মুক্তিযুদ্ধকালে চট্টগ্রামে ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন মীর কাশেম- যুদ্ধাপরাধী বিচার- সেফ হোমে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকারোক্তি
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের শূরা সদস্য মীর কাশেম আলীকে সেফ হোমে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। শনিবার সকাল থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তারা তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক এমএ হান্নান খান বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন তিনি চট্টগ্রামের ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্তের স্বার্থে আর কিছু বলা যাবে না। প্রয়োজনে তাঁকে আবারও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনতে পারি। শনিবার সকাল ১০টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত ধানম-িতে অবস্থিত সেফ হোমে মীর কাশেম আলীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে এক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে দুপুর দু’টা থেকে ৫টা পর্যন্ত আবারও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এর আগে সকালে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সেফ হোমে আনা হয়। ১৭ জুন বেলা আড়াইটার দিকে মীর কাশেমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হয়। বিকেল পৌনে চারটার দিকে মতিঝিলে নয়াদিগন্ত কার্যালয় থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে বিকেল সোয়া চারটার দিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ হাজির করা হয়। পরে ট্রাইব্যুনাল মীর কাসেমকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। এরপর ১৯ জুন মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে মীর কাশেমের জামিন আবেদন খারিজ করে দেয়া হয়। ট্রাইব্যুনাল আগামী ২৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। একই সঙ্গে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে ব্যর্থ হলে অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল-১।
শনিবার সেফ হোমে তদন্তকারী সংস্থার দুই সমন্বয়ক এমএ হান্নান খান ও সানাউল হকসহ তদন্ত কর্মকর্তা নুরুল হক, মোঃ আব্দুর রাজ্জাক খান, মতিউর রহমান উপিস্থিত ছিলেন। এদিকে মীর কাশেম আলীকে সেফ হোমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদিন আগে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের জানানোর নির্দেশ থাকলেও তাদের জানানো হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন আসামি পক্ষের আইনজীবী তাজুল ইসলাম। উল্লেখ্য, ৮ জুলাই মীর কাশেম আলীকে সেফ হোমে নিয়ে এক দিন জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন মঞ্জুর করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। একই সঙ্গে সেফ হোমে নেয়ার দু’দিন আগে মীর কাশেম আলীর আইনজীবীকে জানানোর নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া জিজ্ঞাসাবাদের সময় আইনজীবী ও চিকিৎসকের উপস্থিতিসহ ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনা মানার নির্দেশ দেয়া হয়। ৫ জুলাই তাঁকে সেফ হোমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন জানিয়েছিল প্রসিকিউশন পক্ষ। তিন দিনের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল এক দিনের জন্য মঞ্জুর করে।
তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেছেন, ‘সেফ হোমে জিজ্ঞাসাবাদ শুরুর ৪৮ ঘণ্টা আগে নিয়ম ও ট্রাইব্যুনালের আদেশ অনুসারে আমাদের জানানোর কথা। অথচ এখন পর্যন্ত আমরা কোন লিখিত নোটিস পাইনি। এটা আদালত অবমাননা। ‘আমরা রাষ্ট্রপক্ষের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আদালত অবমাননার অভিযোগ জানাব’ বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তাঁর পরিবারকে জানানো হয়েছে, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পরিবারকে জানানো হলেই তো আর আইনজীবীদের জানানো হলো না। তাছাড়া আজ (শনিবার) সকালেই তাঁরা পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছেন।’ তাজুল বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনা অনুসারে এর আগে এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ ই-মেইল করেছেন বা লিখিত নোটিস করেছেন। এবার সেটা না করা আইন ও বিধির লঙ্ঘন।’
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান জানিয়েছেন, আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই কারাগার থেকে সেফ হোমে আনা হয়েছে মীর কাশেম আলীকে। প্রধান সমন্বয়ক এমএ হান্নান খান জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়ে তিনি কিছু বিষয় স্বীকার করেছেন। তিনি একাত্তরে ইসলামী ছাত্রসংঘের চট্টগ্রামের সভাপতি ছিলেন বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। এছাড়া তাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রামের ডালিম হোটেল দখল করে রাজাকার বাহিনীর নির্যাতন শিবির খোলা ও সেখানে হত্যা-নির্যাতনের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে অনেক তথ্য মিলেছে। তদন্তের স্বার্থে এর বেশি কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন আব্দুল হান্নান খান। তিনি আরও বলেন, মীর কাশেমের ছেলে ব্যারিস্টার মীর আহম্মেদ বিন কাশেম প্রথম পর্বে পাশের কক্ষে ছিলেন।
এর আগে ১৭ জুন মীর কাশেম আলীর গ্রেফতারের আবেদন জানায় প্রসিকিউশন পক্ষ। আবেদনে প্রসিকিউশনপক্ষ মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে লম্বা অভিযোগ তুলে ধরেন। ঐ দিন গ্রেফতারের আবেদনে বলা হয়, একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাদের সহযোগিতাকারী আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। তাঁর প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় একাত্তরে চট্টগ্রামে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটসহ বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটানো হয়। ‘মীর কাশেম জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য। মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের মীর কাশেমকে একাত্তরে চট্টগ্রামের মানুষ চিনত মিন্টু নামে। কলেজছাত্র থাকাকালে সেখানেই তিনি জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। পরে জামায়াতের অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের দায়িত্বও নেন। মীর কাশেম আলীর নির্দেশেই চট্টগ্রামে রাজাকার বাহিনীর ক্যাম্পে বহু লোককে হত্যা ও নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের শেষভাগে পাকিস্তানী বাহিনী এ দেশের যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে, তার তালিকা তৈরিতে মীর কাশেমও ছিলেন।
প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত ট্রাইব্যুনালে গ্রেফতারের আবেদনে বলেছিলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে বাবার চাকরির সুবাদে চট্টগ্রামে যান। চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র থাকার সময় জড়িয়ে পড়েন মওদুদীর মৌলবাদী রাজনীতিতে। জামায়াতের অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের দায়িত্ব পান স্বাধীনতার আগে। স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতার সময় ছাত্রসংঘের নতুন প্রাদেশিক পরিষদ গঠন হয়। মীর কাশেম আলী হন তার সাধারণ সম্পাদক। সে সময় সংগঠনটির সভাপতি ছিলেন যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ।
মীর কাশেম আলীর গ্রেফকতারের আবেদনের সময় প্রসিকিউশন ট্রাইব্যুনালে যে তথ্য প্রদান করে তার মধ্যে রয়েছে, মীর কাশেমের নির্দেশে চট্টগ্রামের টেলিগ্রাফ অফিসের লাগোয়া ডালিম হোটেলে রাজাকার বাহিনীর বন্দীশিবির খোলা হয়। সেখানে লোকদের ধরে এনে টর্চার করা হতো। বহু লোককে সেখানে নিয়ে খুন করা হয়। ১৭ ডিসেম্বর সেখান থেকে সাড়ে ৩শ’ বন্দীকে জীবন্মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যার তালিকা প্রণয়নকারীদের অন্যতম ছিলেন মীর কাশেম আলী। স্বাধীনতার পর মীর কাশেম পালিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। মিন্টু নামে নিজের পরিচয় দিতেন তিনি, নিজেকে বলতেন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু চিহ্নিত হয়ে পড়ার পর আরেক ঘাতক মঈনুদ্দিনের সঙ্গে পালিয়ে চলে যান লন্ডন। সেখান থেকে সৌদি আরব। সেখানে স্বাধীনতাবিরোধীদের সংগঠিত করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশে ফিরে আসেন মীর কাশেম।
জিয়াউর রহমানের সময় নতুন করে সংগঠিত হয় ইসলামী ছাত্রসংঘ, নাম বদলে হয় ইসলামী ছাত্রশিবির। ছাত্রশিবিরের প্রথম কেন্দ্রীয় সভাপতি হন মীর কাশেম আলী। এরপর রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের নামে রাবেতা আল ইসলামী গড়ে তোলেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর টাকায় আস্তে আস্তে প্রতিষ্ঠা করেন ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা ট্রাস্ট ও ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস। চট্টগ্রাম শহরের নন্দনকানন টিএ্যান্ডটি অফিসের পেছনের সড়ক যা এর আগে টেলিগ্রাফ রোড বলে পরিচিত ছিল সেখানে এক হিন্দু পরিবারের মালিকানাধীন ‘মহামায়া ভবন’টিকে মীর কাশেম আলীর নেতৃত্বাধীন আলবদর বাহিনী কেড়ে নিয়ে নাম দেয় ডালিম হোটেল। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ডালিম হোটেলই আলবদর, রাজাকারদের অন্যতম নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিল চট্টগ্রামবাসীর কাছে।
প্রসিকিউটর গ্রেফতারের আবেদনে জানান, একাত্তর সালের ২৬ মার্চ দখলদার পাকিস্তানী বাহিনী অপারেশন সার্চ লাইটের মাধ্যমে বাঙালীদের ওপর আক্রমণ করে, যা ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ মাস অব্যাহত থাকে। এই নয় মাসে হত্যা, গণহত্যা, ধর্মান্তরিত করা, বন্দী, আটক, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, যুদ্ধাপরাধসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে বুদ্ধিজীবী যোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে নির্যাতন কেন্দ্রে রাখা হয়। ৯ মাসে মীর কাশেম আলীর নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী মহামায়া হোটেল বর্তমান ডালিম হোটেলে ধরে এনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের নির্যাতন করত। ডালিম হোটেলে নির্যাতন করে তাদের হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলা হতো। মীর কাশেম আলী চট্টগ্রামের গুডস হিল ও ডালিম হোটেল নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে তোলে। অনেককে হত্যা করা হয়েছে, যাদের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি।
চট্টগ্রামে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অভিযোগের বিষয়ে তদন্তকারী সংস্থা তদন্ত করে। তদন্ত করে তদন্তকারী সংস্থা জানতে পারে, একাত্তরের ১৯ নবেম্বর চট্টগ্রামের চাকতাই এলাকায তিন জনকে ধরে ডামিল হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। সেখান থেকে তাদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও তাদের নির্যাতন করা হয়। তিন জনের মধ্যে একজনকে ইলেকট্রিক শক দিলে তিনি পুরুষত্বহীন হয়ে পড়েন। সে কারণে আজও তিনি কোন সন্তান নিতে পারেননি।
শনিবার সেফ হোমে তদন্তকারী সংস্থার দুই সমন্বয়ক এমএ হান্নান খান ও সানাউল হকসহ তদন্ত কর্মকর্তা নুরুল হক, মোঃ আব্দুর রাজ্জাক খান, মতিউর রহমান উপিস্থিত ছিলেন। এদিকে মীর কাশেম আলীকে সেফ হোমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদিন আগে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের জানানোর নির্দেশ থাকলেও তাদের জানানো হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন আসামি পক্ষের আইনজীবী তাজুল ইসলাম। উল্লেখ্য, ৮ জুলাই মীর কাশেম আলীকে সেফ হোমে নিয়ে এক দিন জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন মঞ্জুর করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। একই সঙ্গে সেফ হোমে নেয়ার দু’দিন আগে মীর কাশেম আলীর আইনজীবীকে জানানোর নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া জিজ্ঞাসাবাদের সময় আইনজীবী ও চিকিৎসকের উপস্থিতিসহ ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনা মানার নির্দেশ দেয়া হয়। ৫ জুলাই তাঁকে সেফ হোমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন জানিয়েছিল প্রসিকিউশন পক্ষ। তিন দিনের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল এক দিনের জন্য মঞ্জুর করে।
তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেছেন, ‘সেফ হোমে জিজ্ঞাসাবাদ শুরুর ৪৮ ঘণ্টা আগে নিয়ম ও ট্রাইব্যুনালের আদেশ অনুসারে আমাদের জানানোর কথা। অথচ এখন পর্যন্ত আমরা কোন লিখিত নোটিস পাইনি। এটা আদালত অবমাননা। ‘আমরা রাষ্ট্রপক্ষের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আদালত অবমাননার অভিযোগ জানাব’ বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তাঁর পরিবারকে জানানো হয়েছে, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পরিবারকে জানানো হলেই তো আর আইনজীবীদের জানানো হলো না। তাছাড়া আজ (শনিবার) সকালেই তাঁরা পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছেন।’ তাজুল বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনা অনুসারে এর আগে এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ ই-মেইল করেছেন বা লিখিত নোটিস করেছেন। এবার সেটা না করা আইন ও বিধির লঙ্ঘন।’
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান জানিয়েছেন, আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই কারাগার থেকে সেফ হোমে আনা হয়েছে মীর কাশেম আলীকে। প্রধান সমন্বয়ক এমএ হান্নান খান জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়ে তিনি কিছু বিষয় স্বীকার করেছেন। তিনি একাত্তরে ইসলামী ছাত্রসংঘের চট্টগ্রামের সভাপতি ছিলেন বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। এছাড়া তাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রামের ডালিম হোটেল দখল করে রাজাকার বাহিনীর নির্যাতন শিবির খোলা ও সেখানে হত্যা-নির্যাতনের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে অনেক তথ্য মিলেছে। তদন্তের স্বার্থে এর বেশি কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন আব্দুল হান্নান খান। তিনি আরও বলেন, মীর কাশেমের ছেলে ব্যারিস্টার মীর আহম্মেদ বিন কাশেম প্রথম পর্বে পাশের কক্ষে ছিলেন।
এর আগে ১৭ জুন মীর কাশেম আলীর গ্রেফতারের আবেদন জানায় প্রসিকিউশন পক্ষ। আবেদনে প্রসিকিউশনপক্ষ মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে লম্বা অভিযোগ তুলে ধরেন। ঐ দিন গ্রেফতারের আবেদনে বলা হয়, একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাদের সহযোগিতাকারী আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। তাঁর প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় একাত্তরে চট্টগ্রামে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটসহ বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটানো হয়। ‘মীর কাশেম জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য। মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের মীর কাশেমকে একাত্তরে চট্টগ্রামের মানুষ চিনত মিন্টু নামে। কলেজছাত্র থাকাকালে সেখানেই তিনি জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। পরে জামায়াতের অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের দায়িত্বও নেন। মীর কাশেম আলীর নির্দেশেই চট্টগ্রামে রাজাকার বাহিনীর ক্যাম্পে বহু লোককে হত্যা ও নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের শেষভাগে পাকিস্তানী বাহিনী এ দেশের যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে, তার তালিকা তৈরিতে মীর কাশেমও ছিলেন।
প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত ট্রাইব্যুনালে গ্রেফতারের আবেদনে বলেছিলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে বাবার চাকরির সুবাদে চট্টগ্রামে যান। চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র থাকার সময় জড়িয়ে পড়েন মওদুদীর মৌলবাদী রাজনীতিতে। জামায়াতের অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের দায়িত্ব পান স্বাধীনতার আগে। স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতার সময় ছাত্রসংঘের নতুন প্রাদেশিক পরিষদ গঠন হয়। মীর কাশেম আলী হন তার সাধারণ সম্পাদক। সে সময় সংগঠনটির সভাপতি ছিলেন যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ।
মীর কাশেম আলীর গ্রেফকতারের আবেদনের সময় প্রসিকিউশন ট্রাইব্যুনালে যে তথ্য প্রদান করে তার মধ্যে রয়েছে, মীর কাশেমের নির্দেশে চট্টগ্রামের টেলিগ্রাফ অফিসের লাগোয়া ডালিম হোটেলে রাজাকার বাহিনীর বন্দীশিবির খোলা হয়। সেখানে লোকদের ধরে এনে টর্চার করা হতো। বহু লোককে সেখানে নিয়ে খুন করা হয়। ১৭ ডিসেম্বর সেখান থেকে সাড়ে ৩শ’ বন্দীকে জীবন্মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যার তালিকা প্রণয়নকারীদের অন্যতম ছিলেন মীর কাশেম আলী। স্বাধীনতার পর মীর কাশেম পালিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। মিন্টু নামে নিজের পরিচয় দিতেন তিনি, নিজেকে বলতেন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু চিহ্নিত হয়ে পড়ার পর আরেক ঘাতক মঈনুদ্দিনের সঙ্গে পালিয়ে চলে যান লন্ডন। সেখান থেকে সৌদি আরব। সেখানে স্বাধীনতাবিরোধীদের সংগঠিত করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশে ফিরে আসেন মীর কাশেম।
জিয়াউর রহমানের সময় নতুন করে সংগঠিত হয় ইসলামী ছাত্রসংঘ, নাম বদলে হয় ইসলামী ছাত্রশিবির। ছাত্রশিবিরের প্রথম কেন্দ্রীয় সভাপতি হন মীর কাশেম আলী। এরপর রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের নামে রাবেতা আল ইসলামী গড়ে তোলেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর টাকায় আস্তে আস্তে প্রতিষ্ঠা করেন ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা ট্রাস্ট ও ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস। চট্টগ্রাম শহরের নন্দনকানন টিএ্যান্ডটি অফিসের পেছনের সড়ক যা এর আগে টেলিগ্রাফ রোড বলে পরিচিত ছিল সেখানে এক হিন্দু পরিবারের মালিকানাধীন ‘মহামায়া ভবন’টিকে মীর কাশেম আলীর নেতৃত্বাধীন আলবদর বাহিনী কেড়ে নিয়ে নাম দেয় ডালিম হোটেল। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ডালিম হোটেলই আলবদর, রাজাকারদের অন্যতম নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিল চট্টগ্রামবাসীর কাছে।
প্রসিকিউটর গ্রেফতারের আবেদনে জানান, একাত্তর সালের ২৬ মার্চ দখলদার পাকিস্তানী বাহিনী অপারেশন সার্চ লাইটের মাধ্যমে বাঙালীদের ওপর আক্রমণ করে, যা ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ মাস অব্যাহত থাকে। এই নয় মাসে হত্যা, গণহত্যা, ধর্মান্তরিত করা, বন্দী, আটক, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, যুদ্ধাপরাধসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে বুদ্ধিজীবী যোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে নির্যাতন কেন্দ্রে রাখা হয়। ৯ মাসে মীর কাশেম আলীর নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী মহামায়া হোটেল বর্তমান ডালিম হোটেলে ধরে এনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের নির্যাতন করত। ডালিম হোটেলে নির্যাতন করে তাদের হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলা হতো। মীর কাশেম আলী চট্টগ্রামের গুডস হিল ও ডালিম হোটেল নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে তোলে। অনেককে হত্যা করা হয়েছে, যাদের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি।
চট্টগ্রামে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অভিযোগের বিষয়ে তদন্তকারী সংস্থা তদন্ত করে। তদন্ত করে তদন্তকারী সংস্থা জানতে পারে, একাত্তরের ১৯ নবেম্বর চট্টগ্রামের চাকতাই এলাকায তিন জনকে ধরে ডামিল হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। সেখান থেকে তাদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও তাদের নির্যাতন করা হয়। তিন জনের মধ্যে একজনকে ইলেকট্রিক শক দিলে তিনি পুরুষত্বহীন হয়ে পড়েন। সে কারণে আজও তিনি কোন সন্তান নিতে পারেননি।
No comments