শহরভেদে জীবনযাত্রার ব্যয় by মাহবুব মোর্শেদ

বিশ্বব্যাপী বাজারদরের নানা বিষয় নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক পত্রিকা। তাতে চমৎকৃত হওয়ার মতো বেশ কিছু তথ্য আছে। কিন্তু চমকপ্রদ তথ্যের বাইরে আটলান্টিকের অনুসন্ধানের বিষয় শহরে শহরে জীবনযাত্রার ব্যয়ভার কীভাবে বাড়ে।


তবে বাজার নিয়ে সেসব তাত্তি্বক আলোচনায় যাওয়ার আগে কিছু তথ্য নিয়ে আলোচনা করা যাক। আটলান্টিক জানাচ্ছে, ম্যানহাটানের একজন আয়ার আয় নাকি বছরে ২ লাখ ডলার। আয়াদের বলা হয় ন্যানি। তবে এই ন্যানিরা বাচ্চা দেখাশোনার জন্য নিযুক্ত সাধারণ আয়া নন। তারা বাচ্চা দেখাশোনা তো করেনই, এমনকি চার রকমের বাহারি রান্নায়ও দক্ষ। কিন্তু ম্যানহাটানের ন্যানিরা কি শুধু তাদের গুণের জন্যই এত বেতন পান? রান্নাবান্না জানা, বাচ্চাদের প্রতি যত্নশীল ন্যানি তো পাওয়াই যায়। সবাই তো আর বছরে ২ লাখ ডলার আয় করেন না। কিন্তু ম্যানহাটানেই ন্যানিদের এই রমরমা কেন। উত্তরটা খুব সোজা। ম্যানহাটানের ধনীরা ন্যানিদের ওই বেতন দিতে সক্ষম। উন্নত ও আধুনিক যোগাযোগ পদ্ধতির কারণে বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম মোটামুটি একই। এটা হতেই পারে না যে, পেরুর রাজধানী লিমায় সোনার দাম একরকম আর যুক্তরাষ্ট্রে অন্য। সোনার দামে হেরফের হলে ব্যবসায়ীরা মুনাফা তৎক্ষণাৎ তুলে নিতে চেষ্টা করেন। আর বৈশ্বিক চাপে সোনার দাম মোটামুটি এককাতারে নেমে আসে। গাড়ি হোক কিংবা পিকাসোর ছবি। তার দাম নিউইয়র্কে যেমন, সেনঝেনেও তেমন হতে বাধ্য। বাংলাদেশেও আমরা অহরহ বিশ্ববাজারের গল্প শুনি। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়লে আমাদের এখানেও পাল্লা দিয়ে বাড়ে। গাড়ির দাম বাড়লেও একই কথা। তবে আমাদের বাজার দাম কমলে ক্রেতাদের সঙ্গে রসিকতা করে। নিজে থেকে দাম আর কমে না। এই যে বিশ্ববাজারের সমান দরে আমরা জিনিসপত্র কিনছি তবু আমাদের জীবনযাত্রার ব্যয় কীভাবে জুরিখ বা ওয়াশিংটনের একজন ক্রেতার ব্যয় থেকে কম থাকছে? জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির সূত্রটিকে বলা হয় বালাসা-স্যামুয়েলশন এফেক্ট। বেলা বালাসা আর পল স্যামুয়েলশন_ এ দুই অর্থনীতিবিদ এই তত্ত্বটি দিয়েছিলেন। আটলান্টিক বলছে, একে সহজভাবে ন্যানি এফেক্ট নামে অভিহিত করা যায়। এই তত্ত্ব বলছে, তেলের দাম, সোনার দাম, স্টকে কোম্পানির শেয়ারের দাম, কিংবা পিকাসোর ছবির দাম জায়গায় জায়গায় খুব বেশি হেরফের হয় না। কিন্তু যে জিনিস স্থানীয়ভাবে তৈরি হয়ে স্থানীয়ভাবেই বাজারজাত হয় তার ভিত্তিতেই জীবনযাত্রার ব্যয়ভার বেড়ে যায়। ঢাকায় একজন আয়ার খরচ আর নিউইয়র্কের আয়ার খরচ এক হবে না। চুল কাটা, রেস্টুরেন্টে খাবারের দাম থেকে শুরু করে স্থানীয়ভাবে যা কিছু কিনে আমরা ভোগ করি, সব মিলিয়ে এই প্রভেদটা সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জিনিসের দাম কখন বাড়তে থাকে। ওই ন্যানি এফেক্ট তত্ত্ব বলছে, এটা আবার নির্ভর করে বাইরের নিয়ামকের ওপর। স্থানীয় বাজারে উৎপাদিত কতটা পণ্য বাইরে যায় তার ওপর নির্ভর করে স্থানীয় সেবার দাম কতটা বাড়বে। যেমন ভারতে ব্যয়ভার ক্রমাগত বাড়ছে। কারণ দেশটিতে উৎপাদিত পণ্য বাইরে রফতানি হয়ে যাচ্ছে বিপুল পরিমাণে। স্থানীয়ভাবে এমন প্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছে যা লাভজনক। তারা এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দিচ্ছে যাদের ক্রয়ক্ষমতা বেশি। তারা বাজারে গিয়ে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে তুলছেন। বেশি দামকে অনুমোদন করছেন। কিন্তু ন্যানি এফেক্টের বাইরেও আছে অনেক কিছু। হয়তো বাড়ির দাম ততটা বাড়ার কথা নয়। কিন্তু বাড়ছে। এমন নগর পরিকল্পনা হচ্ছে যে, লোকজন বেশি দামে বাড়ি কিনতে বাধ্য হচ্ছে। জ্বালানি নীতির কারণেও হেরফের হচ্ছে বাজারে। ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণের দক্ষতার ওপরও নির্ভর করে অনেক কিছু। সব মিলিয়ে জীবনযাত্রায় ব্যয়ভার বেড়ে যায় বা স্থিতাবস্থায় থাকে। কিন্তু এত সব তথ্য-তত্ত্বের বোধহয় অনেক কিছুই খাটবে না ঢাকার ক্ষেত্রে। কেননা এখানে বাজার অনেক সময়ই বাজারের নিয়মে চলে না। নিয়ামক অন্য কিছু হলে তথ্য ও তত্ত্বের বদলে অন্য ব্যবস্থার খোঁজ পড়ে। কিন্তু সে ব্যবস্থাও এখানে দুর্লভ।

No comments

Powered by Blogger.