তাৎক্ষণিক- কী লাভ হবে নতুন মন্ত্রী নিয়ে by আসিফ নজরুল

প্রথমে বড় খবর ছিল, সাতজন নতুন মন্ত্রী নেওয়া হচ্ছে। এ খবরকে ম্লান করে আরও বড় খবর হয়ে ওঠে তোফায়েল আহমেদ ও রাশেদ খান মেননের মন্ত্রী না হওয়ার সিদ্ধান্ত। এই পোড়া দেশে মন্ত্রী হওয়া এবং সাবেক মন্ত্রীর মর্যাদায় সারা জীবন থাকার লোভে বহু রাজনীতিবিদ দল, আদর্শ, এমনকি লোকলজ্জার ভয়কে বিসর্জন দিয়েছেন।


সেখানে তাঁদের মন্ত্রিসভায় যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নজিরবিহীন না হলেও অতিবিরল। বিশেষ করে রাশেদ খান মেননের জন্য, যিনি বহু বছর আগেও মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করেননি।
তোফায়েল আর মেনন সরকারের বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর ওবায়দুল কাদেরও তা-ই ছিলেন। মন্ত্রী হওয়ার পর সুরঞ্জিত সবাইকে হতাশ করে রেলের দুর্নীতির কালিমায় লিপ্ত হয়েছেন এবং একপর্যায়ে সরকারের বাধ্যগত মুখপাত্রে পরিণত হয়েছেন। ওবায়দুল কাদের নিজ মন্ত্রণালয়ে উদ্যোগী থেকেছেন, সরকারের সমালোচনা এড়িয়ে গেছেন। তাঁরা মন্ত্রী হওয়ার সময় এমন ইঙ্গিত ছিল যে সমালোচনাকারী হিসেবে তাঁদের মুখ বন্ধ করতেই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এবারের প্রেক্ষাপট শুধু তা নয়; অর্থ ও পুঁজিবাজারে চরম অব্যবস্থাপনা ও ব্যাংকিং সেক্টরে ভয়াবহ দুর্নীতি, পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে দেশে-বিদেশে উত্থাপিত চাঞ্চল্যকর অভিযোগ, শিক্ষাঙ্গনে বেহাল অবস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে সরকার তার শাসনকালের সবচেয়ে মন্দ সময় অতিবাহিত করছে এখন। সংসদে ও সংসদের বাইরে দল ও মহাজোটের নেতারা সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠছেন এই পরিস্থিতিতে। আন্তর্জাতিক বিশ্বেও পদ্মা সেতু, গ্রামীণ ব্যাংক, গুম ও ক্রসফায়ার এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে সমালোচিত হয়ে সরকার প্রায় একঘরে হয়ে পড়েছে। মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ তাই ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার এবং সরকার, দল ও জোটের শক্তি সংহতিকরণের একটি প্রচেষ্টা হিসেবেও দেখা যায়। বিশেষ করে নির্বাচনের কাছাকাছি সময়ে এ ধরনের রদবদল পৃথিবীর অনেক দেশে হয়ে থাকে।
তবে মন্ত্রিসভার এই সম্প্রসারণ সরকার ও আওয়ামী লীগের জন্য তেমন ফলদায়ক হবে না কয়েকটি কারণে। প্রথমত, এটি করা হয়েছে অনেক দেরি করে; ব্যর্থতা, অদক্ষতা ও দুর্নীতির অভিযোগে সরকার প্রায় নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার সময়ে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে নাগরিক সমাজের বহু মানুষ অন্তত বছর খানেক আগে মন্ত্রিসভার আশু রদবদল করা যে খুব প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল, তা বারবার ব্যাখ্যা করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী উল্টো জবাব দিয়ে বলেছেন যে স্যুটেড-বুটেড না হলেও তাঁর মন্ত্রিসভার সবাই দক্ষ! তাঁরা যে অধিকাংশই আসলে অদক্ষ এবং কেউ কেউ দুর্নীতিগ্রস্ত, তা মানুষের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ এত দিনে জন্মেছে। এসব ব্যাধি এখন এতটাই গুরুতর আকার ধারণ করেছে যে মন্ত্রিসভার বিলম্বিত সম্প্রসারণ তার নিরাময়ে কতটুকু কাজ দেবে, তা সন্দেহজনক। দ্বিতীয়ত, মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণে যাঁদের নাম সরকার প্রচার করেছিল, তাঁদের মধ্যে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে অনীহা জানিয়েছেন যে দুজন (তোফায়েল ও মেনন), তাঁরা রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা এবং ব্যক্তিত্বের দিক থেকে সবচেয়ে উজ্জ্বল ব্যক্তি। এটি সরকারের প্রতি দল ও জোটের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের অনাস্থাকে প্রকট করে তুলেছে। যাঁরা যোগ দিয়েছেন, তাঁরা বিতর্কিত কিংবা অনুল্লেখ্য। ফলে এই সমপ্রসারণ আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যেই বড় কোনো অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে পারবে বলে মনে হয় না। তৃতীয়ত, মন্ত্রিসভার ক্ষেত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় দাবি ছিল অযোগ্য, দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে অভিযুক্ত এবং অগ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের মন্ত্রিসভা ও উপদেষ্টামণ্ডলী থেকে বাতিল করা। মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের পর এই কাজটি অনতিবিলম্বে না করলে সরকারের সামগ্রিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে না। চতুর্থত, মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণের ঘোষণা সরকারের বহু সিদ্ধান্তের মতো আরও কিছু বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছে। সরকার কি এটি করার আগে তোফায়েল ও মেননের সঙ্গে কথা বলে নেয়নি, কেন তা হলে তাঁরা যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানালেন? তা ছাড়া তাঁরা অস্বীকৃতি জানানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সরকার নতুন দুজনের নাম ঘোষণা করে কী বার্তা দিতে চাইল দেশের মানুষকে? তোফায়েল ও মেনন কি ওই দুজন নেতা দ্বারা পরিবর্তনযোগ্য মাপের নেতা!
মন্ত্রিসভায় যাঁরা এসেছেন, তাঁরা সমঝোতার রাজনীতির লক্ষ্যে সরকারকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতাও রাখেন না। মহীউদ্দীন খান আলমগীর জনতার মঞ্চের সময়কাল থেকে বিতর্কিত এবং বিরোধী দলের কাছে অগ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। হাসানুল হক ইনু অদ্ভুত ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার অগণতান্ত্রিক হুংকার দিয়ে বিরোধী দলের কাছে নিন্দনীয় হয়েছেন। অন্যদের মধ্যে হুইপ মুজিবুল হক ছাড়া অন্যরা জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে অনুল্লেখ্য। তবে মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণে স্থানীয় নেতাদের অন্তর্ভুক্তি তৃণমূলের অনেক নেতা-কর্মীকে খুশি করতে পারে।
সরকারের এখন অনুধাবন করা প্রয়োজন, শেষ বারো/পনেরো মাসে বরং প্রয়োজন দেশকে কিছুটা হলেও সুশাসন প্রদান করা। বিরোধী দল, ভিন্নমতাবলম্বী, সাধারণ বিনিয়োগকারী, বুয়েটের বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের প্রতি কঠোর হওয়ার ঘোষণা না দিয়ে বা সত্যি সত্যি কঠোর না হয়ে সরকার যদি দুর্নীতিবাজ, ব্যাংক ও শেয়ারবাজার লোপাটকারী এবং ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর হয়, পদ্মা সেতু ও গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যুতে প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্ত নেয়, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে আন্তরিক আলোচনার ডাক দেয়, তা হলেই সরকারের জনপ্রিয়তা ও ভাবমূর্তি অনেকাংশে পুনরুদ্ধার হতে পারে। শেষ সময়ে মন্ত্রিসভায় অনুল্লেখ্য কিংবা বিতর্কিত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি তেমন কোনো সুফল বয়ে আনবে না।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.