জীবন যেমন-লক্ষেষ্টৗ ঘিরে তালাতের স্মৃতি by মুস্তাফা জামান আব্বাসী

৪০ থেকে '৫০ পর্যন্ত তালাতের মতো সুদর্শন অভিনেতা কমই। রাগ দরবারির সঙ্গে বাগেশ্রীর মিশ্রণে গানটি মুখে মুখে : 'হোঁঠো ছে গুলফিসাঁ হ্যায়, ওয়ো আঁখো সে আসক বারহাম।' দিলীপ কুমার বলেছেন তার সম্পর্কে : মধুর কণ্ঠের গায়কই নন, ব্যবহার ছিল নবাবদেরই মতো, লক্ষেষ্টৗর 'রইস'। কথা ধীরে, ব্যবহার মোলায়েম মাখনের মতো।


ফেরদৌসীর সঙ্গে দুটি গান, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বলিউডের অভিনেতাদের মধ্যে তালাত মাহমুদই রোমান্টিকতার প্রতিমূর্তি


সাহিত্যের সভা বসেছে অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের পরিত্যক্ত লক্ষেষ্টৗ শহরে; উপস্থিত যেখানে ভারত-বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা-নেপাল-পাকিস্তানের কিছু লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী ও সংস্কৃতি অনুরাগী। আজ সকালেই পেঁৗছেছি; ঢাকা থেকে কলকাতা, সেখান থেকে শহরের আমাউসি এয়ারপোর্টে সকাল ১২টা ৪০ মিনিটে। ঢাকার মতোই উষ্ণতা; আয়োজকদের উষ্ণতা তা ছাড়িয়ে এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল অবধি ছড়িয়ে পড়েছে। সবাই সবাইকে জড়িতে ধরছেন, যেন কতকাল পরে দেখা। ম্যাডাম অজিত কাউর, কয়েক বছর আগে যিনি দিলি্লতে সুফি সম্মেলনে ছিলেন আমাদের হোস্ট, আজও সমান ঔদার্যে বরণ করে নিলেন ফাউন্ডেশন অব সার্ক রাইটার্স অ্যান্ড লিটারেচারের পক্ষ থেকে। ১৬ থেকে ১৯ মার্চ চারদিন ধরে চলবে 'সার্ক ফেস্টিভ্যাল অব লিটারেচার' হোটেল ক্লার্কস আভাদে, যেখানে আমাদের খাওয়া-থাকার ব্যবস্থা।
যার কথা মনে পড়েছে তার কথাই আজ। লক্ষেষ্টৗ শহরে জন্মগ্রহণ তালাত মাহমুদের, গজলের পরাক্রান্ত সম্রাট। শিল্পী আব্বাসী কনফারেন্সেও আছেন, ওয়াজেদ আলী খানের স্মৃতিবিধৌত লক্ষেষ্টৗর চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আকর্ষণ লক্ষেষ্টৗর মরিস কলেজ। অভিনেতা পাহাড়ী সান্যাল লক্ষেষ্টৗ মরিস কলেজের ছাত্র, নিজ ওস্তাদ মুহাম্মদ হোসেন খসরুও তাই। পিতা আব্বাসউদ্দিন গান শিখতে আসতে চেয়েছিলেন এখানে, আমিও। ইচ্ছেরা দল মেলেনি। গোধূলিলগ্নে মরিস কলেজের সামনে দাঁড়াতে উদ্ভাসিত হলো স্মৃতি।
সঙ্গীতরাজ্যের রাজকুমার তালাত যেমন সুপুরুষ তেমনি সুকণ্ঠ। তার কথাই প্রথমে মনে পড়বে। তার কালের সুমধুর কণ্ঠের গজল সম্রাট। 'তুম গীত শুনো ম্যায় গাউঁ'/'জিভনকে টুটে তারোসে ম্যায় তেরা মন বাহলাউঁ', এমনই শত গানে সুর দিগন্তে ঝড় তুলেছিলেন প্লে-ব্যাক সিঙ্গার, সুরস্রষ্টা ও অভিনেতা তালাত মাহমুদ। জন্ম ফেব্রুয়ারি ২৪, ১৯২৪। ঢাকায় এলেন, গান গাইলেন ও জয় করলেন। তার গাওয়া বাংলা গানটি 'তোমারে লেগেছে এত যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে', আমার বন্ধু কে জি মুস্তফার লেখা, সুর দিয়েছেন রবীন ঘোষ। তালাত মাহমুদ গান শিখেছিলেন পণ্ডিত সিএসআর ভাতখণ্ডের কাছ থেকে, মরিস মিউজিক কলেজ থেকে।
১৯৩৯ সালে গজল গায়ক হিসেবে আবির্ভাব। পূর্বতন রাজা : ওস্তাদ বরকত আলী খান, কেএল সাইগল ও এমএ রউফ। কমল দাসগুপ্ত ও সুবল দাসগুপ্ত দু'জনেই নামকরা ট্রেইনার, সুযোগ করে দিলেন তালাতকে। প্রথম গানেই বাজার মাত। প্রথম গানটি : 'সব দিন সামান নহি থা।' যখন ছোট, যে গানটি মুখে মুখে, স্ত্রী পুরুষ তরুণ যুবা বৃদ্ধ-নির্বিশেষে সবার কণ্ঠে : 'তসবির তেরি দিল মেরা বাহলানা সাকেগি।' গানটি বেরোল ১৯৪৫-এ, বয়স আমার ৭, আজ ৭৪। গানটি গাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে যেতে পারি ৭ বছর বয়সে।
লক্ষেষ্টৗতে নতুন 'মল' তৈরি হয়েছে, যেখানে এখনও বেঁচে তালাত, টাইম মেশিনে যেন পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে ফিরে গেছি, সুন্দর চেহারার তালাত, ভেসে আসছে বহু দূর থেকে 'তারানা' ছবির গান : 'সিনে মে সুলাগ্তে হ্যায় আরমান', 'সুজাতা' ছবির গান : 'জ্বলতে হ্যাঁয় জিসকে লিয়ে', 'বারাদারি' ছবির গান : 'তসবির বানাতা হু', 'আরজু' ছবির গান : 'অ্যায় দিল মুঝে অ্যায়ছি জায়গা লে চাল যাহা কোই না হো', 'ট্যাক্সি ড্রাইভার' ছবির গান : 'যায়ে তো যায়ে কাঁহা', 'সাংদিল' ছবির গান : 'ইয়ে হাওয়া ইয়ে রাত চাঁদনি', 'দাগ' ছবির গান : 'অ্যায় মেরি দিল কাঁহি অওর চল'। লক্ষেষ্টৗ এসে নতুন করে গাইছি, মনে পড়ছে তালাতের কথা, রোমান্টিক দিনগুলোর কথা।
তপন কুমার নামে বাংলা গানও গেয়েছিলেন, জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যা। কণ্ঠ রেশমের মতো পাতলা ও সূক্ষ্ম। যাদের গান তিনি গেয়েছিলেন তারা হলেন : মির্জা গালিব, মুমিন, সাহির লুধিয়ানভি, মাজরু সুলতান পুরি, প্রেম ধাবান। যাদের বিপরীতে নায়ক হিসেবে অভিনয় করেছিলেন : নায়িকা নূতন, সুরাইয়া, শ্যামা, নাদিরা ও মালা সিনহা। তার বড় ভাই হায়াত মাহমুদ ঢাকায় চাকরি করতেন একটি কোম্পানিতে, কয়েকবার আমার বাসায় এসেছেন। চেহারা তারই মতো।
'৪০ থেকে '৫০ পর্যন্ত তালাতের মতো সুদর্শন অভিনেতা কমই। রাগ দরবারির সঙ্গে বাগেশ্রীর মিশ্রণে গানটি মুখে মুখে : 'হোঁঠো ছে গুলফিসাঁ হ্যায়, ওয়ো আঁখো সে আসক বারহাম।' দিলীপ কুমার বলেছেন তার সম্পর্কে : মধুর কণ্ঠের গায়কই নন, ব্যবহার ছিল নবাবদেরই মতো, লক্ষেষ্টৗর 'রইস'। কথা ধীরে, ব্যবহার মোলায়েম মাখনের মতো। ফেরদৌসীর সঙ্গে দুটি গান, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বলিউডের অভিনেতাদের মধ্যে তালাত মাহমুদই রোমান্টিকতার প্রতিমূর্তি। দিলীপ কুমার, দেবানন্দ, রাজকাপুর, সুনীল দত্ত, সান্তারাম সবার জন্যই প্লে-ব্যাকে কণ্ঠ দিয়েছিলেন তালাত। গায়ক ও অভিনেতা একসঙ্গে দুর্লভ। অভিনয় শেষ হয়ে গেলে গান শ্রোতাদের মনে গুঞ্জরিত, এটাই সাফল্যের চাবিকাঠি। সাইগাল অভিনয় করেছেন, চেহারা তালাতের মতো ছিল না। চলে গেলেন তারা চিরকালের জন্য, যাদের নাম : কেএল সাইগাল, মোহাম্মদ রাফি, মুখেশ। ১৯৯৮ সালের ৯ মে তালাতের ইন্তেকাল।
সাহিত্য সভায় গুণীজন উপস্থিত। তাদের কথা বলতে প্রয়োজন খানিকটা জায়গার। ড. আবিদ হোসেন, ড. নিহাল রোদ্রিগো (শ্রীলংকা), প্রফেসর অভি সুবেদি (নেপাল), ড. সীতাকান্ত মহাপাত্র, ড. শীলকান্ত শর্মা ও প্রধান অতিথি আইসিসিআরের ডাইরেক্টর জেনারেল ড. সুরেশ গোয়েল। লেখক আব্বাসী নিয়ে এসেছেন একটি বক্তৃতা : 'পরিবেশ ব্যবস্থায় সাহিত্যের চ্যালেঞ্জ।' সে কথা ঢাকায় ফিরে। আজ তালাত।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী :সাহিত্য-সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.