রাজধানীর বুকে ঝুপড়ি ঘর তুলে টর্চার সেল by রেজোয়ান বিশ্বাস ও মাসুদ রানা

রাজধানীর শাহজাহানপুর থানার অদূরে রেলওয়ে কলোনি। ৩০টির মতো ভবনে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের পরিবার বসবাস করে এখানে। এতগুলো পাকা ভবনের মধ্যে একটি ঝুপড়ি ঘর দেখে আগন্তুকমাত্রই কৌতূহলী হন। কিন্তু কৌতূহল আতঙ্কে পরিণত হয় যখন জানা যায় ঝুপড়ি ঘরটি সন্ত্রাসীদের ক্ষমতা প্রদর্শনেরই একটি প্রতীক।


দীর্ঘদিন ধরে ঘরটিকে সন্ত্রাসীরা টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করছে। চলে মাদকের আসরও। কেউ চাঁদা দিতে না চাইলে এখানে এনে সন্ত্রাসীদের ভাষায় তাকে 'সাইজ' করা হয়। কলোনি ও এলাকাবাসীর কাছে ঝুপড়ি ঘরটি আতঙ্কের প্রতীক হয়ে উঠলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা জানান, তাঁদের এমন কিছু জানা নেই। কিন্তু গত মঙ্গলবার কলোনির ভেতরে গিয়ে ৩৬ নম্বর ভবনের পাশে ওই ঝুপড়ি ঘরে 'টর্চার সেল' দেখা গেছে। কলোনির বাসিন্দারা জানান, প্রায় রাতেই সন্ত্রাসীরা ওই ঝুপড়িতে বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষকে ধরে এনে ব্যাপক নির্যাতন চালায়। রাতের আঁধারে মানুষের আর্তচিৎকার আর কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙে তাঁদের। বিষয়টি নিয়ে থানার পুলিশের কাছে অভিযোগ করেও লাভ হয় না। দীর্ঘদিনের এ সমস্যার কোনো প্রতিকার করছে না কেউই। স্থানীয় সন্ত্রাসী পাটা সোহেল, রাজু, ফারুক, সালাউদ্দিন, রায়হান, কালু, রাসেল, লিটন, সুমনসহ সংঘবদ্ধ একটি চক্র ওই ঝুপড়ি ঘরে মানুষকে ধরে এনে চাঁদার জন্য নির্যাতন চালায়। এরা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ এলাকার নারীদের রাস্তায় উত্ত্যক্ত করে। এই সন্ত্রাসীরা আগে বিএনপির কর্মী ছিল, বর্তমানে এরা স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ওয়ার্ড কর্মী বলে জানা গেছে।
মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, শাহজাহানপুরের ওই কলোনিতে মানুষ ধরে নিয়ে নির্যাতন ও চাঁদাবাজির বিষয়টি তাঁর জানা নেই। এ রকম কিছু থাকলে তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'শাহজাহানপুর এলাকায় আগে মাদক ব্যবসায়ীদের প্রকাশ্য কর্মকাণ্ড ছিল। ওই এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বর্তমানে ওই এলাকাসহ আশপাশের বেশির ভাগ এলাকার অপরাধ কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এলাকার পরিবেশ ভালো।'
সরেজমিনে শাহজাহানপুর কলোনিতে গিয়ে দেখা যায়, কলোনির ভেতরে ৩০টির মতো বহুতল ভবনের পাশাপাশি আছে বস্তির মতো টিনশেড ঘর। এর মধ্যে ৩৬ নম্বর ভবনের পাশে পরিত্যক্ত জায়গায় বাঁশ ও ছন দিয়ে তৈরি 'ঝুপড়ি ঘরটি' রয়েছে। আব্দুস সোবাহান নামের স্থানীয় এক মুরবি্ব কালের কণ্ঠকে বলেন, সাত-আট মাস ধরে ঝুপড়ি ঘরে সন্ত্রাসীরা আড্ডা দেয়। চাঁদা না পেয়ে সেখানে বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষকে ধরে এনে নির্যাতন চালায়। প্রায়ই গভীর রাতে ঝুপড়ি ঘর থেকে আর্তচিৎকার শোনা যায়। বস্তির বিভিন্ন ঘরের মধ্যেও অস্ত্র ও মাদক লুকিয়ে রাখে ওই সন্ত্রাসীরা। কখনো কখনো অস্ত্র নিয়ে এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায় তারা।
অন্য এক বয়স্ক মহিলা বলেন, 'রাতে ওরা (সন্ত্রাসী) নিরীহ লোকজন ধইরা আইনা ছনের ঘরে (ঝুপড়ি ঘর) মারধর করে। প্রায়ই গভীর রাতে চিৎকার শোনা যায়। কেউ কিছু বলতে গেলে সন্ত্রাসীরা হত্যার হুমকি দেয়। ওরা বস্তির ভেতরে অস্ত্র ও মাদক রাখে। কলোনির ভেতরে গাছগাছালির ভেতরেও তল্লাশি চালালে অনেক অস্ত্র পাওয়া যাবে। আমি নিজের চোখে ওই অস্ত্র দেখেছি।' তিনি বলেন, 'আমার বয়স হয়ে গেছে, বৃদ্ধ মানুষ, আমি কাউকে ভয় পাই না। এ এলাকা থেকে সন্ত্রাসীদের বিতাড়িত করতে হবে।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলোনির একটি ভবনের এক নারী বলেন, এক রাতে তাঁর স্বামী বাসায় নামাজ পড়ছিলেন। এ সময় ছয়-সাতজন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাসায় ঢুকে বলে, 'তোর ঘরে অনেক টাকাপয়সা আছে, আমাগো চাঁদার টাকা কই।' এই বলে সন্ত্রাসীরা তাঁর ঘরের আলমারি ও স্বামীর ব্রিফকেসের চাবি নিয়ে নেয়। এরপর টাকা না পেয়ে সন্ত্রাসীরা তাঁর স্বামীর মোবাইল ফোন ও ঘড়ি নিয়ে যায়। তিনি বলেন, ঘটনার পর তাঁরা ভয়ে কিছুদিন বাসা থেকে বাইরে বের হননি। পরে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে বিষয়টি জানান। কিন্তু তিনি কোনো সহযোগিতা করেননি।
স্থানীয় বাসিন্দা আলমগীর হোসেন, নারগিস বেগম, আম্বিয়া খাতুনসহ আরো কমপক্ষে ১৫ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই ঝুপড়ি ঘরটি সন্ত্রাসী পাটা সোহেল, রাজু, ফারুক, সালাউদ্দিন, রায়হান, কালু, রাসেল, লিটন, সুমনসহ সংঘবদ্ধ একটি সন্ত্রাসী চক্রের আখড়া। তারা চাঁদাবাজি করে প্রকাশ্যে। টাকা না দিলে লোকজনকে ঝুপড়ি ঘরে ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। প্রায় রাতেই চিৎকার আর কান্নায় তাঁদের ঘুম ভেঙে যায়। জানালার কাছে এসে তাঁরা নারী-পুরুষকে পেটানোর শব্দ শুনতে পান। ভয়ে রাতে তাঁদের আর ঘুম আসে না।
কলোনির বাসিন্দারা জানান, সন্ত্রাসীদের হুমকি-ধমকির কারণে তাঁরা সব সময় আতঙ্কের মধ্যে থাকেন। সন্ত্রাসীরা রাস্তায় তাঁদের স্কুলপড়ুয়া মেয়েদেরও 'টিজ' করে। কেউ কিছু বলতে গেলে সন্ত্রাসীরা উল্টো হুমকি দিয়ে বলে, থানা পুলিশ তাদের কেনা। র‌্যাব-পুলিশ তাদের পকেটে থাকে। এলাকাবাসী জানান, আগে এরা বিএনপি করত। বর্তমানে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ পরিচয় দিয়ে চাঁদাবাজি করে। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে ভয় পায়।
চাঁদা না দেওয়ায় চালককে নির্যাতন
গত বৃহস্পতিবার রাতে লেগুনা গাড়ির চালক রনি নামের এক যুবককে প্রথমে রাস্তায় আটকে তাঁর কাছে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে ওই সন্ত্রাসীরা। টাকা না পেয়ে রনিকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ঝুপড়ি ঘরে। সেখানে তাঁর ওপর চলে নির্যাতন। গুরুতর আহত রনি কালের কণ্ঠকে বলেন, তিনি মতিঝিল থেকে শাহজাহানপুর কলোনি এলাকায় লেগুনা গাড়ি চালান। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় খালি গাড়ি নিয়ে শাহজাহানপুর আমতলা এলাকার একটি চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ান। এ সময় পাটা সোহেল, রাজু, ফারুক, সালাউদ্দিন, রায়হান, কালু, রাসেল, লিটন, সুমন, সোহেল, সোলায়মান, জয়নাল, হাতভাঙা হোসেন ও জাবেদসহ ১৫-২০ জনের এক দল সন্ত্রাসী তাঁকে ধরেই 'তুই চাঁদার ট্যাহা না দিয়ে এহনো এলাকায় ঘোরস' বলে অকথ্য ভাষায় গালি দিতে থাকে। 'আজ তোরে মাইরা ফালামু' বলেই কিল, ঘুষি, লাথি মারতে থাকে। কেউ লাঠি দিয়ে পেটায়, কেউ রড দিয়ে পেটাতে থাকে। সন্ত্রাসীরা তাঁর চোখ উপড়ে ফেলার হুমকি দেয়। এ সময় সন্ত্রাসী সোলায়মান তাঁর চোখে বালু ঢুকিয়ে দেয়। এরপর শাহজাহানপুর কলোনির ভেতরে ঝুপড়ি ঘড়ে নিয়ে তাঁকে আরো মারধর করে তারা। ওই সময় সন্ত্রাসীরা তাঁর মাকে ফোন করে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে।
রনির মা সোনিয়া খাতুনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নামধারী সন্ত্রাসীরা তাঁর ছেলেকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে শাহজাহানপুরের কলোনির ভেতরে নিয়ে যায়। সেখানে আটকে রেখে প্রথমে তাঁকে মারধর করে। এরপর মোবাইল ফোনে তাঁর কাছেও ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে সন্ত্রাসীরা। টাকা না দিলে তাঁর ছেলের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালায়। মারধর করে। তিনি জানান, রাতে তাঁর ছেলেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
স্বর্ণ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাঁদা আদায়
শাহজাহানপুর এলাকার মালেক জুয়েলার্স নামের একটি স্বর্ণের দোকানের মালিক আব্দুল মালেক জানান, একদিন এক মহিলা তাঁর দোকান থেকে একটি নাকফুল কিনে নিয়ে যান। এক সপ্তাহ পর ওই মহিলা তাঁর দোকানে এসে বলেন সেই নাকফুল নকল, ইমিটেশন। এর কিছুক্ষণের মধ্যে পাটা সোহেল, রাজু, ফারুক, সালাউদ্দিন, রায়হান, কালু, রাসেল, লিটন, সুমনসহ তাদের সহযোগীরা তাঁর দোকানে আসে। তারা তাঁকে হুমকি দিয়ে ৬০ হাজার টাকা চাঁদা নিয়ে যায়। পরে জানা যায়, ওই মহিলা সন্ত্রাসীদের লোক। বিষয়টি নিয়ে থানার পুলিশকে জানালে হত্যার হুমকি দেয়। তিনি দাবি করেন, সন্ত্রাসীরা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ পরিচয়ে এলাকায় নীরবে চাঁদাবাজি করছে।
রনির মা সোনিয়া আক্তারসহ অন্যদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শাহজাহানপুর থানার ওসি আনিসুর রহমান বলেন, শাহজাহানপুর কলোনি এখন মাদকমুক্ত। ওই ঝুপড়ি ঘরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে তাঁর কাছে কোনো অভিযোগ দেয়নি কেউ। তবে ওই মহিলার ছেলেকে মারধরের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে সোলাইমান নামের এক সন্ত্রাসীকে আটক করা হয়েছে। তবে সোনিয়া আক্তারের অভিযোগ, থানায় অভিযোগ দেওয়ায় ওই সন্ত্রাসীরা তাঁকে এখনো হুমকি দিচ্ছে। মামলা দায়ের করতে নিষেধ করছে। পুলিশ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের হয়ে ওই মহিলার অভিযোগ ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে- এমন এক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওসি বলেন, এ অভিযোগ ঠিক নয়।

No comments

Powered by Blogger.