আর্সেনিক-ঝুঁকিতে সাত কোটি মানুষ by শিশির মোড়ল

দেশে দুই কোটি মানুষ আর্সেনিক দূষিত পানি পান করছে। আর আর্সেনিক দূষণের ঝুঁকিতে আছে সাত কোটি মানুষ। অথচ আর্সেনিক মোকাবিলায় এখন কোনো প্রকল্পই নেই। আর্সেনিক-সংশ্লিষ্ট সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটিগুলোও নিষ্ক্রিয়।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিল, ২০১১ সালের মধ্যে দেশের সব মানুষকে আর্সেনিকমুক্ত পানি সরবরাহ করা


হবে। ২০১০ সালের এপ্রিলে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত প্রথম পয়োব্যবস্থা ও পানিবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল আর্সেনিক-সমস্যা মোকাবিলায় ২০ কোটি মার্কিন ডলারের বিশেষ তহবিল গঠনের কথা বলে। এসব প্রতিশ্রুতি রক্ষা হয়নি।
আর্সেনিক বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল ট্রাস্টের চেয়ারম্যান কাজী কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সরকার আর্সেনিককে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এ নিয়ে বড় কোনো প্রকল্প বা কর্মসূচি নেই। আর্সেনিকের কারণে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে কত মানুষ মারা গেছে, সে হিসাবও সরকারের কাছে নেই।
যোগাযোগ করা হলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. নুরুজ্জামান বলেছেন, আগের চেয়ে বেশি মানুষ এখন আর্সেনিকমুক্ত পানি পানের সুযোগ পাচ্ছে। সরাসরি আর্সেনিক মোকাবিলার নামে প্রকল্প না থাকলেও নিরাপদ পানি সরবরাহের জন্য সরকারের বেশ কিছু প্রকল্প আছে।
সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ১৯৯৩ সালে প্রথম চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার চামা গ্রামের আলকাস আলীর নলকূপে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিকের উপস্থিতি শনাক্ত করেন। সেই তথ্য প্রকাশ করা হয় ১৯৯৬ সালে। এরপর বাংলাদেশের ৬১টি জেলায় আর্সেনিক-দূষণের কথা জানা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে ‘জনগোষ্ঠীতে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিষক্রিয়া’র ঘটনা বলে বর্ণনা করে।
২০ বছর পরও সরকার চামা গ্রামে বা ওই জেলায় আর্সেনিকমুক্ত পানি সরবরাহ করতে পারেনি। গত সপ্তাহে জেলার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবদুল ওয়াদুদ প্রথম আলোকে বলেন, জেলার চারটি গ্রামের ১০০ শতাংশ এবং ২৮ গ্রামের ৮০ শতাংশ নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক রয়েছে।
পরিস্থিতি: বেসরকারি সংস্থা ওয়াটারএইডের এদেশীয় পরিচালক খায়রুল ইসলাম বলেন, নিরাপদ পানি সরবরাহই আর্সেনিক-দূষণ মোকাবিলার প্রধান বিকল্প। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, দুর্গত বহু মানুষের জন্য আর্সেনিকমুক্ত পানি সরবরাহের ব্যবস্থা হয়নি। মানুষ উপায়হীন হয়ে জেনেশুনে আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে।
ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি নিয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সর্বশেষ জরিপ চালায় ২০০৯ সালে। ছয়টি বিভাগের ৫৫ জেলার ৩০১টি উপজেলার তিন হাজার ১৩২টি ইউনিয়নের নয় লাখ ৭২ হাজার ৮৬৫টি উৎসের (অগভীর নলকূপ, গভীর নলকূপ, পাতকুয়া, পুকুর, পনড-স্যান্ড ফিলটার ইত্যাদি) পানি পরীক্ষা করা হয়। তাতে দেখা যায়, ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ উৎসের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক রয়েছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ভূগর্ভস্থ পানি বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সুধীর কুমার ঘোষ বলেন, দেশের কোনো কোনো এলাকায় পাঁচ শতাংশের কম উৎসে আর্সেনিক আছে। আবার কোনো এলাকায় ৭০ শতাংশ উৎস দূষিত। জরিপের ওপর ভিত্তি করে বলা যায়, দেশের দুই কোটি ২০ লাখ মানুষ আর্সেনিকমুক্ত পানি পাচ্ছে না।
অন্যদিকে বিশ্বখ্যাত স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট বলছে, বাংলাদেশের সাত কোটি ৭০ লাখ মানুষ আর্সেনিকের ঝুঁকিতে আছে।
স্বাস্থ্যঝুঁকি: কুষ্টিয়া-ভেড়ামারা সড়কের পাশে নওদা খিমিড়দিয়া গ্রামের সুরত আলীর স্ত্রী রায়মার ডান হাতের তালু ও কোমরে দগদগে ঘা। রায়মা বলেন, ‘কাটার মতো ঝিলিক পাড়ে। দিনে-রাতে যন্ত্রণা। একটি মলম ব্যবহারের পর যন্ত্রণা কিছুটা কমে। তিন বছরে অবস্থার উন্নতি হয়নি।’ সরকারি হাসপাতাল থেকে তিনি চিকিৎসা বা ওষুধ পান না বলে অভিযোগ করেন।
রায়মা আর্সেনিকোসিসের রোগী। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আর্সেনিক কর্মসূচির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাফরউল্লাহ চৌধুরী বলেন, আর্সেনিকোসিসের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে রোগী ছিল ৫৬ হাজার ৭৫৮ জন। ২০০৮ ও ২০০৯ সালে এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২৪ হাজার ৩৮৯ ও ৩৮ হাজার ৩২০ জন। এসব রোগী জেলা বা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ভিটামিন পায়। আর্সেনিকোসিসের অন্য কোনো চিকিৎসা সরকারি পর্যায়ে নেই।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মানব শক্তি উন্নয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক এ কে এম মুনীর আর্সেনিক নিয়ে গবেষণা ও নিরাপদ পানি সরবরাহ বিষয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেন, সরকার রোগীর যে হিসাব দেয়, তাতে ফাঁকি আছে। আর্সেনিকোসিস বিষক্রিয়ার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। বহু মানুষ আছে, যাদের রোগের লক্ষণ নেই, কিন্তু বহু দিন ধরে আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে। তারাও আর্সেনিকের বিষে আক্রান্ত। তিনি বলেন, ‘এদের হিসাবে নিলে বাংলাদেশের চিত্র ভয়াবহ হবে।’
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যানসার, হূদেরাগ, ডায়াবেটিস বা অন্য ক্রনিক রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি আরও বাড়ায় আর্সেনিক। নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজার উপজেলার মানুষের ওপর ১০ বছর গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকেরা এ সিদ্ধান্তে এসেছেন। ওই গবেষণার ফলাফল ২০১০ সালের ১৯ জুন ল্যানসেট-এ ছাপা হয়। ১১ হাজার ৭৪৬ মানুষের ওপর জরিপ করেন গবেষকেরা।
অস্তিত্বহীন জাতীয় কমিটি: ২০০৪ সালের আর্সেনিকবিষয়ক নীতিমালায় জাতীয় পর্যায়ে দুটি কমিটির কথা বলা আছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের কমিটি আর্সেনিক-সম্পর্কিত সব কর্মকাণ্ড ও বাস্তবায়নাধীন কর্মসূচি দেখাশোনা করবে। আট মন্ত্রণালয়ের সচিব এ কমিটির সদস্য।
আর জাতীয় পর্যায়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির কারিগরি বিষয়ে পরামর্শ ও মাঠপর্যায়ে সহায়তা দেওয়ার কথা।
বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আইনুন নিশাত বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি জানান, গত জোট সরকারের আমলে কমিটির সর্বশেষ সভা হয়। গত পাঁচ বছরে দুই কমিটির কোনো সভা হয়নি।
এই দুই কমিটির কোনো অস্তিত্ব নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ ধরনের কোনো কমিটি বর্তমানে সক্রিয় নেই।
প্রতিশ্রুতি রক্ষা হয়নি: গত সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিল, আর্সেনিক সমস্যা সমাধান করে ২০১১ সালের মধ্যে সবার জন্য নিরাপদ সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হবে। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত তিন বছরে সরকার এ বিষয়ে নতুন কোনো প্রকল্পই নেয়নি।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আর্সেনিককে প্রাধান্য দিয়ে কোনো প্রকল্প চলমান নেই। তবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গ্রামীণ পানি সরবরাহ প্রকল্পের কিছু কাজ আছে আর্সেনিক মোকাবিলায়। ২০০৭ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া প্রকল্পটি এ বছর জুনে শেষ হচ্ছে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, নিরাপদ পানি সরবরাহ ও পয়োব্যবস্থাপনার ১৩টি প্রকল্প বর্তমানে চালু আছে। এর কয়েকটি আর্সেনিককে গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
সুধীর কুমার ঘোষ জানান, বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় গ্রামীণ পানি সরবরাহ ও পয়োব্যবস্থা নিয়ে একটি নতুন প্রকল্প এ বছর জুলাই থেকে শুরু হবে। ওই প্রকল্পে আর্সেনিক মোকাবিলার কিছু কাজ আছে।
আইনুন নিশাত বলেন, ‘আর্সেনিক সমস্যা ছিল, আছে। কিন্তু দাতাদের আগ্রহ কম থাকায় এ ক্ষেত্রে কাজ প্রায় বন্ধ। সমস্যাটি এ দেশের। তাই সব পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে সরকারকে এর সমাধানে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।’

No comments

Powered by Blogger.