স্মরণ-বাবার স্মৃতি ও বঙ্গবন্ধুর সেই সার্টিফিকেট by ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান
বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সেই সার্টিফিকেট যেটা আমার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বাবার নামে বঙ্গবন্ধু নিজেই আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে, মনে পড়ে আমার প্রয়াত মাও আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন, সেই সার্টিফিকেটটি আজ আমার জীবনের অনেক মূল্যবান সম্পদ।
১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল (শুক্রবার) আমাদের রেলওয়ের বাসায় পাকিস্তানি বাহিনীর অতর্কিত হামলা। আমার বাবা বললেন, 'তোমরা চলে যাও পাশের অবাঙালির বাসায়।' মা, বড়ভাই আর দুই বোন নিয়ে আমি চলে গেলাম পাশের বাসায়। বাবা আমাদের বাঁচিয়ে দিলেন। তিনটা গুলির শব্দ শোনা গেল। সবাই নির্বাক হয়ে শুনলাম সেই গুলির শব্দ। আর পাঁচিল টপকে আমি দেখলাম তখনো ফায়ারিং পজিশনে বসে আছে সেই তরুণ আর্মি অফিসার। ৫২ বছরের একজন বৃদ্ধকে বধ করতে ওর একটুও বুক কাঁপেনি। পরক্ষণে জুমার আজানের ধ্বনি শোনা গেল। অবাঙালি সেই ভদ্রলোক অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললেন, 'তোমারা আব্বাকো ইন্তেকাল হো গিয়া।' এ কথা শুনে আমরা কেউ কাঁদতে পারলাম না। ভদ্রলোক বললেন, 'জুমার আজান দিচ্ছে ওরা (পাকিস্তানি বাহিনী) চলে গেছে, তোমরাও চলে যাও।' বাবার লাশ পেছনে ফেলে মাত্র ১৭ টাকার পুঁজি নিয়ে পায়ে হেঁটে, কিছুটা বাসে, কিছুটা রিকশায় তিন দিনে আমরা পেঁৗছি ফেনীতে। আমার হাতে ছিল অটোমেটিক রাইফেল। খুঁজছিলাম সেই দালালকে যারা আমার বাবাকে দেখিয়ে দিয়েছিল। পেলাম না। ফাঁকা গুলি করে শান্তি পেয়েছিলাম। ৩ মার্চ ১৯৭১, চট্টগ্রামের রেলওয়ে এলাকায় হঠাৎ উত্তেজনা বেড়ে যায়। একজন উচ্চপদস্থ বাঙালি অফিসারের (নাম মনে নেই) তত্ত্বাবধানে সেনাবাহিনীর একটি অংশ আমাদের এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আনলেও হঠাৎ করে বাঙালিরা অবাঙালিদের মারতে উদ্যত হয়। শান্তিকামী আমার বাবা (শহীদ আবদুস সামাদ) বাঙালিদের শান্ত করেন। সবার প্রিয় সামাদ সাহেব ১ এপ্রিল পর্যন্ত এই শান্তি বজায় রাখতে পেরেছিলেন।
কিন্তু অবাঙালিরা কথা রাখেনি। পাকিস্তানি সৈন্যদের লেলিয়ে দেয় আমাদের পরিবারের দিকে। বাবা আমাদের পাঠিয়ে দেন অন্য বাসায়। নিজে মাথা নত করেননি। ১৯৭১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সেই জায়গায় এসে শুনলাম বাবার নিস্তেজ দেহকে ওরা ওই দিনই নিয়ে গেছে কোনো এক অজানায়। অবাঙালি সেই ভদ্রলোক যিনি রেলওয়েতে আমার বাবার সহকর্মী ছিলেন এবং আমাদের ঘণ্টাখানেকের জন্য আশ্রয়ও দিয়েছিলেন, তিনিই জানালেন অনেক অজানা তথ্য_যা আমরা বাবার কাছ থেকেও জানতে পারিনি। ৩ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১ এপ্রিল ১৯৭১ বাবার কিছু দুঃসাহসিক ঘটনাই সম্ভবত তাঁর জন্য কাল হয়েছিল বলে জানান সেই অবাঙালি ভদ্রলোক এবং ওই ঘটনা প্রতিপক্ষ জানত বলে তিনি জানান।
আমার অত্যন্ত কাছের মানুষ, ভালোবাসার মানুষটি আজ নেই। বাবাকে আর কোনো দিন দেখব না। দুই চোখ ভরে দেখেছি স্বাধীনতার আনন্দ। কিন্তু এর মধ্যে যে শূন্যতা, তা পূরণ করব কী দিয়ে? কী আছে আমাদের? দীর্ঘ ৪১ বছর কী সঞ্চয় করেছি ওই শূন্যতা পূরণ করতে? সেই নিরীহ সাধারণ মানুষটির সঙ্গে যখন দেখা হবে, যখন আমার শহীদ বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে অন্য জীবনে, তখন সেই তিনটি বুলেট বুকের কোন জায়গায় বিদ্ধ হয়েছিল সে প্রশ্ন করতে পারব কী আমার বাবাকে।
ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান
কিন্তু অবাঙালিরা কথা রাখেনি। পাকিস্তানি সৈন্যদের লেলিয়ে দেয় আমাদের পরিবারের দিকে। বাবা আমাদের পাঠিয়ে দেন অন্য বাসায়। নিজে মাথা নত করেননি। ১৯৭১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সেই জায়গায় এসে শুনলাম বাবার নিস্তেজ দেহকে ওরা ওই দিনই নিয়ে গেছে কোনো এক অজানায়। অবাঙালি সেই ভদ্রলোক যিনি রেলওয়েতে আমার বাবার সহকর্মী ছিলেন এবং আমাদের ঘণ্টাখানেকের জন্য আশ্রয়ও দিয়েছিলেন, তিনিই জানালেন অনেক অজানা তথ্য_যা আমরা বাবার কাছ থেকেও জানতে পারিনি। ৩ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১ এপ্রিল ১৯৭১ বাবার কিছু দুঃসাহসিক ঘটনাই সম্ভবত তাঁর জন্য কাল হয়েছিল বলে জানান সেই অবাঙালি ভদ্রলোক এবং ওই ঘটনা প্রতিপক্ষ জানত বলে তিনি জানান।
আমার অত্যন্ত কাছের মানুষ, ভালোবাসার মানুষটি আজ নেই। বাবাকে আর কোনো দিন দেখব না। দুই চোখ ভরে দেখেছি স্বাধীনতার আনন্দ। কিন্তু এর মধ্যে যে শূন্যতা, তা পূরণ করব কী দিয়ে? কী আছে আমাদের? দীর্ঘ ৪১ বছর কী সঞ্চয় করেছি ওই শূন্যতা পূরণ করতে? সেই নিরীহ সাধারণ মানুষটির সঙ্গে যখন দেখা হবে, যখন আমার শহীদ বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে অন্য জীবনে, তখন সেই তিনটি বুলেট বুকের কোন জায়গায় বিদ্ধ হয়েছিল সে প্রশ্ন করতে পারব কী আমার বাবাকে।
ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান
No comments