এই দিনে-অটিজম: ভ্রান্ত ধারণা ও বাস্তবতা by মারুফা হোসেন
আজ বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। অটিজমকে কী চোখে দেখা হয়? আমাদের দেশে স্বাভাবিক একটি শিশুর প্রতি অনেক সময় আচরণ বন্ধুসুলভ নয়। ফলে অটিস্টিক শিশুর অবস্থা যে আরও খারাপ, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। পথেঘাটে, যানবাহনে, স্কুলে অটিজম শিশু ও তার বাবা-মা প্রতিদিন প্রতিনিয়ত কটূক্তি, অসহিষ্ণু মন্তব্য, উপহাসের পাত্র
হচ্ছেন। যদিও বর্তমানে অটিজম নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি হচ্ছে, তবে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। যা হচ্ছে, তার প্রায় সবই ঢাকাকেন্দ্রিক।
সন্তানের অটিজম শনাক্ত হওয়ার পর বাবা-মায়ের পক্ষে তা মেনে নেওয়া খুব কষ্টের ব্যাপার। অনেকে মেনে নিলেও লোকলজ্জার ভয়ে সন্তানের সমস্যা গোপন করার চেষ্টা করেন। যার ফলে শিশুটির জীবন থেকে তার মূল্যবান কয়েকটি বছর নষ্ট্ হয়ে যায়। শিশুটি আরও বেশি পিছিয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে অটিজম শিশুকে নিয়ে নানা ভ্রান্ত ধারণা লক্ষ করা যায়। যেমন—
১. অনেক অভিভাবক মনে করেন, তাঁরা সন্তানকে বেশি সময় দেননি বলে তাঁর সন্তানের অটিজম হয়েছে। আবার অনেকে সান্ত্বনা দিয়ে থাকেন, শিশু দেরিতে কথা বলে বা ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে, যা সঠিক নয়। পিতা-মাতার দুর্বল অভিভাবকত্ব অটিজমের জন্য দায়ী নয়।
২. অটিজম একটি মানসিক রোগ। এখানে শারীরিক কোনো সমস্যা জড়িত নয়। অটিজমের সঙ্গে বিকাশগত অক্ষমতা ও নিওরোবায়োলোজিক্যাল ডিজঅর্ডার জড়িত।
৩. চিকিৎসা করালে অটিজমে আক্রান্তরা স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এটি সাময়িক সমস্যা, বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেরে যাবে। অটিজম কোনো সাময়িক সমস্যা নয়। মনে রাখতে হবে, এই ঘাটতি কখনো পুরোপুরি দূর হবে না।
৪. একই পরিবারে ভাইবোনদের মধ্যে একাধিক জনের অটিজম হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
৫. অটিজম আক্রান্ত সব শিশু/ব্যক্তির সমস্যা একই রকম। বাস্তবতা হলো, অটিজম-আক্রান্ত ব্যক্তিদের লক্ষণ ও উপসর্গ বিভিন্ন ধরনের হয়। একজনের সঙ্গে আরেকজনের মিল নেই।
৬. অনেকে মনে করেন, আক্রান্ত ব্যক্তিরা সবাই সুপ্ত প্রতিভার অধিকারী হয়। কেউ কেউ বিশেষ কোনো কাজে দক্ষতা দেখাতে পারে; কিন্তু এটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। দেখা যায়, অটিজমে আক্রান্ত অনেক শিশুই বিভিন্ন প্রতিভা বা অন্য কোনো ক্ষেত্রে অসম্ভব প্রতিভাসম্পন্ন হওয়া দূরে থাক, খুব সাধারণ দৈনন্দিন কাজকর্মেও অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে।
এসব বিষয় ছাড়া আরও অনেক ধরনের ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, যা মোটেও গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয়। কোনো শিশুর যদি ‘অটিজম’ শনাক্ত হয়, তাহলে এ ধরনের কথাবার্তা অগ্রাহ্য করার মানসিক শক্তি অর্জন করতে হবে। কারণ, নিউরনঘটিত যেকোনো সমস্যার উত্তরণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সময়সাপেক্ষ, পুরোপুরি সুস্থ হওয়াটাও অনিশ্চিত। মনে রাখা প্রয়োজন, কোনো রকম জাদুকরি চিকিৎসায় অটিজম সারে না।
তাই অটিজম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। অটিজম হচ্ছে শিশুদের মস্তিষ্কের বিন্যাসগত বা পরিব্যাপক বিকাশগত সমস্যা। যার লক্ষণ শিশুর জন্মের তিন বছরের ভেতর প্রকাশ পায়। প্রধান তিনটি বৈশিষ্ট্য প্রায় সব অটিজম আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে দেখা যায়:
১. মৌখিক ও অমৌখিক যোগাযোগে সীমাবদ্ধতা। ২. কাঙ্ক্ষিত সামাজিক আচরণে সীমাবদ্ধতা। ৩. পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ ও খেলার ক্রিয়াকলাপে সীমাবদ্ধতা। এ ছাড়া অটিজমে আক্রান্ত শিশু, কিশোরেরা, পঞ্চইন্দ্রিয় যেমন: স্পর্শ, আলো, শব্দ, স্বাদ, ঘ্রাণ ইত্যাদির প্রতি কম বা বেশি সংবেদনশীল হয়ে থাকে।
রুটিন পরিবর্তনের ঘোর বিরোধিতা করাও এদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। শতকরা ১০ জন অটিজম আক্রান্ত শিশু ছবি আঁকা, গান, গণিত কিংবা কম্পিউটারে প্রচণ্ড দক্ষ হয়। অটিজমের ব্যাপ্তি বিশাল। তাই অটিজমের এই ব্যাপকতাকে অটিজম স্পেকটার্ম ডিসঅর্ডার বলা হয়ে থাকে। মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের অধিক হারে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। যার অনুপাত ১:৪। অটিজম কোনো মানসিক রোগ নয় কিংবা মানসিক প্রতিবন্ধিতাও নয়।
সন্তানের কোনো সমস্যা ধরা পড়লে আমাদের সমাজে মাকে সর্বপ্রথম দায়ী করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মা প্রথম হোঁচট খান নিজের পরিবারে, তারপর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব। সমাজের কাছে তিনি এবং তাঁর সন্তান অনেক সময় হয়ে যান উপহাসের পাত্র। সে ক্ষেত্রে মাকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে এবং নিজের মন স্থির করে কার্যকর সময় ব্যয় করার চেষ্টা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে সমমনা বন্ধু-বান্ধব এবং এ ধরনের সমস্যায় ভুগছে এমন কোনো পরিবারের সঙ্গ এনে দিতে পারে স্বস্তি।
অটিজম সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের কাজ শুরু করতে হবে নিজের ঘর থেকে। অনেক সময় দেখা যায়, বাবা কিছুতেই মেনে নিতে চান না তাঁর শিশুর কোনো প্রকার সমস্যা আছে। সে ক্ষেত্রে মায়ের পক্ষে শিশুটির জন্য ভালো কিছু করা কঠিন হয়ে যায়। এ কারণে বাবাসহ বাড়ির অন্যান্য সদস্য যেমন ভাইবোন, দাদা-দাদি, নানা-নানিদেরকেও অটিজম সম্পর্কে ধারণা দেওয়া একান্ত জরুরি। এ কাজটি ধৈর্য ধরে করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, এই শিশু যে কারও হতে পারত; তারাও এ সমাজেরই একজন।
মারুফা হোসেন
পরিচালক, স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেন
সন্তানের অটিজম শনাক্ত হওয়ার পর বাবা-মায়ের পক্ষে তা মেনে নেওয়া খুব কষ্টের ব্যাপার। অনেকে মেনে নিলেও লোকলজ্জার ভয়ে সন্তানের সমস্যা গোপন করার চেষ্টা করেন। যার ফলে শিশুটির জীবন থেকে তার মূল্যবান কয়েকটি বছর নষ্ট্ হয়ে যায়। শিশুটি আরও বেশি পিছিয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে অটিজম শিশুকে নিয়ে নানা ভ্রান্ত ধারণা লক্ষ করা যায়। যেমন—
১. অনেক অভিভাবক মনে করেন, তাঁরা সন্তানকে বেশি সময় দেননি বলে তাঁর সন্তানের অটিজম হয়েছে। আবার অনেকে সান্ত্বনা দিয়ে থাকেন, শিশু দেরিতে কথা বলে বা ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে, যা সঠিক নয়। পিতা-মাতার দুর্বল অভিভাবকত্ব অটিজমের জন্য দায়ী নয়।
২. অটিজম একটি মানসিক রোগ। এখানে শারীরিক কোনো সমস্যা জড়িত নয়। অটিজমের সঙ্গে বিকাশগত অক্ষমতা ও নিওরোবায়োলোজিক্যাল ডিজঅর্ডার জড়িত।
৩. চিকিৎসা করালে অটিজমে আক্রান্তরা স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এটি সাময়িক সমস্যা, বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেরে যাবে। অটিজম কোনো সাময়িক সমস্যা নয়। মনে রাখতে হবে, এই ঘাটতি কখনো পুরোপুরি দূর হবে না।
৪. একই পরিবারে ভাইবোনদের মধ্যে একাধিক জনের অটিজম হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
৫. অটিজম আক্রান্ত সব শিশু/ব্যক্তির সমস্যা একই রকম। বাস্তবতা হলো, অটিজম-আক্রান্ত ব্যক্তিদের লক্ষণ ও উপসর্গ বিভিন্ন ধরনের হয়। একজনের সঙ্গে আরেকজনের মিল নেই।
৬. অনেকে মনে করেন, আক্রান্ত ব্যক্তিরা সবাই সুপ্ত প্রতিভার অধিকারী হয়। কেউ কেউ বিশেষ কোনো কাজে দক্ষতা দেখাতে পারে; কিন্তু এটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। দেখা যায়, অটিজমে আক্রান্ত অনেক শিশুই বিভিন্ন প্রতিভা বা অন্য কোনো ক্ষেত্রে অসম্ভব প্রতিভাসম্পন্ন হওয়া দূরে থাক, খুব সাধারণ দৈনন্দিন কাজকর্মেও অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে।
এসব বিষয় ছাড়া আরও অনেক ধরনের ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, যা মোটেও গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয়। কোনো শিশুর যদি ‘অটিজম’ শনাক্ত হয়, তাহলে এ ধরনের কথাবার্তা অগ্রাহ্য করার মানসিক শক্তি অর্জন করতে হবে। কারণ, নিউরনঘটিত যেকোনো সমস্যার উত্তরণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সময়সাপেক্ষ, পুরোপুরি সুস্থ হওয়াটাও অনিশ্চিত। মনে রাখা প্রয়োজন, কোনো রকম জাদুকরি চিকিৎসায় অটিজম সারে না।
তাই অটিজম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। অটিজম হচ্ছে শিশুদের মস্তিষ্কের বিন্যাসগত বা পরিব্যাপক বিকাশগত সমস্যা। যার লক্ষণ শিশুর জন্মের তিন বছরের ভেতর প্রকাশ পায়। প্রধান তিনটি বৈশিষ্ট্য প্রায় সব অটিজম আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে দেখা যায়:
১. মৌখিক ও অমৌখিক যোগাযোগে সীমাবদ্ধতা। ২. কাঙ্ক্ষিত সামাজিক আচরণে সীমাবদ্ধতা। ৩. পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ ও খেলার ক্রিয়াকলাপে সীমাবদ্ধতা। এ ছাড়া অটিজমে আক্রান্ত শিশু, কিশোরেরা, পঞ্চইন্দ্রিয় যেমন: স্পর্শ, আলো, শব্দ, স্বাদ, ঘ্রাণ ইত্যাদির প্রতি কম বা বেশি সংবেদনশীল হয়ে থাকে।
রুটিন পরিবর্তনের ঘোর বিরোধিতা করাও এদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। শতকরা ১০ জন অটিজম আক্রান্ত শিশু ছবি আঁকা, গান, গণিত কিংবা কম্পিউটারে প্রচণ্ড দক্ষ হয়। অটিজমের ব্যাপ্তি বিশাল। তাই অটিজমের এই ব্যাপকতাকে অটিজম স্পেকটার্ম ডিসঅর্ডার বলা হয়ে থাকে। মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের অধিক হারে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। যার অনুপাত ১:৪। অটিজম কোনো মানসিক রোগ নয় কিংবা মানসিক প্রতিবন্ধিতাও নয়।
সন্তানের কোনো সমস্যা ধরা পড়লে আমাদের সমাজে মাকে সর্বপ্রথম দায়ী করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মা প্রথম হোঁচট খান নিজের পরিবারে, তারপর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব। সমাজের কাছে তিনি এবং তাঁর সন্তান অনেক সময় হয়ে যান উপহাসের পাত্র। সে ক্ষেত্রে মাকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে এবং নিজের মন স্থির করে কার্যকর সময় ব্যয় করার চেষ্টা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে সমমনা বন্ধু-বান্ধব এবং এ ধরনের সমস্যায় ভুগছে এমন কোনো পরিবারের সঙ্গ এনে দিতে পারে স্বস্তি।
অটিজম সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের কাজ শুরু করতে হবে নিজের ঘর থেকে। অনেক সময় দেখা যায়, বাবা কিছুতেই মেনে নিতে চান না তাঁর শিশুর কোনো প্রকার সমস্যা আছে। সে ক্ষেত্রে মায়ের পক্ষে শিশুটির জন্য ভালো কিছু করা কঠিন হয়ে যায়। এ কারণে বাবাসহ বাড়ির অন্যান্য সদস্য যেমন ভাইবোন, দাদা-দাদি, নানা-নানিদেরকেও অটিজম সম্পর্কে ধারণা দেওয়া একান্ত জরুরি। এ কাজটি ধৈর্য ধরে করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, এই শিশু যে কারও হতে পারত; তারাও এ সমাজেরই একজন।
মারুফা হোসেন
পরিচালক, স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেন
No comments