গ্যাসসম্পদ-সমুদ্রের গ্যাস ব্লক নতুন করে নির্ধারণ করতে হবে by বদরূল ইমাম
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক আদালত কর্তৃক বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমুদ্রসীমানা নির্ধারণ করার ফলে দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস-সম্ভাবনাময় এই সমুদ্র অঞ্চল নিয়ে দুটি দেশের মধ্যে যে বিরোধ ছিল তার নিরসন হয়েছে। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বঙ্গোপসাগরের উজ্জ্বল গ্যাস-সম্ভাবনাই মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও ভারতকে সমুদ্রসীমানা নিয়ে পরস্পরের প্রতি
বেশি করে প্রতিযোগী করে তুলেছে। ইতিমধ্যে ভারত ও মিয়ানমার উভয়ই তাদের সমুদ্রে বড় আকারের গ্যাসপ্রাপ্তি প্রত্যক্ষ করেছে। বাংলাদেশ তার সমুদ্রসীমানায় সে রকম জোর অনুসন্ধানকাজ সম্পন্ন করতে না পারার ফলে আশানুরূপ গ্যাসের সন্ধান পায়নি। বাংলাদেশের পক্ষে জোর অনুসন্ধান চালানোর একটি বাধা ছিল পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার ও ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে পারস্পরিক সীমানা বিরোধ। তাই মিয়ানমারের সঙ্গে এ বিরোধ নিরসনের ফলে পূর্ব দিকে আর কোনো সমস্যা থাকল না। অদূর ভবিষ্যতে পশ্চিম দিকে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমারেখার বিরোধ নিষ্পত্তি হবে বলে আশা করা যায়। নতুন সীমারেখা নির্ধারণ হওয়ার পর যে কাজটি প্রথমে সম্পন্ন করা প্রয়োজন তা হলো, সেই অনুযায়ী সমুদ্রের গ্যাস ব্লকসমূহ নতুন করে নির্ধারণ করা। এর ফলে নিষ্কণ্টক এই ব্লকসমূহে পুরোমাত্রায় অনুসন্ধান চালাতে আর কোনো বাধা থাকবে না।
পূর্ব থেকেই ভারত ও মিয়ানমার উভয়ই বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমারেখা নির্ধারণে সমদূরত্বের নীতি অবলম্বন করার পক্ষে দাবি পেশ করে, যা গ্রহণ করা হলে বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চল কেবল ১৩০ মাইলের মধ্যে সংকুচিত হয়ে পড়ত। সুখের কথা এই যে আন্তর্জাতিক আদালত ওই প্রস্তাব নাকচ করে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত ন্যায়পরতানীতির ভিত্তিতে সীমানা নির্ধারণ করেন। ফলে বাংলাদেশ তার একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে সমুদ্রসীমানা ২০০ মাইল পর্যন্ত নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়। আন্তর্জাতিক আদালত যেভাবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমুদ্রসীমারেখা নির্ধারণ করেন, তার কারিগরি সূত্র অনেকের কাছে সুস্পষ্ট না-ও হতে পারে, তবে সাধারণ পাঠকের জন্য তার একটা সচিত্র ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ওই সীমারেখা বাংলাদেশের সমুদ্রে গ্যাস ব্লকসমূহকে কীভাবে প্রভাবিত করবে তা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বটে। এই প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য এ বিষয়টির ওপর আলোকপাত করা।
গভীর সমুদ্র-ব্লকসমূহ
আন্তর্জাতিক আদালতের কাছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়ই তাদের নিজস্ব বিবেচনায় সমুদ্রসীমারেখা প্রস্তাব করে (ম্যাপ নম্বর-১)। প্রথমত দেখা যাক মিয়ানমার কী সীমারেখা দাবি করেছিল এবং তা গ্রহণ করা হলে বাংলাদেশের গ্যাস ব্লকসমূহ কীভাবে প্রভাবিত হতো। ১ নম্বর ম্যাপে দেখা যায়, মিয়ানমার দাবি করে, গভীর সমুদ্রে ১১ নম্বর বিন্দু থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ২৩২ ডিগ্রি (আজিমুথ) লাইন টেনে এই সীমারেখা টানা হোক। এটি গৃহীত হলে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রব্লক (ডিএস) ১৩, ১৭, ১৮, ২১, ২২, ২৩, ২৭ ও ২৮ সম্পূর্ণরূপে এবং (ডিএস) ১২, ১৬ ও ২০ আংশিকভাবে মিয়ানমারের দিকে চলে যেত। অপরদিকে বাংলাদেশ দাবি করে, সীমারেখাটি আরও পূর্ব দিকে (মিয়ানমারের দিকে) ৮ নম্বর বিন্দু থেকে ২১৫ ডিগ্রি লাইন বরাবর টানা হোক (ম্যাপ-১)। কিন্তু আদালত দুটি প্রস্তাবের কোনোটিই গ্রহণ না করে সব দিক বিবেচনা করে মধ্যমপন্থার একটি লাইন নির্ধারণ করেন। লাইনটি বাংলাদেশের প্রস্তাবিত ২১৫ ডিগ্রি লাইন বটে, তা ৮ নম্বর বিন্দুর পরিবর্তে কিছুটা পশ্চিমে ১১ নম্বর বিন্দু থেকে টানা হয় (ম্যাপ-১)। ফলে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র ব্লকসমূহ যেভাবে প্রভাবিত হয়েছে তা হলো: বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রব্লক (ডিএস) ১৮, ২২, ২৩, ২৭ ও ২৮ সম্পূর্ণভাবে এবং ১৩, ১৭, ২১ ও ২৬ আংশিকভাবে মিয়ানমারের দিকে চলে গেছে।
এ থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে, আন্তর্জাতিক আদালত নির্ধারিত সীমারেখা অনুযায়ী, বেশ কিছু গভীর সমুদ্রব্লক বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারের দিকে চলে গেছে। এখানে একটি প্রশ্ন কারও মনে জাগতে পারে, তবে কি বাংলাদেশ তার বেশ কিছু গভীর সমুদ্রব্লক হারাল? আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইতিপূর্বে বাংলাদেশ কর্তৃক নির্ধারিত গভীর সমুদ্রব্লকসমূহ নির্ধারণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মানা হয়নি। অন্য কথায়, বাংলাদেশ ২০০৫ সালে তার গভীর সমুদ্রব্লকসমূহ চিহ্নিত করার সময় কোনো সমুদ্র আইন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করেনি। বরং আন্তর্জাতিক আইনবহির্ভূত পন্থায় মিয়ানমারের সমুদ্রসীমানার অংশবিশেষ তার ভেতর অন্তর্ভুক্ত করে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ যখন উপরিউক্ত গভীর সমুদ্রব্লকসমূহে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিদেশি তেল কোম্পানিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে সে সময় মিয়ানমার তার প্রতিবাদ করে। ফলে অধিকাংশ তেল কোম্পানি তাদের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও এ আহ্বানে সাড়া দিতে দ্বিধা করে এবং অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। এটি সম্ভবত বিব্রতকর যে পেট্রোবাংলা কর্তৃক ঘোষিত ওই আহ্বানপত্র এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি এবং পেট্রোবাংলার ওয়েবসাইটে অদ্যাবধি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিসমূহকে পূর্বে নির্ধারিত গভীর সমুদ্রব্লকসমূহে অনুসন্ধানের আমন্ত্রণ প্রদর্শন করা হচ্ছে।
সম্ভাবনাময় বাড়তি সমুদ্র অঞ্চল
আন্তর্জাতিক আদালত নির্ধারিত সমুদ্রসীমারেখা অনুযায়ী, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে বাংলাদেশের অগভীর গ্যাস ব্লক-১৮ ছাড়িয়ে আরও দক্ষিণে কিছুটা বাড়তি সমুদ্র অঞ্চল বাংলাদেশ পেয়েছে। মিয়ানমারের দাবি ছিল, এই সীমারেখা উত্তর দিকে সরিয়ে এনে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসা, যাতে আদালত রাজি হননি। ফলে বাংলাদেশ তার অগভীর সমুদ্রব্লক-১৮ দক্ষিণ দিকে কিছুটা প্রসারিত করতে পারবে। এই বাড়তি এলাকার পরিধি বিরাট না হলেও এটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে, বঙ্গোপসাগরের অন্যান্য এলাকার তুলনায় এখানে গ্যাস-সম্ভাবনা অতি-উজ্জ্বল। নিকট অতীতে মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশসংলগ্ন অগভীর সমুদ্রসীমানায় তিনটি বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র (শোয়ে, শোয়ে ফুয়ে ও মিউ) আবিষ্কারের পর বাংলাদেশের টেকনাফ উপকূল থেকে মিয়ানমারের আরাকান উপকূল পর্যন্ত সমুদ্র অঞ্চল গ্যাস-সম্ভাবনার অতি মোক্ষম এলাকা বলে ভূবিজ্ঞানীদের নিকট বিবেচিত হয়ে আসছে। এই তিনটি গ্যাসক্ষেত্র যে ভূতাত্ত্বিক গঠন ও পরিবেশে অবস্থান করে, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে তা সমভাবে প্রসারিত বলে ভূবিজ্ঞানীরা মনে করেন। সে কারণে বাংলাদেশের এই সমুদ্র এলাকাটিতে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু বিদেশি সরকারি ও বেসরকারি তেল কোম্পানি গ্যাস অনুসন্ধানে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এখানে এই বাড়তি সমুদ্র এলাকাটি পাওয়া বাংলাদেশের জন্য আশাব্যঞ্জক বলে তেল-গ্যাস বিশেষজ্ঞরা মত দিচ্ছেন।
শেষের কথা
বাংলাদেশের বর্তমান জ্বালানি তথা গ্যাসসংকট দেশের অর্থনীতিতে যে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে তা লাঘবের একমাত্র উপায় দেশের সম্ভাবনাময় গ্যাসসম্পদের ত্বরিৎ আহরণ ও ব্যবহার। দেশের সমুদ্র অঞ্চলে গ্যাস অনুসন্ধানের বাধা হিসেবে প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা বিরোধ একটি প্রধান উপাদান হিসেবে দেখা দিয়েছিল। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির ফলে বর্তমানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার তাদের নিজ সমুদ্র এলাকা নিষ্কণ্টকভাবে চিহ্নিত করতে পারবে। উভয় দেশকেই এখন নতুন সীমানারেখা অনুযায়ী তাদের সমুদ্রের গ্যাস ব্লকসমূহ নতুনভাবে চিহ্নিত করতে হবে। বাংলাদেশের জন্য কাজটি এখনই করা আবশ্যক। বিশেষ করে মিয়ানমারের সমুদ্রসীমানায় প্রমাণিত গ্যাসভান্ডার সংলগ্ন টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিন এলাকায় যে সম্ভাবনার জানালা খুলেছে, তাকে সুপ্ত না রেখে কার্যকরভাবে জাগিয়ে তোলা আবশ্যক। অনেকে মনে করতে চান, বাংলাদেশের নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধানী কোম্পানি দিয়ে সমুদ্রসীমানায় অনুসন্ধান কাজ করতে হবে। দেশীয় অনুসন্ধানী কোম্পানি (বাপেক্স) মূল ভূখণ্ডে সফলতা অর্জন করলেও সমুদ্রবক্ষে এই মুহূর্তে এককভাবে অনুসন্ধান করার কারিগরি দক্ষতা অর্জন করেনি। এই দক্ষতা গড়ে তুলতে হলে দেশীয় কোম্পানিকে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে সমুদ্রবক্ষে যৌথভাবে অনুসন্ধান কাজ করতে দেওয়া যেতে পারে। আর এ ধরনের যৌথ উদ্যোগ বেসরকারি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির সঙ্গে করার পরিবর্তে বিদেশি সরকারি তেল কোম্পানির সঙ্গে করাটা বাংলাদেশের জন্য বেশি লাভজনক হবে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়নে রাশিয়া ও গণচীনের সরকারি তেল অনুসন্ধানী প্রতিষ্ঠানসমূহ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এদের কেউ কেউ বাংলাদেশি কোম্পানি বাপেক্সকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছে। বাংলাদেশের উচিত হবে, কালবিলম্ব না করে নবনির্ধারিত মিয়ানমার-বাংলাদেশ সমুদ্রসীমারেখা অনুযায়ী, সমুদ্রব্লকসমূহ ঘোষণা এবং গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করা।
বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
পূর্ব থেকেই ভারত ও মিয়ানমার উভয়ই বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমারেখা নির্ধারণে সমদূরত্বের নীতি অবলম্বন করার পক্ষে দাবি পেশ করে, যা গ্রহণ করা হলে বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চল কেবল ১৩০ মাইলের মধ্যে সংকুচিত হয়ে পড়ত। সুখের কথা এই যে আন্তর্জাতিক আদালত ওই প্রস্তাব নাকচ করে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত ন্যায়পরতানীতির ভিত্তিতে সীমানা নির্ধারণ করেন। ফলে বাংলাদেশ তার একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে সমুদ্রসীমানা ২০০ মাইল পর্যন্ত নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়। আন্তর্জাতিক আদালত যেভাবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমুদ্রসীমারেখা নির্ধারণ করেন, তার কারিগরি সূত্র অনেকের কাছে সুস্পষ্ট না-ও হতে পারে, তবে সাধারণ পাঠকের জন্য তার একটা সচিত্র ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ওই সীমারেখা বাংলাদেশের সমুদ্রে গ্যাস ব্লকসমূহকে কীভাবে প্রভাবিত করবে তা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বটে। এই প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য এ বিষয়টির ওপর আলোকপাত করা।
গভীর সমুদ্র-ব্লকসমূহ
আন্তর্জাতিক আদালতের কাছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়ই তাদের নিজস্ব বিবেচনায় সমুদ্রসীমারেখা প্রস্তাব করে (ম্যাপ নম্বর-১)। প্রথমত দেখা যাক মিয়ানমার কী সীমারেখা দাবি করেছিল এবং তা গ্রহণ করা হলে বাংলাদেশের গ্যাস ব্লকসমূহ কীভাবে প্রভাবিত হতো। ১ নম্বর ম্যাপে দেখা যায়, মিয়ানমার দাবি করে, গভীর সমুদ্রে ১১ নম্বর বিন্দু থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ২৩২ ডিগ্রি (আজিমুথ) লাইন টেনে এই সীমারেখা টানা হোক। এটি গৃহীত হলে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রব্লক (ডিএস) ১৩, ১৭, ১৮, ২১, ২২, ২৩, ২৭ ও ২৮ সম্পূর্ণরূপে এবং (ডিএস) ১২, ১৬ ও ২০ আংশিকভাবে মিয়ানমারের দিকে চলে যেত। অপরদিকে বাংলাদেশ দাবি করে, সীমারেখাটি আরও পূর্ব দিকে (মিয়ানমারের দিকে) ৮ নম্বর বিন্দু থেকে ২১৫ ডিগ্রি লাইন বরাবর টানা হোক (ম্যাপ-১)। কিন্তু আদালত দুটি প্রস্তাবের কোনোটিই গ্রহণ না করে সব দিক বিবেচনা করে মধ্যমপন্থার একটি লাইন নির্ধারণ করেন। লাইনটি বাংলাদেশের প্রস্তাবিত ২১৫ ডিগ্রি লাইন বটে, তা ৮ নম্বর বিন্দুর পরিবর্তে কিছুটা পশ্চিমে ১১ নম্বর বিন্দু থেকে টানা হয় (ম্যাপ-১)। ফলে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র ব্লকসমূহ যেভাবে প্রভাবিত হয়েছে তা হলো: বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রব্লক (ডিএস) ১৮, ২২, ২৩, ২৭ ও ২৮ সম্পূর্ণভাবে এবং ১৩, ১৭, ২১ ও ২৬ আংশিকভাবে মিয়ানমারের দিকে চলে গেছে।
এ থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে, আন্তর্জাতিক আদালত নির্ধারিত সীমারেখা অনুযায়ী, বেশ কিছু গভীর সমুদ্রব্লক বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারের দিকে চলে গেছে। এখানে একটি প্রশ্ন কারও মনে জাগতে পারে, তবে কি বাংলাদেশ তার বেশ কিছু গভীর সমুদ্রব্লক হারাল? আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইতিপূর্বে বাংলাদেশ কর্তৃক নির্ধারিত গভীর সমুদ্রব্লকসমূহ নির্ধারণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মানা হয়নি। অন্য কথায়, বাংলাদেশ ২০০৫ সালে তার গভীর সমুদ্রব্লকসমূহ চিহ্নিত করার সময় কোনো সমুদ্র আইন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করেনি। বরং আন্তর্জাতিক আইনবহির্ভূত পন্থায় মিয়ানমারের সমুদ্রসীমানার অংশবিশেষ তার ভেতর অন্তর্ভুক্ত করে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ যখন উপরিউক্ত গভীর সমুদ্রব্লকসমূহে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিদেশি তেল কোম্পানিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে সে সময় মিয়ানমার তার প্রতিবাদ করে। ফলে অধিকাংশ তেল কোম্পানি তাদের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও এ আহ্বানে সাড়া দিতে দ্বিধা করে এবং অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। এটি সম্ভবত বিব্রতকর যে পেট্রোবাংলা কর্তৃক ঘোষিত ওই আহ্বানপত্র এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি এবং পেট্রোবাংলার ওয়েবসাইটে অদ্যাবধি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিসমূহকে পূর্বে নির্ধারিত গভীর সমুদ্রব্লকসমূহে অনুসন্ধানের আমন্ত্রণ প্রদর্শন করা হচ্ছে।
সম্ভাবনাময় বাড়তি সমুদ্র অঞ্চল
আন্তর্জাতিক আদালত নির্ধারিত সমুদ্রসীমারেখা অনুযায়ী, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে বাংলাদেশের অগভীর গ্যাস ব্লক-১৮ ছাড়িয়ে আরও দক্ষিণে কিছুটা বাড়তি সমুদ্র অঞ্চল বাংলাদেশ পেয়েছে। মিয়ানমারের দাবি ছিল, এই সীমারেখা উত্তর দিকে সরিয়ে এনে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসা, যাতে আদালত রাজি হননি। ফলে বাংলাদেশ তার অগভীর সমুদ্রব্লক-১৮ দক্ষিণ দিকে কিছুটা প্রসারিত করতে পারবে। এই বাড়তি এলাকার পরিধি বিরাট না হলেও এটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে, বঙ্গোপসাগরের অন্যান্য এলাকার তুলনায় এখানে গ্যাস-সম্ভাবনা অতি-উজ্জ্বল। নিকট অতীতে মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশসংলগ্ন অগভীর সমুদ্রসীমানায় তিনটি বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র (শোয়ে, শোয়ে ফুয়ে ও মিউ) আবিষ্কারের পর বাংলাদেশের টেকনাফ উপকূল থেকে মিয়ানমারের আরাকান উপকূল পর্যন্ত সমুদ্র অঞ্চল গ্যাস-সম্ভাবনার অতি মোক্ষম এলাকা বলে ভূবিজ্ঞানীদের নিকট বিবেচিত হয়ে আসছে। এই তিনটি গ্যাসক্ষেত্র যে ভূতাত্ত্বিক গঠন ও পরিবেশে অবস্থান করে, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে তা সমভাবে প্রসারিত বলে ভূবিজ্ঞানীরা মনে করেন। সে কারণে বাংলাদেশের এই সমুদ্র এলাকাটিতে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু বিদেশি সরকারি ও বেসরকারি তেল কোম্পানি গ্যাস অনুসন্ধানে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এখানে এই বাড়তি সমুদ্র এলাকাটি পাওয়া বাংলাদেশের জন্য আশাব্যঞ্জক বলে তেল-গ্যাস বিশেষজ্ঞরা মত দিচ্ছেন।
শেষের কথা
বাংলাদেশের বর্তমান জ্বালানি তথা গ্যাসসংকট দেশের অর্থনীতিতে যে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে তা লাঘবের একমাত্র উপায় দেশের সম্ভাবনাময় গ্যাসসম্পদের ত্বরিৎ আহরণ ও ব্যবহার। দেশের সমুদ্র অঞ্চলে গ্যাস অনুসন্ধানের বাধা হিসেবে প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা বিরোধ একটি প্রধান উপাদান হিসেবে দেখা দিয়েছিল। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির ফলে বর্তমানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার তাদের নিজ সমুদ্র এলাকা নিষ্কণ্টকভাবে চিহ্নিত করতে পারবে। উভয় দেশকেই এখন নতুন সীমানারেখা অনুযায়ী তাদের সমুদ্রের গ্যাস ব্লকসমূহ নতুনভাবে চিহ্নিত করতে হবে। বাংলাদেশের জন্য কাজটি এখনই করা আবশ্যক। বিশেষ করে মিয়ানমারের সমুদ্রসীমানায় প্রমাণিত গ্যাসভান্ডার সংলগ্ন টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিন এলাকায় যে সম্ভাবনার জানালা খুলেছে, তাকে সুপ্ত না রেখে কার্যকরভাবে জাগিয়ে তোলা আবশ্যক। অনেকে মনে করতে চান, বাংলাদেশের নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধানী কোম্পানি দিয়ে সমুদ্রসীমানায় অনুসন্ধান কাজ করতে হবে। দেশীয় অনুসন্ধানী কোম্পানি (বাপেক্স) মূল ভূখণ্ডে সফলতা অর্জন করলেও সমুদ্রবক্ষে এই মুহূর্তে এককভাবে অনুসন্ধান করার কারিগরি দক্ষতা অর্জন করেনি। এই দক্ষতা গড়ে তুলতে হলে দেশীয় কোম্পানিকে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে সমুদ্রবক্ষে যৌথভাবে অনুসন্ধান কাজ করতে দেওয়া যেতে পারে। আর এ ধরনের যৌথ উদ্যোগ বেসরকারি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির সঙ্গে করার পরিবর্তে বিদেশি সরকারি তেল কোম্পানির সঙ্গে করাটা বাংলাদেশের জন্য বেশি লাভজনক হবে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়নে রাশিয়া ও গণচীনের সরকারি তেল অনুসন্ধানী প্রতিষ্ঠানসমূহ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এদের কেউ কেউ বাংলাদেশি কোম্পানি বাপেক্সকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছে। বাংলাদেশের উচিত হবে, কালবিলম্ব না করে নবনির্ধারিত মিয়ানমার-বাংলাদেশ সমুদ্রসীমারেখা অনুযায়ী, সমুদ্রব্লকসমূহ ঘোষণা এবং গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করা।
বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments