রাজনীতি-গণভোট অথবা ভিন্ন ধরনের ‘নির্বাচিত’ সরকার by আলী রীয়াজ
বাংলাদেশের রাজনীতির আগামী মাসগুলোর ঘটনাপ্রবাহ কেমন হবে, এর সামান্য ইঙ্গিত মার্চ মাসে আমরা সবাই প্রত্যক্ষ করেছি। বিরোধী দলের ডাকা সমাবেশ কেন্দ্র করে সরকারের প্রতিক্রিয়া ও পদক্ষেপ থেকে এ কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে আলাপ-আলোচনায় ক্ষমতাসীন জোটের কোনো উৎসাহ নেই।
অন্যপক্ষে সংসদে বিরোধী দলের প্রধানের দুই ঘণ্টাব্যাপী বক্তৃতা থেকেও স্পষ্ট যে তারা তাদের দাবিদাওয়া থেকে এক কদম পেছাতে প্রস্তুত নয়। ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে ‘বিরোধী দলের ভূমিকার’ যে ঐতিহ্য, তা অনুসরণ করে বিএনপি সদস্যপদ রক্ষার জন্য সংসদে হাজিরা দিয়েছে মার্চ মাসে। সংসদে এর বেশি তারা ভূমিকা রাখবে—এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। বিরোধীদলীয় নেত্রীর বক্তৃতার পর প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায়ও বোঝা যায়, বিরোধী দলকে সংসদে রাখার জন্য হলেও মহাজোট ও তার শরিকেরা সামান্য ছাড়ও দেবে না। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে এই সম্পর্কের কারণ বহুবিধ এবং এর ইতিহাস আমাদের সবারই জানা আছে। এখন যে ইস্যুতে দেশ একটা সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে এগোচ্ছে তা হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়া না-হওয়ার প্রশ্ন। পঞ্চদশ সংশোধনীর পর নির্বাচনের সময় যে সরকারের বিধান রয়েছে, তা অতীতের তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়। প্রধানমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী, অনির্বাচিত সরকারের বিধান চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিএনপি ও তার শরিকেরা বলছে, ‘তত্ত্বাবধায়ক’ কিংবা ‘নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার’ ছাড়া আর কারও তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। সরকার ও বিরোধী দলের এ ধরনের ‘আপসহীন’ ও ‘কঠোর’ অবস্থান সাধারণ মানুষের জন্য কতটা দুর্ভোগ বয়ে আনবে, তারও লক্ষণ আমরা ইতিমধ্যেই দেখতে পেয়েছি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপকারিতা ও অপকারিতা নিয়ে গত বছরগুলোতে বিস্তর আলোচনা হয়েছে—সেগুলো আবার বলার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এখন সরকার ও বিরোধী দল দাবি করছে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তাদের পক্ষে রয়েছে। এই দাবির সমর্থনে কোনো পক্ষই সংশয়াতীত প্রমাণ হাজির করতে পারবে না। মহাজোট তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে এই ব্যবস্থা বাতিলের কথা বলেনি; বিএনপি ও তার শরিকদের সমাবেশে জনসমাগম প্রমাণ করে না যে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক তাদের যুক্তির সঙ্গে একমত। এই পরিস্থিতিতে সবার মনেই প্রশ্ন হচ্ছে, পরস্পরবিরোধী এই অবস্থান থেকে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলার উপায় কী। যেকোনো সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনার ভূমিকা হিসেবে বলা দরকার যে কোনো রকম ব্যবস্থা না নিলে পঞ্চদশ সংশোধনীর পর সংবিধানে যে বিধান রাখা হয়েছে, তাতে আগামী নির্বাচনের সময় বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা যে ধরনের সরকার রাখতে চাইবে, তা ছাড়া আর কোনো ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
এই প্রেক্ষাপটে সম্ভাব্য রাজনৈতিক সংকট এড়ানোর দুটো পথ বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রথমটি হলো গণভোটের আয়োজন করা। দ্বিতীয়টি হলো নির্বাচনের সময় ভিন্ন ধরনের ‘নির্বাচিত’ সরকার নিয়োগ করা।
সংকট মোচনের প্রথম সম্ভাব্য উপায় হচ্ছে, নির্বাচনকালীন সরকারের ধরন বিষয়ে একটি গণভোট অনুষ্ঠান। সহজ ভাষায় বললে, বাংলাদেশের নাগরিকেরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক—এটা চান কি না, তা নিয়ে গণভোটের আয়োজন করা। বাংলাদেশের সংবিধানে কোনো বিষয়ে গণভোট অনুষ্ঠানের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই—এ কথা সবারই জানা। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান সংবিধানে ১৪২ (১ক) অনুচ্ছেদ সংযোজন করে সংবিধানের কতিপয় মৌলিক ধারা সংশোধনের জন্য গণভোটের বিধান রেখেছিলেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়ে যাওয়ার ফলে এই বিধানটিও বাতিল হয়ে গেছে। সংবিধান সংশোধন বিষয়ে দুই-তৃতীয়াংশের সম্মতির অতিরিক্ত গণভোটের বিধান থাকা বাঞ্ছনীয় কি না, তা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। কিন্তু এই ধারা না থাকার অর্থ এই নয় যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপ্রতিনিধি চাইলে কোনো বিষয়ে গণভোট করতে পারবে না।
স্বাধীনতার পর এ যাবৎ তিনবার গণভোটের আয়োজন করা হয়েছে। এগুলো হলো—১৯৭৭ সালের ৩০ মে, ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ এবং ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। প্রথম দুটি গণভোট আয়োজন করা হয়েছিল সামরিক শাসকদের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার জন্য। সেগুলো যেমন অবাধ ছিল না, তেমনি প্রয়োজনও ছিল না। ১৯৯১ সালের গণভোট অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা ছিল সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীকে আইনগত রূপ দেওয়ার জন্য। ১৯৯১-এর গণভোটে মাত্র ৩৫ শতাংশ ভোটার ভোট দেন। এর কারণ হলো, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল সম্মিলিতভাবেই দ্বাদশ সংশোধনী সংসদে পাস করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে কোনো গণভোট হলে তাতে অংশগ্রহণ যে এত কম হবে না—এটা সহজেই অনুমেয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠানের বিষয়ে সাংবিধানিক কোনো বাধা নেই। কিন্তু তার অর্থ এও যে এ ধরনের গণভোট অনুষ্ঠিত হলে তার ফলাফল মানতে সরকারের কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না। এ কথা বিরোধী দলের জন্যও সত্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ ধরনের গণভোট থেকে সুস্পষ্টভাবে জনমত জানা গেলে উভয় পক্ষের ওপরই নৈতিক চাপ সৃষ্টি হবে। গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য আইনি বা সাংবিধানিক কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু সরকার যদি আইন বা সংবিধান বদলের দরকার মনে করে, তবে সে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া তার জন্য মোটেই কষ্টকর নয়। সংসদে তিন-চতুর্থাংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে মহাজোটের; জাতীয় স্বার্থে তারা চাইলেই এই পদক্ষেপ নিতে অগ্রণী হতে পারে।
ক্ষমতাসীন জোট যদি গণভোটের ব্যাপারে অনুৎসাহী হয় এবং সংবিধানের বর্তমান বিধিবিধানের মধ্যে সমাধান খোঁজে, তবে এরও উপায় রয়েছে বলে আমার ধারণা। প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন যে নির্বাচনের সময় অনির্বাচিত সরকার থাকুক তা কাম্য নয়; অর্থাৎ সে সময় নির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে সরকার গঠিত হলে নীতিগতভাবে তাঁর ও মহাজোটের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। প্রধানমন্ত্রী এও বলেছেন যে নির্বাচনের ৯০ দিন আগে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে এবং তারা দৈনন্দিন কার্যকলাপ ছাড়া আর কিছুই করবে না। সে ক্ষেত্রে নির্বাচিত সরকার গঠনের দুটো বিকল্প বিবেচনা করা যেতে পারে।
প্রথম বিকল্প হলো, নির্বাচনের ৯০ দিনের অব্যবহিত পূর্বে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী সংসদ থেকে পদত্যাগ করবেন। তাঁদের আসনে দুজন নির্দলীয় ব্যক্তি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন। ওই দুজনের একজন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন এবং অন্যজন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মন্ত্রণালয় পরিচালনা করবেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত এই দুজনের মধ্যে পদ বণ্টনের দায়িত্ব পালন করবেন। বাকি মন্ত্রিসভা তৈরি হবে প্রধান দুই দলের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে সমসংখ্যক সদস্য নিয়ে। অন্যান্য দল, যারা গত নির্বাচনে মোট ভোটের নির্ধারিত ভাগ (যেমন—৫ শতাংশ) পেয়েছে, তাদের প্রতিনিধিকেও মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। প্রধানমন্ত্রী ও অন্য গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ওই দুই ব্যক্তি পরবর্তী পাঁচ বছর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য হতে পারবেন না বা সরকারি কোনো লাভজনক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হতে পারবেন না।
দ্বিতীয় ‘নির্বাচিত সরকার’ গঠনের উপায় হলো, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিনের অব্যবহিত পূর্বে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীসহ মোট ১০ জন সংসদ সদস্য পদত্যাগ করবেন। ওই আসনগুলোতে উপনির্বাচনের মাধ্যমে ১০ জন সদস্য নির্বাচিত হবেন, যাঁরা অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত এই ১০ জনের মধ্যে একজনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেবেন। এই ১০ জন নির্বাচিত সদস্য নির্বাচনে অংশ নেবেন না, পরবর্তী পাঁচ বছর মন্ত্রিসভার সদস্য হতে পারবেন না কিংবা প্রজাতন্ত্রের কোনো লাভজনক পদে নিযুক্ত হবেন না।
নির্বাচিত সরকারের অধীনে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এই দুই উপায় গণভোটের চেয়ে আরও বেশি জটিল—প্রধান দুই জোট এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সম্মতি প্রয়োজন। তদুপরি এ জন্য দরকার সবার মধ্যে সমঝোতা। সর্বোপরি দরকার সমস্যা সমাধানের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো ও নেতাদের সদিচ্ছা। রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষত প্রধান দুই দলের সে সদিচ্ছা আছে কি না, তা প্রমাণের এটাই সময়।
ইলিনয়, ২৭ মার্চ, ২০১২
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপকারিতা ও অপকারিতা নিয়ে গত বছরগুলোতে বিস্তর আলোচনা হয়েছে—সেগুলো আবার বলার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এখন সরকার ও বিরোধী দল দাবি করছে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তাদের পক্ষে রয়েছে। এই দাবির সমর্থনে কোনো পক্ষই সংশয়াতীত প্রমাণ হাজির করতে পারবে না। মহাজোট তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে এই ব্যবস্থা বাতিলের কথা বলেনি; বিএনপি ও তার শরিকদের সমাবেশে জনসমাগম প্রমাণ করে না যে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক তাদের যুক্তির সঙ্গে একমত। এই পরিস্থিতিতে সবার মনেই প্রশ্ন হচ্ছে, পরস্পরবিরোধী এই অবস্থান থেকে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলার উপায় কী। যেকোনো সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনার ভূমিকা হিসেবে বলা দরকার যে কোনো রকম ব্যবস্থা না নিলে পঞ্চদশ সংশোধনীর পর সংবিধানে যে বিধান রাখা হয়েছে, তাতে আগামী নির্বাচনের সময় বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা যে ধরনের সরকার রাখতে চাইবে, তা ছাড়া আর কোনো ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
এই প্রেক্ষাপটে সম্ভাব্য রাজনৈতিক সংকট এড়ানোর দুটো পথ বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রথমটি হলো গণভোটের আয়োজন করা। দ্বিতীয়টি হলো নির্বাচনের সময় ভিন্ন ধরনের ‘নির্বাচিত’ সরকার নিয়োগ করা।
সংকট মোচনের প্রথম সম্ভাব্য উপায় হচ্ছে, নির্বাচনকালীন সরকারের ধরন বিষয়ে একটি গণভোট অনুষ্ঠান। সহজ ভাষায় বললে, বাংলাদেশের নাগরিকেরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক—এটা চান কি না, তা নিয়ে গণভোটের আয়োজন করা। বাংলাদেশের সংবিধানে কোনো বিষয়ে গণভোট অনুষ্ঠানের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই—এ কথা সবারই জানা। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান সংবিধানে ১৪২ (১ক) অনুচ্ছেদ সংযোজন করে সংবিধানের কতিপয় মৌলিক ধারা সংশোধনের জন্য গণভোটের বিধান রেখেছিলেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়ে যাওয়ার ফলে এই বিধানটিও বাতিল হয়ে গেছে। সংবিধান সংশোধন বিষয়ে দুই-তৃতীয়াংশের সম্মতির অতিরিক্ত গণভোটের বিধান থাকা বাঞ্ছনীয় কি না, তা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। কিন্তু এই ধারা না থাকার অর্থ এই নয় যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপ্রতিনিধি চাইলে কোনো বিষয়ে গণভোট করতে পারবে না।
স্বাধীনতার পর এ যাবৎ তিনবার গণভোটের আয়োজন করা হয়েছে। এগুলো হলো—১৯৭৭ সালের ৩০ মে, ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ এবং ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। প্রথম দুটি গণভোট আয়োজন করা হয়েছিল সামরিক শাসকদের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার জন্য। সেগুলো যেমন অবাধ ছিল না, তেমনি প্রয়োজনও ছিল না। ১৯৯১ সালের গণভোট অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা ছিল সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীকে আইনগত রূপ দেওয়ার জন্য। ১৯৯১-এর গণভোটে মাত্র ৩৫ শতাংশ ভোটার ভোট দেন। এর কারণ হলো, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল সম্মিলিতভাবেই দ্বাদশ সংশোধনী সংসদে পাস করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে কোনো গণভোট হলে তাতে অংশগ্রহণ যে এত কম হবে না—এটা সহজেই অনুমেয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠানের বিষয়ে সাংবিধানিক কোনো বাধা নেই। কিন্তু তার অর্থ এও যে এ ধরনের গণভোট অনুষ্ঠিত হলে তার ফলাফল মানতে সরকারের কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না। এ কথা বিরোধী দলের জন্যও সত্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ ধরনের গণভোট থেকে সুস্পষ্টভাবে জনমত জানা গেলে উভয় পক্ষের ওপরই নৈতিক চাপ সৃষ্টি হবে। গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য আইনি বা সাংবিধানিক কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু সরকার যদি আইন বা সংবিধান বদলের দরকার মনে করে, তবে সে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া তার জন্য মোটেই কষ্টকর নয়। সংসদে তিন-চতুর্থাংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে মহাজোটের; জাতীয় স্বার্থে তারা চাইলেই এই পদক্ষেপ নিতে অগ্রণী হতে পারে।
ক্ষমতাসীন জোট যদি গণভোটের ব্যাপারে অনুৎসাহী হয় এবং সংবিধানের বর্তমান বিধিবিধানের মধ্যে সমাধান খোঁজে, তবে এরও উপায় রয়েছে বলে আমার ধারণা। প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন যে নির্বাচনের সময় অনির্বাচিত সরকার থাকুক তা কাম্য নয়; অর্থাৎ সে সময় নির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে সরকার গঠিত হলে নীতিগতভাবে তাঁর ও মহাজোটের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। প্রধানমন্ত্রী এও বলেছেন যে নির্বাচনের ৯০ দিন আগে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে এবং তারা দৈনন্দিন কার্যকলাপ ছাড়া আর কিছুই করবে না। সে ক্ষেত্রে নির্বাচিত সরকার গঠনের দুটো বিকল্প বিবেচনা করা যেতে পারে।
প্রথম বিকল্প হলো, নির্বাচনের ৯০ দিনের অব্যবহিত পূর্বে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী সংসদ থেকে পদত্যাগ করবেন। তাঁদের আসনে দুজন নির্দলীয় ব্যক্তি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন। ওই দুজনের একজন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন এবং অন্যজন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মন্ত্রণালয় পরিচালনা করবেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত এই দুজনের মধ্যে পদ বণ্টনের দায়িত্ব পালন করবেন। বাকি মন্ত্রিসভা তৈরি হবে প্রধান দুই দলের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে সমসংখ্যক সদস্য নিয়ে। অন্যান্য দল, যারা গত নির্বাচনে মোট ভোটের নির্ধারিত ভাগ (যেমন—৫ শতাংশ) পেয়েছে, তাদের প্রতিনিধিকেও মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। প্রধানমন্ত্রী ও অন্য গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ওই দুই ব্যক্তি পরবর্তী পাঁচ বছর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য হতে পারবেন না বা সরকারি কোনো লাভজনক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হতে পারবেন না।
দ্বিতীয় ‘নির্বাচিত সরকার’ গঠনের উপায় হলো, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিনের অব্যবহিত পূর্বে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীসহ মোট ১০ জন সংসদ সদস্য পদত্যাগ করবেন। ওই আসনগুলোতে উপনির্বাচনের মাধ্যমে ১০ জন সদস্য নির্বাচিত হবেন, যাঁরা অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত এই ১০ জনের মধ্যে একজনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেবেন। এই ১০ জন নির্বাচিত সদস্য নির্বাচনে অংশ নেবেন না, পরবর্তী পাঁচ বছর মন্ত্রিসভার সদস্য হতে পারবেন না কিংবা প্রজাতন্ত্রের কোনো লাভজনক পদে নিযুক্ত হবেন না।
নির্বাচিত সরকারের অধীনে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এই দুই উপায় গণভোটের চেয়ে আরও বেশি জটিল—প্রধান দুই জোট এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সম্মতি প্রয়োজন। তদুপরি এ জন্য দরকার সবার মধ্যে সমঝোতা। সর্বোপরি দরকার সমস্যা সমাধানের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো ও নেতাদের সদিচ্ছা। রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষত প্রধান দুই দলের সে সদিচ্ছা আছে কি না, তা প্রমাণের এটাই সময়।
ইলিনয়, ২৭ মার্চ, ২০১২
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments