কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করা-প্রশাসনিক নির্দেশই যথেষ্ট নয়
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধে আড়াই মাস আগে নীতিমালা জারি করা হলেও তা যে কার্যকর হয়নি, শনিবার সমকালের প্রধান প্রতিবেদন ও বিশেষ আয়োজনে তা স্পষ্ট। দেখা যাচ্ছে, নগরীর নামিদামি স্কুলের শিক্ষকরা 'ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে কোচিং বাণিজ্য' চালিয়েই যাচ্ছেন।
বাস্তবতা বিবেচনা করেই হয়তো আলোচ্য নীতিমালায় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে প্রাইভেট পড়ানোর সুযোগ রাখা হয়েছিল। কিন্তু 'কাকস্য পরিবেদনা'! একই সঙ্গে ক্ষোভ ও কৌতুকের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করলাম, রাজধানীর খ্যাতনামা একটি স্কুলের সাড়ে চারশ' শিক্ষকের মধ্যে মাত্র একজন সেই নিয়ম মেনে চলার গরজ দেখিয়েছেন! কোচিংয়ের মাসিক ফি হিসেবে মহানগর, জেলা, উপজেলায় ১৫০-৩০০ টাকার যে সীমা শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেঁধে দিয়েছে, তাও কেউ মানছেন না। বরং, সমকালের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, নীতিমালার দোহাই দিয়ে ফি আগের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে। আমাদের কোচিং নীতিমালা যেন কাজির গরুর মতো কেতাবেই আছে, বাস্তবে নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, নীতিমালা পালনে প্রশাসনিক হুকুম কিংবা আদালতের নির্দেশ জারি করে কি সংশ্লিষ্টদের বাধ্য করা যাবে? আমরা মনে করি, সেটা এখনই সঙ্গত হবে না, রাতারাতি সম্ভবও নয়। শিক্ষামন্ত্রী নিজেও সমকালের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন, তাদের হাতে ম্যাজিক নেই। তার এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমতের অবকাশ নেই যে, এ জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। বস্তুত শক্তি প্রয়োগ এ ক্ষেত্রে হিতে বিপরীতই হতে পারে। কোচিংয়ের বাস্তবতাও কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না। বর্তমান যে পাঠ্যক্রম, তা কেবল ক্লাসে সম্পন্ন করা কঠিন। শিক্ষার্থীর তুলনায় ভালো স্কুলের অপ্রতুলতার কথাও মনে রাখতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শ্রেণী শিক্ষকের দক্ষতাও প্রশ্নবিদ্ধ। যে কারণে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খোদ ব্যবস্থাপনা কমিটির উদ্যোগ সত্ত্বেও কোচিং বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। তাই বলে কোচিংয়ের ঢালাও 'বাণিজ্য' মেনে নেওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে আমাদের পরামর্শ হচ্ছে, ধাপে ধাপে কোচিং সীমিত এবং অভিভাবকদের জন্য আর্থিকভাবে সহনীয় করে তুলতে হবে। এটা ঠিক, যেসব বিদ্যালয় ও শিক্ষক মূল শিক্ষা কার্যক্রমের চেয়ে কোচিংয়েই বেশি আগ্রহী, এখনই তাদের রাশ টেনে ধরার বিকল্প নেই। সাধারণ ক্ষেত্রে কোচিং বন্ধে আমরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতেই বলব। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নাগরিক সমাজের পরামর্শ নিতে পারেন। শিক্ষক ও অভিভাবক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারেন। আমরা দেখেছি, ইভ টিজিং বন্ধে তার তৎপরতা ফলপ্রসূ হয়েছে। সামাজিক ওই ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। কোচিং বাণিজ্যও আমাদের জন্য এক আর্থ-সামাজিক ব্যাধি। সমাজের সবাই আন্তরিক হলে এটাও দূর করা অসম্ভব নয়। দেশে একসময় নকলের ছড়াছড়ি ছিল। পরীক্ষার সময় সংবাদপত্রে হেডিং হতো_ নকলের মহোৎসব। নকল বন্ধ করা যাবে না, এমন হতাশা বদ্ধমূল হয়েছিল। কিন্তু এখন নকল অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। চারদলীয় জোট সরকারের নানা সমালোচনা থাকলেও এক্ষেত্রে তৎকালীন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সাধুবাদ পেতেই পারেন। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী তৎপর হলে কোচিং বাণিজ্যও বন্ধ করা সম্ভব। শিক্ষা ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য ইতিমধ্যেই সুনামের যে মুকুট তার মাথায় উঠেছে, সেখানে তিনি অনায়াসে আরেকটি পালক যুক্ত করতে পারেন।
No comments