ইয়াবা ব্যাংক! by পারভেজ খান

কোনো ব্যাংক কি এক লাখ টাকা জমা রাখলে এক হাজার টাকা লাভ দেবে এক দিনেই? কল্পনাতীত এ রকম একটি 'ব্যাংকের' অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। বিনিয়োগকারী মহলে এর নাম 'ইয়াবা ব্যাংক'। আমির হোসেন এই ব্যাংকের একজন পরিচালক। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাংকটির শাখার সংখ্যা আটটির মতো। প্রধান কার্যালয় টেকনাফে।


ব্যাংকটির শীর্ষস্থানীয় পরিচালকের সংখ্যা কমপক্ষে ৮০ জন এবং পুঁজি ৩০০ কোটি টাকার ওপরে। আমির ছোট পুঁজির একজন পরিচালক। ব্যাংকের পরিচালক পদ পেতে তাঁর বিনিয়োগ মাত্র এক কোটি টাকা। 'ইয়াবা অফিসার' আমির গত শুক্রবার রাতে গ্রেপ্তারের পর তাঁর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ এবং ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে এই তথ্য।
পুরান ঢাকায় ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক ব্যক্তি জানান, তাঁরাও এই ব্যাংকে হিসাব খুলেছেন। তবে এই হিসাবের কোনো নম্বর নেই। নেই কোনো কাগজপত্র। সব কিছুই চলে বিশ্বাস আর আস্থার ওপর ভিত্তি করে, মৌখিকভাবে। লাভের হিসাব বাৎসরিক নয়, দৈনিক। লাখে এক হাজার। এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে প্রতিদিন এক হাজার টাকা লাভ দেওয়া হয়। বিনিয়োগ বেশি হলে লাভের পরিমাণও বেশি।
ডিবি পুলিশের একজন কর্মকর্তা গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে জানান, ইয়াবা ব্যাংক পরিচালনার কথা তাঁরা প্রথম জানতে পারেন গত বছরের ২৩ মে। সে সময় উত্তরার একটি চায়নিজ রেস্তোরাঁ থেকে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ১৮ হাজার ইয়াবাসহ শাকুর নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর কাছ থেকেই বের হয়ে আসে নানান চমকপ্রদ তথ্য। এই ব্যাংকের গ্রাহক বা সদস্য সারা দেশের আটটি শাখায় পাঁচ হাজারের ওপরে। অনেকেই টাকা বিনিয়োগ করে দৈনিক তাঁদের মুনাফা বুঝে নিচ্ছেন। অনেকে আবার সরাসরি ইয়াবা বেচাকেনায় জড়িয়ে পড়েছেন। এই পুঁজি বিনিয়োগে অনেক মহিলাও আছেন, যাঁরা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী। অধিক লাভের আশায় স্বামীকে না জানিয়েই তাঁরা ব্যাংকের গ্রাহক হয়েছেন।
সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশে এই ইয়াবা ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় মূলত ২০০২ সালের দিকে। এর পরিকল্পনায় ছিলেন কয়েকজন ধনাঢ্য ব্যক্তি। সমাজে তাঁরা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। আর তাঁরা এই ব্যাংক পরিচালনার জন্য বেছে নেন অপরাধজগতের ডন হিসেবে চিহ্নিত একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে। তিনি অনেকের কাছে 'ভাইয়া' নামে পরিচিত। তাঁর সঙ্গে ছিলেন 'গিরি বাবু' নামে পরিচিত আরেক বিদেশি নাগরিক ও প্রতিষ্ঠিত হুন্ডি ব্যবসায়ী এবং নৌপরিবহন ব্যবসা থেকে উঠে আসা আরেক ব্যক্তি। এই ব্যক্তির নামের প্রথম অক্ষর 'এম'। তিনি বর্তমানে কারাগারে এবং বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। গত নির্বাচনে বিএনপির পরাজয়ের পেছনে অনেকে তাঁকেও দায়ী করেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন পুরান ঢাকার আরেক আন্ডারগ্রাউন্ড নেতা ন্যাংড়া শোয়েব আর গুলশানের হুদা। যোগ দেন বি ইসলাম ও বোতল নামের আরো দুই প্রভাবশালী ব্যক্তি। বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে তাঁরা নেমে পড়েন ইয়াবা ব্যবসায়। তাঁদের সবচেয়ে বড় চালানটি ধরা পড়ে ২০০৬ সালে গুলশানে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ইয়াবার চালান বলা হয় এটাকে। গ্রেপ্তার হন হুদা। তিনি এখন জামিনে রয়েছেন এবং বলা চলে তিনিই এখন রাজধানীর সবচেয়ে বড় ইয়াবা ব্যবসায়ী।
সূত্র আরো জানায়, গিরি বাবু কারাগারে থাকা অবস্থায় 'এম' সাহেবের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করতেন। মাঝে কিছু সময় 'ভাইয়া'ও কারাগারে ছিলেন। সে সময় তিনিও ভেতরে থেকেই তাঁর এই ব্যবসা পরিচালনা বা দেখাশোনা করতেন। আর তাঁদের এই ইয়াবা ব্যাংকের মূল বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় ব্যাংককের ফুকেটের মালয়েশিয়া সীমান্ত গোলক, গজ্জাল এলাকায় এবং বাংলাদেশের টেকনাফে। টেকনাফে তাঁদের প্রধান ব্যক্তি হচ্ছেন সালাম ওরফে রোহিঙ্গা সালাম ওরফে বার্মাইয়া সালাম। মিয়ানমার বা বার্মার মন্ডুতে সালামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। মূলত সেখানে থেকেই তিনি এই ব্যাংক পরিচালনা করেন। টেকনাফে সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যরা হচ্ছেন- জাকির, করিম, রোহিঙ্গা লালু, রোহিঙ্গা শুক্কুর, নবী, জাফর মেম্বার, জবান আলী, নুরুল আলম ওরফে নুরু, হাসেম, মিলকি, লিটন, রফিক, তৈয়ব, হাসান, দিদার, মোস্তাক, ছিদ্দিক, শাহজাহান, জিয়াবুল, সাইফুল, গণি, শামসুল আলম মার্কিন, ইসমাইল, জুনিয়র সালাম, আবদুল্লাহ, জাহেদ, বোরহান, আলমগীর, শাহ আলম, বাহাদুর, আমিন, রমজান, গফুর ও শরিফ।
বিভিন্ন সূত্র মতে, এই ইয়াবা ব্যাংকের ঢাকা সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য হচ্ছেন- মুশফিকুর রহমান তমাল, বাপ্পী সাহা, জুয়েল, সুমন, আল আমিন, ফয়সাল, কামরাঙ্গিরচরের আনন্দ দাদা, মামুন, আজমল, শুভঙ্করসহ আরো কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে একজন ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালের মালিক। এই মালিকের ভাগ্নেকে পুলিশ ইয়াবার চালানসহ একাধিকবার গ্রেপ্তার করলেও তিনি এখন পর্যন্ত ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছেন।
ডিবি পুলিশের কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে আরো জানান, ইয়াবা ব্যাংকে পুঁজি খাটানো অনেকেরই নাম-ঠিকানা তাঁরা পেয়েছেন। কিন্তু কোনো নথিগত প্রমাণ না থাকার কারণে যাঁরা টাকা বিনিয়োগ করেছেন তাঁদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে বিনিয়োগের পাশাপাশি যাঁরা ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আমির গ্রেপ্তার হওয়ার পর অনেকেই গা-ঢাকা দিয়েছেন।
পুলিশের আইজি খন্দকার হাসান মাহমুদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমির হোসেনের মতো সমাজের তথাকথিত ভদ্রলোক আর সরকারি কর্মকর্তা এ ধরনের জঘন্য পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এটি সত্যিই দুঃখজনক। অধিক লোভের আশায় যারা এ ধরনের ব্যবসায় পুঁজি খাটাচ্ছে নিঃসন্দেহে তারাও অপরাধ করছে। প্রমাণ পাওয়া গেলে সবাইকেই আইনের আওতায় আনা হবে।' আইজি জানান, ইয়াবাসহ মাদকের বিরুদ্ধে তাঁদের জিহাদ অভিযান চলছে। যে যত বড় প্রভাবশালী আর শক্তিশালীই হোক না কেন, তাঁদের গ্রেপ্তার করা হবেই।
ইয়াবা অফিসারের স্ত্রীও গ্রেপ্তার

No comments

Powered by Blogger.