ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও রেলওয়ের উন্নয়ন by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ

বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০১১-২০১৫ অর্থবছর বাস্তবায়নের নিমিত্তে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ১৯৭৩ থেকে ২০০২ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়। মাঝে অবশ্য ১৯৭৯-৮০ এই দুই বছরের জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ২০০৫ সালের পর এর ব্যত্যয় ঘটে।


এর পরিবর্তে স্বল্পমেয়াদি দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র গ্রহণ করা হয়। বর্তমান সরকার দীর্ঘমেয়াদি ভিশন ২০২১ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। উদ্দেশ্য, এই সময়ের ভেতর বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হবে। এরই আলোকে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এই পরিকল্পনার অধীনে সর্বমোট বিনিয়োগ ধরা হয়েছে ১৩.৫ ট্রিলিয়ন টাকা। এর ভেতর সরকারের বিনিয়োগ ৩.১ ট্রিলিয়ন টাকা (মোট পরিকল্পিত বিনিয়োগের ২২.৮ শতাংশ)। বেসরকারি বিনিয়োগ ১০.৪ ট্রিলিয়ন টাকা অর্থাৎ ৭৭.২ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ অর্থায়নের পরিমাণ ৯০.৭ শতাংশ। বৈদেশিক সব সাহায্যের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৯.৩ শতাংশ। বস্তুত অপচয় এবং দুর্নীতি রোধ করতে পারলে আদৌ কি কোনো বৈদেশিক অর্থায়নের প্রয়োজন হতো। এক হলমার্কের লুট করা টাকা দিয়ে প্রস্তাবিত পদ্মা সেতুর ২০ শতাংশ ব্যয় মেটানো সম্ভব হতো। এ রকম কত হলমার্ক আছে কে জানে? পরিকল্পনাপত্রে ভালো ভালো কথা আছে, যা পড়লে পরান জুড়ায়। যেমন বলা হয়েছে যে পরিকল্পনা সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত করতে হলে প্রয়োজন সুশাসনের। আর সুশাসনের জন্য আবার প্রয়োজন প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, যার সঙ্গে জনগণের প্রত্যক্ষ সংযোগ। কিন্তু যেটি নির্মম পরিহাস, তা হলো- এহেন মূল্যবান দলিল প্রণয়ন করেছে তারা কতটুকু আন্তরিক সুশাসন এবং এর সঙ্গে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে। জেলা স্বায়ত্তশাসনব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট হিসেবে কাজ করতে পারে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো সরকার জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করল না বা করার সাহস দেখাতে পারল না। ভয় একটাই যে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা ক্ষুণ্ন হবে। উপজেলা পরিষদের ব্যাপার আমরা দেখেছি যে সদস্য-সদস্যা কিভাবে একে নিষ্ক্রিয় করতে পারেন তা-ই নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন তারা। তাদের কাছে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা হলো বাত কি বাত।
ফিরে আসি বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রসঙ্গে। পরিকল্পনাপত্র থেকে তথ্য উল্লেখ করছি। দেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন বাংলাদেশ রেলওয়ের ২৮৫৮.০৪ কিলোমিটার রেললাইন ছিল। বর্তমানে তা কমে ২৮৩৫.০৪ কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে রেলওয়ে স্টেশনের সংখ্যাও কমে গেছে। এ রকম অবস্থা কল্পনা করা যায়! বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কমবেশি সব সেক্টরে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। সড়ক ও সড়ক পরিবহনের উন্নতি তো গর্ব করার মতো। উত্তরবঙ্গের সব উপজেলাসহ দেশের বেশির ভাগ উপজেলা সদরের সঙ্গে ঢাকার সরাসরি কোচ সার্ভিস রয়েছে। সড়ক পরিবহনে মুনাফা অনেক বেশি, তাই বেসরকারি খাতের ব্যাপক বিনিয়োগ হয়েছে এখানে। সড়ক পরিবহনের অগ্রগতি হলে রেলকে ধ্বংস করতে হবে, এমনটা কি হতে পারে? প্রতিবেশী দেশ ভারতে সড়ক ও রেলপথ পাল্লা দিয়ে চলছে। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে একে দুবার অবহেলার শিকার হতে হয়েছে। প্রথমে উপমহাদেশ ভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির পর। পাকিস্তানি শাসকরা যাত্রা করল আমাদের মাতৃভাষার গলা টিপে ধরে। শুরু করল সামাজিকভাবে শোষণ। পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি থেকে কলকাতায় শিয়ালদহ পর্যন্ত দীর্ঘ ব্রডগেজের ডাবল লাইন ছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চিলাহাটি থেকে দর্শনা পর্যন্ত বড় একটা অংশ আমাদের ভূখণ্ডে পড়ে। দার্জিলিংয়ের প্রবেশপথ শিলিগুড়ি। বেশ দ্রুতগামী কয়েকটি ট্রেন শিয়ালদহ-শিলিগুড়ি যাতায়াত করত। পাকিস্তানি শাসকরা ধীরে ধীরে এ ডাবল লাইন সিঙ্গেল ট্রাকে পরিণত করল। এর পরও পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে মোটামুটি ভালোভাবে চলছিল। এমনকি লোকাল ট্রেন সময়মতো চলাচল করত। বলা বাহুল্য সে সময় রেলপথ ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় পরিবহন। বেশির ভাগ পণ্য বহন করা হতো রেলপথে। উত্তরবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের মাঝে বড় বাধা যমুনা নদী। এ সত্ত্বেও বেশ কয়েকটি ফেরির মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করা হতো। আর বাহাদুরাবাদ এবং ফুলছড়ি ঘাটে তো ফেরির মাধ্যমে মালবাহী গাড়ির ওয়াগন পার করা হতো। রেল এখন আমাদের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এটা যেন আমাদের সংস্কৃতি। কত লেখক কত গল্পের উৎপত্তিস্থল হিসেবে বেছে নিয়েছেন রেলস্টেশন।
বাংলাদেশ রেলওয়ের দুর্ভাগ্য যে স্বাধীনতার পর রেলওয়ে বিভাগ যে অবহেলায় পড়ল। তা পাকিস্তানি শাসকদের অবহেলার চেয়েও ভয়াবহ। রেললাইনের সংকোচন এবং রেলস্টেশন বন্ধ হওয়া এর বড় প্রমাণ। রেলওয়ে মন্ত্রণালয়কে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হলো। আর মাঝেমধ্যে এমন যোগাযোগমন্ত্রী দায়িত্ব নিয়েছেন, যিনি আসলে সড়ক পরিবহন নেটওয়ার্কের হয় বেনিফিশিয়ারি অথবা স্টেক হোল্ডার। রেলওয়ে বিভাগের আরো দুর্ভাগ্য যে এমন কোনো প্রধান নির্বাহী আসেননি, যাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল রেলওয়ে বিভাগের কাজকর্মে। বেতন-ভাতা নিয়েছেন রেলওয়ে বিভাগ থেকে। সেলুনে চলাফেরা করেছেন। রেলওয়ে নিরাপত্তাকর্মীরা স্যালুট দিয়ে জনবিচ্ছিন্ন করে গন্তব্যস্থলে নিয়ে গেছেন। কিন্তু রেলওয়ে বিভাগের অগ্রগতির জন্য সামান্যতম চিন্তা করেননি কিংবা সময় দেননি। নেমক হালাল করেননি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে সবাই মনে করছেন, রেলওয়ের আধুনিকীকরণ কিংবা উন্নয়ন চুলোয় যাক, একাত্তরের ২৫ মার্চ রেলওয়ে যে অবস্থায় ছিল, সেখানে ফিরে গেলে আমরা বর্তে যাই। এহেন হতাশ অবস্থার কিছুটা অবসান হবে।
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা যখন তৈরি হয়, তখন রেলওয়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরিকল্পনা প্রতিবেদন পড়ে মনে হয় যে যাঁরা প্রণয়ন করেছেন, তাঁরা রেলওয়ের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। পরিকল্পনাপত্রে আমাদের অনেক স্বপ্ন দেখানো হয়েছে যেমন ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের কথা বলা হয়েছে। কে আর অপছন্দ করবে, যদি বাংলাদেশের কোনো রেলওয়ে স্টেশনে রেলগাড়িতে চড়ে বিশ্বভ্রমণে বের হওয়া যায়। সাবেক এক যোগাযোগমন্ত্রী তো ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনে ম্যাগনেটিক ট্রেন চালুর কথাও বলেছিলেন। এ দেশে একটা সুবিধা রয়েছে। মন্ত্রীদের তাঁদের নিয়োগকর্তা ছাড়া আর কারো কাছে দায়বদ্ধতা নেই। তাই যা খুশি বলা যায়। যেমন- সাংবাদিকদের পুলিশ থেকে দূরে থাকতে কেউ উপদেশ দিয়েছেন, আবার কেউ গৃহে তালা লাগার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। যে যোগাযোগমন্ত্রী ম্যাগনেটিক ট্রেন চালুর কথা বলেছিলেন, তাঁর এ সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহ করার অবকাশ রয়েছে। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রস্তাবিত পদ্মা সেতুকে নিয়ে নতুন রেলপথ নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। তারপর ঈশ্বরদী-পাবনা রেলপথ নির্মাণের কথাও বলা আছে। তাদের fesibility প্রথা কি রাজনৈতিক না বাণিজ্যিক সে ব্যাপারে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলে বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থার ওপর জরিপ করার জন্য British Transport Survey Team কাজ করেছিল। কয়েক ভল্যুম তারা রিপোর্ট দিয়ে গেছে। যেখানে একটা পরামর্শ ছিল যে দক্ষিণবঙ্গে রেলপথ নির্মাণ ব্যয়বহুল হবে, তবে জলপথের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তাদের বাক্য অলঙ্ঘনীয় তা বলছি না। তবে সব কিছু পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় জনগণের স্বার্থের কথা ভেবে গ্রহণ করা উচিত। কোনো রাজনৈতিক বা আঞ্চলিক স্বার্থ মুখ্য হওয়া উচিত নয়, তা করলে সেটা হবে অনৈতিক এবং ফৌজদারি দণ্ডবিধি অনুযায়ী অপরাধযোগ্য। কেননা এটা হবে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড।
বর্তমানে রেলওয়ের জন্য প্রয়োজন ক্র্যাশ প্রোগ্রাম। এর অধীনে জরুরি ভিত্তিতে রেলওয়ে ইঞ্জিন, প্যাসেঞ্জার কোচ এবং মালবাহী ওয়াগন আনা দরকার। গত ঈদে জনগণকে রেলওয়ে বিভাগ যেন সর্বোচ্চ সেবা দান করতে পারে, এর জন্য রেলমন্ত্রী খুবই ছোটাছুটি করেছেন। একপর্যায় স্বীকার করেছেন যে জোড়াতালি দিয়ে সেরাটা দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা সেটা বুঝি। চার দশক ধরে রেলওয়েকে যেভাবে অবহেলা করা হয়েছে, তা নজিরবিহীন। সে কথা আগে উল্লেখ করেছি। কোনো মন্ত্রণালয় যুগ যুগ ধরে এ রকম অপকর্ম করতে পারে, এটা বাংলাদেশেই বোধ হয় সম্ভব। মুনতাসীর মামুনের কথার প্রতিধ্বনি করে বলা চলে যে সব সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা রেল সম্পর্কে যে স্বপ্ন দেখিয়েছে, তা আপাতত স্থগিত রাখা যেতে পারে। তখন আগামী দুই-তিন বছরের জন্য ক্র্যাশ প্রোগ্রাম করে রেলওয়েকে সচল করা দরকার। রেলওয়ে বিভাগ যেন কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
শুধু নতুন রেলওয়ে ইঞ্জিন আনলেই ট্রেন দ্রুত চালানো সম্ভব হবে না। রেলওয়ে লাইনেরও সংস্কার করতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। আর একটি কথা শুনে অবাক হতে হয় যে রেলওয়ে বিভাগে ১৩ হাজার পদ খালি। এখন দেশে শিক্ষিত বেকারের অভাব নেই। তা ছাড়া দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য প্রয়োজন বিবিএ ও সিএ ডিগ্রিধারী তরুণ উৎসাহী যুবকদের। তাদেরও অভাব নেই। পরিকল্পনা কমিশনের কাছে আমাদের দাবি, তারা দয়া করে Bureaucratic varity পরিহার করে পরিকল্পনায় সংশোধন করবে। Bureaucratic varity-এর অপর নাম মৌলবাদ। এটি অবশ্য পরিত্যাজ্য। এখানে আরো একটি আবেদন রাখছি পরিকল্পনা কমিশনের কাছে। তারা যখন পরিকল্পনা তৈরি করে তখন রেলওয়ে এতিম ছিল। এখন তো পৃথক মন্ত্রণালয় হয়েছে। তাই বরাদ্দটা এখন বিভক্ত করে সড়ক ও রেলপথের অর্থ পৃথকভাবে দেখাতে হবে।
লেখক : সাবেক সরকারি কর্মকর্তা

No comments

Powered by Blogger.