মঙ্গোলিয়ার পথ ধরেছি! by এম আবদুল হাফিজ

মহাজোট সরকারের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা স্বাভাবিক নিয়মেই কমেছে। সব সরকারের ক্ষেত্রেই তা হয়। কেননা ক্ষমতাসীন দল বা জোটের ব্যর্থতা অথবা দুর্বলতা জনগণ সরাসরি প্রত্যক্ষ করে। সরকারও জনগণের দৃষ্টিতে তাদের অবস্থান কী সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।


এ নিয়ে এন্তার বিতর্ক হতে পারে এবং তা হচ্ছেও, কিন্তু অল্প কিছু ক্ষমতাসংশ্লিষ্ট ভাগ্যবান ছাড়া দেশের ষোলো কোটি মানুষ ভালো নেই।
১৯৯০ সালকে যদি আমরা গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিভাজন রেখা বলে গণ্য করি, সেই থেকে আজ পর্যন্ত কোনো নির্বাচিত সরকার পদাধিকারের কারণে পুনর্নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করতে পারেনি। এটা যতটা না তাদের ব্যর্থতার কারণে তারও বেশি তাদের আচরণ ও উচ্চারণে তিক্ততা সৃষ্টির কারণে, যে জন্য জনগণ তাদের কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমাদের এ রাজনীতির প্রবণতাকে তাহলে আমরা কীভাবে সংজ্ঞায়ন করব? সব সরকারই সরকার পরিচালনায় কমবেশি ভুল করে থাকে। আমাদের চেয়ে অর্ধেক গণতন্ত্রায়িত দেশেও নির্বাচিত সরকারগুলো কদাচিত ভুলের ঊধর্ে্ব। তাই বলে জনগণ তাদের এমনভাবে বর্জন করে না। তাহলে কি আমরা এটিকে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি উপাদান ভাবব? কিন্তু এমন রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনেকটাই আবেগতাড়িত এবং তা সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য।
এ মুহূর্তে এটি একটি সর্বজন স্বীকৃত বাস্তবতা যে, মহাজোট সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তার অনুগত শ্রোতামণ্ডলীকে যতই দেশের শনৈঃশনৈঃ অগ্রগতির বয়ান শোনান না কেন, সংবাদপত্রে যখন আমরা পড়ি যে, জনৈক মা তার ৩ শিশুকন্যাকে অভাবের তাড়নায় বিষ খাইয়ে হত্যা করেছে এবং খুলনার কোনো এক অঞ্চলে এক পিতা তার দুই সন্তানকে একই কারণে পানিতে চুবিয়ে হত্যা করেছে_ তখন সরকারের অসংখ্য অগ্রগতির বক্তব্য সম্পর্কে কী ভাবব!
জোট সরকারের সময়ে বেগম খালেদা জিয়াও 'উন্নয়নের জোয়ারে' দেশ ভাসিয়ে দিতেন শুধু তার বক্তৃতায়, যখন দেশবাসী পান করার বিশুদ্ধ পানির জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকত। বিদ্যুতের অভাবে সারাদেশ অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকত, যদিও হাওয়া ভবনের দাপুটেরা তারেক জিয়ার আনুকূল্যে হাজার কোটি টাকার শুধু বিদ্যুতের খাম্বারই ব্যবসা করত। কিন্তু খালেদা জিয়ার ধারণায় দেশের উন্নয়ন তার বিহনে বিঘি্নত হবে। তাকে অন্তত আরেক মেয়াদ দেশের খাতিরে ক্ষমতায় থাকতেই হবে। তার পরের সব কাহিনী জনগণের জানা।
খুবই দুর্ভাগ্যের কথা, এমন এক মর্মান্তিক এপিসোড থেকে আওয়ামী লীগ বা মহাজোট কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনি। বরং উদ্ধত মহাজোট সরকার শুধু চারদলীয় জোটের পথেই হাঁটছে না বরং তাদের কৌশলকে টেক্কা দিয়ে দেশকে এক ভয়াবহ সংঘর্ষের পথে ঠেলে দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত দল কী করে ভাবল যে, তাদের দলীয় একটি অন্তর্বর্তী সরকার দিয়ে নির্বাচন করিয়ে দলটি 'মিউজিক্যাল চেয়ার' রাজনীতির ধারার ব্যত্যয় ঘটিয়ে বাজিমাৎ করবে। বিএনপির মতো দল, যাদের শত ভুল সত্ত্বেও এখনও একটি ঈর্ষণীয় ভোট ব্যাংক আছে, যা আওয়ামী লীগকে ছুঁই ছুঁই দূরত্বের মধ্যে রাখে। শোনা যায়, বিএনপি নির্বাচন বয়কট করলে তার স্থান পূরণ করবেন এরশাদের মতো নীতিভ্রষ্ট এক ব্যক্তি।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আওয়ামী লীগের অন্তত আরেক মেয়াদের ক্ষমতালিপ্সা দেশকে আরও কয়েক ধাপ পেছনে নিয়ে যাবে। বিএনপি অবশ্যই মহাদুর্নীতিগ্রস্ত ছিল, তবে তা জিয়া পরিবার ও তাদের বাছাই করা অনুগ্রহভাজনদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন আমরা কী দেখছি? দুর্নীতির মহামারী, যার কীট সর্বত্র কিলবিল করছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা উল্লেখ করব! সুরঞ্জিতের বাসভবনে টাকার বস্তা? পদ্মা সেতু অর্থায়নের লেজেগোবরে অবস্থা, যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খলনায়ক একাধিক? শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি? সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের যোগসাজশে হলমার্ক কেলেঙ্কারি? ডেসটিনি? ওয়াসা? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়? সড়কপথ মৃত্যুফাঁদ? দেশজুড়ে অবকাঠামোর জরাজীর্ণ অবস্থা? প্রশাসনের দলীয়করণ? তাৎক্ষণিকভাবে স্মৃতি থেকে এতটুকুই উল্লেখ করতে পারলাম।
ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত এ দেশ। এখনও সময় আছে। গণতন্ত্রে নির্বাচন, সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা_ এগুলোই শেষ কথা নয়। এগুলো শুধু গণতন্ত্রের সিম্বলিজম। এগুলো চালিয়ে নিতে সহিষ্ণুতা, আপস-নিষ্পত্তি ও সমঝোতার বিকল্প নেই। আমরা কি সে পথে চলতে পারি না? আমরা কি শুধু বিভক্তি-বিভাজনের পথে চলেই দেশি-বিদেশি সুযোগসন্ধানীদের জন্য এ দেশকে মৃগয়া ক্ষেত্রে পরিণত হতে দেব!

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
 

No comments

Powered by Blogger.