জীববৈচিত্র্য-কাছিম পাচার, না কাছিম খামার by গাজী আসমত
ভূতাত্তি্বক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ এক সময় বন্যপ্রাণীতে সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে সুপরিচিত ছিল। এসব বন্যপ্রাণী দেশের প্রাকৃতিক ও আহরণযোগ্য সম্পদ। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে এ প্রাণিসম্পদ সহজেই অর্থসম্পদে পরিণত হতে পারবে।
তবে দক্ষ প্রশাসক ছাড়া এসব কল্পনা করা অবশ্য অনুচি
কাছিম পাচারের খবরে এখন আর মানুষ অবাক হয় না। কয়েক দিন পরপরই সীমান্ত পাড়ি দেওয়া পাচারি কাছিমের খবর পড়তে হয়। এসব কাছিম নাকি ভারত থেকে পাচার হয়ে প্রথমে বাংলাদেশে ঢোকে। এর পর চলে যায় থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর বা দক্ষিণ-পূর্ব অন্যান্য দেশে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে বন্যপ্রাণী পাচার রোধে দেশের ভেতরে বন্যপ্রাণী ও বন্যপ্রাণীর অংশবিশেষ পরিবহনে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, শত শত কাছিম কী করে বর্ডার গার্ডের (এবং বিএসএফ) কড়া নজরের মধ্যে দেশে ঢুকে খুব সহজেই বাস-ট্রাকে চড়ে খোদ ঢাকা শহরে এসে শুধু অবস্থানই করছে না; বিমানে চড়ে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে! কয়েকটি ঘটনা সম্প্র্রতি খবরের কাগজ ও টেলিমিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে বলে আমরা কাছিম পাচার বিষয়ে জানতে পেরেছি। গত ৪০ বছরে এমন চালান কত গেছে, তার হিসাব কারও জানা আছে কি-না কে জানে! এসব ঘটনার মধ্য দিয়েই ফুটে ওঠে বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী পাচারচক্র কতখানি সক্রিয়।
কাছিম পাচারের কথায় প্রথমেই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক_ যেসব কাছিম ভারত থেকে আসছে; সে দেশে কাছিম বেচাকেনা-রফতানির প্রচলন আছে কি-না? যদি থাকত, তাহলে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে তা পাচার হতো না_ এটা স্বাভাবিক উত্তর। কিন্তু এত কাছিম ভারত থেকে এসে বাংলাদেশে ধরা পড়ল; এ বিষয়ে বাংলাদেশের বন বিভাগ ভারতের বন বিভাগের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেছে কি-না, সে বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। শুধু তাই নয়; কাছিমগুলো পুশব্যাকও করা হচ্ছে না দেখে বরং অবাক হচ্ছি। কয়েক বছর আগে একটা ভারতীয় হাতি এদেশে চলে এসেছিল। সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা কতই না মেহনত করেছেন সেই হাতিকে ভারতে ফেরত পাঠাতে! পাঠিয়েওছিলেন। সৌহার্দ্যের হাতি বলে কথা! (কারণ এটি নাকি বাংলা-ভারত দু\'দেশেই যাতায়াত করে)। এ ব্যক্তিরা কিন্তু কখনও পাচারি কাছিমগুলো ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করেন না। তারা কোন ক্ষমতাবলে ভিনদেশের প্রাণী ধরে সাফারি পার্কে পাঠিয়ে দেন, সেখানে ওগুলো মরে যায়, নাকি পাচার হয়ে যায়, তার হদিস থাকে না। তারা রোগ-জীবাণুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে এসব প্রাণী ধরে দেশের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেন। এর জবাবা কে দেবে? অথচ চিড়িয়াখানায় প্রাণী আমদানি করা হলেও নিয়ম অনুযায়ী সেসব প্রাণীকে তিন মাস আলাদা রাখা হয় রোগ-ব্যাধি-জীবাণু পরীক্ষার জন্য।
অবাক কাণ্ড হচ্ছে, এসব নিয়ম-নীতি বন বিভাগ মানে না। নিয়ম-নীতি তো মানেই না; ভারতীয় কাছিম পাচার হয়ে এ দেশে আসছে_ তার খোঁজও রাখছে না। ধরা পড়ছে শেষ মুহূর্তে; বিমানবন্দরের কাস্টমসে। কেন এই পুনঃপাচার? কাছিম কি আমরা উৎপাদন করতে পারি না? সহায়ক রফতানি খাত হিসেবে কাছিমের খামার প্রতিষ্ঠা ও কাছিম রফতানির অনুমতি দিলে কি ক্ষতি হবে? রফতানির কী দরকার? অভ্যন্তরীণ বাজারে এর চাহিদা কি কম? বাংলাদেশে সামুদ্রিক-অসামুদ্রিক মিলে প্রায় ৩০ প্রজাতির কাছিম আছে। সামুদ্রিক ৪ প্রজাতি বাদ দিয়ে বাকি ছোট-বড় সবই ভোগ্য কাছিম। তবে বড় ও মাঝারি কাছিমগুলোর কদর বেশি। বলা যেতে পারে, ২০ প্রজাতির কাছিম বাংলাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভোগ্য কাছিম হিসেবে জনপ্রিয়। এ ২০ প্রজাতির মধ্য থেকেও যদি বাছাই করে ১০ প্রজাতির কাছিমের খামার গড়ে তোলা যায়, তাহলে গরু-ছাগল-মাছের পাশাপাশি কাছিম থেকেও মানুষ প্রোটিন পাবে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আগে থেকেই এমন অপ্রচলিত পদ্ধতিকে সচল করতে হবে। বন্যপ্রাণী উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্যরা ঠাণ্ডা মাথায় এখনই যদি কাছিম-সাপ-হরিণের খামার প্রতিষ্ঠার কথা না ভাবেন, তাহলে প্রবাল দ্বীপ যেমন হোটেল দ্বীপ হয়ে গেছে; ঠিক তেমনি বন্য কাছিম-সাপ-হরিণ সবকিছু পোষা হয়ে যাবে। আলামত শুরু হয়ে গেছে বাতাগুর আর পাহাড়ি কাছিমকে বাস্তুচ্যুত করার মধ্য দিয়ে।
কাছিমের খামার কীভাবে হতে পারে_ এ বিষয়টি অন্য দেশের খামার পর্যালোচনা করে দেশীয় পরিস্থিতির সমন্বয় ঘটিয়ে করা যেতে পারে। চওড়া অথচ নরম মাটির পাড়যুক্ত একটি বড় পুকুর থেকে প্রতি বছর শত শত আহরণ উপযোগী কাছিম পাওয়া যাবে। ডিম পাড়ার জায়গাটি (পুকুরপাড়) ঠিক রাখতে পারলে ডিম সরবরাহে কষ্ট হবে না। প্রথমবার হয়তো বন্য কাছিমের ডিম বা বাচ্চা সংগ্রহ করতে হতে পারে। পরে এ সমস্যা একেবারেই থাকবে না। উপজেলা পশু কর্মকর্তার অফিস থেকে কেউ কাছিম ফার্ম সপ্তাহে একবার ঘুরে দেখতে পারবেন না_ তা মনে হয় না। ডিসি সাহেবরা প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি বড় খাস পুকুর ভালোভাবে সংস্কার করে একটি কাছিমের খামার গড়ায় অনায়াসে সাহায্য করতে পারেন। এ খামার জেলা শহরের কেন্দ্রে করতে হবে_ এমন কথা নেই। জেলার যে কোনো জায়গায় তা হতে পারে। যেমন ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে অন্তত একটি বড় ও কাছিম চাষোপযোগী পুকুর পাওয়া যাবে না_ তা কেউ বিশ্বাস করবেন না। চাষের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কাছিম প্রজাতি সম্বন্ধে সতর্ক থাকতে হবে। নিয়মের মধ্যে আনতে হবে_ যে জেলায় যে কাছিম প্রজাতি বেশি পাওয়া যায়, সে জেলায় ওই কাছিম প্রজাতির চাষ করা যাবে না। অন্য প্রজাতির কাছিমের খামার গড়তে হবে। এর কারণ, ওই এলাকার বন্য কাছিম প্রজাতির সংখ্যা ও বৈচিত্র্য রক্ষা করা। যেমন এ মুহূর্তে যদি খুলনা বিভাগে বাণিজ্যিকভাবে হরিণ খামারের অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে সুন্দরবন ফাঁকা হয়ে গেছে। খামারের নামে সুন্দরবনের হরিণ বিক্রি শুরু হয়ে যাবে। এ কথা মাথায় রেখে গরিব জনগোষ্ঠী যেখানে বেশি, সেখানে এবং ওই গরিবদের তত্ত্বাবধানে কাছিমের খামারগুলো দেখভালের দায়িত্ব দিলে কাজ হতে পারে। এর প্রধান তত্ত্বাবধান ও নিরাপত্তা বিধান করবেন উপজেলা পশু কর্মকর্তা, যারা গবাদি পশু-পাখির কর্মকর্তা। তিন-চার বছরে শাবক কাছিম বড় হয়ে ডিম দিতে শুরু করবে। তখন থেকে প্রতি বছর বা দু\'বছর পরপর গরিবদের সঙ্গে সরকারের টাকা ভাগাভাগির ব্যাপারটা সরকার ভালো বুঝবে। সড়কের দু\'পাশের গাছ দেখভালের জন্য যেমন গ্রামবাসী ও সরকারের আর্থিক লাভের বিষয় জড়িত; ঠিক তেমনি কাছিম খামারিদের সঙ্গেও সরকারের এমন চুক্তি হতে পারে।
ভূতাত্তি্বক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ এক সময় বন্যপ্রাণীতে সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে সুপরিচিত ছিল। এসব বন্যপ্রাণী দেশের প্রাকৃতিক ও আহরণযোগ্য সম্পদ। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে এ প্রাণিসম্পদ সহজেই অর্থসম্পদে পরিণত হতে পারবে। তবে দক্ষ প্রশাসক ছাড়া এসব কল্পনা করা অবশ্য অনুচিত। নির্লোভ ও কৌশলী, বুদ্ধিদীপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া এ কার্যক্রম সফল করা অসম্ভব। নতুন বন্যপ্রাণী আইনে যদি এখনও উপদেষ্টা বোর্ডের বিধান রাখা হয়ে থাকে, তবে নিরপেক্ষ বোর্ড গঠনের উদ্দেশ্যে মাঠপর্যায় থেকে দক্ষ সংগঠক ও নিবেদিতপ্রাণ বন্যপ্রাণী-প্রেমিকদের নিয়ে আসতে হবে।
আশা করব, মানুষের আয় বাড়াতে এবং দেশের রফতানি ও পর্যটন খাত উন্নয়নে গতিশীল ভূমিকা রাখবে কাছিম খামারগুলো। আমাদের মনে রাখতে হবে সামনের ভয়াবহ দুর্দিনের কথা। সারা পৃথিবীতে আবহাওয়া পরিবর্তনের কুফল এসে পড়বে বাংলাদেশে। এখন থেকেই যদি নির্দিষ্ট জেলার নির্দিষ্ট স্থানে হরিণ, সাপ, কাছিমের খামার করার উদ্যোগ না নেওয়া হয়, অপ্রচলিত প্রাণীর খামার উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের সহায়ক আয়ের পথ উন্মুক্ত করা না হয়, তাহলে ভয়াবহ দিনগুলো কেবল দুর্বিষহই হবে না; সামাজিক বিশৃঙ্খলায় আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব।
ড. গাজী আসমত :অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
gasmat@gmail.com
কাছিম পাচারের খবরে এখন আর মানুষ অবাক হয় না। কয়েক দিন পরপরই সীমান্ত পাড়ি দেওয়া পাচারি কাছিমের খবর পড়তে হয়। এসব কাছিম নাকি ভারত থেকে পাচার হয়ে প্রথমে বাংলাদেশে ঢোকে। এর পর চলে যায় থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর বা দক্ষিণ-পূর্ব অন্যান্য দেশে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে বন্যপ্রাণী পাচার রোধে দেশের ভেতরে বন্যপ্রাণী ও বন্যপ্রাণীর অংশবিশেষ পরিবহনে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, শত শত কাছিম কী করে বর্ডার গার্ডের (এবং বিএসএফ) কড়া নজরের মধ্যে দেশে ঢুকে খুব সহজেই বাস-ট্রাকে চড়ে খোদ ঢাকা শহরে এসে শুধু অবস্থানই করছে না; বিমানে চড়ে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে! কয়েকটি ঘটনা সম্প্র্রতি খবরের কাগজ ও টেলিমিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে বলে আমরা কাছিম পাচার বিষয়ে জানতে পেরেছি। গত ৪০ বছরে এমন চালান কত গেছে, তার হিসাব কারও জানা আছে কি-না কে জানে! এসব ঘটনার মধ্য দিয়েই ফুটে ওঠে বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী পাচারচক্র কতখানি সক্রিয়।
কাছিম পাচারের কথায় প্রথমেই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক_ যেসব কাছিম ভারত থেকে আসছে; সে দেশে কাছিম বেচাকেনা-রফতানির প্রচলন আছে কি-না? যদি থাকত, তাহলে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে তা পাচার হতো না_ এটা স্বাভাবিক উত্তর। কিন্তু এত কাছিম ভারত থেকে এসে বাংলাদেশে ধরা পড়ল; এ বিষয়ে বাংলাদেশের বন বিভাগ ভারতের বন বিভাগের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেছে কি-না, সে বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। শুধু তাই নয়; কাছিমগুলো পুশব্যাকও করা হচ্ছে না দেখে বরং অবাক হচ্ছি। কয়েক বছর আগে একটা ভারতীয় হাতি এদেশে চলে এসেছিল। সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা কতই না মেহনত করেছেন সেই হাতিকে ভারতে ফেরত পাঠাতে! পাঠিয়েওছিলেন। সৌহার্দ্যের হাতি বলে কথা! (কারণ এটি নাকি বাংলা-ভারত দু\'দেশেই যাতায়াত করে)। এ ব্যক্তিরা কিন্তু কখনও পাচারি কাছিমগুলো ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করেন না। তারা কোন ক্ষমতাবলে ভিনদেশের প্রাণী ধরে সাফারি পার্কে পাঠিয়ে দেন, সেখানে ওগুলো মরে যায়, নাকি পাচার হয়ে যায়, তার হদিস থাকে না। তারা রোগ-জীবাণুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে এসব প্রাণী ধরে দেশের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেন। এর জবাবা কে দেবে? অথচ চিড়িয়াখানায় প্রাণী আমদানি করা হলেও নিয়ম অনুযায়ী সেসব প্রাণীকে তিন মাস আলাদা রাখা হয় রোগ-ব্যাধি-জীবাণু পরীক্ষার জন্য।
অবাক কাণ্ড হচ্ছে, এসব নিয়ম-নীতি বন বিভাগ মানে না। নিয়ম-নীতি তো মানেই না; ভারতীয় কাছিম পাচার হয়ে এ দেশে আসছে_ তার খোঁজও রাখছে না। ধরা পড়ছে শেষ মুহূর্তে; বিমানবন্দরের কাস্টমসে। কেন এই পুনঃপাচার? কাছিম কি আমরা উৎপাদন করতে পারি না? সহায়ক রফতানি খাত হিসেবে কাছিমের খামার প্রতিষ্ঠা ও কাছিম রফতানির অনুমতি দিলে কি ক্ষতি হবে? রফতানির কী দরকার? অভ্যন্তরীণ বাজারে এর চাহিদা কি কম? বাংলাদেশে সামুদ্রিক-অসামুদ্রিক মিলে প্রায় ৩০ প্রজাতির কাছিম আছে। সামুদ্রিক ৪ প্রজাতি বাদ দিয়ে বাকি ছোট-বড় সবই ভোগ্য কাছিম। তবে বড় ও মাঝারি কাছিমগুলোর কদর বেশি। বলা যেতে পারে, ২০ প্রজাতির কাছিম বাংলাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভোগ্য কাছিম হিসেবে জনপ্রিয়। এ ২০ প্রজাতির মধ্য থেকেও যদি বাছাই করে ১০ প্রজাতির কাছিমের খামার গড়ে তোলা যায়, তাহলে গরু-ছাগল-মাছের পাশাপাশি কাছিম থেকেও মানুষ প্রোটিন পাবে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আগে থেকেই এমন অপ্রচলিত পদ্ধতিকে সচল করতে হবে। বন্যপ্রাণী উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্যরা ঠাণ্ডা মাথায় এখনই যদি কাছিম-সাপ-হরিণের খামার প্রতিষ্ঠার কথা না ভাবেন, তাহলে প্রবাল দ্বীপ যেমন হোটেল দ্বীপ হয়ে গেছে; ঠিক তেমনি বন্য কাছিম-সাপ-হরিণ সবকিছু পোষা হয়ে যাবে। আলামত শুরু হয়ে গেছে বাতাগুর আর পাহাড়ি কাছিমকে বাস্তুচ্যুত করার মধ্য দিয়ে।
কাছিমের খামার কীভাবে হতে পারে_ এ বিষয়টি অন্য দেশের খামার পর্যালোচনা করে দেশীয় পরিস্থিতির সমন্বয় ঘটিয়ে করা যেতে পারে। চওড়া অথচ নরম মাটির পাড়যুক্ত একটি বড় পুকুর থেকে প্রতি বছর শত শত আহরণ উপযোগী কাছিম পাওয়া যাবে। ডিম পাড়ার জায়গাটি (পুকুরপাড়) ঠিক রাখতে পারলে ডিম সরবরাহে কষ্ট হবে না। প্রথমবার হয়তো বন্য কাছিমের ডিম বা বাচ্চা সংগ্রহ করতে হতে পারে। পরে এ সমস্যা একেবারেই থাকবে না। উপজেলা পশু কর্মকর্তার অফিস থেকে কেউ কাছিম ফার্ম সপ্তাহে একবার ঘুরে দেখতে পারবেন না_ তা মনে হয় না। ডিসি সাহেবরা প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি বড় খাস পুকুর ভালোভাবে সংস্কার করে একটি কাছিমের খামার গড়ায় অনায়াসে সাহায্য করতে পারেন। এ খামার জেলা শহরের কেন্দ্রে করতে হবে_ এমন কথা নেই। জেলার যে কোনো জায়গায় তা হতে পারে। যেমন ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে অন্তত একটি বড় ও কাছিম চাষোপযোগী পুকুর পাওয়া যাবে না_ তা কেউ বিশ্বাস করবেন না। চাষের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কাছিম প্রজাতি সম্বন্ধে সতর্ক থাকতে হবে। নিয়মের মধ্যে আনতে হবে_ যে জেলায় যে কাছিম প্রজাতি বেশি পাওয়া যায়, সে জেলায় ওই কাছিম প্রজাতির চাষ করা যাবে না। অন্য প্রজাতির কাছিমের খামার গড়তে হবে। এর কারণ, ওই এলাকার বন্য কাছিম প্রজাতির সংখ্যা ও বৈচিত্র্য রক্ষা করা। যেমন এ মুহূর্তে যদি খুলনা বিভাগে বাণিজ্যিকভাবে হরিণ খামারের অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে সুন্দরবন ফাঁকা হয়ে গেছে। খামারের নামে সুন্দরবনের হরিণ বিক্রি শুরু হয়ে যাবে। এ কথা মাথায় রেখে গরিব জনগোষ্ঠী যেখানে বেশি, সেখানে এবং ওই গরিবদের তত্ত্বাবধানে কাছিমের খামারগুলো দেখভালের দায়িত্ব দিলে কাজ হতে পারে। এর প্রধান তত্ত্বাবধান ও নিরাপত্তা বিধান করবেন উপজেলা পশু কর্মকর্তা, যারা গবাদি পশু-পাখির কর্মকর্তা। তিন-চার বছরে শাবক কাছিম বড় হয়ে ডিম দিতে শুরু করবে। তখন থেকে প্রতি বছর বা দু\'বছর পরপর গরিবদের সঙ্গে সরকারের টাকা ভাগাভাগির ব্যাপারটা সরকার ভালো বুঝবে। সড়কের দু\'পাশের গাছ দেখভালের জন্য যেমন গ্রামবাসী ও সরকারের আর্থিক লাভের বিষয় জড়িত; ঠিক তেমনি কাছিম খামারিদের সঙ্গেও সরকারের এমন চুক্তি হতে পারে।
ভূতাত্তি্বক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ এক সময় বন্যপ্রাণীতে সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে সুপরিচিত ছিল। এসব বন্যপ্রাণী দেশের প্রাকৃতিক ও আহরণযোগ্য সম্পদ। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে এ প্রাণিসম্পদ সহজেই অর্থসম্পদে পরিণত হতে পারবে। তবে দক্ষ প্রশাসক ছাড়া এসব কল্পনা করা অবশ্য অনুচিত। নির্লোভ ও কৌশলী, বুদ্ধিদীপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া এ কার্যক্রম সফল করা অসম্ভব। নতুন বন্যপ্রাণী আইনে যদি এখনও উপদেষ্টা বোর্ডের বিধান রাখা হয়ে থাকে, তবে নিরপেক্ষ বোর্ড গঠনের উদ্দেশ্যে মাঠপর্যায় থেকে দক্ষ সংগঠক ও নিবেদিতপ্রাণ বন্যপ্রাণী-প্রেমিকদের নিয়ে আসতে হবে।
আশা করব, মানুষের আয় বাড়াতে এবং দেশের রফতানি ও পর্যটন খাত উন্নয়নে গতিশীল ভূমিকা রাখবে কাছিম খামারগুলো। আমাদের মনে রাখতে হবে সামনের ভয়াবহ দুর্দিনের কথা। সারা পৃথিবীতে আবহাওয়া পরিবর্তনের কুফল এসে পড়বে বাংলাদেশে। এখন থেকেই যদি নির্দিষ্ট জেলার নির্দিষ্ট স্থানে হরিণ, সাপ, কাছিমের খামার করার উদ্যোগ না নেওয়া হয়, অপ্রচলিত প্রাণীর খামার উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের সহায়ক আয়ের পথ উন্মুক্ত করা না হয়, তাহলে ভয়াবহ দিনগুলো কেবল দুর্বিষহই হবে না; সামাজিক বিশৃঙ্খলায় আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব।
ড. গাজী আসমত :অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
gasmat@gmail.com
No comments