নারী-নারীর প্রতি সহিংসতা সর্বত্রই by তৌহিদা শিরোপা
২৭ ফেব্রুয়ারি। ওয়াশিংটন ডিসি। এক ছাদের নিচে প্রায় দেড় হাজার মানুষ। স্বপ্ন তাদের একটাই, একদিন বন্ধ হবে নারীর প্রতি সহিংসতা। দি ইউএস ন্যাশনাল নেটওয়ার্ক টু অ্যান্ড ডমেস্টিক ভায়োলেন্স (এনএনইডিভি) এবং দ্য গ্লোবাল নেটওয়ার্ক অব উইমেনস শেল্টারস (জিএনডব্লিউএস) আয়োজন করেছিল এ সম্মেলনের।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে এদিন সন্ধ্যায় সবাই জড়ো হয়েছেন নারীর নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য দ্বিতীয় বিশ্ব সম্মেলন শুরুর আনুষ্ঠানিকতায়। বাংলাদেশ থেকে অংশ নিয়েছিলাম আমরা সাতজন।
এই প্রথম বিদেশ ভ্রমণ, তা-ও আবার পেশাগত কাজে। মনে উত্তেজনার কমতি ছিল না। উত্তেজনা ছাপিয়ে গেছে নানা বিস্ময়ে। সভ্য জাতি, সভ্য দেশ হিসেবেই যুক্তরাষ্ট্র আমাদের কাছে পরিচিত। শুনেছি, এখানেই নারী সবচেয়ে নিরাপদ। কিন্তু এই সম্মেলন সেই ভুল ভাঙাল। এখানে এসে বুঝলাম, নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা এখানেও কম খর্ব হয় না। একটি পরিসংখ্যানে দেখালাম, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার। যদিও এখানে তাঁদের জন্য রয়েছে নিরাপদ আশ্রয় (শেল্টার হোম) ও অন্যান্য নানা সুবিধা। সহিংসতার শিকার হলে জরুরি ফোন নম্বরগুলোতে তা জানানোর সুযোগও রয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে নির্যাতনের শিকার নারীদের যথাযথ সহায়তা নিশ্চিত করে সরকার। কিন্তু নির্যাতনের শুরুতে ওই দেশেও নারী শুরুতে মুখ বুজে সহ্য করেন সবকিছু। কাউকে বলতে পারেন না। নির্যাতন সীমা ছাড়িয়ে গেলেই ভিন্ন পথ ধরেন তাঁরা।
সামাজিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও নারীর সহিংসতার চিত্র তো একই। বোঝা যায়, শিক্ষিত হলেও নারীকে সহিংসতার শিকার হতে হচ্ছে। এসব বিষয়ের সমাধান খোঁজার জন্যই এ সম্মেলনের আয়োজন। সম্মেলনে যোগ দেওয়া বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, ‘আমরা যাঁরা নারী পাচার, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে কাজ করি, তাঁদের অনেক কিছু শেখা হলো এই সম্মেলনে। এ সম্মেলন থেকে শিক্ষা নিয়ে পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন ২০১০-এর সংশোধনীতে আমরা আরও নতুন কিছু যোগ করতে পারব।’
সম্মেলনে পরিচয় হয় সুদান থেকে আসা একমাত্র প্রতিনিধি নিশির সঙ্গে। তাঁর একসময় মনে হতো, কালো পুরুষেরাই হয়তো সহিংসতা বেশি ঘটান। এখন বুঝতে পেরেছেন, শুধু কালো নন, সব বর্ণের পুরুষই নারীর ওপর যৌন ও পারিবারিক নির্যাতন চালাতে সিদ্ধহস্ত। নিশি জানান, সুদানে ঐক্যবদ্ধভাবে এলাকার মানুষ সহিংসতার শিকার নারীদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র করার চেষ্টা করে।
নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে করণীয় নানা বিষয় নিয়ে একাধিক অধিবেশন ছিল সম্মেলনে। নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি, প্রযুক্তির অপব্যবহার ও নারীকে এ থেকে রক্ষার উপায় নিয়ে আলোচনা করা হলো গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সকালে একটা প্রাক্-সম্মেলন অধিবেশনে। প্রযুক্তির কারণে কত বড় বড় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে তা তুলে ধরা হলো। কিন্তু তাই বলে নারী ইন্টারনেট বা তথ্যপ্রযুক্তির বাইরে থাকবেন, তা নয়। এর সমাধানের জন্য কয়েকটি বিশেষ ধরনের সফটওয়্যার ও কৌশল খুঁজে বের করেছেন বিশেষজ্ঞরা; যাতে সহজে অপরাধীকে চিহ্নিত করা যায়।
আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশের তথ্যচিত্র দেখে মনে হয়েছে, স্থানীয় মানুষের সহায়তা থাকলে নারীর প্রতি সহিংসতা অনেকখানি কমানো সম্ভব। প্ল্যান বাংলাদেশ ও ইউএসএআইডির সহায়তায় এই বিশ্ব সম্মেলনে অংশ নিয়ে শুধু নারীর শারীরিক নির্যাতনের বিষয়টি নয়, মানসিকভাবেও যে কত ধরনের নির্যাতন হতে পারে, তার নানা দিক জানতে পারি। এই পরিস্থিতিতে কীভাবে নারীকে মানসিক শক্তি জোগানো যায়, সে প্রসঙ্গ এসেছে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে পুরুষের অংশগ্রহণ বাড়ানোর কথা বারবার আলোচনায় এসেছে। বাইরে থেকে যে পুরুষকে সভ্য ও ভদ্র মনে হচ্ছে, তিনি আদর্শ পুরুষ না-ও হতে পারেন। শিক্ষা বা পেশার দিক দিয়ে পুরুষটি যোগ্য হলেও তিনিই হয়তো ঘরে গিয়ে স্ত্রীকে নির্যাতন করেন। তাই পুরুষের জন্য কাউন্সেলিং ও প্রশিক্ষণের বিষয়টিও খুবই গুরুত্ব পেয়েছে আলোচনায়।
নারীপক্ষের প্রকল্প পরিচালক রীতা দাস রায় সম্মেলনের বিভিন্ন আলোচনা শুনে বলেন, ‘নারীর প্রতি সহিংসতা দেশ-কাল-পাত্র বিবেচনা করে হয় না। ৯৬টি দেশের অংশগ্রহণ সেটিই প্রমাণ করেছে। সহিংসতার শিকার নারীরাও এই সম্মেলনে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা কথা বলেছেন। আফ্রিকা ও যুক্তরাষ্ট্রে সহিংসতার শিকার নারীকে স্বল্প মেয়াদে বাসস্থানের সুযোগ করে দেওয়া হয়। এ উদ্যোগ আমরা নিতে পারি। সম্মেলনের একটি বিষয়ের সঙ্গে আমি একমত পোষণ করতে পারিনি। আমার মনে হয়েছে, ক্ষুদ্রঋণ নারীর সহিংসতা প্রতিরোধের একমাত্র হাতিয়ার নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর কারণে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় নারীকে।’
মানসিক নির্যাতনের হার কমিয়ে আনার জন্য নানা ধরনের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা, যোগাসনের কথা তুলে ধরেন সম্মেলনের প্রতিনিধিরা। কেননা, খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই মানসিক বিপর্যস্ততার কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে। জিএনডব্লিউএসের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য বন্দনা রানার নেতৃত্বে এশিয়ার অংশগ্রহণকারীরা নিজ দেশ ও প্রতিবেশী দেশের যেকোনো সমস্যায় সহায়তার জন্য এশিয়া নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। সম্মেলনের আকর্ষণীয় দিক ছিল প্রামাণ্যচিত্রের প্রদর্শনী। নানা দেশের নানা জাতির নারীর সহিংসতার চিত্র দেখে কখনো গা শিউরে উঠেছে। কখনো সব বাধা পেরিয়ে তাদের সফলতার কাহিনি অনুপ্রাণিত করেছে আমাদের। তবে গণমাধ্যমকর্মীরা যখন এ ধরনের নির্যাতন বা সহিংসতার শিকার নারীর কাহিনি, সাক্ষাৎকার গ্রহণ করবেন, তার যথাযথ প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত সহিংসতা বা নির্যাতনের শিকার হওয়া নারী (ভিকটিম) কথা বলতে রাজি না হবেন, তাঁকে কোনোভাবেই চাপ দেওয়া যাবে না। গণমাধ্যমকর্মীকে এক ধরনের কাউন্সেলরের ভূমিকা পালন করতে হবে।
চার দিনের সম্মেলনে শেখা ও জানা হলো অনেক কিছুই। একটা বিষয় পরিষ্কার বোঝা গেল, উন্নত বা অনুন্নত, সাদা-কালো অর্থাৎ স্থান-কাল-পাত্র এখন কোনো ব্যাপার নয়, নারীর প্রতি সহিংসতা দুনিয়াজুড়েই হচ্ছে; যা প্রতিরোধ করা দরকার সবার সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমে।
তৌহিদা শিরোপা: সাংবাদিক।
No comments