ওজোন স্তরের ক্ষয় অব্যাহত হুমকিতে মানবজাতি by আহমেদ ফিরোজ
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে ক্ষতিতে পড়ছে পৃথিবীর ওজন স্তর। পাল্টে যাচ্ছে পরিবেশের আচরণ। হুমকিতে পড়ছে গোটা মানবজাতি। যার বাইরে নয় বাংলাদেশও। এই ঝুঁকির প্রেক্ষক্ষতে আজ রোববার বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে আমত্মর্জাতিক ওজোন স্তর রক্ষা দিবস।
১৯৯৫ সাল থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালন করা হচ্ছে। ওজোন স্তর ক্ষয় ও তার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৯৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর এক সভায় প্রতিবছর ১৬ সেপ্টেম্বর ‘আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর রক্ষা দিবস’ (International Day for the Preservation of the Ozone Layer) হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য: Protecting our atmosphere for generations to come অর্থাৎ আগামী প্রজন্মের জন্য বায়ুম-লকে সুরক্ষিত করতে হবে।
সারা বিশ্বে মানব সম্প্রদায় নিজেরা নিজেদের বিরম্নদ্ধে যুদ্ধে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করে পরিবেশ বাঁচাতে তার ১০ শতাংশ ব্যবহার করলে নিশ্চিত বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হতো। আধুনিক জীবনে শক্তির রূপান্তরের মাধ্যমে বায়ুম-লের ওজোন স্তর ধ্বংসে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো সবচেয়ে বেশি দায়ী। প্রসঙ্গত, সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে পৃথিবীকে নিরাপদ রাখতে ওজোন স্তরের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে মানবসৃষ্ট বিভিন্ন গ্যাস ও দ্রব্য ওজোন স্তর ক্ষয় করছে-যা পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। ওজোন স্তর ক্ষয়রোধে তাই বিশ্ববাসী আজ সোচ্চার। আশির দশকের শেষদিকে আন্তর্জাতিক পরিম-লে বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বসহকারে চিমত্মা-ভাবনা শুরম্ন হয়। প্রথমে ১৯৮৫ সালে ভিয়েনায় এবং পরে ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ওজোন স্তরকে রক্ষা করার জন্য কানাডার মন্ট্রিল শহরে ওজোনস্তর রক্ষা সংক্রান্ত মন্ট্রিল প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ওজোন স্তরের সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ওই দিনটিকেই সে কারণে ওজোন স্তর রক্ষা দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়। এ বছর মন্ট্রিল চুক্তির ২৫ বছর পূর্তি। বাংলাদেশ মন্ট্রিল প্রটোকল স্বাক্ষর করে এবং প্রটোকলের লন্ডন, কোপেনহেগেন, মন্ট্রিল ও বেইজিং সংশোধনীতে অনুস্বাক্ষর করে। এ ছাড়া প্রটোকল বাস্তবায়নের লক্ষ্য একটি কর্মসূচি প্রণয়ন করে তার আলোকে কাজ করে যাচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. জিলস্নুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। সরকারি পর্যায়ে পরিবেশ অধিদপ্তর শোভাযাত্রা এবং আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
প্রসঙ্গত, পৃথিবীর সকল শক্তির মূল উৎস সূর্যের আলো। সূর্যরশ্মি ক্ষুদ্র তরঙ্গের মাধ্যমে পৃথিবীতে নেমে আসে, পৃথিবী এর সবটাই ধরে রাখে না। ইনফ্রারেড রেডিয়েশনের মাধ্যমে অতিরিক্ত তাপ মহাশূন্যে চলে যায়। বায়ুমণ্ডলের কিছু গ্যাস, যেমন-কার্বন ডাইঅক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেন, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন প্রতিফলিত সবটুকু সূর্যের তাপকে বিকিরিত করে না। পৃথিবীর বর্তমান তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে বেড়ে ২১০০ সালে আরো ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠদেশও ০.৫ মিটার উপরে উঠে আসবে। সমুদ্রের পানি মাত্র ৩ ফুট বাড়লে বাংলাদেশের ১০ ভাগের এক ভাগ এলাকা ডুবে যাবে। ফলে ১৫ ভাগ আবাদযোগ্য জমি ও ৩.৩০ ভাগ বনাঞ্চলের ক্ষতি হবে। আশ্রয়হীন হবে দেড় কোটি লোক। পাহাড় কেটে আবাসস্থল গড়ে তোলার কারণে সমুদ্রস্তর বেড়ে যাচ্ছে আর উপকূলীয় ভাঙন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার তথ্য অনুয়ায়ী, আকাশের নীলাভ রঙ-ই হচ্ছে ওজোন স্তর। ওজোন অক্সিজেনের একটি রূপ। যার রাসায়নিক সংকেত হচ্ছে তিনটি অক্সিজেন পরমাণুর একত্রিকরণ। সূর্যের ‘অতিবেগুনি রশ্মি’ এই ওজোন স্তর শোষণ করে নেয়। এর জন্য সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাব থেকে পৃথিবীর উদ্ভিদসহ প্রাণীজগতের বেঁচে থাকা সম্ভব হয়। প্রায় ২৫ বছর আগে ড. জো ফারম্যানের নেতৃত্বে একদল আবহাওয়া বিজ্ঞানী যখন অ্যান্টার্কটিকায় গবেষণা চালাচ্ছিলেন, তখনই তাদের সূক্ষ্ম আকাশ পর্যবেক্ষক যন্ত্রের মাধ্যমে ওজোন স্তরে ফুটো দেখতে পান। এর আকার দিনে দিনে বাড়ছে। আর এর মাধ্যমেই সূর্যের ‘অতিবেগুনি রশ্মি’ এসে পৌঁছাচ্ছে পৃথিবীতে। পৃথিবীর উষ্ণতাও বেড়ে চলেছে আশঙ্কাজনক হারে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা জানিয়েছে, ২০০৮ সালে ওজোন স্তরের এই ফাটলের পরিমাণ ছিল ২৭ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার। আর ২০০৬ সালে ছিল ২৫ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার। ২০০৯ সালে এই পরিমাণটি একটু কম হলেও তা কোনোভাবেই আশঙ্কার বাইরে নয়৷ ২০০৯ সালে এই পরিমাণ ছিল ২৪ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটারে।
দিবসটির গুরম্নত্ব সম্পর্কে পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, “ওজোন স্তরে ক্ষয়ের সাম্প্রতিক কয়েক বছরের তথ্য সবাইকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে। এ সমস্যা মোকাবিলার জরম্নরি সমাধান খুঁজছেন বিজ্ঞানীরা।” তিনি আরো বলেন, “ভয়াবহ এ অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে জনসচেনতার কোনো বিকল্প নেই। ব্যক্তিগত সচেতনতার পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে প্রতিটি দেশের সরকারকে। আর কাজটি করা যেহেতু কোনো একটি দেশের একার পক্ষে সম্ভব নয়, এ জন্য গোটা বিশ্বকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।”
মন্ট্রিল প্রটোকল অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৯৯৯ সালের ১ জুলাই থেকে ওজোনস্তর ক্ষয়কারী দ্রব্য সিএফসি-১১ ও সিএফসি-১২-এর আমদানি ও ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ শুরু হয়েছে। ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সিএফসি গ্যাসের ৫০ শতাংশ, ২০০৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৮৫ শতাংশ এবং ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে প্রধান প্রধান ওজোন স্তর ক্ষয়কারী দ্রব্য, যেমন- সিএফসি-১১, সিএফসি-১২, কার্বনটেট্রাক্লোরাইডের ব্যবহার শতভাগ হ্রাস করার বাধ্যবাধকতা ছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশ মন্ট্রিল প্রটোকল বাস্তবায়নের সবগুলো ধাপ পালন করেছে। ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি শুধু ওষুধ শিল্প ছাড়া ওডিএস ক্ষয়কারী দ্রব্যের ব্যবহার শতভাগ হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছে।
পরিশেষে, বাসযোগ্য পৃথিবীর আকাঙক্ষায় আমাদেরকে অবশ্যই আরো বেশি সতর্ক হতে হবে এবং মনে রাখতে হবে, মানব সৃষ্ট দূষণ ও বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে প্রকৃতি প্রদত্ত নিরাপত্তা বেষ্টনী ওজোন স্তর দিন দিন ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। গৃহস্থালি পণ্য, যেমন- ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশনার, বিভিন্ন ধরনের স্প্রে ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয় এক ধরনের ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (সিএফসি) গ্যাস- যা শিল্প কারখানাতেও প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। আর এই সিএফসি গ্যাসই মহাশূন্যের ওজোন স্তর ক্ষয়ের অন্যতম কারণ। গাড়ির ধোঁয়া, কলকারখানার বর্জ্য, মারাত্মক পরিবেশ দূষণের ফলে ক্রমবধর্মান হারে নির্গত হচ্ছে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও মিথেন গ্যাস। আবার নির্বিচারে বনভূমি উজাড় করার ফলে অতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষিত হচ্ছে না। ফলে ওজোন স্তরের ক্ষয়জনিত কারণে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি মাত্রাতিরিক্ত পৃথিবীতে পৌঁছাচ্ছে। এভাবে পৃথিবী হয়ে উঠছে উত্তপ্ত। সামগ্রিকভাবে পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, নিম্নভূমিতে প্লাবন, পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, আকস্মিক বন্যা, নদীভাঙন, খরা, সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সম্মুখীন হচ্ছে। আসুন, আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর রক্ষা দিবসে উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে ধরিত্রীকে বাঁচাই।
No comments