এটাও কি কম কথা! by আবু এন এম ওয়াহিদ
পার্কিংলটে
গাড়ি রেখে বিল্ডিংয়ের এলেভেটারে চড়ে চারতলায় উঠে একটি লম্বা হলওয়ে ধরে
হেঁটে গিয়ে আমার অফিসে ঢুকতে হয়। অফিস থেকে যখন কাসে যাই, সেই একই পথ
মাড়িয়ে নিচতলায় নেমে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করি। প্রতিদিন এই হলওয়ে দিয়ে আমাকে
অন্তত চার-পাঁচবার যাওয়া আসা করতে হয়। প্রায় দুই যুগ হতে চলল, এ আমার
নিত্যদিনের চলার পথ, বড় পরিচিত পথ, বড় প্রিয় পথ। হলওয়ের ডানে বামে ছোট বড়
অনেক অফিস রুম আছে। বাঁ দিকে কিছু অংশে একটি ‘ওপেন টু বিলো’ লবিও। লবির এক
পাশে আছে বড় অডিটরিয়াম, যেখানে সব সময় অনুষ্ঠানাদি লেগেই থাকে। লবিতে হয়
অংশগ্রহণকারী ও অতিথিদের আপ্যায়ন ও খাওয়াদাওয়া। হলওয়ে দিয়ে যাওয়া আসার সময়
প্রায়ই শোনা যায় মানুষজনের হৈচৈ আর বাসনকোসনের টুংটাং আওয়াজ। অনুষ্ঠান না
হলেও ছাত্রছাত্রীদের আনাগোনায় লবি এবং হলওয়ে সব সময় গমগম করে। জীবনের ও
তারুণ্যের উচ্ছ্বাসই এ কোলাহলের নির্যাস। ছুটির দিনে অফিসে এলে কাজ হয় বটে,
কিন্তু জীবনের সজীবতা ও প্রাণচাঞ্চল্যের ছোঁয়া পাওয়া যায় না।
একদিন দোতলা কী তিনতলায় কাস শেষ করে ওই হলওয়ে ধরে অফিসে ফিরছি। ‘ওপেন টু বিলো’ লবি পার হওয়ার পর ডান দিকে নজর পড়ল এক অফিস কক্ষে। কাচের দরজা দিয়ে দেখতে পেলাম দেয়ালে আনুমানিক আট ইঞ্চি বাই তিরিশ ইঞ্চি একটি ছবি হরাইজোন্টালি ঝুলছে। এটি আগে কখনো চোখে পড়েনি। কে, কখন, কেন ছবিটি টাঙিয়েছে তারও হদিস পাইনি। ছবিটি সে দিন আমাকে কেন আকর্ষণ করল তা-ও জানি না। কী মনে করে কাছে গিয়ে ওটা একনজর দেখার জন্য দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। ঠিক সামনে গিয়ে বুঝতে পারলাম, আমি একটি বিশেষ ছবির বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছি। অতি সাধারণ ফ্রেমে বাঁধানো একটি সাদা-কালো ছবি। ধারণ করে আছে পাঁচজন বিশ্ববিখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্বের অবয়ব। প্রথমে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, তারপর বারাক ওবামা, তৃতীয়জন ম্যালকম এক্স, তারপর নেলসন ম্যান্ডেলা। এ পর্যন্ত আমার কোনো অসুবিধা হয়নি। ধাক্কা খেলাম শেষেরজনে এসে। তার চেহারাটা কোনোভাবেই চিনতে পারলাম না। মনে মনে ভাবলাম, ‘এই চারজনের পাশে যে তার নিজের জায়গা করে নিয়েছে, সে কোনো সাধারণ ব্যক্তি হতে পারে না! আমারই কসুর, আমি তাকে জানি না, তাকে চিনি না।’
ছবিটির দিকে আমি বেশ কিছুক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছি। এমন সময় ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো আমারই এক পুরনো ছাত্র। ছেলেটি বলল, ‘হোয়াট আর ইউ লুকিং অ্যাট ড. ওয়াহিদ?’ আমি বললাম, ‘ক্যান ইউ টেল মি, হু দিস ম্যান ইজ।’ সে অবাক হয়ে বলল, ‘ও! ইউ ডোন্ট নো হিম! হি ইজ বব মার্লি।’ এখানেই শেষ নয়, সে আমাকে বব মার্লির একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয়ও দিলো। আমি আমার অফিসে ফিরে এলাম। আসতে আসতে ভাবলাম, ‘আমি কত বড় বেকুব, এত বড় একজন গুণী মানুষের নাম কেনো দিন শুনিনি।’ অফিসে বসে গুগুল সার্চ দিয়ে বব মার্লির জীবনী পড়লাম এবং অনেক অজানা বিষয় জানলাম।
কয়েক দিন পর এ নিয়ে একদিন আমার ইংল্যান্ড প্রবাসী বন্ধু মাহবুবের সাথে অনেকক্ষণ কথাও হলো। দু’জন দু’জনের কাছ থেকে বব মার্লি সম্বন্ধে আরো শিখলাম, আরো জানলাম। মাহবুবের সাথে আলাপের সময় দেয়ালে ঝুলানো ছবি এবং বব মার্লির অবস্থান নিয়ে আরেকটি প্রাসঙ্গিক ভাবনা হঠাৎ আমার মনে উঁকি মারে এবং এ নিয়ে তার সাথে আমার বেশ কথাও হয়। হঠাৎ ভাবনাটা কী এবং কী আলাপ হয়, সে প্রসঙ্গে একটু পরেই আবার ফিরে আসব। ওই হঠাৎ ভাবনাটি মাঝে মধ্যে আমাকে নাড়া দেয়। আমি ভাবতে থাকি, ‘এ নিয়ে একটা কিছু লেখা দরকার।’ লিখব লিখব করেও আলসেমিতে আর লেখাটা হয়ে ওঠেনি। না লেখার পেছনে অবশ্য আরেকটি কারণও ছিল। ঘটনার কিছু দিন আগেই ভাইরাসজনিত কারণে আমার কম্পিউটার ক্র্যাশ করে। এর সাথে স্বাভাবিকভাবেই আমার বিজয় সফটওয়্যারও হারিয়ে যায়। এতে আমার বাংলা লেখালেখি বন্ধ থাকে বহু দিন।
সম্প্রতি আমার এক তরুণ বন্ধু ঢাকার ইবনে আয়াজ রানার বদৌলতে আমি আমার কম্পিউটারে বিজয় সফটওয়্যার নতুন করে ইনস্টল করি। রানার সাথে এ দৈব পরিচয় না হলে আমার বাংলা লেখালেখি এখনো বন্ধই থাকত। তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই! এর মধ্যে আরেকটি ঘটনা ঘটে, যা কিনা আমাকে এ লেখার জন্য চূড়ান্তভাবে উদ্বুদ্ধ করে। সকালে অফিসে যাওয়ার সময় গাড়ি চালাতে চালাতে আমি বিবিসি রেডিও শুনি। ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত এই এক ঘণ্টা খবর এবং আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহের চুলচেরা বিশ্লেষণ হয় বিবিসিতে। এমনি একদিন বিবিসি রেডিওতে একটি সংবাদভাষ্য শুনতে পেলাম। বিষয়বস্তু, ‘সৌদি আরবে বব মার্লির গানের রেকর্ড বিক্রি হচ্ছে’ এ খবরকে কেন্দ্র করে। সে দিন নতুন করে বুঝলাম মার্লির জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তার দেশের সীমানা পেরিয়ে অনেক দূর বিস্তৃত। এরপর এ নিয়ে লেখার তাগিদটা আরো জোরেশোরে অনুভব করলাম।
আজকের নিবন্ধের মূল বিষয়ে আসার আগে আমার মতো বব মার্লি সম্পর্কে যাদের কোনো ধারণা নেই, তাদের জন্য ওই ক্ষণজন্মা পুরুষ, তার জীবন ও কর্মপরিসর নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত বয়ান তুলে ধরছি। বব মার্লির পুরো নাম রবার্ট নেস্টা মার্লি। কৃষ্ণাঙ্গ পিতা-মাতার ঘরে তার জন্ম ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৫ সালে জ্যামাইকার (ওয়েস্ট ইন্ডিজ) সেইন্ট অ্যানের নাইন মাইল নামক স্থানে। তার বাবা নোরভাল সিনকেয়ার মার্লি। বব মার্লির বয়স যখন মাত্র দশ, তখন তার বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। বব মার্লি প্রাইমারি ও জুনিয়র হাইস্কুল পর্যন্ত পড়েন নাইন মাইলেই। তারপর ১২ বছর বয়সে মার সাথে চলে যান কিংস্টনের ট্রেঞ্চ টাউনে। স্কুলে থাকতে মার্লি তার বন্ধু নেভিল লিভিংস্টোনের (পরে তিনি বানি উয়েইলার নামে পরিচিতি পান) সাথে গান গাইতে শুরু করেন। মার্লির সাথে তার বন্ধু ওয়েইলারও ট্রেঞ্চ টাউনে চলে আসেন। সেখানে তারা দুই বন্ধু একই বাড়িতে থাকতেন। কী কারণে এবং কী ব্যবস্থায় দুই বন্ধু একই বাড়িতে থাকতেন, মার্লির জীবনী থেকে সে রহস্য আমি উন্মোচন করতে পরিনি। এ সময় মার্লি এবং উয়েইলার আরো কয়েকজন সাথী নিয়ে একটি গানের গ্রুপ তৈরি করেন। এ গ্রুপের নাম তারা কয়েকবার পরিবর্তন করেন। যে নামে এটা থিতু হয় এবং বিশ্ব পরিচিতি পায়, তা হলো ‘দ্য উয়েইলারস’। এভাবে শুরু হয় মার্লির গান লেখা, গান গাওয়া ও গান নিয়ে গভীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পালা। প্রথমে মার্লি শুধু গান লিখতেন এবং গাইতেন। পরে তিনি গিটার শিখেছিলেন এবং ভালোই শিখেছিলেন। ১৯৬২ সালে প্রথমবারের মতো ‘উয়েইলারসের’ চারটি গানের রেকর্ড বের হয়। সবই ভীষণভাবে হিট করে। এর পর শুরু হয় তাদের বিরামহীন সামনে পথ চলা। শুরু হয় ম্যাজিকের মতো একটার পর একটা সফলতা। এর মাঝে তাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
কোনো একসময় মার্লির মা চলে আসেন আমেরিকার উলমিংটন ডেলওয়ারে। মার্লি ১৯৬৬ সালে রিটা অ্যান্ডারসনকে বিয়ে করে অল্প কিছু দিনের জন্য মায়ের কাছে উলমিংটন ডেলওয়ারে এসে থাকতে শুরু করেন। ওই সময় তিনি ডুপন্ট ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে ক্রাইসলার করপোরেশনে অল্প দিন চাকরিও করেন। হলেইবা কী, গানপাগল মার্লিকে কি ক্রাইসলার ধরে রাখতে পারে! গানের টানে তিনি ঠিকই চাকরি ছেড়ে আবার জ্যামাইকা ফিরে যান। ক্যাথলিক খ্রিষ্টান হিসেবে বড় হলেও ওই সময় মার্লি রাস্টাফারিয়ান খ্রিষ্টানে ধর্মান্তরিত হন। এরপর তার নতুন ধর্মীয় অনুশাসন মোতাবেক তিনি চুল কাটা বন্ধ করে দেন।
ষাট দশকের শেষ এবং পুরো সত্তর দশককে বলা যায় মার্লির জীবনের স্বর্ণযুগ। এ সময় তিনি স্বল্প সময়ের জন্য ইংল্যান্ডের লন্ডনবাসী হয়ে যান। লন্ডনকে বেস করে তিনি গোটা ইউরোপে গান গেয়ে বেড়ান। লন্ডনে থাকলেও আমেরিকার সাথে ছিল তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। তিনি জিমি হ্যান্ডরিক্স, লেসলি কঙ্গ, জিমি নরম্যান, রোজার স্টেফেনের মতো গুণী সঙ্গীত প্রযোজক এবং সঙ্গীত বিশারদদের সাথে নিবিড় যোগসূত্র গড়ে তোলেন এবং রেকর্ড করেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম। সত্তর এবং আশির দশকের গোড়ার দিকে তিনি ইউরোপের বিভিন্ন বড় শহরে অত্যন্ত সফলতার সাথে একের পর এক লাইভ পারফরম্যান্স করতে থাকেন। ইটালির মিলানে তার এক লাইভ শোতে এক লাখেরও বেশি দর্শকশ্রোতা উপস্থিত ছিল। এটা ছিল তার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সফল পারফরম্যান্স।
১৯৭৭ সালে বব মার্লি মেলোনোমা জাতীয় স্কিন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং ১৯৮১ সালের ১১ মে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তিনি ফোরিডার মায়ামিতে মারা যান। বব মার্লি একজন সমাজসচেতন গীতিকার ও সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। তার জীবনে তিনি সঙ্গীতের মাধ্যমে জ্যামাইকায় বসবাসকারী অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কথা তুলে ধরার চেষ্টা করে গেছেন। তিনি তাদের উন্নয়নের জন্যও অনেক কিছু করেছেন। সঙ্গীত এবং সমাজসেবা ছাড়াও তিনি রাস্টাফারিয়ান খ্রিষ্টান আন্দোলনের সাথেও যুক্ত ছিলেন।
আমার আজকের নিবন্ধের মূল উদ্দেশ্য কিন্তু বব মার্লি, তার জীবনজীবিকা কিংবা জীবনদর্শনও নয়। ফিরে আসি আসল কথায়। শুরু করেছিলাম যেখান থেকে, সেই ছবির প্রসঙ্গে। দেয়ালের ছবিটি দেখে আমার মনে তাৎক্ষণিক যে প্রতিক্রিয়াটি হয়েছিল তা হলো, বব মার্লির মতো একজন মানুষকে আমি কেন জানলাম না। পরবর্তীকালে আমার মনে এসে বাসা বাঁধলো আরো একটি প্রশ্ন। তারপরে দেখা দিলো সেই হঠাৎ অনুভূতি, যার কথা আগে আপনাদের বলেছি। প্রশ্নটি হলো, ছবির ফ্রেমে যে পাঁচ ব্যক্তিত্ব ধরা পড়েছেন, তার একজন আফ্রিকান, একজন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান। বাকি তিনজনই জন্মগতভাবে আমেরিকার নাগরিক। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের প্রায় সবারই পূর্বপুরুষরা এসেছেন আফ্রিকা থেকে। আফ্রিকাই কৃষ্ণাঙ্গদের আদি জন্মভূমি। অধিকাংশ কালো মানুষ হাজার হাজার বছর ধরেই বাস করছেন এই প্রাচীন মহাদেশেই। আমার প্রশ্ন, তার পরেও আফ্রিকা কেন আরেকজন নেলসন ম্যান্ডেলা বা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র অথবা বারাক ওবামা, কিংবা ম্যালকম এক্স অথবা বব মার্লির জন্ম দিতে পারল না? এ প্রশ্নের কী উত্তর হতে পারে তা আমার জানা নেই। পাঠক ভাবতে থাকুন।
এবার আসি আমার অনুভূতি বা শেষ প্রসঙ্গে। এটা শুধু আমার অনুভূতিই নয়, আমার মতো আরো অনেকেই এমন মতামত পোষণ করে থাকেন। এটা বলা যায়, আমার একটি ব্যক্তিগত অপিনিয়ন বা জাজমেন্ট। আমার এই জাজমেন্ট পাঠকদের পছন্দ হতে পারে আবার না-ও হতে পারে। তাই আগেই আপনাদের সবার কাছে মাফ চেয়ে নিচ্ছি। প্রসঙ্গটা বব মার্লিকে নিয়েই। বব মার্লিকে কোনোক্রমেই ছোট না করেই যে কথাটি আমি বলতে চাই, তা হলো, আমার বিচারে উল্লিখিত ছবির মিলনমেলায় বব মার্লি একেবারেই বেমানান। আমার মতে, তার পরিবর্তে ওইখানে স্থান পাওয়ার কথা ছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বক্সার মোহাম্মদ আলীর। এটা শুধু আমার একার মতামতই নয়। এর সাথে আমার বন্ধুবান্ধবের অনেকেই সহমত ব্যক্ত করেছেন। জানি না, আপনাদের মতামত কী। আর তাই যদি হতো তাহলে আমার একটি অনুভূতি আছে। অনুভূতিটি হলো, বারাক ওবামার ধমনীতে মুসলমানের যেটুকু রক্ত বহমান, তা বিবেচনায় না নিলেও ম্যালকম এক্সের সাথে মোহাম্মদ আলীকে যোগ করলে দেখা যায় আধুনিক বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পাঁচজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্বের দু’জনাই মুসলমান। এটা কি কম কথা!
লেখক : অধ্যাপক-টেনেসি স্টেইট ইউনিভার্সিটি; এডিটর, জার্নাল অফ ডেভেলপিং এরিয়াজ;
Email: wahid2569@gmail.com
একদিন দোতলা কী তিনতলায় কাস শেষ করে ওই হলওয়ে ধরে অফিসে ফিরছি। ‘ওপেন টু বিলো’ লবি পার হওয়ার পর ডান দিকে নজর পড়ল এক অফিস কক্ষে। কাচের দরজা দিয়ে দেখতে পেলাম দেয়ালে আনুমানিক আট ইঞ্চি বাই তিরিশ ইঞ্চি একটি ছবি হরাইজোন্টালি ঝুলছে। এটি আগে কখনো চোখে পড়েনি। কে, কখন, কেন ছবিটি টাঙিয়েছে তারও হদিস পাইনি। ছবিটি সে দিন আমাকে কেন আকর্ষণ করল তা-ও জানি না। কী মনে করে কাছে গিয়ে ওটা একনজর দেখার জন্য দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। ঠিক সামনে গিয়ে বুঝতে পারলাম, আমি একটি বিশেষ ছবির বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছি। অতি সাধারণ ফ্রেমে বাঁধানো একটি সাদা-কালো ছবি। ধারণ করে আছে পাঁচজন বিশ্ববিখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্বের অবয়ব। প্রথমে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, তারপর বারাক ওবামা, তৃতীয়জন ম্যালকম এক্স, তারপর নেলসন ম্যান্ডেলা। এ পর্যন্ত আমার কোনো অসুবিধা হয়নি। ধাক্কা খেলাম শেষেরজনে এসে। তার চেহারাটা কোনোভাবেই চিনতে পারলাম না। মনে মনে ভাবলাম, ‘এই চারজনের পাশে যে তার নিজের জায়গা করে নিয়েছে, সে কোনো সাধারণ ব্যক্তি হতে পারে না! আমারই কসুর, আমি তাকে জানি না, তাকে চিনি না।’
ছবিটির দিকে আমি বেশ কিছুক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছি। এমন সময় ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো আমারই এক পুরনো ছাত্র। ছেলেটি বলল, ‘হোয়াট আর ইউ লুকিং অ্যাট ড. ওয়াহিদ?’ আমি বললাম, ‘ক্যান ইউ টেল মি, হু দিস ম্যান ইজ।’ সে অবাক হয়ে বলল, ‘ও! ইউ ডোন্ট নো হিম! হি ইজ বব মার্লি।’ এখানেই শেষ নয়, সে আমাকে বব মার্লির একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয়ও দিলো। আমি আমার অফিসে ফিরে এলাম। আসতে আসতে ভাবলাম, ‘আমি কত বড় বেকুব, এত বড় একজন গুণী মানুষের নাম কেনো দিন শুনিনি।’ অফিসে বসে গুগুল সার্চ দিয়ে বব মার্লির জীবনী পড়লাম এবং অনেক অজানা বিষয় জানলাম।
কয়েক দিন পর এ নিয়ে একদিন আমার ইংল্যান্ড প্রবাসী বন্ধু মাহবুবের সাথে অনেকক্ষণ কথাও হলো। দু’জন দু’জনের কাছ থেকে বব মার্লি সম্বন্ধে আরো শিখলাম, আরো জানলাম। মাহবুবের সাথে আলাপের সময় দেয়ালে ঝুলানো ছবি এবং বব মার্লির অবস্থান নিয়ে আরেকটি প্রাসঙ্গিক ভাবনা হঠাৎ আমার মনে উঁকি মারে এবং এ নিয়ে তার সাথে আমার বেশ কথাও হয়। হঠাৎ ভাবনাটা কী এবং কী আলাপ হয়, সে প্রসঙ্গে একটু পরেই আবার ফিরে আসব। ওই হঠাৎ ভাবনাটি মাঝে মধ্যে আমাকে নাড়া দেয়। আমি ভাবতে থাকি, ‘এ নিয়ে একটা কিছু লেখা দরকার।’ লিখব লিখব করেও আলসেমিতে আর লেখাটা হয়ে ওঠেনি। না লেখার পেছনে অবশ্য আরেকটি কারণও ছিল। ঘটনার কিছু দিন আগেই ভাইরাসজনিত কারণে আমার কম্পিউটার ক্র্যাশ করে। এর সাথে স্বাভাবিকভাবেই আমার বিজয় সফটওয়্যারও হারিয়ে যায়। এতে আমার বাংলা লেখালেখি বন্ধ থাকে বহু দিন।
সম্প্রতি আমার এক তরুণ বন্ধু ঢাকার ইবনে আয়াজ রানার বদৌলতে আমি আমার কম্পিউটারে বিজয় সফটওয়্যার নতুন করে ইনস্টল করি। রানার সাথে এ দৈব পরিচয় না হলে আমার বাংলা লেখালেখি এখনো বন্ধই থাকত। তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই! এর মধ্যে আরেকটি ঘটনা ঘটে, যা কিনা আমাকে এ লেখার জন্য চূড়ান্তভাবে উদ্বুদ্ধ করে। সকালে অফিসে যাওয়ার সময় গাড়ি চালাতে চালাতে আমি বিবিসি রেডিও শুনি। ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত এই এক ঘণ্টা খবর এবং আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহের চুলচেরা বিশ্লেষণ হয় বিবিসিতে। এমনি একদিন বিবিসি রেডিওতে একটি সংবাদভাষ্য শুনতে পেলাম। বিষয়বস্তু, ‘সৌদি আরবে বব মার্লির গানের রেকর্ড বিক্রি হচ্ছে’ এ খবরকে কেন্দ্র করে। সে দিন নতুন করে বুঝলাম মার্লির জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তার দেশের সীমানা পেরিয়ে অনেক দূর বিস্তৃত। এরপর এ নিয়ে লেখার তাগিদটা আরো জোরেশোরে অনুভব করলাম।
আজকের নিবন্ধের মূল বিষয়ে আসার আগে আমার মতো বব মার্লি সম্পর্কে যাদের কোনো ধারণা নেই, তাদের জন্য ওই ক্ষণজন্মা পুরুষ, তার জীবন ও কর্মপরিসর নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত বয়ান তুলে ধরছি। বব মার্লির পুরো নাম রবার্ট নেস্টা মার্লি। কৃষ্ণাঙ্গ পিতা-মাতার ঘরে তার জন্ম ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৫ সালে জ্যামাইকার (ওয়েস্ট ইন্ডিজ) সেইন্ট অ্যানের নাইন মাইল নামক স্থানে। তার বাবা নোরভাল সিনকেয়ার মার্লি। বব মার্লির বয়স যখন মাত্র দশ, তখন তার বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। বব মার্লি প্রাইমারি ও জুনিয়র হাইস্কুল পর্যন্ত পড়েন নাইন মাইলেই। তারপর ১২ বছর বয়সে মার সাথে চলে যান কিংস্টনের ট্রেঞ্চ টাউনে। স্কুলে থাকতে মার্লি তার বন্ধু নেভিল লিভিংস্টোনের (পরে তিনি বানি উয়েইলার নামে পরিচিতি পান) সাথে গান গাইতে শুরু করেন। মার্লির সাথে তার বন্ধু ওয়েইলারও ট্রেঞ্চ টাউনে চলে আসেন। সেখানে তারা দুই বন্ধু একই বাড়িতে থাকতেন। কী কারণে এবং কী ব্যবস্থায় দুই বন্ধু একই বাড়িতে থাকতেন, মার্লির জীবনী থেকে সে রহস্য আমি উন্মোচন করতে পরিনি। এ সময় মার্লি এবং উয়েইলার আরো কয়েকজন সাথী নিয়ে একটি গানের গ্রুপ তৈরি করেন। এ গ্রুপের নাম তারা কয়েকবার পরিবর্তন করেন। যে নামে এটা থিতু হয় এবং বিশ্ব পরিচিতি পায়, তা হলো ‘দ্য উয়েইলারস’। এভাবে শুরু হয় মার্লির গান লেখা, গান গাওয়া ও গান নিয়ে গভীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পালা। প্রথমে মার্লি শুধু গান লিখতেন এবং গাইতেন। পরে তিনি গিটার শিখেছিলেন এবং ভালোই শিখেছিলেন। ১৯৬২ সালে প্রথমবারের মতো ‘উয়েইলারসের’ চারটি গানের রেকর্ড বের হয়। সবই ভীষণভাবে হিট করে। এর পর শুরু হয় তাদের বিরামহীন সামনে পথ চলা। শুরু হয় ম্যাজিকের মতো একটার পর একটা সফলতা। এর মাঝে তাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
কোনো একসময় মার্লির মা চলে আসেন আমেরিকার উলমিংটন ডেলওয়ারে। মার্লি ১৯৬৬ সালে রিটা অ্যান্ডারসনকে বিয়ে করে অল্প কিছু দিনের জন্য মায়ের কাছে উলমিংটন ডেলওয়ারে এসে থাকতে শুরু করেন। ওই সময় তিনি ডুপন্ট ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে ক্রাইসলার করপোরেশনে অল্প দিন চাকরিও করেন। হলেইবা কী, গানপাগল মার্লিকে কি ক্রাইসলার ধরে রাখতে পারে! গানের টানে তিনি ঠিকই চাকরি ছেড়ে আবার জ্যামাইকা ফিরে যান। ক্যাথলিক খ্রিষ্টান হিসেবে বড় হলেও ওই সময় মার্লি রাস্টাফারিয়ান খ্রিষ্টানে ধর্মান্তরিত হন। এরপর তার নতুন ধর্মীয় অনুশাসন মোতাবেক তিনি চুল কাটা বন্ধ করে দেন।
ষাট দশকের শেষ এবং পুরো সত্তর দশককে বলা যায় মার্লির জীবনের স্বর্ণযুগ। এ সময় তিনি স্বল্প সময়ের জন্য ইংল্যান্ডের লন্ডনবাসী হয়ে যান। লন্ডনকে বেস করে তিনি গোটা ইউরোপে গান গেয়ে বেড়ান। লন্ডনে থাকলেও আমেরিকার সাথে ছিল তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। তিনি জিমি হ্যান্ডরিক্স, লেসলি কঙ্গ, জিমি নরম্যান, রোজার স্টেফেনের মতো গুণী সঙ্গীত প্রযোজক এবং সঙ্গীত বিশারদদের সাথে নিবিড় যোগসূত্র গড়ে তোলেন এবং রেকর্ড করেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম। সত্তর এবং আশির দশকের গোড়ার দিকে তিনি ইউরোপের বিভিন্ন বড় শহরে অত্যন্ত সফলতার সাথে একের পর এক লাইভ পারফরম্যান্স করতে থাকেন। ইটালির মিলানে তার এক লাইভ শোতে এক লাখেরও বেশি দর্শকশ্রোতা উপস্থিত ছিল। এটা ছিল তার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সফল পারফরম্যান্স।
১৯৭৭ সালে বব মার্লি মেলোনোমা জাতীয় স্কিন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং ১৯৮১ সালের ১১ মে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তিনি ফোরিডার মায়ামিতে মারা যান। বব মার্লি একজন সমাজসচেতন গীতিকার ও সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। তার জীবনে তিনি সঙ্গীতের মাধ্যমে জ্যামাইকায় বসবাসকারী অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কথা তুলে ধরার চেষ্টা করে গেছেন। তিনি তাদের উন্নয়নের জন্যও অনেক কিছু করেছেন। সঙ্গীত এবং সমাজসেবা ছাড়াও তিনি রাস্টাফারিয়ান খ্রিষ্টান আন্দোলনের সাথেও যুক্ত ছিলেন।
আমার আজকের নিবন্ধের মূল উদ্দেশ্য কিন্তু বব মার্লি, তার জীবনজীবিকা কিংবা জীবনদর্শনও নয়। ফিরে আসি আসল কথায়। শুরু করেছিলাম যেখান থেকে, সেই ছবির প্রসঙ্গে। দেয়ালের ছবিটি দেখে আমার মনে তাৎক্ষণিক যে প্রতিক্রিয়াটি হয়েছিল তা হলো, বব মার্লির মতো একজন মানুষকে আমি কেন জানলাম না। পরবর্তীকালে আমার মনে এসে বাসা বাঁধলো আরো একটি প্রশ্ন। তারপরে দেখা দিলো সেই হঠাৎ অনুভূতি, যার কথা আগে আপনাদের বলেছি। প্রশ্নটি হলো, ছবির ফ্রেমে যে পাঁচ ব্যক্তিত্ব ধরা পড়েছেন, তার একজন আফ্রিকান, একজন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান। বাকি তিনজনই জন্মগতভাবে আমেরিকার নাগরিক। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের প্রায় সবারই পূর্বপুরুষরা এসেছেন আফ্রিকা থেকে। আফ্রিকাই কৃষ্ণাঙ্গদের আদি জন্মভূমি। অধিকাংশ কালো মানুষ হাজার হাজার বছর ধরেই বাস করছেন এই প্রাচীন মহাদেশেই। আমার প্রশ্ন, তার পরেও আফ্রিকা কেন আরেকজন নেলসন ম্যান্ডেলা বা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র অথবা বারাক ওবামা, কিংবা ম্যালকম এক্স অথবা বব মার্লির জন্ম দিতে পারল না? এ প্রশ্নের কী উত্তর হতে পারে তা আমার জানা নেই। পাঠক ভাবতে থাকুন।
এবার আসি আমার অনুভূতি বা শেষ প্রসঙ্গে। এটা শুধু আমার অনুভূতিই নয়, আমার মতো আরো অনেকেই এমন মতামত পোষণ করে থাকেন। এটা বলা যায়, আমার একটি ব্যক্তিগত অপিনিয়ন বা জাজমেন্ট। আমার এই জাজমেন্ট পাঠকদের পছন্দ হতে পারে আবার না-ও হতে পারে। তাই আগেই আপনাদের সবার কাছে মাফ চেয়ে নিচ্ছি। প্রসঙ্গটা বব মার্লিকে নিয়েই। বব মার্লিকে কোনোক্রমেই ছোট না করেই যে কথাটি আমি বলতে চাই, তা হলো, আমার বিচারে উল্লিখিত ছবির মিলনমেলায় বব মার্লি একেবারেই বেমানান। আমার মতে, তার পরিবর্তে ওইখানে স্থান পাওয়ার কথা ছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বক্সার মোহাম্মদ আলীর। এটা শুধু আমার একার মতামতই নয়। এর সাথে আমার বন্ধুবান্ধবের অনেকেই সহমত ব্যক্ত করেছেন। জানি না, আপনাদের মতামত কী। আর তাই যদি হতো তাহলে আমার একটি অনুভূতি আছে। অনুভূতিটি হলো, বারাক ওবামার ধমনীতে মুসলমানের যেটুকু রক্ত বহমান, তা বিবেচনায় না নিলেও ম্যালকম এক্সের সাথে মোহাম্মদ আলীকে যোগ করলে দেখা যায় আধুনিক বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পাঁচজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্বের দু’জনাই মুসলমান। এটা কি কম কথা!
লেখক : অধ্যাপক-টেনেসি স্টেইট ইউনিভার্সিটি; এডিটর, জার্নাল অফ ডেভেলপিং এরিয়াজ;
Email: wahid2569@gmail.com
No comments