প্রশাসনে অনিয়ম ও স্থবিরতা by এ এম এম শওকত আলী
প্রশাসনে অনিয়মের বিষয়টি এখন মিডিয়ায় বহুল আলোচিত। ১২ সেপ্টেম্বর এ শিরোনামে কালের কণ্ঠ সম্পাদকীয় মন্তব্যও করেছে। প্রথমেই বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য জনপ্রশাসনের স্থবিরতা দূর করা প্রয়োজন বা উচিত। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
স্মরণ করা যেতে পারে যে বর্তমান সরকারপ্রধান ক্ষমতা গ্রহণের অব্যবহিত পরেই এ বিষয়ে অধিকতর মনোযোগী হওয়ার জন্য সচিবদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিন বছরের অধিক সময় পেরিয়ে গেলেও এ বিষয়টি নিয়ে সরকারি মহল ও মিডিয়ায় বারবার আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। এর মানে, সমস্যাটির সমাধান তো দূরের কথা বরং আরো বেশি ঘনীভূত হচ্ছে। যত দূর মনে পড়ে, সচিবদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে সরকারপ্রধান একটি সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন। তা ছিল প্রচলিত আইন বা বিধি যদি দ্রুতগতিতে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রধান অন্তরায় হয়, তাহলে সেগুলোর সংশোধনীর জন্য তাঁর কাছে সুস্পষ্ট প্রস্তাব পেশ করতে হবে। এ পর্যন্ত কয়টি মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা জানা নেই। তবে অনুমান করা যায়, এ কাজটি তিন বছরেও হয়নি। যদি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হতো, তাহলে নিশ্চয় বিষয়টি জানা সম্ভব ছিল।
কয়েক দশক ধরেই প্রশাসন দলীয়করণের প্রবণতার বিষয়টি মিডিয়ায় একটি বহুল আলোচিত ক্ষেত্র ছিল। এখনো তা-ই আছে। সম্পাদকীয় মন্তব্যে প্রধান কয়েকটি বিষয় এ সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। এক. রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রশাসনের দলীয়করণ। দুই. সম্প্রতি এ বিষয়ে পদ না থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি বা টাইম স্কেলের সুবিধাভোগী একমাত্র প্রশাসনিক ক্যাডার। অন্যদিকে ২৭টি ক্যাডারের ৬০ হাজার কর্মকর্তা বঞ্চিত হয়েছেন। এ বিষয়ে সরকারপ্রধান আইন বা বিধি মোতাবেক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তিন. ইতিপূর্বে যেসব প্রশাসনিক সংস্কারসংক্রান্ত কমিটি কমিশনের সুপারিশ ছিল, তার একটিও বাস্তবায়ন করা হয়নি। নীতি, আইন বা বিধিসংক্রান্ত সংস্কারের মূল দায়িত্ব ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের, সরকারি কর্মকর্তাদের নয়। এসব বিষয়ে সাধারণত মন্ত্রিসভায় বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রিপরিষদ কমিটিতে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তাহলে ব্যর্থতা কার? এ বিষয়টি পরোক্ষভাবে সম্পাদকীয় মন্তব্যেই স্বীকৃত। বলা হয়েছে যে সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের জন্য সংবিধানে সুস্পষ্ট বিধান থাকলেও তা গত ৪০ বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি। যা বলা হয়নি তা হলো, খসড়া সিভিল সার্ভিস আইন প্রণীত হয়েছে। এ বিষয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার অর্থায়নে খসড়া প্রণয়ন করা হলেও তা এখন পর্যন্ত মন্ত্রিপরিষদে আলোচিত হয়নি। সংসদে কোনো খসড়া বিলও উত্থাপিত হয়নি। খসড়া আইনটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২০১০ সালে চূড়ান্ত করেছিল।
বিভিন্ন ক্যাডারের সুবিধাদির বৈষম্য দূর করার জন্য ১৯৮২-৯০ সালে কিছু সুপারিশ করা হয়েছিল। এর মধ্যে অন্যতম সুপারিশ ছিল সচিবালয়ে উপসচিব পদে নিয়োগের সুযোগ সব ক্যাডারের জন্য খোলা থাকবে। তবে শর্ত ছিল এই যে এর জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। এর আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল, নিয়োগ যেন নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক হয়। এ বিশেষ ব্যবস্থার নাম ছিল সিনিয়র সার্ভিস পুল। পাবলিক সার্ভিস কমিশন একটি নির্দিষ্ট দিন পরীক্ষার জন্য নির্ধারণও করেছিল। শেষ পর্যন্ত ওই নির্ধারিত দিনের এক দিন আগে জারীকৃত প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার করা হয়। এ বিষয়ে সাধারণ ধারণা হলো, কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। কারণ বিষয়টি সরকারের এখতিয়ারভুক্ত, কমিশনের নয়। পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত কমিশনের সঙ্গে পরামর্শ করে সরকার গ্রহণ করে। তবে সিদ্ধান্তটি পাল্টানোর জন্য সরকার কোনো লিখিত নির্দেশ দিয়েছিল কি না তা জানা নেই।
১৯৯১-১৯৯৬ সাল- এ সময়ে তৎকালীন সরকার আরেকটি পদোন্নতিবিষয়ক কাঠামোর পরিবর্তন করে। মন্ত্রীদের নিয়ে গঠিত মন্ত্রিপরিষদ কমিটি করা হয়। এর সঙ্গে যোগ হয় উপসচিব পর্যায়ে পদোন্নতির জন্য তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের (বর্তমানে জনপ্রশাসন) প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটি করা হয়। যা আগে কখনো ছিল না। উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতিবঞ্চিত এক কর্মকর্তা হাইকোর্টে একটি রিট মামলা করেন। তিনি মামলায় জয়ী হন। এতে অন্য সবার জন্য একটি বাড়তি সুবিধাও সৃষ্টি হয়। তা হলো- মন্ত্রীপর্যায়ের সব কমিটির বিলুপ্তি। এর পর থেকে ১৯৭২ সালে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে গঠিত সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) এ বিষয়ে সরকারপ্রধানের কাছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সুপারিশ করতে থাকত। সবার আশা ছিল, এর মাধ্যমে সুপারিশ নিরপেক্ষ হবে। বিষয়টি যে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি, তা অনস্বীকার্য। এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতেই এখনো পদোন্নতি হচ্ছে।
জনপ্রশাসনে অনিয়মসংক্রান্ত বহু সাক্ষ্য-প্রমাণ মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। ১২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায়, বগুড়ার স্বাস্থ্য বিভাগের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর জনবল নিয়োগে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগে আদালতে মামলা থাকা সত্ত্বেও ৩৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে এ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা ছিল না। নিষেধাজ্ঞার আদেশসংক্রান্ত শুনানির দিন শুনানি স্থগিত হয়। কারণ ছিল, সংশ্লিষ্ট আইনজীবী প্রস্তুত নন। পরবর্তী তারিখ ৩ অক্টোবর নির্ধারিত হয়। কিন্তু ৫ সেপ্টেম্বর সংশ্লিষ্ট দপ্তর ৩৫ জনকে নিয়োগ করার আদেশ জারি করে। স্পষ্টই বোঝা যায়, নিষেধাজ্ঞার আদেশসংক্রান্ত শুনানির দিন মুলতবির জন্য এ ঘটনা ঘটেছে। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের সোজা জবাব হবে, কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না।
কালের কণ্ঠের একই দিনের প্রকাশনায় খাদ্য অধিদপ্তরের বড় অপরাধে ছোট শাস্তি ও বদলি পদায়নে অনিয়মসংক্রান্ত সংবাদও দেখা গেছে। মন্তব্য করা হয়েছে, এ অধিদপ্তরে বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম রয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতি একে অপরের সহায়ক শক্তি। কিছু পাওয়ার আশায় অনিয়ম করা হয়। তবে এ ধারণা সম্পূর্ণ সত্যি নয়। আংশিকভাবে সত্যি বা অর্ধসত্য। সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক অনিয়মের বহু বস্তুনিষ্ঠ উদাহরণ দিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও কর্মকর্তারা অনিয়ম করতে বাধ্য হন। দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব এ বিষয়ের একটি প্রধান উৎস। দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবের অন্য একটি উৎস হলো, রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রাথমিক নিয়োগ। পরবর্তী সময়ে পদায়ন। পদায়নের ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্য রয়েছে এমন সব কর্মকর্তাকে বিভিন্ন পদে বদলি করা হয়। সব শেষের স্তরটি হলো পদোন্নতি। অবশ্য পদোন্নতি ও পদায়ন একই সঙ্গে হতে পারে। সব মিলিয়ে একটি অনুগত আমলা বাহিনীর সৃষ্টি হয়। এরা প্রধানত দুই বৃহৎ দলের, যারা পালাক্রমে ১৯৯১ থেকে দেশ শাসন করছে।
বিপদ হয় রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা গ্রহণের পর। যে দল দেশ শাসন করার দায়িত্ব গ্রহণ করে, সে দল ক্ষমতাসীন থাকার সময় যে অনুগত আমলাদের পদায়ন করে, তাঁরা অন্য দল ক্ষমতায় আশার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববর্তী দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবপুষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তারা হয় বদলি, না হয় বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে কর্মবিহীন জীবন যাপন করতে থাকেন। অবশ্য বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধাও তাঁদের অক্ষুণ্ন থাকে। কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই এ কারণে সরকারি কোষাগারের অর্থের অপচয় হওয়ার বিষয়টি প্রচার করা হয়েছে। বেতন-ভাতা দিচ্ছি অথচ কাজ দিচ্ছি না- এমন সব কর্মকর্তার সংখ্যাও নিরূপণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অন্য একটি কারণও উল্লেখ করা যায়। যেমন দলীয় বিবেচনায় পদ না থাকা সত্ত্বেও বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। পদ নেই অথচ পদোন্নতি হচ্ছে কর্মবিহীন পদের বিপরীতে। তাঁদের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও একেবারেই কম হবে না, এটাও একটি অনিয়ম।
জনপ্রশাসন ব্যবস্থাপনায় এ নীতির সুফলের চেয়ে কুফলই বেশি। সুফল মাত্র একটাই। এক রাজনৈতিক দলের সময় যাঁরা দলীয় আনুগত্যের অভাবের কারণে অথবা পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীন দলের সময় পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন, তাঁদেরই পরবর্তী দল পদ থাকুক বা না থাকুক পদোন্নতি দিতে থাকে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে একই নীতি প্রয়োগ করা হয়। কিছু কর্মকর্তা পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হন। তাঁরা অপেক্ষায় থাকেন কখন আবার যে দল ক্ষমতাসীন সময়ে তাঁদের পদোন্নতি দিয়েছিল সে দল পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হবে। অন্যদিকে পদোন্নতিবঞ্চিতদের কিছু কর্মকর্তা নিয়মিত পদে নিয়োজিত থাকলেও সার্থকভাবে কাজ করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলেন। ফলে প্রশাসন স্থবির হয়। ওই সময় ক্ষমতাসীন দলের কিছু কর্মকর্তা দলীয় আনুগত্যের কারণে পদোন্নতি পাওয়ার পর নিয়মিত পদে সঠিকভাবে অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদনে ব্যর্থ হন। কারণ তাঁদের অনেকেই রাজনৈতিক কারণে পদোন্নতি পেয়েছেন, মেধার ভিত্তিতে নয়। অথবা তাঁরা উদ্যোগ বা উদ্যম হারান। সব সময় শঙ্কাগ্রস্ত থাকেন। কী জানি তাঁদের কোনো সিদ্ধান্তে ক্ষমতাসীন দল রুষ্ট হয়। ফলে সিদ্ধান্ত চূড়ান্তকরণপ্রক্রিয়ার গতি শ্লথ হয়।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
কয়েক দশক ধরেই প্রশাসন দলীয়করণের প্রবণতার বিষয়টি মিডিয়ায় একটি বহুল আলোচিত ক্ষেত্র ছিল। এখনো তা-ই আছে। সম্পাদকীয় মন্তব্যে প্রধান কয়েকটি বিষয় এ সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। এক. রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রশাসনের দলীয়করণ। দুই. সম্প্রতি এ বিষয়ে পদ না থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি বা টাইম স্কেলের সুবিধাভোগী একমাত্র প্রশাসনিক ক্যাডার। অন্যদিকে ২৭টি ক্যাডারের ৬০ হাজার কর্মকর্তা বঞ্চিত হয়েছেন। এ বিষয়ে সরকারপ্রধান আইন বা বিধি মোতাবেক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তিন. ইতিপূর্বে যেসব প্রশাসনিক সংস্কারসংক্রান্ত কমিটি কমিশনের সুপারিশ ছিল, তার একটিও বাস্তবায়ন করা হয়নি। নীতি, আইন বা বিধিসংক্রান্ত সংস্কারের মূল দায়িত্ব ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের, সরকারি কর্মকর্তাদের নয়। এসব বিষয়ে সাধারণত মন্ত্রিসভায় বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রিপরিষদ কমিটিতে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তাহলে ব্যর্থতা কার? এ বিষয়টি পরোক্ষভাবে সম্পাদকীয় মন্তব্যেই স্বীকৃত। বলা হয়েছে যে সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের জন্য সংবিধানে সুস্পষ্ট বিধান থাকলেও তা গত ৪০ বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি। যা বলা হয়নি তা হলো, খসড়া সিভিল সার্ভিস আইন প্রণীত হয়েছে। এ বিষয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার অর্থায়নে খসড়া প্রণয়ন করা হলেও তা এখন পর্যন্ত মন্ত্রিপরিষদে আলোচিত হয়নি। সংসদে কোনো খসড়া বিলও উত্থাপিত হয়নি। খসড়া আইনটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২০১০ সালে চূড়ান্ত করেছিল।
বিভিন্ন ক্যাডারের সুবিধাদির বৈষম্য দূর করার জন্য ১৯৮২-৯০ সালে কিছু সুপারিশ করা হয়েছিল। এর মধ্যে অন্যতম সুপারিশ ছিল সচিবালয়ে উপসচিব পদে নিয়োগের সুযোগ সব ক্যাডারের জন্য খোলা থাকবে। তবে শর্ত ছিল এই যে এর জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। এর আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল, নিয়োগ যেন নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক হয়। এ বিশেষ ব্যবস্থার নাম ছিল সিনিয়র সার্ভিস পুল। পাবলিক সার্ভিস কমিশন একটি নির্দিষ্ট দিন পরীক্ষার জন্য নির্ধারণও করেছিল। শেষ পর্যন্ত ওই নির্ধারিত দিনের এক দিন আগে জারীকৃত প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার করা হয়। এ বিষয়ে সাধারণ ধারণা হলো, কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। কারণ বিষয়টি সরকারের এখতিয়ারভুক্ত, কমিশনের নয়। পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত কমিশনের সঙ্গে পরামর্শ করে সরকার গ্রহণ করে। তবে সিদ্ধান্তটি পাল্টানোর জন্য সরকার কোনো লিখিত নির্দেশ দিয়েছিল কি না তা জানা নেই।
১৯৯১-১৯৯৬ সাল- এ সময়ে তৎকালীন সরকার আরেকটি পদোন্নতিবিষয়ক কাঠামোর পরিবর্তন করে। মন্ত্রীদের নিয়ে গঠিত মন্ত্রিপরিষদ কমিটি করা হয়। এর সঙ্গে যোগ হয় উপসচিব পর্যায়ে পদোন্নতির জন্য তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের (বর্তমানে জনপ্রশাসন) প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটি করা হয়। যা আগে কখনো ছিল না। উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতিবঞ্চিত এক কর্মকর্তা হাইকোর্টে একটি রিট মামলা করেন। তিনি মামলায় জয়ী হন। এতে অন্য সবার জন্য একটি বাড়তি সুবিধাও সৃষ্টি হয়। তা হলো- মন্ত্রীপর্যায়ের সব কমিটির বিলুপ্তি। এর পর থেকে ১৯৭২ সালে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে গঠিত সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) এ বিষয়ে সরকারপ্রধানের কাছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সুপারিশ করতে থাকত। সবার আশা ছিল, এর মাধ্যমে সুপারিশ নিরপেক্ষ হবে। বিষয়টি যে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি, তা অনস্বীকার্য। এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতেই এখনো পদোন্নতি হচ্ছে।
জনপ্রশাসনে অনিয়মসংক্রান্ত বহু সাক্ষ্য-প্রমাণ মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। ১২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায়, বগুড়ার স্বাস্থ্য বিভাগের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর জনবল নিয়োগে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগে আদালতে মামলা থাকা সত্ত্বেও ৩৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে এ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা ছিল না। নিষেধাজ্ঞার আদেশসংক্রান্ত শুনানির দিন শুনানি স্থগিত হয়। কারণ ছিল, সংশ্লিষ্ট আইনজীবী প্রস্তুত নন। পরবর্তী তারিখ ৩ অক্টোবর নির্ধারিত হয়। কিন্তু ৫ সেপ্টেম্বর সংশ্লিষ্ট দপ্তর ৩৫ জনকে নিয়োগ করার আদেশ জারি করে। স্পষ্টই বোঝা যায়, নিষেধাজ্ঞার আদেশসংক্রান্ত শুনানির দিন মুলতবির জন্য এ ঘটনা ঘটেছে। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের সোজা জবাব হবে, কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না।
কালের কণ্ঠের একই দিনের প্রকাশনায় খাদ্য অধিদপ্তরের বড় অপরাধে ছোট শাস্তি ও বদলি পদায়নে অনিয়মসংক্রান্ত সংবাদও দেখা গেছে। মন্তব্য করা হয়েছে, এ অধিদপ্তরে বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম রয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতি একে অপরের সহায়ক শক্তি। কিছু পাওয়ার আশায় অনিয়ম করা হয়। তবে এ ধারণা সম্পূর্ণ সত্যি নয়। আংশিকভাবে সত্যি বা অর্ধসত্য। সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক অনিয়মের বহু বস্তুনিষ্ঠ উদাহরণ দিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও কর্মকর্তারা অনিয়ম করতে বাধ্য হন। দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব এ বিষয়ের একটি প্রধান উৎস। দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবের অন্য একটি উৎস হলো, রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রাথমিক নিয়োগ। পরবর্তী সময়ে পদায়ন। পদায়নের ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্য রয়েছে এমন সব কর্মকর্তাকে বিভিন্ন পদে বদলি করা হয়। সব শেষের স্তরটি হলো পদোন্নতি। অবশ্য পদোন্নতি ও পদায়ন একই সঙ্গে হতে পারে। সব মিলিয়ে একটি অনুগত আমলা বাহিনীর সৃষ্টি হয়। এরা প্রধানত দুই বৃহৎ দলের, যারা পালাক্রমে ১৯৯১ থেকে দেশ শাসন করছে।
বিপদ হয় রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা গ্রহণের পর। যে দল দেশ শাসন করার দায়িত্ব গ্রহণ করে, সে দল ক্ষমতাসীন থাকার সময় যে অনুগত আমলাদের পদায়ন করে, তাঁরা অন্য দল ক্ষমতায় আশার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববর্তী দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবপুষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তারা হয় বদলি, না হয় বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে কর্মবিহীন জীবন যাপন করতে থাকেন। অবশ্য বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধাও তাঁদের অক্ষুণ্ন থাকে। কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই এ কারণে সরকারি কোষাগারের অর্থের অপচয় হওয়ার বিষয়টি প্রচার করা হয়েছে। বেতন-ভাতা দিচ্ছি অথচ কাজ দিচ্ছি না- এমন সব কর্মকর্তার সংখ্যাও নিরূপণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অন্য একটি কারণও উল্লেখ করা যায়। যেমন দলীয় বিবেচনায় পদ না থাকা সত্ত্বেও বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। পদ নেই অথচ পদোন্নতি হচ্ছে কর্মবিহীন পদের বিপরীতে। তাঁদের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও একেবারেই কম হবে না, এটাও একটি অনিয়ম।
জনপ্রশাসন ব্যবস্থাপনায় এ নীতির সুফলের চেয়ে কুফলই বেশি। সুফল মাত্র একটাই। এক রাজনৈতিক দলের সময় যাঁরা দলীয় আনুগত্যের অভাবের কারণে অথবা পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীন দলের সময় পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন, তাঁদেরই পরবর্তী দল পদ থাকুক বা না থাকুক পদোন্নতি দিতে থাকে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে একই নীতি প্রয়োগ করা হয়। কিছু কর্মকর্তা পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হন। তাঁরা অপেক্ষায় থাকেন কখন আবার যে দল ক্ষমতাসীন সময়ে তাঁদের পদোন্নতি দিয়েছিল সে দল পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হবে। অন্যদিকে পদোন্নতিবঞ্চিতদের কিছু কর্মকর্তা নিয়মিত পদে নিয়োজিত থাকলেও সার্থকভাবে কাজ করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলেন। ফলে প্রশাসন স্থবির হয়। ওই সময় ক্ষমতাসীন দলের কিছু কর্মকর্তা দলীয় আনুগত্যের কারণে পদোন্নতি পাওয়ার পর নিয়মিত পদে সঠিকভাবে অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদনে ব্যর্থ হন। কারণ তাঁদের অনেকেই রাজনৈতিক কারণে পদোন্নতি পেয়েছেন, মেধার ভিত্তিতে নয়। অথবা তাঁরা উদ্যোগ বা উদ্যম হারান। সব সময় শঙ্কাগ্রস্ত থাকেন। কী জানি তাঁদের কোনো সিদ্ধান্তে ক্ষমতাসীন দল রুষ্ট হয়। ফলে সিদ্ধান্ত চূড়ান্তকরণপ্রক্রিয়ার গতি শ্লথ হয়।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments