ওজোনস্তরের সুরক্ষা by হাসান জাহিদ

ওজোনস্তর পৃথিবীকে রক্ষা করে আসছে সূর্যের ক্ষতিকর অতি বেগুনি রশ্মি থেকে। এই স্তরটি সূর্যের ক্ষতিকর অতি বেগুনি রশ্মিকে ছাঁকনির মতো ছেঁকে নিয়ে পৃথিবীর বুকে সরাসরি পতিত হওয়াকে ঠেকিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয় নির্মল সূর্যালোক। অথচ মানব কর্মকাণ্ডের দরুন ওজোনস্তর ক্ষয়ে যাচ্ছে।


ক্ষয়ের প্রধান কারণ বায়ুমণ্ডলে অতিমাত্রায় ক্লোরোফ্লুরো কার্বন (সিএফসি) বা হাইড্রোক্লোরোফ্লুরো কার্বন (এইচএফসি) নিক্ষেপ। শিল্প বিপ্লবের শুরু থেকেই বায়ুমণ্ডলে পরিবেশবিনাশী রাসায়নিক দ্রব্য ছড়ানোর রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে আসছে। ১৯২০ সালের দিকে সিএফসি ব্যবহারের প্রারম্ভ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বায়ুমণ্ডলবিনাশী যে কর্মকাণ্ড শুরু হয়, তাতে বিশাল ক্ষত সৃষ্টি হয় ওজোনস্তরে।
ওজোনস্তরের অবক্ষয়রোধে ১৯৮৭ সালে গৃহীত হয় 'মন্ট্রিয়াল প্রটোকল'। এই প্রটোকলের সিদ্ধান্তগুলো বিশ্বব্যাপী বাস্তবায়িত হচ্ছে। যেহেতু উন্নত দেশগুলোই গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদনসহ ওজোনস্তর ক্ষয়কারী বস্তুগুলোর উদ্ভাবন ও ব্যবহারের মূল হোতা, তাই ওজোনস্তর রক্ষা করার দায়িত্ব বেশির ভাগই তাদের ওপর বর্তায়। অন্যদিকে, যেহেতু বিশ্ব উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও ওজোনস্তরের ক্ষয় ইত্যাদির ক্ষতিকর প্রভাব বিশ্বব্যাপী কমবেশি পড়বে, তাই ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে বিশ্বের কোনো দেশই নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না। ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর মন্ট্রিয়াল চুক্তি সাধনের পর ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের এক প্রস্তাবে প্রতি বছর ১৬ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক ওজোন দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আর এ দিবসটি পালনে উদ্বুদ্ধকরণ ও সচেতনতা সৃষ্টির কাজটি করে আসছে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি বা ইউনেপ। সংস্থাটি প্রতি বছর ওজোন দিবস উপলক্ষে একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে। এ বছর প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে 'চৎড়ঃবপঃরহম ঙঁৎ অঃসড়ংঢ়যবৎব ভড়ৎ এবহবৎধঃরড়হং ঃড় ঈড়সব', যার বাংলা ভাবার্থ দাঁড়ায় 'আসন্ন প্রজন্মের জন্য বায়ুমণ্ডলকে সুরক্ষিত রাখা।'
যদি ওজোনস্তরের ক্ষয়বৃৃদ্ধি চলমান থাকে তবে তা পৃথিবীর মানুষ ও জীববৈচিত্রের ওপর ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। স্তরটির পাতলা হয়ে যাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। বিজ্ঞানী ও গবেষকদের মতে, ওজোনস্তরের ক্ষয়জনিত কারণে পৃথিবীর সামুদ্রিক প্ল্যাংকটনের (জলীয় জীবাণু) ওপর সর্বাধিক বিরূপ প্রভাব ফেলে জলীয় বা সামুদ্রিক ফুড চেইনে (খাদ্য শৃঙ্খল) বিপর্যয় ঘটাবে। ওজোনস্তরের ক্ষয়জনিত কারণে অধিকমাত্রায় সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি ভূপৃষ্ঠে প্রাণীদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেবে। অনেক উদ্ভিদ প্রজাতি বিলীন হয়ে যাবে। মানুষের খাদ্যের জোগান কমে আসবে। ১৯৮৪ সালে গবেষক ও চিকিৎসক ড. জো ফারম্যান 'নেচার' ম্যাগাজিনে একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধে এসব তথ্য তুলে ধরেন। তখন থেকেই অতি বেগুনি রশ্মির ভূপৃষ্ঠে সরাসরি প্রবেশজনিত কারণে প্রাণমণ্ডলে বিরূপ প্রভাবের চিত্রটি বিশ্বের চিন্তাবিদ, গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায় আর একইসঙ্গে বিষয়টি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এরই ধারাবাহিকতায় বহুপক্ষীয় পরিবেশ চুক্তি হিসেবে ১৯৮৫ সালে ভিয়েনা সম্মেলনে 'ঠরবহহধ ঈড়হাবহঃরড়হ ভড়ৎ ঃযব চৎড়ঃবপঃরড়হ ড়ভ ঃযব ঙুড়হব খধুবৎ্থ গৃহীত হয়। পরবর্তীকালে ১৯৭টি দেশ এতে অনুস্বাক্ষর করে। ওজোনস্তর রক্ষায় এটি একটি আন্তর্জাতিক দিকনির্দেশনা রূপে কাজ করছে, অন্যদিকে মন্ট্রিয়াল প্রটোকল গৃহীত হয় অ্যাকশন তথা ওডিএস (ওজোন ডিপ্লেটিং সাবস্ট্যান্সেস) বা ওজোন ক্ষয়কারী রাসায়নিক বস্তুগুলোর উৎপাদন ও ব্যবহার কমিয়ে আনা ও বন্ধকরণ বিষয়ে।
১৯৯০ সালের ২ আগস্ট বাংলাদেশ মন্ট্রিয়াল প্রটোকলভুক্ত হয় এবং ১৯৯৪, ২০০০, ২০০১ ও ২০১০ সালে যথাক্রমে লন্ডন, কোপেনহেগেন, মন্ট্রিয়াল ও বেইজিং সংশোধনীগুলোতে অনুস্বাক্ষর করে। ২০৪০ সাল নাগাদ প্রটোকলে অন্তর্ভুক্ত সব গ্যাসের ব্যবহার বন্ধ হওয়ার কথা। এসব সংশোধনীতে সম্মতি ও অনুস্বাক্ষরের ফলে বাংলাদেশ তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে সমর্থ হয়। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৯ সালে ক্লোরোফ্লুরো কার্বন আমদানি ও ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং ২০১০ সালের জানুয়ারিতে এর ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করতে সমর্থ হয়। কিন্তু অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে দেশটির সামনে। শিক্ষা, খাদ্য, আশ্রয়, নিরাপত্তা, টেকসই উন্নয়ন, মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট অর্জন, পরিবেশবান্ধব শিল্পায়ন_ সবই তো দেশের টপ প্রায়োরিটি। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মূল লক্ষ্য দারিদ্র্যবিমোচন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন। কিন্তু এই লক্ষ্য ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের বিষয়টি বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল সেই অর্জনের পদক্ষেপকে শ্লথ করে দিচ্ছে। উন্নত বিশ্ব এবং অধিক কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর দায়ভার বহন করছে বাংলাদেশ। প্রাকৃতিকভাবে নাজুক ভৌগোলিক অবস্থানের ফলে প্রাচীনকাল থেকেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার দেশটি। উপরন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দেশটি ঘন ঘন শিকার হচ্ছে ঝড়-ঝঞ্ঝা-সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসের। এসবের ফলে পরিবেশ-উদ্বাস্তু সৃষ্টি হচ্ছে, সম্পদ ও অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রতিপাদ্যের তাগাদায় ওজোনস্তর ক্ষয়রোধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ এবং ওডিএসের ব্যবহার পর্যায়ক্রমে কমিয়ে একেবারে শূন্যাবস্থায় নিয়ে আসতে হবে। ওজোনস্তরের ক্ষয়রোধ করতে হবে মানবজাতির অস্তিত্বের স্বার্থেই।

হাসান জাহিদ :পরিবেশবিষয়ক লেখক

No comments

Powered by Blogger.