জাতিসংঘ শান্তি মিশন-পিসবিল্ডিং ও বাংলাদেশের নেতৃত্ব by মমতাজউদদীন আহমদ

শক্তিধরদের লোভ, মদমত্ততার জন্য প্রকৃতি ও মানবজাতি শাস্তি ভোগ করতে পারে না। যুদ্ধোত্তর দেশগুলোর দুর্দশার জন্য তাদেরই যুদ্ধবিগ্রহ ও অধিকার মত্ততা দায়ী। যুদ্ধোত্তর দেশগুলোর জন্য স্থায়ী শান্তি বিনির্মাণ কর্মকাণ্ড পরিচালনায় অর্থ অনুদান তাদেরই করতে হবে।


আহত দেশের অর্থনীতির বুনিয়াদ একবার মজবুত এবং নির্ভয় হলে সে দেশ ও জাতি নিজেই এগিয়ে আসবে। বাংলার নেতৃত্বে বিশ্বময় মানুষের মধ্যে জাগরণ আসুক, আমরা স্থায়ী শান্তি চাই, যুদ্ধকে ঘৃণা করি আমরা

যত কারণ আর অজুহাত হোক, দেশে দেশে, গোত্রে গোত্রে বিবাদ-বিসংবাদ লেগেই আছে। বিবাদের গভীরতা যত বেশি হয়, ততই বেশি ক্ষয়ক্ষতি। স্বৈরশাসক কর্নেল গাদ্দাফির দীর্ঘকালীন শাসনে লিবিয়ায় নানা অসন্তোষ ছিল। তাকে তাড়ানোর জন্য নানা ষড়যন্ত্র, বিচিত্র আয়োজন হয়েছে। বড় শক্তিগুলো একাট্টা হয়ে এমন আক্রমণ করল যে, গাদ্দাফির বেবাক শক্তি আর দম্ভ চুরমার হয়ে গেল। লিবিয়ার ভাড়াটে বিদ্রোহীদের বিদেশি শক্তিকে সম্ভাষণ জানিয়ে যত ঝাঁপাঝাঁপি তাতে নিরীহ জনগণের জানমাল নিয়ে ত্রাহি অবস্থা। বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার শ্রমিক ছিল লিবিয়াতে, তাদেরও মরণদশা। নিরাপত্তার জন্য সবাই লিবিয়া ছেড়ে পাশের দেশ নাইজারে পালিয়ে বাঁচল। গাদ্দাফির জীবন গেল আর লিবিয়াজুড়ে এলো হাহাকার-ভাংচুর। নৈরাজ্য ও নৈরাশ্যের অন্ধকারে আচ্ছন্ন হলো তেলসমৃদ্ধ লিবিয়া।
এমনটাই হয়েছে ইরাকে। তেলের দখল নেওয়ার জন্য সাদ্দাম হোসেনকে তাড়াতে শক্তিমানদের ভয়ঙ্কর সব আক্রমণ। তাতে ইরাকের সভ্যতা ও সম্পদ ছারখার। দলে দলে নিরীহ জনগণের নিজ ভূমি ছেড়ে পাশের দেশে ছোটাছুটি। এমন ধারা হয়েছে কঙ্গোতে। দুই কঙ্গোর সংঘর্ষ আর হাজার হাজার মানুষের প্রাণ নিয়ে পলায়ন। এমনি হয়েছে আফগানিস্তানে। মিসরেও একই হাল। একই রকম ছোটাছুটি আর ধ্বংস চলছে সিরিয়ায়। অশান্তি-নৈরাজ্য আর ছারখার অবস্থা দেশে দেশে। অশান্তি, সংঘর্ষ আর বিবাদ নিয়ে লড়াই যদি চলতেই থাকে, তবে কার লাভ আর কার ক্ষতি? আফগানিস্তানে আগুন জ্বললে আমেরিকার ক্ষতি হওয়ার কারণ নেই। পলাতকদের আশ্রয় দিতে গিয়ে পাকিস্তানের বিপদ হতে পারে।
এমনি হয়েছিল বাংলাদেশজুড়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের কালে। বাঙালি বড় নিরীহ-দুঃখসহিষুষ্ণ জাতি। হাজার ব্যথা সইবার মতো অসীম ধৈর্য বাঙালির। যখন সহনের সীমা অতিক্রম করেছে তখনই বাঙালির জাগরণ ঘটেছে। সর্বশক্তি নিয়ে বিদ্রোহ আর বিপ্লব। কার বিরুদ্ধে বাঙালির বিদ্রোহ? বাংলাকে যারা দুই দশক ধরে নির্মম ও বিচিত্রভাবে শোষণ করেছে, অন্যায়-অবিচারের তলায় নিয়ে গিয়ে বাঙালি জাতিসত্তাকে চিরতরে পদদলিত করেছে, তখনই বাংলার দলিত মানুষের জাগরণ। নিরস্ত্র, নিরীহ বাঙালির উত্থান তখন। কিন্তু বিপক্ষ শক্তি নিজের বলে ও বিদেশি মহাশক্তির প্রশ্রয়ে উন্মত্ত হয়ে বাংলার মানুষের ওপর আছড়িয়ে পড়েছে। রক্তের বন্যায় বাংলা ভেসে গেল। লাখ লাখ ঘর-দুয়ার অগি্নদগ্ধে ছাই হলো। যাতায়াত ব্যবস্থা ধ্বংস হলো। ঘরে ঘরে সম্ভ্রমহীন বেদনার মহারোল। অনন্যোপায় বাংলার মানুষ সর্বস্ব ফেলে বাঁচার জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারতে ছুটেছে। ছুটতে ছুটতে পথের মাঝেই ক্ষুধায় প্রাণ গেছে হাজার মানুষের।
শান্তির জন্য সংগ্রাম। সেই সংগ্রামের কারণেই জীবনপাত। শান্তির জন্য লড়াই, তাতেই সর্বহারাদের ক্রন্দন, তাতেই দুনিয়ার ছোট দরিদ্র দেশে ভাংচুর আর ধ্বংস। খাদ্য নেই, বসবাস নেই, সঙ্গতি নেই, এমনি অসহনীয় করুণ অবস্থা। তবু বড়দের ইঙ্গিত আর উস্কানিতে পক্ষ-বিপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ। শান্তি নেই দেশে দেশে, স্বজনহারার বেদনায় আর্তনাদ ঘরে ঘরে।
জাতিসংঘ এই বিবাদ নিরসন আর সংঘর্ষ শীতল করার জন্য 'পিসকিপিং' করেছে। নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশ থেকে সেনাসদস্য নিয়ে পিসকিপিং। বাংলাদেশের এগারো হাজার সেনা ও পুলিশ সদস্য এমনি পিসকিপিং কমিশনে কাজ করে চলেছে দুই দশক ধরে। কিন্তু কেবল শান্তি স্থাপন শেষ কথা নয়। অশান্তির জন্য যে ধ্বংস হয়েছে, বিভিন্ন সংস্থাপন বন্ধ হয়ে গেছে, বসবাসের বাড়িঘর ধুলায় লুটিয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, সেসবের পুনর্বাসনের জন্য জাতিসংঘ পিসকিপিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে পিসবিল্ডিং গড়ে তোলায় আগ্রহী। মাত্র দু'একদিনের জন্য শান্তি নয়, চিরস্থায়ী শান্তি ও নিশ্চিন্ত সুখের জীবন। শান্তি বিনির্মাণের জন্য চাই স্থায়ী টেকসই আয়োজন। জাতিসংঘ পিসবিল্ডিং কমিশন এ রকমই প্রস্তাব করেছে ব্যাপক ও বিস্তৃত কর্মসূচির।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পুনরায় অশান্তি ও বিবাদ বন্ধ করার জন্য সংঘর্ষে আহত দেশটির অতি প্রয়োজনীয় সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে পুনরায় সেখানে পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করতে হবে। সে দেশের উন্নয়নের জন্য এবং পুনরায় বিবাদ ও সংঘর্ষ ঘটার আগেই সে দেশের ন্যায্য প্রয়োজনগুলো নির্দিষ্ট করে উন্নয়ন ক্রিয়াকাণ্ডে সর্বপ্রকার সাহায্যের জোগান দিতে হবে।
সেসব দেশের জনগণের জাতীয় অধিকার ও সত্তাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। সে জাতির রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকারকে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করে সে সমাজে একটি সুস্থির অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে।
উপরোক্ত কর্মসূচির সাফল্যের জন্য সামগ্রিক সহযোগিতা প্রয়োজন। দ্বিপক্ষীয় বা বহুমাত্রিক সহযোগ নিয়ে সে দেশের বিনির্মাণ কাজে নামতে হবে। এমন কর্মধারা তৈরির আগে যে অর্থ সম্পদের প্রয়োজন, তার জন্য সক্ষম জাতিগুলোর সাহায্য ও সহযোগিতা আদায় করতে হবে।
এমন সব পুনর্বাসনকর্মে উৎসাহ দিতে হলে প্রাক্তন অভিজ্ঞতার বেশি প্রয়োজন। আজ ইরাক বা লিবিয়াজুড়ে যে ছিন্নভিন্ন অবস্থা, তেমন অবস্থায় অন্য দেশের পুনর্বাসনের কাজ কীভাবে করা হয়েছে, তা লক্ষ্য করা। যেমন যুদ্ধোত্তর ধ্বংসপ্রায় বাংলাদেশের অর্থনীতির সংগঠন, যাতায়াত ব্যবস্থার পুনঃসংগঠন এবং আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় যে অভিজ্ঞতা, তার সাহায্যে বর্তমানকালের যুদ্ধোত্তর দেশের সমস্যা সমাধানের দিকনির্দেশনা নিতে হবে।
মোট কথা, ক্ষণিকের জন্য বিবাদ ও সংঘর্ষ মিটিয়ে দেওয়া হয়তো খুব কঠিন কাজ নয়। সকলেই মিলেমিশে সহাবস্থানে থেকে শান্তির নীড় রচনা করতে চায়। আর এই শান্তির আলয় তৈরির জন্য যে বিস্তৃত কাজ_ যেমন, শাসন ব্যবস্থা, অর্থনীতির সংগঠন, শিক্ষার আবহ, গণতন্ত্রের যথার্থ ব্যবহার, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্ম সাধন ইত্যাদি বিচিত্র কর্মকাণ্ডকে স্থির করার জন্যই পিসবিল্ডিং।
জাতিসংঘ যুদ্ধোত্তর দেশগুলোর অশান্ত পরিমণ্ডলে স্থির জীবন ও সমাজ গঠনে পিসবিল্ডিং কমিশন কাজ করেছে ১৯০৫ সালে। ২০১২ সালে সে কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পুনর্বাসন কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা আছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কিছুকাল আগেও পার্বত্য অঞ্চলে বিদ্রোহীদের উপদ্রব ছিল। এ দেশ যুদ্ধোত্তর ধ্বংসের মধ্য থেকে পুনরায় শান্তির নিলয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। নিজের সম্বল দিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে বিপুল উন্নয়ন কর্ম করে চলেছে। নিদ্বর্িধায় বলা যায়, বাংলাদেশ এখন শান্তির 'রোল মডেল' হিসেবে স্বীকৃত। মৌলবাদীদের উৎপাত বন্ধ হয়েছে। এ দেশের সামাজিক অস্থিরতা আর বিচার বিভাগীয় নিরপেক্ষতা স্বীকৃত হয়েছে। ছোটখাটো কিছু সামাজিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তি আগেও ছিল, এখনও আছে। কিন্তু সরকারি শাসনযন্ত্র এসব বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক এবং সজাগ।
বাংলাদেশ তার এমন সব অভিজ্ঞতা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রের অশান্তি নিরসনে যেমন সফল হয়েছে, তেমনি পিসবিল্ডিং অর্থাৎ শান্তি স্থায়ীকরণের গুরুদায়িত্বে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম।
বিশ্বের জলবায়ুতে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সমুদ্রের গভীরতা হ্রাস পেয়ে সমুদ্রের পানি ওপরের দিকে উঠে আসছে। বিশাল বরফরাশি অস্বাভাবিক তাপ বৃদ্ধির ফলে গলে গিয়ে দ্রুতবেগে জলধারায় সমতলে ছুটে আসছে। প্রকৃতির এমন আচরণের জন্য দায়ী মহাশক্তিমানদের যুদ্ধাস্ত্র ও পারমাণবিক বিষাক্ত বোমার বিস্টেম্ফারণ। শক্তিধরদের লোভ, মদমত্ততার জন্য প্রকৃতি ও মানবজাতি শাস্তি ভোগ করতে পারে না। যুদ্ধোত্তর দেশগুলোর দুর্দশার জন্য তাদেরই যুদ্ধবিগ্রহ ও অধিকার মত্ততা দায়ী। যুদ্ধোত্তর দেশগুলোর জন্য স্থায়ী শান্তি বিনির্মাণ কর্মকাণ্ড পরিচালনায় অর্থ অনুদান তাদেরই করতে হবে। আহত দেশের অর্থনীতির বুনিয়াদ একবার মজবুত এবং নির্ভয় হলে সে দেশ ও জাতি নিজেই এগিয়ে আসবে। বাংলার নেতৃত্বে বিশ্বময় মানুষের মধ্যে জাগরণ আসুক, আমরা স্থায়ী শান্তি চাই, যুদ্ধকে ঘৃণা করি আমরা।
বর্তমানে জাতিসংঘ চিহ্নিত যুদ্ধ ও বিবাদ বিধ্বস্ত দেশগুলো হলো বুরুন্ডি, সিয়েরালিওন, গিনি, গিনি-বিসাও, লাইবেরিয়া এবং সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক। এ ছাড়াও যুদ্ধবিধ্বস্ত অনেক দেশ আছে। সবখানেই পিসবিল্ডিংয়ের কার্যক্রম দরকার। এসব দরকার ও প্রয়োজনকে পাশ কেটে যারা শান্তির কথা বলে মাতবরি করছে বা হুকুমের ছড়ি ঘোরাচ্ছে, তারাই অশান্তি সৃষ্টি করে ফায়দা লুটতে চায়। তারা শান্তির জন্য স্থায়ীভাবে পুনর্গঠন কর্মকাণ্ডে আগ্রহী নয়। স্থায়ী শান্তিতে তাদের সুখ হয় না।
যুদ্ধে বিধ্বস্ত বাংলাদেশের মানুষ আমরা ভালো করেই বুঝি শান্তি ও শান্তির স্থায়ী অবস্থা না হলে কোটি কোটি মানুষের ঘরে ও হৃদয়ে কখনোই আনন্দ ও সুখ আসবে না। তাই পিসবিল্ডিং কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিতে বাংলাদেশ পিছপা নয়।

মমতাজউদদীন আহমদ : কলাম লেখক ও নাট্য ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.