ভিন্নমত-হাসপাতাল, ডাক্তার এবং রোগী by আবু আহমেদ

বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে এখন ডাক্তার, ডায়াগনিস্ট সেন্টার ও ওষুধের দোকানের সাইনবোর্ড নজরে পড়ে। এক বিদেশি দুই বছর বাংলাদেশে থেকে আমাকে একটি প্রশ্ন করলেন, তোমাদের দেশে এত ওষুধ কারা খায়? আমি বললাম, মানুষের ওষুধ মানুষে খায়। তিনি বললেন, ওষুধ খেয়ে তারা কি ভালো আছে? বরং আমি তো তোমাদের পথে-ঘাটে


রোগাক্রান্ত লোকই বেশি দেখি। আমি বললাম, তুমি ঠিকই বলছ, এরা রোগাক্রান্ত হচ্ছে দুই কারণে। এক. অত ভালো খাদ্য এই দেশের লোকের কিসমতে নেই। খাদ্য আছে বটে, তবে সবই ভেজাল। তোমাদের দেশে ভেজাল খাদ্য বাজারজাত করার সাহস কারো নেই, তোমাদের দেশের লোক খাদ্যে ভেজাল দিয়ে দুই পয়সা কামাই করবে- এটা ভাবতেও পারে না। আর আমাদের দেশের সেই নৈতিক মানটা অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। বাজারে যা কিছু পাওয়া যায়, সবটাতেই যেন ত্রুটি আছে। তবে আরো বড় কথা হলো, তোমাদের দেশে ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আছে খাদ্যজাতীয় পণ্যের মান দেখভাল করার জন্য।
আমাদের দেশে কী আছে? আমরা ব্যর্থ ষোলো আনা। এ পর্যন্ত খাদ্যবাজারে যাতে দুই নম্বরি করতে না পারে, সে জন্য একটি কমিশন বা কর্তৃপক্ষ গড়ে তুলতে পারিনি। আর যে কারণে লোকজন রোগী হচ্ছে, সেটা হলো, ওষুধ খেয়েও রোগ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। ভুল ওষুধ, অতি-ওষুধ রোগীকে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রোগী সেসব খেয়ে আবার একই ডাক্তার বা অন্য ডাক্তারের কাছে আসছে এবং আসছে আরো জটিলতা নিয়ে। আর্থিকভাবে কষ্ট হলেও রোগী ভালো হলে পয়সা দিতে কার্পণ্য করছে না। তবে সত্য হলো, পয়সা দিয়ে এ দেশে চিকিৎসা কেনা যায় না। আর বেশি ওষুধ, ভুল ওষুধের মানে হলো এক শ্রেণীর ডাক্তার। তাঁদের মধ্যে বড় বড় ডিগ্রিধারী চিকিৎসকও আছেন। আমাদের দেশে যে দু-চারজন স্বনামধন্য চিকিৎসক ছিলেন, তাঁরা বোধ করি অতীতে ছিলেন, এখনো জীবিত থাকলে তাঁরা বয়সের কারণে রোগী অত দেখেন না। তবে হ্যাঁ, এখনো কিছু ভালো ডাক্তার আছেন, কিন্তু তালাশ করে নিতে হয়। এবার বিদেশি জনাথন প্রশ্ন করলেন, তোমাদের দেশে ডাক্তারদের নামের পাশে এত ডিগ্রি কেন লেখা হয়? আমি বললাম, সেটাও ব্যবসায়িক।
অনেক ডাক্তার মনে করেন, যত বেশি ডিগ্রি-ট্রেনিং ইত্যাদি লেখা যাবে, ততই লোকে বড় ডাক্তার মনে করবেন। তাই তো অনেকে এক সপ্তাহের কোনো ওয়ার্কশপে গিয়ে সেটা এমনভাবে নামের পরে ব্যবহার করছেন, মনে হবে সেটাও একটি 'ডিগ্রি'। কিন্তু তুমি কি বাইরের কোনো দেশে এমন করে ডাক্তারের সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখছ? আমি তো যুক্তরাষ্ট্রে দেখিনি, তাঁরা শুধু তাঁদের নামের শেষে এমডি লিখতেন। তবে জনাথন শোনো, এই ডাক্তারদের পেশাগত ডিগ্রি-ট্রেনিং এসব ক্ষেত্রেও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। শুনেছি, BMDC নামে তাঁদেরই একটা সংস্থা Practice করার সনদ দেয়। তাঁরা কিন্তু নামের পেছনের ডিগ্রি ধরে বা ট্রেনিংয়ের এসব লম্বা ফিরিস্তি নিয়ন্ত্রণ করেন না। আরো একটা বিষয়ে কেউ কোনো দিন জিজ্ঞাসা করে না বা জানতেও চায় না, সত্যিকার অর্থে চিকিৎসক মহোদয় লন্ডন-জেনেভাতে কয়েক বছর লেখাপড়া করেছেন কি না। সেই জন্যই তুমি দেখবে, এ দেশে অনেক 'ভুয়া' ডাক্তার আবিষ্কার হচ্ছে। অন্য ব্যাপারটি হলো, লোকে 'ছোট' ডাক্তার বা শুধু MBBS পাস করা ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না। এটা আমাদের দোষ। আমি আমার এ বয়সে দেখিছি, অনেক ছোট ডাক্তার কথিত বড় ডাক্তারের চেয়ে অনেক বেশি ভালো জানেন। এই যে ছোট ডাক্তাররা রোগী পান না, সেই জন্য তাঁরাও লেগে গেছেন অন্তত নামের পেছনে এক-দুই দিনের একটা ট্রেনিংয়ের যে সনদ পেয়েছেন সেটা উল্লেখ করতে। তুমি দেখছ না, এই দেশে রাস্তাঘাটে ওষুধের দোকান! লোকজন সমানে ওষুধ কিনছে, আর খাচ্ছে। তোমাদের দেশে এটা কল্পনা করা যাবে? জনাথন, তুমি তো নিশ্চয় থাইল্যান্ড গিয়েছ। সেখানে একটা নামি হাসপাতাল আছে নাম বামরুন গ্রাদ। কিন্তু লক্ষণীয় হলো, ওই হাসপাতালের আশপাশে সহজে তুমি Pharmacy নামের ওষুধের দোকান খুঁজে পাবে না। পাবে দূরে লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে।
তাহলে কি বামরুনগ্রাদ হাসপাতালের ডাক্তাররা দেশ-বিদেশ থেকে আসা রোগীকে ওষুধ দিচ্ছেন না? দিচ্ছেন, ভেতর থেকে, নিজেদের Store থেকে, তবে অত ওষুধ তাঁরা দেন না। আমাদের দেশের আজিজ সাহেব গেলেন ওই হাসপাতালে। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব। দেশি হাসপাতালের ডাক্তারের ওপর ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত ব্যাংকক গেলেন নিজের শরীরটা চেকআপ করাতে। আজিজ সাহেব ফেরত এসে বললেন, তাঁকে ডাক্তার কোনো ওষুধ দেননি। শুধু খাওয়াদাওয়া এবং চালচলনে পরিবর্তন আনতে বলেছেন। অথচ এই আজিজ সাহেবকেই এ দেশে চিকিৎসা নিতে গিয়ে সাতটি ওষুধ খেতে হয়েছে একসঙ্গে এক মাস। এখন আজিজ সাহেব অনেক আত্মপ্রত্যয়ী। তাই বলছিলাম, আমাদের চিকিৎসক শ্রেণীকে বোধ করি এটাই শেখানো হয় যে রোগীকে যত বেশি ওষুধ খাওয়াতে পারো, খাইয়ে যাও। তবে শুনেছি, এটা ক্লাসরুমে শেখানো হয় না, এটা ডাক্তার রপ্ত করে ফেলে পরে যখন কোনো হাসপাতালে-ফার্মেসির সঙ্গে সংযুক্ত হয়। এটাও আমি শুনেছি, যে ডাক্তার কম ওষুধ দেন হাসপাতাল সেই ডাক্তারকে রাখতে চায় না। এবার জনাথনের প্রশ্ন- এটা কেন হবে? আমি বললাম, শোনো, এটার পেছনেও একটি অর্থনীতি কাজ করছে। হাসপাতাল তো ডাক্তারকে রেখেছে কয়েক লাখ টাকা বেতন দিয়ে।
অনেক অধ্যাপক ডাক্তার আছেন, পাঁচ জায়গায় তাঁর নাম ঝুলছে। সবাই তাঁর নাম বিক্রি করছে। তিনি দুই ঘণ্টা নামের জায়গায় যান বটে, তবে এত রোগী তাঁর জন্য অপেক্ষা করে যে প্রত্যেককে দুই মিনিট করে সময় দেওয়ারও সুযোগ নেই। হাসপাতাল তাঁর নাম ব্যবহার করে আয় করছে। আয় হলো তাঁর নামে কিন্তু তিনি যে প্যাথলজিক্যাল টেস্ট দিচ্ছেন তার মূল্য? এসব খাত থেকে অধ্যাপক-চিকিৎসক যদি হাসপাতালকে বেশি আয় করে দিতে পারেন, তাহলে হাসপাতালের জন্য তিনি অমূল্য সম্পদ। তাহলে বোঝো, হাপসাতাল, ডাক্তার আর ওষুধ কম্পানির স্বার্থ কিভাবে এক হয়ে সেই ভার রোগীর ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে! আজিজ সাহেবের আর এক অভিযোগ হলো, যে চিকিৎসক তাঁকে দিয়ে এত Test করালেন, তিনি কিন্তু ওষুধ লেখার সময় মনোযোগ দিয়ে একবারও সেগুলো দেখলেন না। আজিজ সাহেব যেমন আমাদের ওষুধ, হাসপাতাল-ডাক্তারের বাজার নিয়ে হতাশ, আমিও তেমনি হতাশ। আজিজ সাহেব অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেছেন। শুধু তাঁকে বললাম, পদে থাকাকালে কিছু করতে হতো। রেগুলেশন বা তদারকি বলতে একটা কথা আছে। আপনার দেশে এই বাজারে তা কি আদৌ আছে? তাই তো আপনার দেশের ডাক্তার যা খুশি তাই প্রেসক্রিপশন লিখছেন, অধিকাংশ সময় ওষুধ কম্পানি আর হাসপাতালের পক্ষ হয়ে তিনি রোগীর ওপর আর্থিক বিল চাপানোর যন্ত্র হিসেবে কাজ করছেন, এসব দেখার জন্য তো একটা তদারকি সংস্থা থাকা উচিত ছিল। আজও যে দু-চারজন ভালো ডাক্তার আছেন, যাঁরা কম ওষুধ লেখেন, তাঁরা নিজেদের বিবেকের তাড়নায় তেমন আছেন। আপনি কয়জন প্রফেসর নুরুল ইসলাম পাবেন, যিনি শুধু একটি ট্যাবলেট লিখতেন। সেই দিন বাংলাদেশে অনেক আগেই ইতি হয়ে গেছে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.