নো ইজি ডেলাদের হত্যার প্রত্যক্ষ বয়ান-১- শিশু কোলে বেরিয়ে এল এক নারী by মশিউল আলম

‘...অভিযান এখন দ্রুত এগিয়ে চলেছে। প্রায় পাঁচ মিনিট হলো আমরা [হেলিকপ্টার থেকে] মাটিতে নেমেছি, বাড়িটার চত্বরের ভেতরে আমরা এখন ২৪ জন। অন্তত দুটো বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে [দেয়াল ভেঙে ভেতরে ঢোকার জন্য]। বিস্ফোরণ আর হেলিকপ্টারের শব্দে বাড়ির বাসিন্দারা নিশ্চয় টের পেয়ে গেছে, আমরা আসছি।


কোনো সন্দেহ নেই, ওরা আত্মরক্ষার জন্য ইতিমধ্যে প্রস্তুত!’
ওসামা বিন লাদেন হত্যা অভিযানে অংশগ্রহণকারী মার্কিন নেভি সিলের সদস্য ম্যাট বিসোনেটের প্রত্যক্ষ বয়ান থেকে কিছু অংশ আমরা প্রথম আলোর পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি। মার্ক ওয়েন ছদ্মনামে তাঁর লেখা বই নো ইজি ডে ৪ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এসেছে এবং বিক্রিতালিকায় শীর্ষে রয়েছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর বইটি প্রকাশের ব্যাপারে আপত্তি প্রকাশ করে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দিয়েছিল, তবে এখনো সে রকম কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। নেভি সিলের কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান সদস্য মার্ক ওয়েনকে (ম্যাট বিসোনেট) ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার গোপন নির্দেশে মার্কিন সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (সিআইএ) নেতৃত্বে ২০১১ সালের ১ মে দিবাগত রাতে পাকিস্তানের ইসলামাবাদের কাছাকাছি অ্যাবোটাবাদ শহরে লাদেনের গোপন আবাসস্থলে অভিযান চালানো হয়। আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি থেকে কয়েকটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে মার্কিন বিশেষ বাহিনী হামলা চালায় পাকিস্তান সরকারের অজ্ঞাতসারে। অ্যাবোটাবাদের ওই বাড়িটিতে ছিলেন ৫৪ বছর বয়সী লাদেন, তাঁর দুই স্ত্রী, ২৩ বছর বয়সী ছেলে খালিদ, তাঁর স্ত্রী, আল-কায়েদা সদস্য ও লাদেনের বার্তাবাহক দুই ভাই আরশাদ খান (আবু আহমেদ আল-কুয়েতি) ও আবরার খান, তাঁদের স্ত্রী-সন্তানেরা। সাত হাজার মাইল দূরে ওয়াশিংটন ডিসিতে বসে অভিযানটি ভিডিওতে সরাসরি মনিটর করেন প্রেসিডেন্ট ওবামা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা এজেন্সির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা।
ঘন আঁধারে ঢাকা ছিল সেই রাত। কিন্তু হত্যাকারী দলের হেলমেটগুলোর সঙ্গে লাগানো ছিল নাইট-ভিশন গগলস। তাঁরা সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন। লাদেনের বাড়ির চত্বরে ঢোকার পাঁচ মিনিট পর বিসোনেট লিখছেন: ‘আমার টিমের তৃতীয় সদস্যটি ঢুকে পড়ল চত্বরের ভেতরে। হেলিকপ্টার থেকে যারা সবশেষে নেমেছে, ও তাদের একজন। ওর কাজ একটা সিঁড়ি পরিষ্কার করা। দরজা বরাবর শুরু হয়ে সিঁড়িটা গিয়ে ঠেকেছে বৈঠকখানার ছাদে। ও যখন সেদিকে এগিয়ে গেল, দরজাটির ওপরের কাচ ভেঙে ছুটে আসতে লাগল একে-৪৭ অটোমেটিক রাইফেলের গুলি, অল্পের জন্য রক্ষা পেল সে। আমি সাৎ করে সরে এলাম, মাথার কয়েক ইঞ্চি ওপরে আঘাত হানল বুলেটের ঝাঁক। বিচূর্ণ কাচের আঘাত টের পেলাম কাঁধে।’
গুলির শব্দেই বিসোনেট টের পান, অস্ত্রটা একে-৪৭ স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। অভিযানে অংশগ্রহণকারী মার্কিন সেনাদের এ অস্ত্র নেই। তা ছাড়া যে শব্দ হলো, তাতে বিসোনেট বুঝলেন, ওটাতে শব্দনিরোধক (সাপ্রেসর) লাগানো নেই। মার্কিন সেনাদের সবার অস্ত্রে শব্দনিরোধক লাগানো আছে। তার মানে ওই গুলি ছুটে আসছে শত্রুপক্ষের দিক থেকে। বিসোনেটের মনে হলো, ‘ভেতরে একজনের হাতে আছে অ্যাসল্ট রাইফেল। বুক বরাবর তাক করে সে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুড়তে লেগেছে। উইল (বিসোনেটের সঙ্গী) দরজাটির বাঁ পাশ থেকে পাল্টা গুলি চালাতে শুরু করে দিল। আমিও পেছনে ঘুরে গুলি চালালাম।...আমাদের পাল্টা গুলির ঝাঁক ধাতব দরজাটি ভেদ করে ঢুকে গেল। দরজার কাছ থেকে ডিগবাজি দিয়ে সরে এসে আমি দাঁড়ালাম, তারপর এগিয়ে গেলাম একটা জানালার কাছে, সেটি দরজার দেয়ালটি থেকে কয়েক ফুট নিচে।
‘উইল চিৎকার করে ডাকল, “আল-কুয়েতি, বেরিয়ে এসো!”’
‘আমার অস্ত্রের নল দিয়ে জানালা ভেঙে আমি ভেতরে গুলি চালাতে লাগলাম। উইল চিৎকার করে চলল, কিন্তু কোনো সাড়া এল না। আমাদের সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই; ফিরে গেলাম আবার সেই ধাতব দরজার কাছে।’
গোলাগুলি শুরু হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে ম্যাট বিসোনেট ওই ধাতব দরজায় বিস্ফোরক লাগিয়েছিলেন। বিস্ফোরণ ঘটানো ছাড়া দরজাটি ভেঙে ভেতরে ঢোকার কোনো পথ তাঁদের ছিল না। কিন্তু সেটিতে ডেটোনেটর লাগানোর আগেই গোলাগুলি শুরু হলে তাঁকে সেখান থেকে সরে যেতে হয়েছিল। একটু পরে আবার তিনি সেখানে ফিরে আসেন ডেটোনেটর লাগিয়ে দরজাটি উড়িয়ে দিতে। এর আগে বাড়িটির ভেতরে ঢুকতে তাঁরা দেয়ালগুলোতে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গর্ত সৃষ্টি করেছেন; তারপর এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতেও একইভাবে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন।
ম্যাটের সহযোদ্ধা আহমেদ আল-কুয়েতি নামে যাঁকে চিৎকার করে ডাকছেন, ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে বলছেন, তিনি ওসামা বিন লাদেনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত অনুচর ও বার্তাবাহক শেখ আবু আহমেদ আরশাদ খান, একজন পাকিস্তানি পাখতুন। তাঁর জন্ম কুয়েতে, সেখানেই লেখাপড়া করেছেন বলে তাঁকে আল-কুয়েতিও বলা হয়। তিনি উচ্চশিক্ষিত; বলা হয়, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকায় সন্ত্রাসী হামলা চালানোর আগে হামলাকারীদের তিনি করাচিতে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। ২০০১ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন বাহিনী লাদেনকে ধরার জন্য আফগানিস্তানের তোরাবোরায় যখন হামলা চালিয়েছিল, আরশাদ খান তখন সেখানে লাদেনের সঙ্গে ছিলেন, লড়াই করেছিলেন এবং আহত হয়েছিলেন।
লাদেনের জীবনের শেষ মুহূর্তেও তিনি তাঁর পাশেই রয়েছেন। মার্কিন সেনারা তাঁকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানাচ্ছেন, কিন্তু তিনি তা করতে রাজি নন। সহযোদ্ধা উইলের ডাকে আল-কুয়েতির দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে ম্যাট বিসোনেটের মনে হচ্ছে, আল-কুয়েতি ভাঙবে, কিন্তু মচকাবে না, ‘বিনা লড়াইয়ে ছেড়ে দেবে না’। কিন্তু ম্যাট কোনো ঝুঁকি নিতে চান না, বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দরজাটা উড়িয়ে দিয়ে ঘরের ভেতরে ছুড়ে দেবেন গ্রেনেড। তিনি লিখছেন, ‘আমি দরজায় সাঁটা বিস্ফোরকের সঙ্গে ডেটোনেটর যুক্ত করতে যাব, এমন সময় শুনতে পেলাম, ভেতরে কেউ দরজার হুড়কোটা খুলে ফেলে দিল। উইলও সেটা শুনল। সঙ্গে সঙ্গে আমরা দরজা থেকে সরে আসতে লাগলাম। ব্যাপারটা কী? কে বেরিয়ে আসছে? সে কি দরজাটা একটু ফাঁকা করে আমাদের দিকে গ্রেনেড ছুড়ে মারবে? নাকি একে-৪৭ থেকে আমাদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলি চালাতে শুরু করবে?
‘আমি চটজলদি চারপাশটা চোখ বুলিয়ে নিলাম। না, কোনো আড়াল নেই, জায়গাটা গৃহস্থালি আবর্জনা আর বাগানে কাজ করার জিনিসপত্রে ভরা। আমাদের আত্মরক্ষার একমাত্র উপায় ক্রমাগত পেছনে সরে যাওয়া, ওই দরজা আর জানালা থেকে দূরে সরে যাওয়া।
‘শব্দ করে দরজাটি একটুখানি খুলে গেল। আমি এক মহিলার কণ্ঠ শুনতে পেলাম, তিনি আমাদের উদ্দেশে ডেকে উঠলেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমাদের আর কোনো ঝুঁকি নেই, এখন আমরা নিরাপদ। যদি সে নিজের শরীরে বোমা বেঁধে বেরিয়ে এসে থাকে, তাহলে আমরা শেষ! এটা লাদেনের বাড়ি। আর এসব লোকজন তাঁর সহযোগী। এখানে গোলাগুলি যখন শুরু হয়ে গেছে, তখন এরা নিশ্চয়ই লাদেনকে রক্ষা করার জন্য নিজেদের জান দিতে প্রস্তুত।
‘আমার গাল বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে, চোখে লেগে আছে হেলিকপ্টারের পাখার বাতাসের তোড়ে ছুটে আসা ধুলোবালি; আমার নাইট-ভিশন গগলসের ভেতর দিয়ে সবুজ আলোয় দেখতে পেলাম, দরজার ফাঁকে দাঁড়িয়ে আছে এক নারীমূর্তি। দুই হাতে সে কিছু একটা ধরে আছে, আমার অস্ত্রের ট্রিগারে ধীরে ধীরে চেপে আসতে শুরু করল আমার আঙুল। আমি দেখছি, মহিলার মাথার চারপাশে চক্কর খেয়ে নাচছে আমাদের লেজারযন্ত্রের রশ্মিগুলো...।
‘দরজাটি আরও খানিকটা খুলে গেলে আমি দেখতে পেলাম, মহিলার কোলে কাপড়ে মোড়ানো একটি শিশু। আল-কুয়েতির স্ত্রী মরিয়ম বাচ্চাকে বুকের মধ্যে ধরে দরজা দিয়ে বের হয়ে এলেন। তাঁর পেছনে বেরিয়ে এল আরও তিনটি শিশু।
‘“এখানে এসো”—ওদের উদ্দেশে আরবিতে ডেকে উঠল উইল।
‘ওরা সামনের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল। আমি ওদের দিকে অস্ত্র তাক করে রইলাম।
‘“সে মারা গেছে”, মরিয়ম আরবিতে বললেন উইলকে, “আপনারা তাকে গুলি করেছেন। সে মরে গেছে। আপনারা তাকে মেরে ফেলেছেন।”
‘উইল মহিলাকে থামিয়ে দিয়ে তার আরবি উক্তি আমাকে অনুবাদ করে বলল, “এই! মহিলা বলছে, লোকটা মারা গেছে!”
‘আমি উবু হয়ে ডান পাশ থেকে ঠেলে দরজাটা খুললাম।
‘শোবার ঘরের দরজার কাছে মেঝেতে দেখতে পেলাম এক জোড়া পা। বোঝার কোনো উপায় নেই বেঁচে আছে, না মারা গেছে। কিন্তু আমি কোনো ঝুঁকি নিতে চাই না। উইল আমার কাঁধে চাপ দিল। বুঝলাম সে প্রস্তুত। আমরা ভেতরে ঢুকে পড়লাম। আমি আমার রাইফেলটা কাঁধে তুলে নিলাম, আল-কুয়েতির মৃত্যু নিশ্চিত করতে কয়েকটি গুলি ছুড়লাম।
‘ঘরময় কেরোসিনের গন্ধ; আল-কুয়েতির লাশ ডিঙিয়ে আমি এগিয়ে গেলাম। শোবার ঘরের দরজার দেখতে পেলাম, মেঝেতে পড়ে আছে একটি পিস্তল আর একটি একে-৪৭ রাইফেল। লাথি মেরে সেগুলো সরিয়ে দিয়ে আমি ঘরটির চারপাশে তাকালাম: ঘরের মাঝখানে একটা খাট, তারপর দেয়ালের পাশে বাচ্চাদের কয়েকটি ছোট ছোট খাট। পুরো পরিবারটি মনে হয় এই ঘরেই ঘুমাত।...পানি আর আল-কুয়েতির রক্তে পিচ্ছিল হয়ে আছে মেঝে। রক্ত গড়িয়ে এসেছে অন্য ঘরটিতেও, আমাদের বুটের নিচে রক্ত।’
মশিউল আলম: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.