সোঁদামাটির গন্ধমাখা গান অশীতিপর চন্দ্রাবতীর কণ্ঠে মুগ্ধ শ্রোতা- শিল্পকলায় রাধারমণের গানের ব্যতিক্রমী আয়োজন by মোরসালিন মিজান

ইট পাথরের শহর ঢাকায়, হ্যাঁ, হরহামেশাই শোনা যায় রাধারমণের গান। তবে সেসব গান কতটা আসলে গান হয়ে ওঠে? ভাটির দেশ সুনামগঞ্জ থেকে কয়জন পারে তুলে আনতে অবিকৃত রাধারমণকে? সেসব প্রশ্ন থেকে যায়। এর পরও প্রশ্নবিদ্ধ বাণী সুর শহরে চলছে স্টুডিও ইঞ্জিনিয়ারিং। সর্বত্রই শোনা যাচ্ছে প্রলেপযুক্ত কথা সুরের রাধারমণ।


তবে এ সবের বাইরে রাধারমণ শোনার যে আনন্দ সেটি পাওয়া যায় কখনও সখনও। শনিবার ছিল তেমন একটি দিন। এদিন শিল্পকলা একাডেমীর সঙ্গীত ও নৃত্যশালায় গান করেন সুনামগঞ্জের কিংবদন্তি শিল্পী চন্দ্রাবতী রায়। বয়স এখন ৮১ তাঁর। এর পরও কী কণ্ঠ! কী সুর! সোঁদামাটির গন্ধমাখা গান শুনে চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। গ্রামের নরম মাটিতে নাড়ি পুঁতে আসা শহুরে মানুষ নিজেকে নতুন করে আবিষ্কারের সুযোগ পান। ইট-পাথরের ঢাকায় এ সুযোগ কত কত দিন পর! বিরল এ সুযোগটি করে দেয় রাধারমণ সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র। শনিবার শিল্পকলা একাডেমীর সঙ্গীত ও নৃত্যশালায় কেন্দ্র আয়োজন করে ব্যতিক্রমী এ অনুষ্ঠানের। এতে চন্দ্রাবতী ছাড়াও গান করেন শিল্পী বিশ্বজিৎ রায়। দুই জনের পরিবেশনায় মন্ত্রমুগ্ধ হন শ্রোতা।
আয়োজনের শুরু হয় চন্দ্রাবতীর গান দিয়ে। অশীতিপর শিল্পীর কণ্ঠটি এদিন যাঁরা প্রথম শুনেন তাঁরা শুধু বিস্মিতই হয়েছেন। প্রথমেই শ্যামের জন্য নিজের আকুলতার কথা জানান শিল্পী। সুরে সুরে বলেন শ্যাম আওনা কেনে রসবৃন্দাবনে রে/ আনন্দ স্থানে শ্যাম তুমি আওনা কেনে...। হ্যাঁ, একটু কম শোনা। অপ্রচলিত একটি গান। তবে শিল্পী যে বহু কাল ধরে গাইছেন তা ঠিক বোঝা গেল গান শুনে। গায়কীর কারণে শ্রোতারাও একাত্ম হলেন তাঁর কথার সঙ্গে। সুর আর ভাবের সঙ্গে নীবিড় হলেন। উপভোগ করলেন। পরের গানটির অবশ্য গ্রাম শহর নেই। সারা বাংলাদেশে একইরকম জনপ্রিয়। বার বার গাওয়া। কালজয়ী সে গানে ‘শ্যাম’ নেই। শিল্পী বলেন তাঁর বন্ধুর কথা। প্রাণের বন্ধুকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে গেয়ে যান আমার বন্ধু দয়াময়/ তোমারে দেখিবার মনে লয়/ তোমারে না দেখলে রাধার/ জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে...। পরিবেশনাটি মিলনায়তন ভর্তি শ্রোতাকে সত্যি যেন বলে দেয় এই হলেন রাধারমণ। তবে এর পরে ফের অপ্রচলিত গানে ফেরেন শিল্পী। তেমন একটি গানে তিনি বলেন ‘আজ কেনে প্রাণ কেন্দে কেন্দে/ ওঠেরে ভাইরে নিতাই/ আমি যার লাগিয়া দেশান্তরি/ কোথায় গেলে তারে পাই...। শিল্পী পরে একে একে গেয়ে শোনান আমার কৃষ্ণ কোথায় পাই, সুবল মন্দ আর বলিসনে তোরা, শুনগো পরান সই, আমি উদাসী হইলাম যার লাগিয়া গো, ঐ নাকি ঐ যায় গো সই নিঠুর কালিয়া এবং জীবনের সাধ নাইগো আমার। চন্দ্রাবতী রায় পরিবেশনা শেষ করেন আনন্দের কথা বলে। এসময় তিনি গান চাইয়া দেখগো কী আনন্দ হইতাছে নদীয়ায়..। সব মিলিয়ে দশটি গান। ফলে কিছুতেই যেন মন ভরছিল না শ্রোতার। আরও চাই তাদের। কিন্তু এর পরও শেষ করতে হয় চন্দ্রাবতী রায়কে। শিল্পীর পরিবেশনা নিশ্চিত বলা যায়, বহু দিন মনে রাখবেন সঙ্গীতের সমজদাররা।
দ্বিতীয় পর্বে যিনি গান করতে মঞ্চে ওঠেন তিনি এই প্রজন্মের। নগরের মানুষও বটে। তবে রাধারমণের শুদ্ধ চর্চায় বিশেষ মনোযোগ তাঁর। তিনি বিশ্বজিৎ রায়। রাধারমণের বেশ কিছু জনপ্রিয় গান গেয়ে শোনান তিনি। তাঁর গাওয়া গানগুলোর মধ্যে ছিল আইজ কেনরে প্রাণের সুবল, ওরে ও রসিক নাইয়া ওরে সুজন নাইয়া, আমারে আসিবার কথা কইয়া, হরি গুণাগুণ কৃষ্ণ গুণাগুণ, শ্যাম জানি কই রইলো গো, আমার সাধনের ধন, জলে যাইয়ো না গো রাই, কেমন আছে কমলিনী রাই এবং কুঞ্জে মিলিল মিলিল গো। বিশ্বজিৎ শেষ করেন ভ্রমরের গান দিয়ে যে গান না করলে রাধারমণ যেন এখন সবটুকু প্রকাশিত হন না। এ গানটি ছিল ভ্রমর কইও গো...। গানটির সঙ্গে উপস্থিত শ্রোতারাও কণ্ঠ মেলান। শেষ হয় আয়োজন। এমন একটি আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ পেতেই পারেন আয়োজকরা।

No comments

Powered by Blogger.