ঋতু-বন্দনা- সেই শরতের সকাল বেলায় by মাহবুব আলম
ভাদ্র ও আশ্বিন—এই দুই মাস নিয়ে শরৎকাল। কিন্তু ভাদ্রের মাঝামাঝিতেও দখল ছাড়তে নারাজ বর্ষা। যে শরৎকে দেখে আমরা গাই ‘আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে’, সেই অপরূপ ঋতুর সঠিক রূপটি ফোটে কিন্তু আশ্বিনেই।
বর্ষার বিদায়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,‘কালো মেঘের আর কি আছে দিন, ও যে হলো সাথী হীন।’ ভাদ্র মাসেও তো সাথিহীন হওয়ার লক্ষণ নেই কালো মেঘের।
নীল আকাশের সাদা মেঘের আনাগোনা হটিয়ে
আর শরৎ-সোনার আলো নিভিয়ে দিয়ে
বর্গীর মতো হঠাৎ হঠাৎ হামলা দেয় কালচে
ধূসর মেঘ। ভাদ্রের শেষেও।
আবহাওয়াবিদেরা বলেন, শরৎকালে মেঘের রং সাদা হওয়া কাম্য। নইলে বিলম্বিত বর্ষার ভয় থাকে। সময়ের বর্ষা যেমন প্রকৃতির আশীর্বাদ, অসময়ের অতিবৃষ্টি তেমনি অভিশাপের মতো। বিলম্বিত বর্ষার সঙ্গে সঙ্গে আসে বন্যা, রোগ আর ফসলনাশ।
একসময় আমাদের ঋতুগুলো ছিল ভারী নিয়মনিষ্ঠ। এখন বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে ঋতুরাজ্যে চলছে নানা স্বেচ্ছাচার। তাদের আসা-যাওয়ায় নেই কোনো নিয়মানুবর্তিতা। অনেকেই যেন ফাঁকিবাজ চাকুরে;
দেরি করে এসে ছুটির আগেই উধাও। তাই ট্রেন-প্লেনের মতো ঋতুরাজ্যেও এখন চলছে শিডিউল বিপর্যয়। কাব্যের ভাষায়, ‘ঋতুরঙ্গ’ বলে একে হালকা করে দেখার দিন আর নেই।
এরই পাশাপাশি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে প্রায়ই পরাক্রান্ত ঋতুগুলো (যেমন—বর্ষা) প্রতিবেশী ঋতুর (শরৎ) রাজ্যে ঢুকে পড়ছে অম্লানবদনে। কবি নিজেও প্রবল ঋতুর এহেন নীতিবহির্ভূত আচরণ প্রীতির চোখে দেখেননি ‘কোন খেপা শ্রাবণ ছুটে এল আশ্বিনেরই আঙ্গিনায়। দুলিয়ে জটা ঘনঘটা পাগল হাওয়ায়।’
বলা বাহুল্য, শ্রাবণের শরৎরাজ্যে এই অনুপ্রবেশ যে ভরা খেতের ধানের জন্য ভালো হয়নি, তাও উল্লেখ করেছেন কবি পরবর্তী ছত্রে, ‘লুটিয়ে-পড়া কিসের কাঁদন উঠছে আজ নবীন ধানে।’ আমাদের বুঝতে দেরি হয় না এই কান্না ধানের চেয়ে কৃষকের বুকেই বেজে ওঠে সবচেয়ে বেশি। একেই বোধ হয় বলা যায় আধুনিক যুগের ঋতু সংহার। এই ঋতু সংহারের জন্য কে দায়ী? দায়ী স্রেফ মানুষের অপরিণামদর্শিতা, অপরিমিত লোভ আর উন্নত বিশ্বের ভোগবিলাসের উদগ্র লালসায় প্রকৃতির ওপর নিরন্তর অত্যাচার। দায়ী না হয়েও বাংলাদেশকে এই বিপর্যয়ের দায় ভোগ করতে হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে। এখনই এই বিপর্যয়ের যথাযথ মোকাবিলা না করলে এই অঞ্চলের বহু মানুষের জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
২. জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন যে শরৎকালে তাঁর সৃজনী শক্তি ‘অকারণ পুলকে’ ছবি আঁকা, গল্প লেখা আর সুরের সৃষ্টিতে ঝলমলিয়ে উঠেছে। এই বইয়ে আরও ধরা রয়েছে তাঁর শারদ প্রাতের আনন্দঘন স্মৃতি, শরৎমুগ্ধতা। তিনি লিখেছেন, ‘সেই শরতের সকাল বেলায়... সোনা গলানো রৌদ্রের মধ্যে দক্ষিণের বারান্দায় গান বাঁধিয়া তাহাতে যোগিয়া সুর লাগাইয়া গুনগুন করিয়া গাহিয়া বেড়াইতেছি।’ ‘আজি শরত তপনে প্রভাত স্বপনে/ কী জানি পরাণ কী চায়।’
শরতের মধ্যাহ্নে গানের আবেশে কবির মনটা মেতে থাকে, কাজকর্মের কোনো দাবিতে কান দেন না ‘হেলাফেলা সারাবেলা/ এ কী খেলা আপনমনে’—এমন পঙিক্ত তো লিখেছেন শরতের দিনে।
আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না, কেন এই ঋতুটিতে তিনি বলেছেন, ‘আমার গান-পাকানো শরৎ’, চাষিদের যেমন ধান-পাকানো শরৎ। কেন আরও বলেছেন, শরৎ তাঁর সমস্ত দিনের আলোকময় আকাশের গোলা—তাঁর বন্ধনহীন মনের মধ্যে ‘অকারণ পুলকে ছবি-আঁকানো গান-বানানো শরৎ’।
৩. আমাদের ছেলেবেলার শরৎ ঋতু ছিল বিশুদ্ধ শিশির আর দূষণহীন হাওয়ার যুগলবন্দী। সেদিনের মতোই আজও শরতের বারতা আসে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলায়, শিউলিতলার ঝরা ফুলের পাশে আর নবীন ধানের মঞ্জরিতে। শরত এখনো আসে নদীর ধারের বাঁশঝাড়ে, গলানো সোনার আলো ছড়িয়ে।
পুঁই-মাচার কচি সবুজের উল্লাসে আর ঢাকের বাদ্যির ছন্দে দেখা মেলে তার।
সেদিনের শরতের প্রায় সব লক্ষণই বহাল রয়েছে। তবে আমাদের কৈশোর-যৌবনের এই ঋতুটির একটি অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্যের কথা এখানে না বললেই নয়। তখনকার শরৎকাল ছিল যথার্থই গান শোনাবার ঋতু। বাতাসে তখন গান ভেসে বেড়াত। আরও খোলসা করে বললে, সেই ঋতুতে বাজারে সদ্য ওঠা গ্রামোফোন রেকর্ড ছিল নতুন বাংলা গানের একমাত্র অভিজাত ভান্ডারী, সর্বজন মান্য একটি উৎস, বাংলা গানের এক উজ্জ্বল ঝরনাতলা, যেখানে ছোট-বড় ধর্ম-গোত্রনির্বিশেষে সকলেই স্বাগত। বাংলা গানের তখন স্বর্ণযুগ, কিন্তু তাই বলে বছরভর গানের রেকর্ড বের করার চল ছিল না (ছায়াছবির গান ব্যতিক্রম), নতুন রেকর্ড ছাড়া হতো শুধু শারদ উৎসবের সময়। তাই সংগীতরসিকেরা সারা বছর এই সময়টার দিকে তাকিয়ে থাকতেন গভীর আগ্রহে। সেই নতুন রেকর্ডকে বলা হতো বেসিক রেকর্ড। তখনকার প্রখ্যাত শিল্পী, সুরকার-গীতিকারদের সারা বছরের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল শ্রেষ্ঠ গানগুলো তুলে রাখা হতো শরৎ ঋতুর শ্রোতাদের জন্য। সে সময়ের সংগীতজগতের দিকপালেরা বছরে দু-চারটির বেশি বেসিক গান রেকর্ড করতেন না। কেননা, গানের গুণগত মানের দিকে ভারী তীক্ষ� নজর ছিল তাঁদের। সেই গানগুলোই তাঁদের মেধা, স্বকীয়তা আর সাধনার স্বাক্ষর নিয়ে কালজয়ী হয়ে আছে আজও।
আমাদের দেশে গুণী সংগীতশিল্পীর অভাব নেই। খ্যাতিমান সুরকার-গীতিকার রয়েছেন প্রচুর। শরৎকালও ফিরে আসে বারবার। প্রকৃতিতে নাকি সবই পালাক্রমে আসে-যায়। তাই সেদিনের সোনাঝরা গানগুলোও নতুন বেশে আবার ফিরে আসবে—এমন আশা মনে জাগলেই বা ক্ষতি কী?
মাহবুব আলম: সাবেক রাষ্ট্রদূত।
mahboob1122@hotmail.com
No comments