জুবায়ের হত্যার রায়- ক্যাম্পাসকে সন্ত্রাসমুক্ত করতেই হবে
জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সম্মান শ্রেণীর ছাত্র জুবায়ের আহমেদের
হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায়ে পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড এবং ছয়জনকে যাবজ্জীবন
কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪-এর বিচারক। ঠিক তিন বছর
আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মান শ্রেণীর এই শিক্ষার্থীকে কুপিয়ে
হত্যা করেছিল ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। সংগঠনের
অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার হন তিনি। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন
ক্যাম্পাসের ছাত্র ও শিক্ষকরা। গোটা দেশ স্তম্ভিত হয়ে পড়ে_ এ কেমন ছাত্র
সংগঠন? হতভাগ্য এ শিক্ষার্থীর পরিবারের সদস্যরা আদালতের রায় প্রকাশের পর
আরেকবার বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচজনই পলাতক।
তাদের খুঁজে বের করে দণ্ড কার্যকর করা হবে_ এই সামান্য সান্ত্বনাটুকু তাদের
মিলবে কি? আইনের ফাঁকফোকর গলে ঘাতকরা যেন মুক্ত জীবনে ফিরতে না পারে,
সেজন্য রাষ্ট্রপক্ষ সাধ্যমতো সবকিছু করবে_ এমন প্রত্যাশা তাদের।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ
নেতাকর্মীরা খুন করেছে তাদের দলীয় নেতাকর্মীদের, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের এক
গ্রুপ খুন করেছে দলের অপর পক্ষের সমর্থককে। কিন্তু কোনো ঘটনারই বিচার এ
পর্যন্ত হয়নি। জুবায়ের আহমেদের হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হতে তিন বছর সময়
লেগে গেল। আমরা আশা করব, এর ধারাবাহিকতায় অন্য হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার
হবে। এ মামলার বিচারক তার রায়ে কিছু মূল্যবান পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেছেন, এ হত্যাকাণ্ডে আদর্শহীন রাজনীতির চেহারাই ফুটে উঠেছে। তদন্ত
কর্মকর্তা রাজনীতির চরম বিশৃঙ্খলা, নীতিহীন ও আদর্শচ্যুত চেহারা উন্মোচন
করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসব প্রতিরোধ করতে পারেনি, কারণ সেখানে
রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত রাজনৈতিক প্রভাব। আমরা আশা করব, বিশ্ববিদ্যালয়
কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশের ছাত্র সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও
পরোক্ষভাবে যুক্ত সবাই এ পর্যবেক্ষণ গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্লেষণ করে নিজেদের
করণীয় নির্ধারণ করবেন। এ নিয়ে দ্বিমত নেই যে, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন
সুমহান ঐতিহ্যের অংশ। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তারা বুকের রক্ত ঢেলে
দিয়েছে, জেল-জুলুম সহ্য করেছে। এখন যে প্রকৃত অর্থেই সবার জন্য শিক্ষার
লক্ষ্য অর্জিত হতে চলেছে তার প্রেক্ষাপট সৃষ্টিতে ষাটের দশকে সক্রিয় ছিল
বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। স্বাধীনতার জন্য দেশবাসীকে এই ছাত্রছাত্রীরাই
অনুপ্রাণিত করেছে এবং তারা দলে দলে অংশ নিয়েছে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে। এখন
এই ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে যারা রয়েছে তারা কেন সংকীর্ণ স্বার্থের কাছে,
লোভ-লালসার কাছে নিজেদের বিকিয়ে দেবে, লিপ্ত হবে হানাহানি ও প্রাণঘাতী
সংঘর্ষে? বিচারক তার পর্যবেক্ষণে যথার্থই বলেছেন, ছাত্র সংগঠনগুলোর অনৈতিক
কর্মকাণ্ডের পরিণতি হচ্ছে জুবায়ের হত্যাকাণ্ড। আমরা ক্যাম্পাসে পেশিশক্তির
জোরে হিংসা-অশান্তি দেখতে চাই না। এখন একটিই আকুতি_ উগ্রতা-বর্বরতা নয়,
প্রতিটি ক্যাম্পাসে বিরাজ করুক শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ। জুবায়ের হত্যাকাণ্ডে
যুক্তরা ছাত্রলীগের সক্রিয় নেতাকর্মী। এ সংগঠনের বিভিন্নম্ন শাখার একটি
অংশের বিরুদ্ধে অনৈতিক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার খবর নিয়মিত
সংবাদপত্রে আসে। দাপট-দৌরাত্ম্যে তারা এতই বেপরোয়া যে সাংগঠনিক শাস্তিকে
বিন্দুমাত্র আমলে নেয় না। জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের রায় তাদের চৈতন্যোদয় ঘটাতে
পারবে কি? আদালতের পর্যবেক্ষণে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের
কাছে যুগোপযোগী আচরণবিধি তৈরির প্রত্যাশা করা হয়েছে। রায় প্রকাশের পর
জুবায়ের আহমেদের মা হাসিনা আহমেদ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়
যেন শুধু পড়াশোনার জায়গা হয়। মেধার প্রতিযোগিতা হয়। সন্ত্রাস বন্ধ হয়। এ
প্রত্যাশা পূরণে সরকার এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সম্ভাব্য
সবকিছু করতেই হবে।
No comments