একুশ শতক- ইন্টারনেট ও সাংস্কৃতিক রূপান্তর by মোস্তাফা জব্বার
॥ দুই ॥ (গত সপ্তাহে আমরা ইন্টারনেটের বিকাশ ও বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট যুগের বিস্তার নিয়ে আলোচনা করেছি। এবার আমরা মোবাইল ফোনসহ এর প্রভাব ও নতুন সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করছি। সামনের সপ্তাহেও এই আলোচনা অব্যাহত থাকবে। বরাবরের মতো এবারও সাম্প্রতিক অন্য প্রসঙ্গও আলোচনা করা হলো।
এবার তাতে মন্ত্রিসভার রদবদল প্রসঙ্গ অতি সংক্ষেপে আলোচিত হলো)
ইন্টারনেট ও মোবাইল : আমাদের আলোচনার মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় ইন্টারনেট ও সংস্কৃতি হলেও এর সঙ্গে মোবাইলকে সম্পৃক্ত করতেই হচ্ছে। কারণ আমাদের ডিজিটাল সভ্যতার হাতেখড়ি মোবাইল থেকে। আমাদের দেশের ইন্টারনেটের ব্যবহারকারীর বিষয়টির প্রতি নজর দিলেই সেটি উপলব্ধি করা যাবে। জুলাই ২০১২ সালের হিসাব অনুসারে এদেশে যে ২.৯৪ কোটি লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করে তার ২.৭৭ কোটি লোকই মোবাইলের সহায়তায় ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। অন্যদিকে দেশের প্রায় সাড়ে ৯ কোটি লোক মোবাইল ব্যবহার করে। ব্যক্তি-সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের জীবনধারা এটি কত বড় একটি ঘটনা সেটি আমরা খুব সহজেই আন্দাজ করতে পারি। আমাদের সভ্যতার ইতিহাসে আমরা এমনকি এত লোক কোনকালে লাঙ্গলও ব্যবহার করিনি। আমরা সবাই প্রায় নিশ্চিত যে আগামী এক দশকে আমাদের মোবাইল ব্যবহার সম্ভবত জনপ্রতি একাধিক হয়ে যেতে পারে। দুনিয়ার অনেক দেশে জনসংখ্যার চাইতে মোবাইলের সংযোগ অনেক বেশি। জার্মানি, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, রাশিয়া এসব দেশ এই তালিকায় আছে। ২০১১ সালের হিসাব অনুসারে দুনিয়ার সাত শ’ কোটি লোকের মাঝে ৫৬০ কোটি মোবাইল সংযোগ ছিল। বর্তমানে বাংলাদেশ দুনিয়ার ১২তম মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী দেশ। সবচেয়ে বেশি মোবাইল সংযোগ রয়েছে চীনে। দুনিয়ার জনসংখ্যার অনুপাতে মোবাইল ব্যবহারকারীর গড় প্রায় ৮০ শতাংশ হলেও বাংলাদেশের গড় এখনও শতকরা ৬২।
মোবাইল ও ইন্টারনেটের প্রভাব : খুব সঙ্গত কারণেই মোবাইলের ব্যবহারের সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির মান যুক্ত আছে। আরও একটি বিষয় উপলব্ধি করা জরুরী। আমরা ব্যাপকহারে ইন্টারনেট ব্যবহার করার আগে মোবাইল ব্যবহার করা শুরু করেছি। এমনকি কম্পিউটারের অনুপ্রবেশের চাইতেও বহুগুণ বেশি হয়েছে মোবাইল বা ইন্টারনেটের অনুপ্রবেশ। যদিও ১৯৬৪ সালে আমাদের দেশে কম্পিউটার এসেছে এবং ১৯৮৭ সালে কম্পিউটারে বাংলা প্রয়োগ, ডিটিপি বিপ্লব ও মেকিন্টোসের ইন্টারফেসের বদৌলতে আমাদের কম্পিউটার ব্যবহারের মাত্রা গতি পেয়েছে, তথাপি মোবাইলই হলো প্রথম ডিজিটাল প্রযুক্তি যেটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ করেছে। সমাজের সকল স্তরে এভাবে আর কোন ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রবেশ করেনি। আমরা রেডিও-টিভির কথা ধরতে পারি। সেসব প্রযুক্তি অনেক আগেই এসেছে। কিন্তু যেভাবে মোবাইল এসেছে সেভাবে আর কেউ আসেনি। রেডিও-টিভি ছিল একপক্ষীয় কর্মকা-। এসব থেকে আমরা তথ্য পেতাম। কিন্তু মোবাইল হলো দ্বিপক্ষীয়, ইন্টারএ্যাকটিভ ও যোগাযোগ মাধ্যম। ফলে এটি কেবলমাত্র ফোনের প্রযুক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এটি এসএমএস-এর সহায়তায় ডাটা আদান প্রদানে আমাদের যুক্ত করেছে। এতে সাউন্ড ও ভিডিও যুক্ত হয়েছে এবং ইন্টারনেটের সহায়তায় ডিজিটাল সভ্যতা বা জ্ঞানভিত্তিক সভ্যতার মাঝে নিয়ে গেছে। আমি নিজে বিশ্বাস করি, মোবাইলের মতো একটি যন্ত্র যাতে ইন্টারনেট ও কথা বলার সুযোগ থাকবে সেটিই হবে আগামী দিনের ডিজিটাল যন্ত্র। যা হোক ইন্টারনেটই যে সকল প্রযুক্তির কেন্দ্র হবে সেটি নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।
ফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে মোবাইলের বদৌলতে টেলিঘনত্বের মাপকাঠিতে অনেক উপরে আছি আমরা। আমাদের মোবাইলের ব্যবহারও অবিশ্বাস্য গতিতে বেড়েছে। কোন সন্দেহ নেই যে, উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের অল্প বয়সের মানুষেরা এতে বেশি করে যুক্ত হচ্ছেন। মোবাইল ও ইন্টারনেট নামক ডিজিটাল যুগের দুটি যোগাযোগ মাধ্যমের প্রসারের ফলে দেশের সার্বিক অগ্রগতি হবে এটি অর্থনীতিবিদদের সাধারণ বক্তব্য। কোন দেশে শতকরা ১০ ভাগ যোগাযোগ প্রবৃদ্ধি জাতীয় আয়ের ক্ষেত্রে অন্তত শতকরা ১ ভাগ প্রভাব ফেলে সেটি প্রায় সকল মতের অর্থনীতিবিদরাই মনে করেন। সেই ধারণা থেকে আমাদের জাতীয় আয়েও মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারের পরিমাণ বাড়াটা সুখের বিষয়। স্বাভাবিকভাবে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যদি সাত ভাগ হয় তবে আইসিটির জন্য সেটি ৮ ভাগেরও বেশি হওয়া উচিত।
সার্বিকভাবে ইন্টারনেটের প্রভাব এখন আর আগের মতো ই-মেইল, ফেসবুক, টুইটার বা গুগল সার্চের মাঝেই সীমিত নয়। বিশেষ করে থ্রিজি বা ৪জি প্রযুক্তির বদৌলতে ইন্টারনেট একটি ডিজিটাল জীবনধারা গড়ে তুলছে। আমি এক কথায় বলব মানব সভ্যতা এর আগে আর কখনও এমন গভীর প্রভাব বিস্তারকারী প্রযুক্তির মুখোমুখি হয়নি।
মোবাইল, ইন্টারনেট ও সংস্কৃতি : মোবাইল ও ইন্টারনেট সংস্কৃতিতে কি প্রভাব ফেলবে সেই আলোচনা করতে হলে প্রথমেই বুঝতে হবে এইসব প্রযুক্তি মানুষের জীবনধারায় কি পরিবর্তন এনেছে। উনিশ শতকের আশির দশকের মাঝামাঝিতে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের টেলিফোন এবং ১৯৬০ সালে পরস্পরের তথ্য বিনিময়ের নেটওয়ার্ক কালক্রমে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব হয়ে এখন যখন মোবাইল ও ইন্টারনেটের সভ্যতা তৈরি করেছে তখন বস্তুত এটি জীবনের প্রায় সকল অলিন্দ্যে প্রবেশ করে বসে আছে। মোবাইল তো বটেই ইন্টারনেট এখন জীবনের সকল যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, ভাব বিনিময়, তথ্য-উপাত্ত বিনিময় ও সামাজিক-ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যম। এটি এখন কেবল কথা বা লেখা বিনিময় করে না, সাউন্ড, ভিডিও-এর পাশাপাশি একটি চমৎকার ইন্টারএ্যাকটিভ মাধ্যম হিসেবে এই প্রযুক্তি গড়ে উঠেছে। থ্রিজি প্রযুক্তির মোবাইল থেকেই আমরা বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ স্যাটেলাইট টিভিগুলো মোবাইল ফোনে দেখব। ইন্টারনেট মাধ্যমটি এখন টিভি দেখার, ভিডিও দেখার, গান শোনার, সিনেমা দেখার এবং লেখাপড়া করার শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম। এই মাধ্যমটি এখন ব্যবসা-বাণিজ্যের বা শিল্প কলখানার কেন্দ্রবিন্দু। এমনকি ইন্টারনেট এখন রাজনীতির সবচেয়ে বড় মাধ্যম। রাজনীতিবিদ-মন্ত্রী, সাংসদরা এখন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে তার মনের ভাব প্রকাশ করছেন। ওবায়দুল কাদের গত ১৩ সেপ্টেম্বর জানান যে তিনি রেল মন্ত্রী থাকছেন না।
সংস্কৃতি যদি জীবনবোধ, জীবনধারা, জীবনাচার, সমাজ, সভ্যতা; আনন্দ-বিনোদন থেকে শিক্ষা-সাহিত্য, ব্যবসা ইত্যাদির সব কিছুকে বোঝায় তবে অন্য সকল মাধ্যম হলো আংশিক বাহক, কেবলমাত্র ইন্টারনেটই এখন সংস্কৃতির সবটাকে ধারণ করে।
খুব সহজেই যে কেউ এটি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ধারণা করতে পারেন যে, সংস্কৃতির পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হিসেবে ইন্টারনেটনির্ভর। আমাদের এটি বোঝা উচিত যে, আমরা যেসব উপাদান দিয়ে সংস্কৃতির রূপান্তরকে বিবেচনা করে থাকি তার সবই এখন ইন্টারনেটকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। আমরা যদি আরও কয়েক বছর পরের কথা বিবেচনা করি তবে যেসব সাংস্কৃতিক মাধ্যমগুলো এখনও আলাদা আছে যেমন, সিডি-ডিভিডি, বই, রেডিও, টিভি; সেগুলোর চাইতে বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠবে ইন্টারনেট। অন্য অর্থে বলা যায় যে, এসব মাধ্যম টিকে থাকলেও তার ভিত্তি হিসেবে ইন্টারনেটই থাকবে। আমি এই কারণেই মনে করি ভবিষ্যতে সংস্কৃতির মানদ- বিবেচনা করার সময় প্রথমেই ইন্টারনেটকেই ভাবতে হবে। (চলবে)
অন্যপ্রসঙ্গ ॥ সাত তেরো : গত বৃহস্পতিবার ১৩ অক্টোবর বিকেলে শেখ হাসিনার সরকারের ১৫ মাস সময় থাকতে ৭ মন্ত্রীকে নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে। এর মাঝে ৫ জন মন্ত্রী ও ২ জন প্রতিমন্ত্রী আছেন। সাতজনের ছয় জনই আওয়ামী লীগের। তাদের মন্ত্রিত্বে তেমন নতুনত্ব নেই। অন্যদিকে জাসদের সভাপতি জনাব হাসানুল হক ইনুর দল জাসদের জন্য এটিই প্রথম মন্ত্রিত্বের স্বাদ। ৪০ বছর আগে জাসদ গঠনের পর জাসদের একাংশের নেতা আসম আব্দুর রব সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হন। তাকে এরশাদের গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা বলা হতো। জাসদ ঘরানার জিয়াউদ্দিন বাবলু এরশাদের প্রতিমন্ত্রী হন। জাসদের জন্মকালীন সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ হন বেগম জিয়ার মন্ত্রী। তবে হাসানুল হক ইনু, যিনি এখনও জাসদের মূল স্রোত ধরে রাখছেন তাঁর দলের পক্ষ থেকে এবারই প্রথম মন্ত্রিত্ব পাওয়া। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বেঁধে প্রায় ৪ বছর পার করার পর এই মন্ত্রিত্ব জাসদের কাছে গুরুত্ব বহন করে। এই অক্টোবরে দলটি যখন তার প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর উদ্যাপন করছে তখন এই নতুন মাত্রাটি তাদের জন্য অনেকটাই আশার সঞ্চার করবে।
এবারের পরিবর্তনের নতুন মাত্রা হলো যে ২ জন মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে অনীহা প্রকাশ করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি নেতা রাশেদ খান মেননের মন্ত্রিত্বের অফার ছিল। তাঁরা সেটি নেননি। তাঁদের প্রত্যাখ্যানেও একটি নতুনত্ব এনেছে। মন্ত্রিত্ব পাবার অফার ত্যাগ করার এমন দৃষ্টান্তের কথা আমার জানা নেই। এতে রাজনীতিবিদরা কেবল মন্ত্রিত্বের জন্য, পদের জন্য বা লোভে পড়ে রাজনীতি করেন সেটি অসত্য প্রমাণিত হলো। ’৬৯-এর গণআন্দোলনের নেতা তোফায়েল ও সেই সময়কালেই ছাত্র নেতা মেনন তাই দেশের বিবেকবান মানুষদের অভিনন্দন পেয়েছেন।
সাম্প্রতিককালে সুরঞ্জিত সেনকে দফতরবিহীন মন্ত্রী বানানো ও সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগ এবং সরকার পরিচালনা বিষয়ে নানা জটিলতার কারণে এমন একটি রদবদল অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। রেল পথের জন্য মন্ত্রী নিয়োগের পাশাপাশি আইসিটির জন্য মন্ত্রী নিয়োগ করা প্রয়োজন ছিল।
এই লেখাটি যখন ছাপা হবে তখন মন্ত্রীদের দফতরও বণ্টন হয়ে যাবে। আমি ধারণা করি রেলপথ ও আইসিটি উভয় মন্ত্রণালয়ে যোগ্য মন্ত্রী পাওয়া যাবে। প্রায় এক বছর আগে গড়ে তোলা আইসিটি মন্ত্রণালয় তাতে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে। কারণ মন্ত্রণালয় গঠনের পর পুরো বছর জুড়েই মন্ত্রী সংক্রান্ত জটিলতায় ভুগেছে মন্ত্রণালয়টি। শেখ হাসিনা সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচী তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিপুল পরিমাণ অতি জরুরী কাজের শেকলে বন্দী হয়ে আছে মন্ত্রণালয়টি। আশা করি এতে একজন যোগ্য ব্যক্তি দায়িত্ব নেবেন। বিশেষ করে হাসানুল হক ইনু যিনি নিজে প্রকৌশলী ও মন্ত্রিসভার সবচেয়ে আইসিটিপ্রেমিক মানুষ তাঁকেই এই দায়িত্ব প্রদান করা হতে পারে। তিনি টিএ্যান্ডটি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে এদেশের তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে যে অবদান রেখেছেন সেটি প্রশংসা করার মতো। আমি আরও খুশি হবো; একইসঙ্গে যদি আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়কেও যুক্ত করা হয়।
ঢাকা, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ॥ লেখক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর প্রণেতা ॥ ই-মেইল : mustafajabbar@gmail.com, ওয়েবপেজ: www.bijoyekushe.net
ইন্টারনেট ও মোবাইল : আমাদের আলোচনার মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় ইন্টারনেট ও সংস্কৃতি হলেও এর সঙ্গে মোবাইলকে সম্পৃক্ত করতেই হচ্ছে। কারণ আমাদের ডিজিটাল সভ্যতার হাতেখড়ি মোবাইল থেকে। আমাদের দেশের ইন্টারনেটের ব্যবহারকারীর বিষয়টির প্রতি নজর দিলেই সেটি উপলব্ধি করা যাবে। জুলাই ২০১২ সালের হিসাব অনুসারে এদেশে যে ২.৯৪ কোটি লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করে তার ২.৭৭ কোটি লোকই মোবাইলের সহায়তায় ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। অন্যদিকে দেশের প্রায় সাড়ে ৯ কোটি লোক মোবাইল ব্যবহার করে। ব্যক্তি-সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের জীবনধারা এটি কত বড় একটি ঘটনা সেটি আমরা খুব সহজেই আন্দাজ করতে পারি। আমাদের সভ্যতার ইতিহাসে আমরা এমনকি এত লোক কোনকালে লাঙ্গলও ব্যবহার করিনি। আমরা সবাই প্রায় নিশ্চিত যে আগামী এক দশকে আমাদের মোবাইল ব্যবহার সম্ভবত জনপ্রতি একাধিক হয়ে যেতে পারে। দুনিয়ার অনেক দেশে জনসংখ্যার চাইতে মোবাইলের সংযোগ অনেক বেশি। জার্মানি, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, রাশিয়া এসব দেশ এই তালিকায় আছে। ২০১১ সালের হিসাব অনুসারে দুনিয়ার সাত শ’ কোটি লোকের মাঝে ৫৬০ কোটি মোবাইল সংযোগ ছিল। বর্তমানে বাংলাদেশ দুনিয়ার ১২তম মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী দেশ। সবচেয়ে বেশি মোবাইল সংযোগ রয়েছে চীনে। দুনিয়ার জনসংখ্যার অনুপাতে মোবাইল ব্যবহারকারীর গড় প্রায় ৮০ শতাংশ হলেও বাংলাদেশের গড় এখনও শতকরা ৬২।
মোবাইল ও ইন্টারনেটের প্রভাব : খুব সঙ্গত কারণেই মোবাইলের ব্যবহারের সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির মান যুক্ত আছে। আরও একটি বিষয় উপলব্ধি করা জরুরী। আমরা ব্যাপকহারে ইন্টারনেট ব্যবহার করার আগে মোবাইল ব্যবহার করা শুরু করেছি। এমনকি কম্পিউটারের অনুপ্রবেশের চাইতেও বহুগুণ বেশি হয়েছে মোবাইল বা ইন্টারনেটের অনুপ্রবেশ। যদিও ১৯৬৪ সালে আমাদের দেশে কম্পিউটার এসেছে এবং ১৯৮৭ সালে কম্পিউটারে বাংলা প্রয়োগ, ডিটিপি বিপ্লব ও মেকিন্টোসের ইন্টারফেসের বদৌলতে আমাদের কম্পিউটার ব্যবহারের মাত্রা গতি পেয়েছে, তথাপি মোবাইলই হলো প্রথম ডিজিটাল প্রযুক্তি যেটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ করেছে। সমাজের সকল স্তরে এভাবে আর কোন ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রবেশ করেনি। আমরা রেডিও-টিভির কথা ধরতে পারি। সেসব প্রযুক্তি অনেক আগেই এসেছে। কিন্তু যেভাবে মোবাইল এসেছে সেভাবে আর কেউ আসেনি। রেডিও-টিভি ছিল একপক্ষীয় কর্মকা-। এসব থেকে আমরা তথ্য পেতাম। কিন্তু মোবাইল হলো দ্বিপক্ষীয়, ইন্টারএ্যাকটিভ ও যোগাযোগ মাধ্যম। ফলে এটি কেবলমাত্র ফোনের প্রযুক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এটি এসএমএস-এর সহায়তায় ডাটা আদান প্রদানে আমাদের যুক্ত করেছে। এতে সাউন্ড ও ভিডিও যুক্ত হয়েছে এবং ইন্টারনেটের সহায়তায় ডিজিটাল সভ্যতা বা জ্ঞানভিত্তিক সভ্যতার মাঝে নিয়ে গেছে। আমি নিজে বিশ্বাস করি, মোবাইলের মতো একটি যন্ত্র যাতে ইন্টারনেট ও কথা বলার সুযোগ থাকবে সেটিই হবে আগামী দিনের ডিজিটাল যন্ত্র। যা হোক ইন্টারনেটই যে সকল প্রযুক্তির কেন্দ্র হবে সেটি নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।
ফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে মোবাইলের বদৌলতে টেলিঘনত্বের মাপকাঠিতে অনেক উপরে আছি আমরা। আমাদের মোবাইলের ব্যবহারও অবিশ্বাস্য গতিতে বেড়েছে। কোন সন্দেহ নেই যে, উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের অল্প বয়সের মানুষেরা এতে বেশি করে যুক্ত হচ্ছেন। মোবাইল ও ইন্টারনেট নামক ডিজিটাল যুগের দুটি যোগাযোগ মাধ্যমের প্রসারের ফলে দেশের সার্বিক অগ্রগতি হবে এটি অর্থনীতিবিদদের সাধারণ বক্তব্য। কোন দেশে শতকরা ১০ ভাগ যোগাযোগ প্রবৃদ্ধি জাতীয় আয়ের ক্ষেত্রে অন্তত শতকরা ১ ভাগ প্রভাব ফেলে সেটি প্রায় সকল মতের অর্থনীতিবিদরাই মনে করেন। সেই ধারণা থেকে আমাদের জাতীয় আয়েও মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারের পরিমাণ বাড়াটা সুখের বিষয়। স্বাভাবিকভাবে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যদি সাত ভাগ হয় তবে আইসিটির জন্য সেটি ৮ ভাগেরও বেশি হওয়া উচিত।
সার্বিকভাবে ইন্টারনেটের প্রভাব এখন আর আগের মতো ই-মেইল, ফেসবুক, টুইটার বা গুগল সার্চের মাঝেই সীমিত নয়। বিশেষ করে থ্রিজি বা ৪জি প্রযুক্তির বদৌলতে ইন্টারনেট একটি ডিজিটাল জীবনধারা গড়ে তুলছে। আমি এক কথায় বলব মানব সভ্যতা এর আগে আর কখনও এমন গভীর প্রভাব বিস্তারকারী প্রযুক্তির মুখোমুখি হয়নি।
মোবাইল, ইন্টারনেট ও সংস্কৃতি : মোবাইল ও ইন্টারনেট সংস্কৃতিতে কি প্রভাব ফেলবে সেই আলোচনা করতে হলে প্রথমেই বুঝতে হবে এইসব প্রযুক্তি মানুষের জীবনধারায় কি পরিবর্তন এনেছে। উনিশ শতকের আশির দশকের মাঝামাঝিতে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের টেলিফোন এবং ১৯৬০ সালে পরস্পরের তথ্য বিনিময়ের নেটওয়ার্ক কালক্রমে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব হয়ে এখন যখন মোবাইল ও ইন্টারনেটের সভ্যতা তৈরি করেছে তখন বস্তুত এটি জীবনের প্রায় সকল অলিন্দ্যে প্রবেশ করে বসে আছে। মোবাইল তো বটেই ইন্টারনেট এখন জীবনের সকল যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, ভাব বিনিময়, তথ্য-উপাত্ত বিনিময় ও সামাজিক-ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যম। এটি এখন কেবল কথা বা লেখা বিনিময় করে না, সাউন্ড, ভিডিও-এর পাশাপাশি একটি চমৎকার ইন্টারএ্যাকটিভ মাধ্যম হিসেবে এই প্রযুক্তি গড়ে উঠেছে। থ্রিজি প্রযুক্তির মোবাইল থেকেই আমরা বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ স্যাটেলাইট টিভিগুলো মোবাইল ফোনে দেখব। ইন্টারনেট মাধ্যমটি এখন টিভি দেখার, ভিডিও দেখার, গান শোনার, সিনেমা দেখার এবং লেখাপড়া করার শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম। এই মাধ্যমটি এখন ব্যবসা-বাণিজ্যের বা শিল্প কলখানার কেন্দ্রবিন্দু। এমনকি ইন্টারনেট এখন রাজনীতির সবচেয়ে বড় মাধ্যম। রাজনীতিবিদ-মন্ত্রী, সাংসদরা এখন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে তার মনের ভাব প্রকাশ করছেন। ওবায়দুল কাদের গত ১৩ সেপ্টেম্বর জানান যে তিনি রেল মন্ত্রী থাকছেন না।
সংস্কৃতি যদি জীবনবোধ, জীবনধারা, জীবনাচার, সমাজ, সভ্যতা; আনন্দ-বিনোদন থেকে শিক্ষা-সাহিত্য, ব্যবসা ইত্যাদির সব কিছুকে বোঝায় তবে অন্য সকল মাধ্যম হলো আংশিক বাহক, কেবলমাত্র ইন্টারনেটই এখন সংস্কৃতির সবটাকে ধারণ করে।
খুব সহজেই যে কেউ এটি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ধারণা করতে পারেন যে, সংস্কৃতির পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হিসেবে ইন্টারনেটনির্ভর। আমাদের এটি বোঝা উচিত যে, আমরা যেসব উপাদান দিয়ে সংস্কৃতির রূপান্তরকে বিবেচনা করে থাকি তার সবই এখন ইন্টারনেটকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। আমরা যদি আরও কয়েক বছর পরের কথা বিবেচনা করি তবে যেসব সাংস্কৃতিক মাধ্যমগুলো এখনও আলাদা আছে যেমন, সিডি-ডিভিডি, বই, রেডিও, টিভি; সেগুলোর চাইতে বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠবে ইন্টারনেট। অন্য অর্থে বলা যায় যে, এসব মাধ্যম টিকে থাকলেও তার ভিত্তি হিসেবে ইন্টারনেটই থাকবে। আমি এই কারণেই মনে করি ভবিষ্যতে সংস্কৃতির মানদ- বিবেচনা করার সময় প্রথমেই ইন্টারনেটকেই ভাবতে হবে। (চলবে)
অন্যপ্রসঙ্গ ॥ সাত তেরো : গত বৃহস্পতিবার ১৩ অক্টোবর বিকেলে শেখ হাসিনার সরকারের ১৫ মাস সময় থাকতে ৭ মন্ত্রীকে নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে। এর মাঝে ৫ জন মন্ত্রী ও ২ জন প্রতিমন্ত্রী আছেন। সাতজনের ছয় জনই আওয়ামী লীগের। তাদের মন্ত্রিত্বে তেমন নতুনত্ব নেই। অন্যদিকে জাসদের সভাপতি জনাব হাসানুল হক ইনুর দল জাসদের জন্য এটিই প্রথম মন্ত্রিত্বের স্বাদ। ৪০ বছর আগে জাসদ গঠনের পর জাসদের একাংশের নেতা আসম আব্দুর রব সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হন। তাকে এরশাদের গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা বলা হতো। জাসদ ঘরানার জিয়াউদ্দিন বাবলু এরশাদের প্রতিমন্ত্রী হন। জাসদের জন্মকালীন সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ হন বেগম জিয়ার মন্ত্রী। তবে হাসানুল হক ইনু, যিনি এখনও জাসদের মূল স্রোত ধরে রাখছেন তাঁর দলের পক্ষ থেকে এবারই প্রথম মন্ত্রিত্ব পাওয়া। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বেঁধে প্রায় ৪ বছর পার করার পর এই মন্ত্রিত্ব জাসদের কাছে গুরুত্ব বহন করে। এই অক্টোবরে দলটি যখন তার প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর উদ্যাপন করছে তখন এই নতুন মাত্রাটি তাদের জন্য অনেকটাই আশার সঞ্চার করবে।
এবারের পরিবর্তনের নতুন মাত্রা হলো যে ২ জন মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে অনীহা প্রকাশ করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি নেতা রাশেদ খান মেননের মন্ত্রিত্বের অফার ছিল। তাঁরা সেটি নেননি। তাঁদের প্রত্যাখ্যানেও একটি নতুনত্ব এনেছে। মন্ত্রিত্ব পাবার অফার ত্যাগ করার এমন দৃষ্টান্তের কথা আমার জানা নেই। এতে রাজনীতিবিদরা কেবল মন্ত্রিত্বের জন্য, পদের জন্য বা লোভে পড়ে রাজনীতি করেন সেটি অসত্য প্রমাণিত হলো। ’৬৯-এর গণআন্দোলনের নেতা তোফায়েল ও সেই সময়কালেই ছাত্র নেতা মেনন তাই দেশের বিবেকবান মানুষদের অভিনন্দন পেয়েছেন।
সাম্প্রতিককালে সুরঞ্জিত সেনকে দফতরবিহীন মন্ত্রী বানানো ও সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগ এবং সরকার পরিচালনা বিষয়ে নানা জটিলতার কারণে এমন একটি রদবদল অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। রেল পথের জন্য মন্ত্রী নিয়োগের পাশাপাশি আইসিটির জন্য মন্ত্রী নিয়োগ করা প্রয়োজন ছিল।
এই লেখাটি যখন ছাপা হবে তখন মন্ত্রীদের দফতরও বণ্টন হয়ে যাবে। আমি ধারণা করি রেলপথ ও আইসিটি উভয় মন্ত্রণালয়ে যোগ্য মন্ত্রী পাওয়া যাবে। প্রায় এক বছর আগে গড়ে তোলা আইসিটি মন্ত্রণালয় তাতে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে। কারণ মন্ত্রণালয় গঠনের পর পুরো বছর জুড়েই মন্ত্রী সংক্রান্ত জটিলতায় ভুগেছে মন্ত্রণালয়টি। শেখ হাসিনা সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচী তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিপুল পরিমাণ অতি জরুরী কাজের শেকলে বন্দী হয়ে আছে মন্ত্রণালয়টি। আশা করি এতে একজন যোগ্য ব্যক্তি দায়িত্ব নেবেন। বিশেষ করে হাসানুল হক ইনু যিনি নিজে প্রকৌশলী ও মন্ত্রিসভার সবচেয়ে আইসিটিপ্রেমিক মানুষ তাঁকেই এই দায়িত্ব প্রদান করা হতে পারে। তিনি টিএ্যান্ডটি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে এদেশের তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে যে অবদান রেখেছেন সেটি প্রশংসা করার মতো। আমি আরও খুশি হবো; একইসঙ্গে যদি আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়কেও যুক্ত করা হয়।
ঢাকা, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ ॥ লেখক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর প্রণেতা ॥ ই-মেইল : mustafajabbar@gmail.com, ওয়েবপেজ: www.bijoyekushe.net
No comments