দুই মহাসমাবেশের হিসাব-নিকাশ by কাজী সিরাজ

সব জল্পনা-কল্পনা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে ১২ ও ১৪ মার্চ ঢাকায় বিরোধী চারদলীয় জোট ও সরকারি ১৪ দলীয় জোটের সমাবেশ দুটি কোনো ধরনের অঘটন ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। দুটি সমাবেশেই যথেষ্ট লোকসমাগম হয়েছিল।


তবে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোটের 'চলো চলো ঢাকা চলো' কর্মসূচি পালিত হয়েছে সরকারের নানা কূটকৌশল, প্রশাসন-পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবি এবং প্রধান শাসক দল আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, লালবাহিনীসহ নানা রং-বেরঙের বাহিনীর প্রচণ্ড বাধা ও প্রতিরোধ উপেক্ষা করে। লাঠিসোঁটা, রামদা-কিরিচসহ বিভিন্ন দেশি অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ১২ মার্চ বিরোধী জোটের মহাসমাবেশে যোগদানরতদের ওপর ছাত্রলীগ, লালবাহিনীসহ অন্যদের হামলে পড়ার দৃশ্য প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচার হয়েছে। তবে বিরোধী জোটকে যেহেতু গাড়ি-ঘোড়া ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি, সেহেতু তাদের খরচ হয়েছে তুলনামূলকভাবে কম। আদর-আপ্যায়ন, এক শ্রেণীর নেতা-কর্মীর কয়েক দিনের 'সার্ভিস চার্জ' বাবদ কোনো জোটের খরচই অবশ্য কম হয়নি। এসব খরচাপাতির ব্যাপারে দলের কেন্দ্র, মহানগর ও স্থানীয় নেতাদের পকেট থেকে খরচের ব্যাপারটা ধরা হয়, কিন্তু দল না করলেও একটু পয়সাওয়ালা, মুদি দোকানদার, চা দোকানদারসহ ছোটখাটো ব্যবসায়ী-চাকরিজীবীদের বাধ্যতামূলক খরচের হিসাবটা করা বা ধরা হয় না। বাধ্যতামূলক খরচ মানে চাঁদা বাবদ আদায় করা অর্থ। এটা উভয় বড় দলই করে। কেন্দ্র বা মহানগর অথবা স্থানীয় নেতারাই-বা টাকা পান কোথায়? তাঁদের অর্থের উৎস কী? এই ধরনের একেকটা বড় সমাবেশ করতে যে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়, সে রকম একটা সমাবেশের অর্থ দিয়ে মাঝারি ধরনের এক-দুটি গার্মেন্ট কারখানা স্থাপন করে সহস্রাধিক লোকের কর্মসংস্থান করা যায়। আমাদের নেতা-নেত্রীরা এ ধরনের কিছু কি চিন্তা করতে পারেন? তাই বলে কি রাজনৈতিক দল সভা-সমাবেশ করবে না? এটা তো তাদের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার। অবশ্যই করবে। সভা, সমাবেশ, মিছিল, বিক্ষোভের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলসমূহ তাদের রাজনীতি, আদর্শ ও কর্মসূচির পক্ষে জনমত গঠন করবে। এ ধরনের সভা-সমাবেশ অতীতেও হয়েছে। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ অনেক সভা, সমাবেশ, সম্মেলন করেছেন। বিশেষ করে আমাদের এই ভূখণ্ডে মওলানা ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কত কৃষক সম্মেলন ও জনসভা-সমাবেশ করেছেন, তার হিসাব নেই। তখন সভা-সমাবেশে লোক সরবরাহকারী রাজনৈতিক টাউট-কন্টাক্টরের অস্তিত্ব ছিল না, প্রয়োজনও ছিল না। লোকজন সভা-সমাবেশে আসত যার যার রাজনীতি ও আদর্শের টানে। ট্রাক-বাস দিয়ে ভাড়াটে লোক আনার প্রবণতা তখন ছিল না। টঙ্গী, আদমজী থেকে হাজার হাজার মানুষ মিছিল করে আসত পল্টনের জনসভায়। চট্টগ্রাম লালদীঘির জনসভায় বিশাল বিশাল মিছিল আসত কালুরঘাট, নাসিরাবাদ শিল্পাঞ্চলসহ আশপাশের বিভিন্ন থানা থেকে। এখন শান্তিনগর, নয়াপল্টন, ফকিরাপুল থেকে পল্টনের বা বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণের জনসভায় যাওয়ার জন্যও বাস-ট্রাক দিতে হয়, নিদেনপক্ষে বাস-ট্রাকের ভাড়ার টাকাটা দিয়ে দিতে হয়।
দুই মহাসমাবেশে কার কী লাভ হলো, তা মূল্যায়ন করতে গেলে দুটি বিষয়ের প্রতি নজর দিতে হবে_এক. দলগত বা জোটগতভাবে সরকারি ও বিরোধী পক্ষের কে বেশি লাভবান হলো; দুই. জনগণের কী লাভ হলো বা হবে? দুই জোটের মহাসমাবেশ থেকে বেশি লাভবান হয়েছে বিরোধী জোট। সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও ক্রোধের বিষয়টা এখন আর গোপন কিছু নয়। সরকারের নানা ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতা, নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করতে না পারা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতিতে তথা দলের একজন জনপ্রিয় নেতা নরসিংদীর সাবেক মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ডের কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি সরকার, অতিসম্প্রতি সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক মাসের বেশি সময় চলে গেলেও কিছুই করতে পারেনি, উল্টো বলা হচ্ছে বেডরুম পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়, সৌদি আরবের কূটনীতিক খালাফ আল আলী বেডরুমের বাইরে খোলা রাজপথে খুন হলেন, কিন্তু আশ্বাস ছাড়া বিশ্বাস করার মতো কোনো তৎপরতা দেখাতে পারেনি শাসকরা, প্রায় সারা দেশে এই ধরনের হত্যা, বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমকে গুম করে ফেলাসহ অনেক গুম ও গুপ্তহত্যা, নারী নির্যাতন ও সন্ত্রাস রোধে সরকারের নির্জীবতায় ক্ষুব্ধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির তীব্র সংকটে জর্জরিত মানুষ যারা মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামী তো নয়ই, এমনকি রাজাকারপন্থী হয়ে যাওয়ার এবং বিগত শাসনামলে দুর্নীতিতে ডুবসাঁতার কাটার কারণে বিএনপির ওপর থেকেও সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছিল, তারা এবং সংসদ নির্বাচনে নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়া অনেকেও এখন তৃতীয় কোনো বিকল্প না থাকায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের প্রতি ঝুঁকছে। এটা বাস্তবতা। তাই বিরোধী জোটের ১২ মার্চের মহাসমাবেশের প্রতি আমজনতার আকর্ষণ ছিল বেশি। লীগ সরকারই জনগণকে বিএনপিমুখী করছে। তার ওপর বিরোধীদের মহাসমাবেশ পণ্ড করার জন্য সরকারের নানা কূটচাল এবং সরকারি ও দলীয় বাহিনী দিয়ে শক্তি প্রয়োগ বিরোধী জোট সমর্থকদের জেদি ও বেপরোয়া করে তুলেছিল। জনগণের সমর্থন তাদের উৎসাহ জুগিয়েছে। ফলে ১২ মার্চের মহাসমাবেশে পুলিশের ১১ দফা শর্ত ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। কিছু করার ক্ষমতা ছিল না পুলিশের বা সরকারের, তা পারাও যায় না। এমন পরিস্থিতি অতীতে আইয়ুব-ইয়াহিয়াও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। বিরোধী জোটের সমাবেশ পণ্ড করার ব্যর্থতার চেয়েও এর পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সরকারের জন্য আরো বেশি ক্ষতিকর হয়েছে, যার প্রতিফলন ঘটতে পারে আগামী সাধারণ নির্বাচনে। ১২ মার্চের মহাসমাবেশে লোকসমাগম রোখার জন্য সরকার, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং শাসক দল ও তার বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন, আবার ভয়ংকর লালবাহিনীসহ নানা বাহিনী কী করেছে তা জনগণই প্রত্যক্ষ করেছে, তিন দিন সীমাহীন যন্ত্রণা ভোগ করেছে তারা। এক অঞ্চলের খবর অন্য অঞ্চলের মানুষ জেনেছে মিডিয়া সূত্রে। ১২ মার্চ মহাসমাবেশের সরাসরি সম্প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছিল বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ইটিভি, বাংলাভিশন ও এনটিভি। সমাবেশ চলাকালে আকস্মিক চ্যানেল তিনটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটকে দায়ী করলেও ১৫ মার্চ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে স্বীকার করেছেন যে নাশকতার আশঙ্কায় সরকার কিছু ব্যবস্থা নিয়েছিল। তাতে জনগণের দুর্ভোগের জন্য তিনি দুঃখও প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ যে তিনি জনগণের মনোভঙ্গি বুঝতে পেরেছেন। তবে বুঝলেন বা তাঁর উপদেষ্টারা তাঁকে বোঝালেন ক্ষতি হওয়ার পর। অর্থাৎ বিএনপির ওই মহাসমাবেশ থেকে রাজনৈতিক যা অর্জন হওয়ার তা প্রায়ই অর্জিত হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর বাড়াবাড়ি এবং মহাসমাবেশের সম্মুখভাগজুড়ে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারাধীন জামায়াত নেতা গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ব্যানার-ফেস্টুনের ছড়াছড়িতে কারো মনে হতে পারে যে সমাবেশটা বুঝি জামায়াতের এবং সভাটা বুঝি বা জামায়াত নেতাদের মুক্তির দাবিতেই অনুুষ্ঠিত হয়েছে। একটা সময় ছাত্রদলের কর্মীরা তাদের দাবড়ে এক পাশে সরিয়ে দিলেও মহাসমাবশের তাৎপর্য তাতে কিছুটা হলেও ম্লান হয়েছে।
খালেদা জিয়ার 'ঢাকা চলো' কর্মসূচি ঠেকাতে সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা আগামী দিনের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে জব্দ করার একটি অস্ত্র হয়ে থাকল বিএনপির হাতে।
দুই সমাবেশে থেকে জনগণের যা প্রাপ্তি, তার মধ্যে মূল বিষয় হচ্ছে, বিরোধী দল সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে, সরকারকে ভয় পাইয়ে দিতে পেরেছে। ফলে জনস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে সরকার সংযত হবে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি রোধে সচেষ্ট হবে, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ নাগরিকদের অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর দিকে নজর দেবে ভোটের চিন্তা করে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বিরোধী দল যে জনমত গঠন করতে পেরেছে, তা নিশ্চিত হলে জনগণের ভোটের অধিকার তথা অবাধ ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের পছন্দের সরকার গঠন করতে পারবে। আগামী পৌনে দুই বছর লীগ-সরকার তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কিছু হলেও বাস্তবায়নে উদ্যোগী হবে। এসবই ভবিষ্যতের সম্ভাব্য পাওনা। তাৎক্ষণিকভাবে জনগণ পেয়েছে দুর্ভোগ আর দুর্দশা। এর আর বর্ণনা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে এটুকু বলা দরকার যে ১০, ১১ ও ১২ মার্চ ঢাকায় চিকিৎসাধীন মৃত্যুপথযাত্রী আপনজনকে শেষ দেখা দেখতে আসতে পারেননি ঢাকার বাইরের মানুষ। অনেকে গ্রামে যেতে পারেননি প্রিয়জনের জানাজা আর দাফনে শরিক হতে। ১৪ মার্চ সরকারি মহাসমাবেশের আগের দিন ভয়াবহ লঞ্চ দুর্ঘটনায় শতাধিক লোক মারা গেল। বঙ্গবন্ধু হলে সমাবেশের বক্তৃতা বাদ দিয়ে ছুটে যেতেন দুর্গত ও শোকার্ত মানুষের কাছে। অথচ ১৪ মার্চের জনসভায় নেতারা তাতে একটুও বিচলিত হয়েছেন বলে মনে হয়নি। বিরোধী জোটের মহাসমাবেশ থেকে ১২ মার্চ জনগণের কল্যাণে কত কিছু করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলো, আগামী নির্বাচনের আগাম ম্যানিফেস্টো ঘোষণা করলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু লঞ্চ দুর্ঘটনায় এত মানুষের সলিল সমাধি হলো, এত পরিবারের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে গেল, তাদের জন্য কী করলেন তিনি তার দল বা সম্প্রসারিত জোট? সরকার ও সরকারি দলই বা কী করল? জনগণ সভা-সমাবেশে যোগদান করে, নেতা-নেত্রীদের বক্তৃতা শুনে হাততালি দেয়, তাদের ভোটে সবাই এমপি, মন্ত্রী হন, পরে ভুলে যান জনগণের কথা, তাদের কষ্ট আর জীবন-যন্ত্রণার কথা। এভাবে আর কত?

No comments

Powered by Blogger.