তোফায়েলের মন্ত্রিত্ব না নেওয়া ষড়যন্ত্রের অংশ : আশরাফ by পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য

'তোফায়েল আহমেদের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ না করা বড় ষড়যন্ত্রের অংশ। তিনি সাময়িকভাবে বাহবা কুড়ালেও কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছেন। মন্ত্রিত্ব না নিয়ে তোফায়েল সাহেব দলকে ছোট, দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন, এলাকাবাসীকে বঞ্চিত করেছেন। দলের সিদ্ধান্তকে অপমান করেছেন।'


এভাবেই আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদের মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। গতকাল শনিবার রাতে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গণভবনে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে সৈয়দ আশরাফ এমন মন্তব্য করেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, দলের এমন একজন কর্মকর্তা এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।
তোফায়েল আহমেদ এবং প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের একটি ডিনার পার্টির কথা উল্লেখ করে বৈঠকে সৈয়দ আশরাফ বলেন, 'ওই পার্টিতে এবং অন্য অনেকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তোফায়েল সাহেব এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তোফায়েল আহমেদের এই সিদ্ধান্ত বড় ষড়যন্ত্রের অংশ। দলের একজন প্রবীণ নেতা হিসেবে এই সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পারেন না- এটা দুঃখজনক।'
এদিকে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মন্ত্রিসভায় যোগদানের প্রস্তাবে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। গতকাল গণভবনে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে প্রারম্ভিক বক্তব্যে তিনি বলেন, 'আমরা এর আগে যখন ক্ষমতায় ছিলাম তখন যেভাবে আহ্বান জানিয়েছিলাম, এবারও সেভাবেই আহ্বান জানিয়েছি। কাজেই নিয়মের ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।'
সূত্র জানায়, সৈয়দ আশরাফ তাঁর বক্তব্যে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের সমালোচনা করে বলেন, 'একজনের জন্য পদ্মা সেতু বন্ধ হয়ে যেতে পারে না। আমাদের পদ্মা সেতু করতে হবে। যেকোনোভাবেই ২০১৩ সালের জানুয়ারির মধ্যে আমাদের এর কাজ শুরু করতে হবে। দাতারা পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগ করার জন্য আগ্রহী হয়ে আছে কিন্তু তাদের শর্ত মসিউর রহমানকে তিন মাসের ছুটিতে পাঠাতে হবে।' এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'মসিউর রহমানকে ছুটিতে পাঠালে পদ্মা সেতুতে দাতারা ফিরে আসবে- এমন নিশ্চয়তা নেই। তা ছাড়া মসিউর ভাইয়ের পুরো চাকরিজীবনে কোনো কালিমা নেই। কিভাবে একজনের কথার ভিত্তিতে তাঁর গায়ে কালিমা লাগাব?' প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'তারা ইচ্ছুক হলে তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তেমন কোনো লক্ষণ তো দেখি না।'
সৈয়দ আশরাফ অর্থমন্ত্রীর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, 'ওনার বয়স হয়েছে। উল্টাপাল্টা কথা বলেন।' এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, 'বয়স হয়েছে। তা ছাড়া স্ট্রোক করার পর থেকে তিনি এমন উল্টাপাল্টা কথা বলেন। তবে তিনি তো আমাদের ছেড়ে যেতে চান না।'
সূত্র জানায়, বৈঠকে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ দলের সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত মাহমুদুর রহমান মান্না, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, অধ্যাপক মান্নান এবং সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদের নাম উল্লেখ করে বলেন, এঁরা দলের বিরুদ্ধে এবং সরকারের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের লোক হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে দলীয় সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি। শেখ হাসিনা পরবর্তী সভায় তাঁদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে বৈঠকে আশ্বস্ত করেন।
বৈঠকে ২৯ ডিসেম্বর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পরবর্তী সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। গত ২৩ জুলাই বর্তমান কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বর্তমান কমিটির মেয়াদ বর্ধিত করা হয়েছে। তবে এটি কাউন্সিলের অনুমোদন সাপেক্ষে। এ ছাড়া ৩০ নভেম্বরের মধ্যে দলের সব উপজেলা এবং জেলা সম্মেলন শেষ করার জন্য সাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই হিসাবে চলতি বছরের ২৩ জুলাই বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে।
গতকাল বৈঠকে সাংগঠনিক সম্পাদকরা নিজ নিজ বিভাগের সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করার সময় দলের এমপিদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এবং দলের সঙ্গে তাঁদের দূরত্বের কথা তুলে ধরেন। তাঁদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, 'আমি সব জানি। এমপিরা নিজেদের পকেটের লোক সৃষ্টি করছেন। তবে পকেটের লোক দিয়ে নির্বাচনে জয় সম্ভব নয়।' জনগণ যাঁদের চায় তাঁদের পরবর্তী সময়ে মনোনয়ন দেওয়া হবে বলেও জানিয়ে দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দলের বিজয়ের জন্য অনেককে মনোনয়ন দিতে হয়। কিন্তু দল আগে। দলকে যে ক্ষতিগ্রস্ত করবে তার ভবিষ্যৎ ভালো হবে না।
বরিশাল বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম তাঁর রিপোর্টে পটুয়াখালীর সরকারদলীয় সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনির প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন বলেও সূত্র জানায়। নাছিম বলেন, 'দলের সঙ্গে রনির সম্পর্ক খারাপ। দলের স্থানীয় সংগঠনকে রনি দুমড়ে-মুচড়ে শেষ করে ফেলেছেন।' এর পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা বলেন, 'রনি দলের কে, ও দলের কেউ নয়।' বাহাউদ্দিন নাছিম এর পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন রনির কথার বাইরে যায় না। পরে শেখ হাসিনা নাছিমকে আশ্বস্ত করে বলেন, 'ব্যাপারটা আমি দেখছি।'
বৈঠকে হলমার্ক নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হলে শেখ হাসিনা বলেন, এই ঘটনায় দল বা সরকারের কেউ জড়িত নয়। তবে সরকার এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব পেয়েও প্রত্যাখ্যান করার এক দিন পর ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন গতকাল বলেন, 'মন্ত্রিত্বের বিষয়টি একটি নীতিনির্ধারণী ব্যাপার। আমন্ত্রণ এলো একজন সচিবের কাছ থেকে। এ ধরনের আমন্ত্রণে কোনো সভ্য দেশে মন্ত্রী হয় কি না, আমার জানা নেই।' ওই বক্তব্যের জবাবে শেখ হাসিনা গতকাল রুদ্ধদ্বার বৈঠকের আগের প্রারম্ভিক বক্তব্যে বলেন, মেননের আই কে গুজরালের আত্মজীবনী পড়া দরকার। প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'ইন্ডিয়া সভ্য দেশ কি না জানি না। তবে গুজরাল মন্ত্রী হয়েছিলেন কেবিনেট থেকে ফোন পেয়েই। কেবিনেট ডিভিশন থেকেই তাঁকে ফোন করা হয়েছিল।' এ প্রসঙ্গে তিনি গুজরালের একটি বইয়ের উদ্ধৃতি তুলে ধরেন।
শেখ হাসিনা বলেন, '২০০৯ সালে আমরা যখন মন্ত্রিসভা গঠন করি, সে সময় পত্রিকায় দেখেছি, সাংবাদিকরা ওনাকে (মেনন) জিজ্ঞেস করেছেন মন্ত্রী হচ্ছেন কি না, তখন উনি নিজেই বলেছিলেন, এখনো কেবিনেট সচিবের ফোন পাইনি। তাহলে এখন উনি কোথা থেকে এই যুক্তি পেলেন, আমার জানা নেই।'
আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদের মন্ত্রিসভায় যোগদানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, 'কে নেবেন, কে নেবেন না- এটা তাঁদের ডিসিশন। আমরা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাইনি। আমাদের তো অনেক সংসদ সদস্য। সবাইকে তো আর মন্ত্রী করা সম্ভব নয়, যেভাবে যতটুকু করা যায় করে যাচ্ছি।'
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের সমালোচকদের সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, 'সরকার জনগণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। খেটে খাওয়া মানুষের উন্নতিই সরকারের কাজ। সরকার সেটা ভালো করছে। কিন্তু যারা আমাদের সরকারের সমালোচনা করছে, তারা সাধারণ মানুষের ভালো চায় না। আমরা দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি।'
প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'মাঝেমধ্যে কিছু ঘটনা ঘটছে। ঘটনা ঘটলেই সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি না- এটা কেউ বলতে পারবে না।'
টক শোর সমালোচনা : টিভি টক শোতে সরকারের সমালোচনার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমাদের মিডিয়ার তো অভাব নেই। আমরা ছিয়ানব্বই সালে ক্ষমতায় এসে প্রথম ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অনুমতি দিই। অনেক লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। আবার সেখানে বসে এমন সব লোক কথা বলে, আমরা তো সবাইকে চিনি।' এ প্রসঙ্গে প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসার নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, 'একটা টেলিভিশন চ্যানেল দিতে পারিনি বলে আমাদের চোর-দুর্নীতিবাজ বলছেন। আমি তো ওনাকে চিনি। উনি তো বয়স্ক মানুষ। ওনাকে জিজ্ঞেস করতে পারি না, মিডিয়ার অনুমতি দিলে উনি টাকা পেতেন কোথায়?'
সম্প্রতি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে টক শোতে এবিএম মূসা বলেন, দুর্নীতি ও লুটপাট যে পর্যায়ে গেছে তাতে সরকারি লোকজন দেখলেই সাধারণ মানুষের উচিত হবে 'তুই বেটা চোর' বলা।
শেখ হাসিনা বলেন, 'কিছু আমলা আছেন যাঁরা ডিজিএফআইয়ের কাছে উপদেষ্টা হওয়ার জন্য ধরনা দিতেন। এখন তাঁদের মুখে তাত্ত্বিক কথা শুনি। তাঁরা যখন দায়িত্বে ছিলেন তখন দেশের জন্য কী করেছেন, কী দায়িত্ব পালন করেছেন?'

No comments

Powered by Blogger.