গ্রাস করছে ইয়াবার নেশা-প্রতিরোধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা প্রয়োজন

একেই বলে 'প্রদীপের নিচে অন্ধকার।' দেশে যুবসমাজ যখন নেশায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সরকারের যখন সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিরোধ করা প্রয়োজন, তখন একজন সরকারি কর্মকর্তাকেই পাওয়া গেল এই ব্যবসায়ে। কালের কণ্ঠে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, আমির হোসেন নামের গণপূর্ত বিভাগের এক কর্মকর্তার সরকারি বাসা থেকে পুলিশ ৫০ লক্ষাধিক টাকার


ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করেছে এবং তাঁকে আটক করেছে। জানা যায়, এর আগেও আমির হোসেন একাধিকবার আটক হয়েছিলেন। কিন্তু কখনো তাঁর শাস্তি হয়নি, চাকরিও যায়নি। এবার কি অপরাধ প্রমাণিত হবে? সাম্প্রতিক সময়ে ইয়াবার আগ্রাসন খুবই বেড়ে গেছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু চালান ধরাও পড়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে আরেকটি বড় চালান ধরা পড়েছিল টেকনাফে। চালানটিতে প্রায় ছয় কোটি টাকা মূল্যের সোয়া লাখ বড়ি ছিল। ঢাকায় খুবই সহজলভ্য এই ট্যাবলেট বিক্রিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছুসংখ্যক অসাধু সদস্যের সরাসরি সম্পৃক্ত থাকারও অভিযোগ রয়েছে। শুধু ইয়াবা নয়, হেরোইন, প্যাথিডিনসহ অন্যান্য নেশাসামগ্রীও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে বলেও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়।
ইয়া-বা অর্থ হলো পাগলের ওষুধ। এটি মূলত মেথামফিটামিন, সঙ্গে ক্যাফেইনও ব্যবহৃত হয়। এর এক ডজনেরও বেশি ব্র্যান্ড রয়েছে। বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মেথামফিটামিন তৈরি হয় মিয়ানমারে। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে পেশ করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি মিয়ানমারে ৩৭টি কারখানায় ইয়াবা তৈরি হয় এবং এসব কারখানার প্রধান লক্ষ্য বাংলাদেশ। প্রতিবেদনে কারখানাগুলো বন্ধ করার জন্য কূটনৈতিক আলোচনার সুপারিশ করা হয়েছিল। আমরা আশা করি, সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে। কারণ এর মাধ্যমে বাংলাদেশের যুবসমাজ (মূলত ১৮ থেকে ৩০ বছর) সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। খুন-ডাকাতি-ছিনতাইসহ দেশে অপরাধপ্রবণতা দ্রুত বাড়ছে, রাস্তাঘাটে নেশাজনিত দুর্ঘটনা বাড়ছে এবং যুবসমাজের কর্মদক্ষতা ও কর্মস্পৃহা কমছে। নেশাজাতীয় অন্যান্য দ্রব্যের মতো ইয়াবারও রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব। এটি খুব বেশি পরিমাণে আসক্তি ও নির্ভরশীলতা তৈরি করে এবং ক্রমেই তা বাড়তে থাকে। দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারকারীরা প্রতিদিন ৫-১০টি বড়ি সেবন করে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে হাইপোথার্মিয়া, অনিদ্রা, অমনোযোগিতা, কাঁপুনি, খিঁচুনি, দুশ্চিন্তা, আগ্রাসী মনোভাবসহ নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে লিভার ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পিঠের ব্যথা দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশে ইয়াবার ব্যবহারকারী মূলত উচ্চবিত্ত ও তাদের ঘরের সন্তানরা। ইতিপূর্বে হোটেল পূর্বাণীর ম্যানেজিং ডিরেক্টর জয়নাল ও তাঁর বন্ধু নিকিতাকে এই অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। যত দূর জানা যায়, কারখানা পর্যায়ে একেকটি ট্যাবলেটের দাম পড়ে ১৩ টাকা, টেকনাফ পর্যন্ত আসতে দাম হয়ে যায় ৫০ টাকা এবং ঢাকায় বিক্রি হয় ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকায়। বিপুল মুনাফার কারণে এর সঙ্গে বহু অবৈধ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট জড়িত হয়ে পড়েছে। গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী এ রকম সিন্ডিকেটের সংখ্যা ১৩০টির বেশি। ইয়াবা আসক্তদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং নব্য চাকরিজীবীরা রয়েছে। আশঙ্কাজনক হচ্ছে, ক্রমেই মেয়ে এবং স্কুলছাত্রদের মধ্যেও এই নেশা ছড়িয়ে পড়ছে। এই অবস্থা প্রতিরোধ করা না গেলে অবিলম্বে বাংলাদেশ এক মহাসংকটের দিকে এগিয়ে যাবে এটা প্রায় নিশ্চিত। আমরা আশা করি, সরকার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ইয়াবাসহ সব নেশাজাতীয় দ্রব্যের সহজপ্রাপ্যতা বন্ধ করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে হবে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ও কোস্টগার্ডকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রাখতে হবে। প্রয়োজনে এ কাজে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। আমরা কোনোভাবেই এ দেশের যুবসমাজের এই ধ্বংস কেবল তাকিয়ে দেখতে পারি না।

No comments

Powered by Blogger.