মেরিন একাডেমী স্থাপন এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ by আবুল কাসেম হায়দার

চিন্তা, চেতনা ও পরিকল্পনায় আমরা অনেক পিছিয়ে। বিশ্ব যখন অনেক দূর এগিয়ে যায়, তখনও আমরা পিছিয়ে থাকি। নতুন চিন্তার সৃষ্টি ও উপলব্ধি আমাদের হয়, তবে দেরিতে। বিগত কয়েক দশক ধরে বলা হচ্ছে, আমাদের অদক্ষ শ্রমিক বিদেশে গিয়ে খুবই স্বল্প আয় করে। দক্ষ শ্রমিক প্রেরণ করতে পারলে আয় বাড়বে দ্বিগুণ থেকে চার গুণ।


কিন্তু দক্ষ শ্রমিক সৃষ্টির পরিকল্পনা, ব্যয় আমাদের খুবই কম। বর্তমান বাজেটেও দক্ষ শ্রমিক সৃষ্টির বাজেট খুবই সামান্য রাখা হয়েছে। বিষয়টি সরকার অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া উচিত। বিদেশে দক্ষ ও প্রফেশনাল শ্রমিক বেশি বেশি প্রেরণ করতে পারলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। যেমন ধরা যাক দক্ষ সি ফেয়ার্স ও মেরিনার্স। এই দুই ধরনের দক্ষ কর্মকর্তার বিদেশে যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। তাদের বেতন-ভাতাও অনেক বেশি। এই খাতে জনশক্তি সৃষ্টি করার বিরাট সুযোগ রয়েছে। অনেক বছর ধরে মাত্র ৫০ শিক্ষার্থী ভর্তি করা হতো। বর্তমানে তা বৃদ্ধি করে ২০০ জনে করা হয়েছে। এটি সরকারের একটি চমৎকার ভাল উদ্যোগ। অনেক পরে হলেও সরকার চমৎকার একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, দেশে নতুন ছয়টি মেরিন একাডেমী স্থাপন করা হবে। অনেক আগেই এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল। তবু বিলম্বে হলেও একটি ভাল কাজ দেশের জন্য শুরু হচ্ছে। দেশে ও বিদেশের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ মেরিন কর্মকর্তা ও প্রকৌশলী সৃষ্টি করতে নতুন করে আরও ছয়টি মেরিন একাডেমী তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে চারটি ও পরবর্তী সময়ে বাকি দুটি স্থাপন করা হবে। এর ফলে আগামী ৫ বছরের মধ্যে বর্তমানের চেয়ে কমপক্ষে ৬ গুণ বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও এই একাডেমীগুলোর মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন করে বেকারত্ব দূর করা সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে। একই সঙ্গে, দেশের প্রতিটি বিভাগে মেরিন স্টাডি সহজলভ্য করা, দক্ষ সি ফেয়ারার্স ও মেরিনার্স রফতানিরও পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪১ কোটি ৫০ লাখ ৮২ হাজার টাকা। গত ৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়েছে। ২০১৫ সালের জুনের মধ্যে এগুলো স্থাপনের কাজ শেষ করবে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা বৃদ্ধির দিক বিবেচনা করে ছয়টি নতুন মেরিন একাডেমী (এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে তিনটি) স্থাপন করা হলে আরও ৬০০ ক্যাডেট প্রশিক্ষণের সুযোগ পাবে। এর ফলে আগামী ৫ বছরের মধ্যে বর্তমানের তুলনায় ৬ গুণ বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ২শর অধিক নদ-নদী সারাদেশে বিস্তৃত রয়েছে। এর মধ্যে দেশের দক্ষিণে অবস্থিত বঙ্গোপসাগর দিয়েই বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পাদিত হয়। এ প্রেক্ষাপটে অনেক মেরিন প্রফেশনাল তৈরির সুযোগ রয়েছে। কিন্তু মেরিন ট্রেনিং একাডেমীর স্বল্পতার অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে চট্টগ্রামে অবস্থিত মেরিন একাডেমীতে মাত্র ২০০ ক্যাডেটের শিক্ষার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে মেরিন প্রফেশনালদের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। একজন সনদপ্রাপ্ত মেরিন ক্যাপ্টেন অথবা ইঞ্জিনিয়ার মাসিক ১০ হাজার ইউএস ডলার আয় করে থাকেন, যা অন্যান্য চাকরির আয়ের তুলনায় প্রায় দশগুণ বেশি। বাংলাদেশে ছয়টি নতুন মেরিন একাডেমী স্থাপন করা গেলে অনেক মেরিন প্রফেশনাল তৈরি সম্ভব হবে এবং আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে চাকরির সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে বেকারত্ব হ্রাস পাবে। জাহাজ শিল্প এবং মেরিন প্রফেশনাল তৈরিতে বাংলাদেশের দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু যথাযথ ট্রেনিং ও শিক্ষার অভাবে এই শিল্পের বিকাশ হচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। অথচ বিশ্বে মেরিন প্রফেশনালদের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ক্রমেই জাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রপথে বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। পাশাপাশি পশ্চিমা দেশগুলোতে মেরিন প্রফেশনালদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমীতে ক্যাডেট ভর্তির সংখ্যা ৭০ থেকে বৃদ্ধি করে ২০০-তে উন্নীত করা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে বছরভিত্তিক অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৮৬ কোটি ২৯ লাখ ২২ হাজার টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১০৮ কোটি ৫৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকা এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৪৬ কোটি ৬৬ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। প্রকল্পের আওতায় মূল কার্যক্রম হচ্ছে তিনটি মেরিন একাডেমী ভবন নির্মাণ, প্রত্যেকটি মেরিন একাডেমীর জন্য ১০ একর করে মোট ৩০ একর ভূমি অধিগ্রহণ, যানবাহন, বোট এবং আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র ক্রয় করা হবে। উল্লেখ্য, এর আগে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের কথা চিন্তা করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্টান্ডিং কমিটি নতুন মেরিন একাডেমী প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেয়। সে অনুযায়ী আরও ৬০০ ক্যাডেটের প্রশিক্ষণের জন্য এ প্রকল্পটি ৭৪৯ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরে ২০১৪ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের প্রস্তাব করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটির ওপর ২ ফেব্রুয়ারি পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ব্যাপক আলোচনা ও সিদ্ধান্তের আলোকে প্রথম পর্যায়ে তিনটি মেরিন একাডেমী স্থাপনের জন্য মোট ৩৪১ কোটি ৫০ লাখ ৮২ হাজার টাকা ব্যয় ধরে এবং বাস্তবায়নকাল জুন ২০১৫ পর্যন্ত ধরে প্রকল্পের ডিপিপি পুনর্গঠন করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে সিলেট, নারায়ণগঞ্জ এবং রংপুরে বাকি তিনটি মেরিন একাডেমী স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দেশে শুধু মেরিন একাডেমী স্থাপন করলে চলবে না। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে ভকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করা জরুরী। বিদেশে দক্ষ জনশক্তি রফতানির জন্য ভকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। এই কাজটি প্রতি অর্থবছরে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। দেশে সেনাবাহিনী কর্তৃক বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে। সব প্রতিষ্ঠান সুনামের সঙ্গে চলছে। আশা করব মেরিন একাডেমীগুলো তেমনি উচ্চমানের সুশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও সাবেক সহ-সভাপতি এফবিসিসিআই, লেখক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.