে।
গত ডিসেম্বর মাসে মিয়ানমারের পরিবেশবিদদের একটি দল বাংলাদেশে এসেছিল। দলটির সদস্যরা কুষ্টিয়া, পাবনা, রংপুর ও বগুড়ার মহাস্থানগড় ঘুরে গেছেন। এই সফরে এসে তাঁরা প্রথম বাংলাদেশের বৌদ্ধবিহারগুলো সম্পর্কে জানতে পারলেন। গত মাসে ঢাকা থেকেও শিক্ষাবিদ ও নাগরিক সমাজের একটি প্রতিনিধিদল ইয়াঙ্গুন গিয়েছিল দুই দেশের বিদ্বৎ সমাজের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াতে।
এ কথা ঠিক যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ব্যবসা–বাণিজ্য বাড়ছে। যোগাযোগ বাড়ানোরও চেষ্টা চলছে। ইয়াঙ্গুনে বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে শুনলাম, রাষ্ট্রদূত সফিউর রহমান সিটু গিয়েছেন ত্রিপক্ষীয় সড়ক যোগাযোগের একটি বৈঠকে যোগ দিতে। ভারত হয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সরাসরি সড়কযোগাযোগ স্থাপিত হবে, যার সঙ্গে চীনের প্রস্তাবিত সিল্ক রোড যুক্ত হবে।
ইয়াঙ্গুনের নাগরিক সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁদের ধারণা ইতিবাচক। বললেন, বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ, অন্তত পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো মৌলবাদী–জঙ্গিবাদী দেশ নয়।
কিন্তু মিয়ানমার সম্পর্কে আমরাই বা কতটা জানি?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net
অং সান সু চি
মিয়ানমারের গণতন্ত্রের নেত্রী অং সান সু চি সম্পর্কে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের একটি ভুল ধারণা আছে যে তিনি রোহিঙ্গা মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে যথেষ্ট সংবদেনশীল নন। রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার সরকারের অমানবিক আচরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে অনেক সময়ই তিনি এড়িয়ে যান। কখনো কখনো মিয়ানমারে গণতন্ত্র এলে সব নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে বলে তাঁকে দায়সারা মন্তব্য করতে দেখা যায়।
কিন্তু গত মাসে ইয়াঙ্গুনে বাংলাদেশি বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে ঠিক বিপরীত চিত্রটিই পেলাম। ফেসবুকে অং সান সু চির বিরুদ্ধে অব্যাহত অপপ্রচারের বেশ কিছু তথ্য-প্রমাণ হাজির করলেন তাঁরা। একটি স্ট্যাটাসে সু চিকে বৌদ্ধবিরোধী ও মুসলমানহিতৈষী হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করতে গিয়ে তাঁর মাথায় হিজাব পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। একটি ছবিতে দেখা যায়, তিনি হিজাব পরে মিয়ানমারের মুসলমান নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন। যেহেতু অং সান সুচি মুসলমান নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন, সেহেতু তিনি মুসলমানদের দালাল। এ ধরনের রাজনৈতিক অপপ্রচার কেবল মিয়ানমারের নয়, বাংলাদেশের নেতা-নেত্রীদের নামেও প্রতিপক্ষ করে থাকে।
আমাদের স্মরণ থাকার কথা, ১৯৮৮ সালে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ছাত্ররাই মিয়ানমারে আন্দোলন শুরু করেছিলেন এবং অং সান সু চিকে তাঁরা নেত্রী হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সামরিক সরকার বৌদ্ধ ভিক্ষু ও সু চির সমর্থকদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালায়। গণতন্ত্রের আন্দোলন করতে গিয়ে অং সান সু চিকে ১৬ বছরের বেশি সময় অন্তরীণ থাকতে হয়েছে। আমাদের এ-ও মনে রাখা দরকার যে মিয়ানমারের ৯০ শতাংশ মানুষ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী, যার মধ্যে ৬৪ শতাংশ বার্মিজ। সু চি ক্ষমতায় যেতে চান। ফলে তাঁকে ভোটের রাজনীতি করতে হয়। দেশে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠের জাত্যভিমান এতই প্রকট যে সহজে ঝেড়ে ফেলা যায় না (বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রবক্তাও পাহাড়িদের বাঙালি হয়ে যেতে বলেছিলেন)। তার পরও মিয়ানমারের মুসলমান এবং অন্যান্য ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী মনে করে, সু চিই শেষ ভরসা। আসলে নভেম্বরের নির্বাচনকে ঘিরে একটি মহল প্রচারণা চালাচ্ছে যে সু চি সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের সঙ্গে নেই। এই প্রচারণা তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ অর্থাৎ ক্ষমতাসীনদের সুবিধা এনে দেবে। তাই তাঁকে প্রতিটি কথা বলতে হয় হিসাব করে।
সন্দেহ নেই, মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা খুবই দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে আছে। যারা নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দিতে অস্বীকার করছে, তারা এখন নিজ দেশে পরবাসী। কোনো রকম নাগরিক–সুবিধা পায় না। যেসব বিদেশি সাহায্য সংস্থা রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছে, তাদেরও নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
সম্প্রতি জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার ইয়াংহি লি রাখাইন রাজ্য পরিদর্শন করে সেখানকার পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। অনেক রোহিঙ্গা তাঁকে বলেছেন, ‘আমাদের বাঙালি বা রোহিঙ্গা যা-ই বলা হোক না কেন, আমরা নাগরিকত্ব কার্ড চাই।’ ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গারা মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কেউ ক্যাম্পের বাইরে যেতে পারে না। যাঁরা বাঙালি পরিচয়কে মেনে নিয়েছে, তাঁরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে সীমিত সুযোগ-সুবিধা পেলেও কখনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে কিংবা রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারবেন না।
রোহিঙ্গারা ইতিহাসের শিকার। যেমনটির শিকার বাংলাদেশে বসবাসকারী বিহারিরা। বাংলাদেশে ৪৩ বছর ধরে কয়েক লাখ বিহারি রেড ক্রিসেন্ট ক্যাম্পে আছে, কেউ বা বস্তিতে। তাদের প্রতি রাষ্ট্রের আচরণ চরম বৈরী ও বৈষম্যমূলক। আমরা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে যতটা সোচ্চার, বিহারিদের প্রশ্নে ততটাই নীরব। এটাও বাঙালি মুসলমানের স্ববিরোধিতা।
মিয়ানমারে ১৯৬২ সালে সামরিক শাসক প্রণীত আইনে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার হরণ বা খর্ব করা হয়েছে। কিন্তু এই জনগোষ্ঠী এতটাই দুর্বল ও দরিদ্র যে তারা এর বিরুদ্ধে কার্যকর আন্দোলন করতে পারেনি। বরং দারিদ্র্যের সুযোগে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী সংগঠন নানাভাবে তাদের প্ররোচিত করে চলেছে, যে কারণে রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আরও বেশি বিদ্বিষ্ট। আর বৌদ্ধ রাখাইনদের সঙ্গে রোহিঙ্গা মুসলমানদের যুদ্ধটা কয়েক শ বছরের পুরোনো। ব্রিটিশ আমলে যেসব রাখাইন বাংলাদেশ বা তৎকালীন অবিভক্ত ভারত থেকে গিয়েছে বা যেতে বাধ্য হয়েছে, মাতৃভূমি হারানোর কষ্ট কিন্তু তাদেরও কম নয়।
ইয়াঙ্গুনের বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি, মিয়ানমারের সরকার ও প্রশাসন রোহিঙ্গাদের থেকে অন্য মুসলমানদের আলাদাভাবে দেখে। অর্থাৎ শত্রু ভাবে না। ইয়াঙ্গুন, মান্দালেসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী মুসলমানরা মোটামুটি সচ্ছল। অধিকাংশই ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। পুরোনো ইয়াঙ্গুনে বেশ কজন মুসলমান নারী-পুরুষের সঙ্গে আলাপ হলো। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা হলেও মিয়ানমারের ভাষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিকে আত্মস্থ করে নিয়েছেন। প্রত্যেকের দুটি নাম—একটি ধর্মীয় বা পারিবারিক, আরেকটি বার্মিজ। প্রতিবেশীদের সঙ্গে তঁারা বর্মি ভাষায়ই কথা বলেন। প্রতিবেশীরাও তাঁদের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলে। কিন্তু মিয়ানমারের কোথাও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দিলে কিংবা অঘটন ঘটলেই তার রেশ এসে তাঁদের ওপরও পড়ে। তখন আতঙ্কে থাকতে হয়। সংখ্যালঘুর এই যাতনা কোথায় নেই?
সরকার ‘হোয়াইট কার্ড’ নামে রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী পরিচয়পত্র দিয়েছে। যাঁরা অস্থায়ী কার্ড নেননি, তাঁদের ক্যাম্পেই প্রায় বন্দিজীবন কাটাতে হয়। সবচেয়ে অমানবিক হলো বিয়ে করতে বা সন্তান নিতেও রোহিঙ্গাদের সরকারের অনুমতি নিতে হয়। তাঁরা দুটির বেশি সন্তান নিতে পারেন না। কিন্তু মিয়ানমারের অন্য কোনো জনগোষ্ঠীর ওপর এ নিষেধাজ্ঞা নেই।
মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মিজরা মনে করে, রাখাইন মুসলমানরা বহিরাগত। অথচ ইতিহাস তাদের এই দাবি সমর্থন করে না। উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, অষ্টম ও নবম শতকে যখন আরবরা এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আসে, তখনই পশ্চিম মিয়ানমারে মুসলমানরা বসতি শুরু করে। রাখাইন প্রদেশের ৪০ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ৩০ লাখ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, যারা রাখাইন নামে পরিচিত। বাকি ১০ লাখ মুসলমান ধর্মাবলম্বী এবং বেশির ভাগই বাংলাভাষী। অারও নির্দিষ্ট করে বললে, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে।
রোহিঙ্গারা এখন নিজ দেশে কেবল পরবাসী নয়, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রান্তিক ও নির্যাতিত জনগোষ্ঠীগুলোর একটি। অথচ ঐতিহাসিকভাবে তারা শুধু মিয়ানমারের অবিচ্ছেদ্য অংশই নয়, দেশটির স্বাধীনতাসংগ্রামেও অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। ১৯৪৭ সালে অং সানের সঙ্গে যে কজন স্বাধীনতাসংগ্রামী নিহত হন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন রোহিঙ্গা মুসলমান।
১৯৮৮ সালে অং সান সু চিকে রাজনীতিতে আনার ক্ষেত্রেও রোহিঙ্গা মুসলিম লেখক ও রাজনীতিক মং থু কার (মুসলিম নাম নূর মোহাম্মদ) ভূমিকা ছিল। তিনি পরে এনএলডির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মিজ শাসকেরা এসব মনে রাখেননি। তাঁরা জাতিবিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মিয়ানমারের বহুজাতিক ও গণতান্ত্রিক চরিত্র। মিয়ানমারে ১৩৫টি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী আছে, কিন্তু তাদের মধ্যে রোহিঙ্গা নেই।
রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাটি দীর্ঘদিনের। এর সমাধানে যে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করার প্রয়োজন ছিল, বাংলাদেশ তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। মাঝেমধ্যে পশ্চিমা নেতারা তাঁদের বক্তৃতা–বিবৃতিতে বুড়ি ছোঁয়ার মতো রোহিঙ্গাদের বিষয়টি ছুঁয়ে যান। কোনো কাজ হয় না।
এখন প্রশ্ন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না? আমরা কি পূর্বদিকের দরজা বন্ধ করে রাখব? ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্তবিরোধ আছে। বিরোধ আছে তিব্বত নিয়েও। তাই বলে তো তারা একে অপরের দরজা বন্ধ করে রাখেনি। বিরোধ মেনে নিয়েই ভারত–চীন ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াচ্ছে। বিনিয়োগ করছে।
গত বছরের মার্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বিমসটেকের শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে মিয়ানমারে গিয়েছিলেন, তখন তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট থেইন সিয়েনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জবাবে থিয়েন সিয়েন শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যার সমাধানের কথা বলেছিলেন। তবে আগের ও পরের কিছু ঘটনা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে বাধা হয়ে আছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন। ২০১২ সালে বাংলাদেশে রামু ট্র্যাজেডির পর মিয়ানমারেও কয়েক দফা মুসলমানবিরোধী দাঙ্গা হয়। দ্বিতীয়ত, দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক পর্যায়ে যেসব সিদ্ধান্ত হয়, তার বাস্তবায়নে আমলাতন্ত্র গড়িমসি করে থাকে।
ইয়াঙ্গুনে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা দুই দেশের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর ওপর জোর দিলেন। বর্তমানে যেটুকু যোগাযোগ আছে, সরকারিভাবে। দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক লেনদেন হওয়া প্রয়োজন বলেও তাঁরা জানান। এখানকার লেখক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, শিল্পীরা যদি ওখানে যান; আর ওখানকার লেখক, শিক্ষাবিদ, শিল্পীরা যদি এখানে আসেন, পরস্পরকে জানতে পারবেন। ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটবে।
গত ডিসেম্বর মাসে মিয়ানমারের পরিবেশবিদদের একটি দল বাংলাদেশে এসেছিল। দলটির সদস্যরা কুষ্টিয়া, পাবনা, রংপুর ও বগুড়ার মহাস্থানগড় ঘুরে গেছেন। এই সফরে এসে তাঁরা প্রথম বাংলাদেশের বৌদ্ধবিহারগুলো সম্পর্কে জানতে পারলেন। গত মাসে ঢাকা থেকেও শিক্ষাবিদ ও নাগরিক সমাজের একটি প্রতিনিধিদল ইয়াঙ্গুন গিয়েছিল দুই দেশের বিদ্বৎ সমাজের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াতে।
এ কথা ঠিক যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ব্যবসা–বাণিজ্য বাড়ছে। যোগাযোগ বাড়ানোরও চেষ্টা চলছে। ইয়াঙ্গুনে বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে শুনলাম, রাষ্ট্রদূত সফিউর রহমান সিটু গিয়েছেন ত্রিপক্ষীয় সড়ক যোগাযোগের একটি বৈঠকে যোগ দিতে। ভারত হয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সরাসরি সড়কযোগাযোগ স্থাপিত হবে, যার সঙ্গে চীনের প্রস্তাবিত সিল্ক রোড যুক্ত হবে।
ইয়াঙ্গুনের নাগরিক সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁদের ধারণা ইতিবাচক। বললেন, বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ, অন্তত পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো মৌলবাদী–জঙ্গিবাদী দেশ নয়।
কিন্তু মিয়ানমার সম্পর্কে আমরাই বা কতটা জানি?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net
No comments