ব্যস্ত রাস্তায় রূপালীরা by মেহেরুন নেছা রুমা

পান্থপথ ট্রাফিক সিগন্যালে ধীরে ধীরে থেমে গেল গাড়ির চাকা। গ্গ্নাস নামানোই ছিল। দু'পাশ দিয়ে আট-দশ বছরের দুটি মেয়ে এসে গাড়ির মধ্যে উঁকি দিয়ে বলল, 'আফা, একটা মালা ন্যান।' আরেকটা মেয়ের হাতেও বেলী ও গাজরা ফুলের মালা। সেও বলে, 'আফা, আমারটা ন্যান, আমার মালা তাজা ফুলের।


অনেক সোন্দর গন্ধ।' আমি ওদের দু'জনকেই প্রথমে বললাম, 'আমার মালা লাগবে না, অন্যদিকে যা।' ওরা যায় না। একইভাবে দাঁড়িয়ে বলেই যাচ্ছে, 'নেন আফা আফনেরে অনেক সোন্দর লাগবো চুলে দিলে।' আরে আজব তো, কোনো উৎসব ছাড়া আমি কেন চুলে মালা পরতে যাব! একটু বিরক্তির সঙ্গে বললাম, 'বলেছি না লাগবে না, বিরক্ত করছিস কেন?' মেয়ে দুটিকে ধমক দিয়ে মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখি ডান পাশের মেয়েটা আরেকটা গাড়ির দরজায় টোকা দিচ্ছে। অন্যজনকে হাতের ইশারায় ডাক দিলাম। ব্যাগ থেকে দশটা টাকা বের করে দিয়ে বললাম, 'যা, নিয়ে যা।' মেয়েটা হাতের একটা মালা আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি বললাম, 'মালা লাগবে না। এটা তোকে এমনি দিলাম।' আমার দিকে চেয়ে একটা হাসি দিয়ে বলে, 'বখশিশ? সিগন্যালের সবুজ বাতি এখনও জ্বলছে না। টাকাটা দিয়ে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'নাম কী?' বলে, 'রূপালি।' 'বাহ, তোর নামটা তো অনেক সুন্দর।' আমার প্রশংসা শুনে সে আরও একগাল রূপালি হাসি দিল। বললাম, 'রাস্তায় এমন ফুল বিক্রি করিস, ভয় করে না? যদি গাড়ির নিচে পড়িস?' রূপালি বলে, 'ভয় করলে কি আর প্যাট চলবো আফা? আগে ডরাইতাম, এখন আর ডরাই না।' জিজ্ঞেস করলাম, 'কোথায় থাকিস, বাবা কী করে, ভাইবোন কয়জন? সব প্রশ্নের উত্তর দিল। তারপর বললাম, 'লেখাপড়া করিস?' মাথা দু'দিকে দুলিয়ে বলে, 'না।' 'কেন করিস না? তোদের মতো শিশুদের জন্য তো স্কুল আছে। সেখানে যেতে পারিস না? কাজের ফাঁকে পড়াশোনা করবি।' রূপালি বলে, 'আমার ভাইডা পড়ে, আমরা দুই বইন পড়ি না।' 'কেন পড়িস না?' বলে, 'রাস্তায় পোলাগো থিকা মাইয়্যাগো ব্যবসা ভালো হয় দেইখা আব্বা আমাগো দুই বোইনেরে দিয়া কাম করায়। আর ভাইডা পড়ে।' আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেল ওর কথা শুনে। কী বলে মেয়েটা! জিজ্ঞেস করলাম, 'কিসের ব্যবসা?' বলে, 'এই যে মালা বেচি। মাইয়্যারা ধরলে কেউ না কেউ নেয়ই। পোলারা আমাগো চাইতে বেশি বিক্রি করতে পারে না। মাইয়্যারা করুণ কইরা কিছু বললে আফনের মতো অনেকেরই মন গইল্যা যায়। ফুল না নিয়াও টেকা দেয়। তারপর ফুল বেচতে বেচতে পরিচিতি হইলে বড় হইলেও টেকা কামাই করন যায়। আব্বা কইছে।' সিগন্যালের সবুজ বাতি জ্বলে উঠলো, গাড়ি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার মাথার মধ্যে মেয়েটার কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। বেঁচে থাকার কত নির্মম উপায় শিখে যাচ্ছে এই শিশু বয়সেই মেয়েটি, তার দরিদ্র নিরক্ষর বাবার কাছ থেকে। কন্যাসন্তানের প্রতি বৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষিত সমাজে কিছুটা পরিবর্তন হলেও নিরক্ষর দরিদ্র শ্রেণীতে কতটা প্রকট তা আমরা জানি। প্রতিটি শিশুর শিক্ষার অধিকার আছে। মেয়ে বলে তাকে করুণার পাত্র হতে শিক্ষা না দিয়ে, সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মাথা উঁচু করে সমাজে চলতে শিক্ষা দেওয়ার পথ তৈরি করা আমাদের দায়িত্ব ।

No comments

Powered by Blogger.