মিসরে বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা

মিসর বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য এক সময় আর্দশ ক্ষেত্র বিবেচিত ছিল। সস্তায় কাঁচামাল ও অবকাঠামোগত সুবিধার জন্য। এই দেশটিতে পশ্চিমা বিশ্ব ও ইউরোপের দেশগুলোর বিনিয়োগ করলেও উল্লেখযোগ্যহারে বিনিয়োগ করত উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো।


কিন্তু আরব বসন্ত শুরু হওয়ার পর মিসরে বিনিয়োগ পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায়। অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এক বছরেরও বেশি সময় মিসরে বিনিয়োগ থেকে বিরত ছিলেন উপসাগরীয় অঞ্চলের বিনিয়োগকারীরা। তারা উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নিতে চাননি। সংগ্রাম-বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে হোসনে মোবারককে উৎখাত করা হলেও মিসরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দীর্ঘদিন অচলাবস্থার মধ্য দিয়ে যায় সেনা নিয়ন্ত্রণের কারণে। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ব্রাদারহুডের প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসী মিসরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় বর্তমানে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক। আর এই স্বাভাবিক পরিস্থিতির কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা মিসরে বিনিয়োগ করতে আবার আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে উপসাগরীয় অঞ্চলের বিনিয়োগকারীরা তাদের পুঁজি বিনিয়োগে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। মিসরের রাজনীতি ও ব্যবসায়িক সংস্কৃতির সঙ্গে আরব বিনিয়োগকারীরা পশ্চিমাদের চেয়ে বেশি পরিচিত। তাই দেশটিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তারা সবসময়ই পশ্চিমাদের চেয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। হোসনে মোবারকের পতনের পর দেশটির অর্থনীতিতে নাজুক পরিস্থিতি দেখা দিলে অনেক পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানই মিসর থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। আমেরিকা ও ইউরোপের প্রতিষ্ঠানগুলো মিসরে নিজেদের বিনিয়োগ বন্ধ করে দিলে একদিকে তা যেমন মিসরের অর্থনীতিকে আরও খারাপ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যায় তেমনি সৃষ্টি করে ব্যবসায়িক শূন্যতা। পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক থাকলেও বিদেশী বিনিয়োগ এখনও বাড়েনি আর পূরণ হয়নি ব্যবসায়িক শূন্যতা। এই সৃষ্ট ব্যবসায়িক শূন্যতাকে সুযোগ হিসেবেই মনে করছেন উপসাগরীয় অঞ্চল ও মধ্যপ্রাচ্যের ব্যবসায়ীরা। তাছাড়া দেশটিতে সস্তায় সম্পদ কেনার সুযোগকেও হাতছাড়া করতে চান না অনেক ব্যবসায়ী। মূলত এই ব্যবসায়িক চিন্তা তাদের মিসরে বিনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডেলোয়িট্টির মধ্যপ্রাচ্য শাখার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডেকলান হায়েস বলেন, উপসাগরীয় বিনিয়োগকারীরা চলতি বছর মিসরে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছেন। এটি শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় নয়, দেশটির সামগ্রিক ব্যবসা খাতেও। মিসরের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এখনও চ্যালেঞ্জিং পর্যায়ে আছে। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট হুসনি মোবারকবিরোধী আন্দোলন শুরু হওয়ার পর দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতির উত্তপ্ততার কারণে শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে অস্থিরতা বেড়ে যায়। ফলে গত বছর থেকেই সঙ্কুচিত হতে থাকে এর অর্থনীতি। যা মিসরের জাতীয় আয়ে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। একদিকে বেকারত্বের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলে আর অন্যদিকে কমতে থাকে মিসরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস অনুযায়ী চলতি বছর মিসরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ, যা বেকারত্বের হার কমানোর জন্য মোটেই পর্যাপ্ত নয়। মিসরের নতুন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি জুনে ক্ষমতা গ্রহণ করলেও দেশটি এ মুহূর্তে নতুন সংবিধান তৈরির অবস্থানে নেই বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকতার কারণে। এ বছরের শুরুর নির্বাচনের ফলকে আদালত নাকচ করে দেয়ার পরই দেশটিতে আবার পার্লামেন্টারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু মুরসির প্রেসিডেন্ট হওয়ার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ধারণা। তাই অনেক বিনিয়োগকারীই এখন ঝুঁকি গ্রহণে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। বিনিয়োগে ঝুঁকি থাকবেই। গত বছরের তুলনায় পরিস্থিতি অনেক ভাল হওয়ায় বিনিয়োগ ঝুঁকি গ্রহণ করতে উপসাগরীয় ও মধ্যেপ্রাচ্যর বিনিয়োগকারীরা প্রস্তুত। এদিকে মুরসি দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে আইএমএফের কাছে ৪৮০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের আবেদন করে রাজনৈতিকাবে সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তিনি বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনার উদ্দেশে গত মাসে চীন সফরেও গিয়েছিলেন। দুবাইভিত্তিক ব্যক্তিমালিকানাধীন বৃহৎ প্রতিষ্ঠান আব্রাজ ক্যাপিটালের সিনিয়র পার্টনার ও উপপ্রধান আহমেদ বাদ্রেলদিন বলেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সামরিক কর্মকর্তাদের সম্পর্ক ভাল হওয়া এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনে সহায়তা করেছে। আব্রাজের পোর্টফোলিও মিসরভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আল বর্গ ল্যাবরেটরিজ গত মাসে আল মোখতাবার ল্যাবরেটরিজের সঙ্গে একীভূতকরণে সম্মত হয়েছে। এটিই ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ মেডিকেল ডায়াগনস্টিক ব্যবসায় পরিণত হবে।
ব্যবসায়িক আস্থা ফিরে আসায় ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশটির শেয়ারবাজারেও। ২০১১ সালের জুনের পর এই কিছুদিন আগে থেকে মিসরের শেয়ারবাজারে সূচকের উর্ধগতি হয়। মিসরের বাজারে উপসাগরীয় বিনিয়োগকারীদের প্রবেশের সহজতম পথ হচ্ছে ব্যাংক খাতে বিনিয়োগ। ফ্রান্সভিত্তিক ব্যাংক সোসিয়েতে জেনারিলে গত সপ্তাহে জানিয়েছে, ব্যাংকটি মিসর শাখা ন্যাশনাল সোসিয়েতে জেনারিলে বিক্রির বিষয়ে তারা কাতার ন্যাশনাল ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করছে। সোসিয়েতে জেনারিলে ওই ব্যাংকের ৭৭ দশমিক ২ শতাংশ স্বত্ব বিক্রি করে দেয়ার পরিকল্পনা করছে। উপসাগরীয় অঞ্চলের বিনিয়োগকারীদের মিসরে বিনিয়োগের আগ্রহ পশ্চিমা দেশগুলোর বিনিয়োগকারীদেরও বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলছে। মিসরে যদি বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় আশানুরূপভাবে তবে সম্পদ ও মূলধনের গতিশীলতা যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি কর্মসংস্থানের পরিমাণও বাড়বে। এর মধ্যে দিয়ে মিসর বর্তমান নাজুক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে আশা করা যায়।
মো. আরিফুর রহমান

No comments

Powered by Blogger.