ডায়াবেটিসের বিশ্ব, বিশ্বের ডায়াবেটিস by ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
রোগ হিসেবে যার বয়স হাজার বছরের, প্রসার-প্রতিপত্তিতে গজেন্দ্রগামী, আহ্বায়ক অনেক অসংক্রামকের, মহামারি আকারে যার বিস্তার বীভৎসতায় ভাবিয়ে তুলছে গোটা বিশ্বকে, তাকে চিনতে, জানতে, নিয়ন্ত্রণে প্রতিরোধের নাকি এখনই সময়, সেই মহাসর্বনাশা শত্রুরূপী রোগটির নাম ডায়াবেটিস। যুগে যুগে, দেশে দেশে তার হরেক নাম_মধুমেহ, বহুমূত্র, ডায়াবেটিস মেলিটাস, এন্ডোক্রাইন এবং মেটাবলিক ডিজঅর্ডারস। গোটা বিশ্বে এখন প্রতি আট সেকেন্ডে একজন করে ডায়াবেটিক রোগী মারা যাচ্ছে_এই ভয়াবহ সংবাদ ভাবিয়ে তুলছে গোটা বিশ্বকেই।
নীরব ঘাতক স্বভাবের ডায়াবেটিক রোগটি এমনিতে দেহে বহু ব্যাধির (চোখ, হার্ট, কিডনিসহ মূল্যবান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যাপক ক্ষতিসাধনে সক্ষম) আহ্বায়ক। এই রোগটির অব্যাহত অভিযাত্রায় শঙ্কিত সবাইকে এটি নিয়ন্ত্রণে যথাসচেতন করে তুলতেই আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশন আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯১ সাল থেকে ১৪ নভেম্বরকে বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবস হিসেবে পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
বস্তুত, বিগত শতাব্দীর শেষার্ধে সংক্রামক ব্যাধিনিচয়ের নিয়ন্ত্রণে গোটা বিশ্বে সবাই উঠেপড়ে লাগলেও এবং গুটিবসন্ত, কলেরা, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়ার মতো মহামারি নির্মূলে সফল হতে সক্ষম হলেও মানুষের সুন্দর-সাবলীল জীবন যাপনের পথে নীরবে তার সর্ব কর্মক্ষমতা হরণকারী অসংক্রামক ব্যাধি ডায়াবেটিসের বিস্তার রোধে ও নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিসচেতনতার অনিবার্যতা এবং এর জন্য সুপরিকল্পিত সার্বজনীন উদ্যোগ গ্রহণে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণের আবশ্যকতা যথা_মনোযোগ ও চেতনার চৌহদ্দিতে আনা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান সমস্যা ও সীমাবদ্ধতাগুলোর প্রতি বিশ্বদৃষ্টি আকর্ষণ এবং সব সরকার ও জনগণের তরফে সংহত এবং সমন্বিত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে ঐকমত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস) জাতিসংঘকে প্রস্তাব গ্রহণের আহ্বান জানায়। মূলত, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির হয়ে বাংলাদেশ সরকারের আহ্বানে এবং যৌক্তিকতার প্রচারণা-প্রয়াসে ১৪ নভেম্বরকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে জাতিসংঘ ২০০৭ সালে ৬১/২২৫ নম্বর প্রস্তাব গ্রহণ করে। সেই থেকে জাতিসংঘের সব সদস্য দেশে, বিশ্ব ডায়াবেটিক ফেডারেশনের ২০০-এরও বেশি সদস্য সংগঠনে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সংস্থা কম্পানি পেশাজীবী সংগঠন ও ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবস নানা প্রাসঙ্গিক প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে উদ্যাপিত হচ্ছে। ২০০৭ সালেই জাতিসংঘের গৃহীত প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে (ব্লু) বা নীল সার্কেল লোগোটিও নির্বাচিত হয়। নীল বৃত্ত জীবন ও স্বাস্থ্যের ধনাত্মক প্রতীক, নীলাকাশ সব জাতিনিচয়কে সংঘবদ্ধ করেছে এবং এ কারণে জাতিসংঘের পতাকার রংও নীল। নীল বৃত্ত বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিক মহামারিকে নিয়ন্ত্রণ ও জয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের প্রতীক। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (২০০৯-২০১৩) মূল প্রতিপাদ্য হলো ডায়াবেটিসকে জানা এবং নিয়ন্ত্রণ। এটি (ক) ডায়াবেটিস রোগীদের শিক্ষার মাধ্যমে ক্ষমতায়নের, (খ) সরকারগুলোকে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে ও প্রতিরোধমূলক উপযুক্ত ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি মোকাবিলার, (গ) স্বাস্থ্যকর্মী পেশাজীবী সম্প্রদায়কে অধিকতর গবেষণা ও বাস্তব কৌশল উদ্ভাবনের দ্বারা উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগে যত্নশীল হতে এবং (ঘ) সব সাধারণ জনগণকে ডায়াবেটিসের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিভাবে এর থেকে দূরে থাকা বা প্রতিরোধ করা সম্ভব, সে সম্পর্কে সচেতন হওয়ার তাগিদ দেয়।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে ব্যক্তির সজ্ঞান ও আন্তরিক আগ্রহ আবশ্যক, তবে তাকে উদ্বুদ্ধকরণ, সার্বিক সহায়তা প্রদান, চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি এবং উপায়-উপকরণ সরবরাহ তথা পরিবেশ নির্মাণে অবিসংবাদিত ভূমিকা রয়েছে সরকার এবং সমাজের। সুস্থ জনশক্তি বা নাগরিকের সুস্বাস্থ্য সব রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার অন্যতম অবলম্বন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে ২০০০ সালে ভিত্তি বছরে বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা যেখানে প্রায় ১৭ কোটি (বিশ্ব জনসংখ্যার শতকরা প্রায় তিন ভাগ) ছিল, তাদের আশঙ্কা ২০৩০ সালে সে সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হয়ে যাবে। প্রাদুর্ভাবের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, উন্নত বিশ্বে টাইপ-২ অর্থাৎ ইনসুলিন নিরপেক্ষ রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোয় সবচেয়ে বেশি ১৮০%, এরপর আফ্রিকা মহাদেশে ১৬০%, তারপর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ১৫৫% হারাহারিমতে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতায় রয়েছে। বিশ্বে গড় বিস্তার যেখানে ১১৪%, আমাদের বাংলাদেশে সেই বিস্তারের হার ১৪৯%, যা যথেষ্ট আশঙ্কাজনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষামতে নগরায়ণ, ওয়েস্টার্ন ফুড আর সার্বিক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতায় এই রোগের বিস্তারকে করছে বেগবান। বিশ্ব রোগ নিরাময় কেন্দ্রের মতে, এই শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পেঁৗছার আগেই এটি মানবভাগ্যে মারাত্মক মহামারিরূপে উদ্ভাসিত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ডায়াবেটিক তথ্য নিকাশ কেন্দ্রের হিসাব মতে, খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই এই ঘাতকব্যাধি বছরে ১৩২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিসাধন করে জাতীয় অর্থনীতির। ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয়। বেশি মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়_এ ধারণা ঠিক নয়। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা এবং ওষুধ এ রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায়। গুণগত মানের দিকে নজর রেখে পরিমাণ মতো খাদ্য নিয়মিতভাবে গ্রহণ, জীবনের সব ক্ষেত্রে নিয়ম-কানুন বা শৃঙ্খলা মেনে অর্থাৎ কাজেকর্মে, আহারে-বিহারে, চলাফেরায়, এমনকি বিশ্রামে ও নিদ্রায় শৃঙ্খলা মেনে চলা দরকার। নিয়ম-শৃঙ্খলাই ডায়াবেটিস রোগীর জীবনকাঠি। ডায়াবেটিস রোগীকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণ এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মতো খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়। রোগ সম্বন্ধে ব্যাপক শিক্ষা ছাড়া ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের চিকিৎসায় আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। তবে ডায়াবেটিস বিষয়ে শিক্ষা কেবল রোগীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, একই সঙ্গে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব এবং ডাক্তার ও নার্সদের শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। রোগী যদি চিকিৎসকের সঙ্গে সহযোগিতা করে, তার উপদেশ ও নির্দেশ ভালোভাবে মেনে চলে এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা যথাযথভাবে গ্রহণ করে, তবে সুখী, কর্মঠ ও দীর্ঘজীবন লাভ করতে পারে। ডায়াবেটিস মেলাইটাস সংক্রামক রোগ না হওয়ার কারণে এখনো পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সব দেশের স্বাস্থ্য কার্যক্রমের অগ্রাধিকার তালিকায় সংক্রামক রোগের তুলনায় এর স্থান অনেক নিচে। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও সংক্রামক যোজকে তাদের আঞ্চলিক অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। সুতরাং ডায়াবেটিস স্বাস্থ্য পরিচর্যা কর্মসূচি এসব দেশে সন্তোষজনকভাবে গড়ে ওঠেনি। সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনা মূল্যে চিকিৎসা করা হয় ঠিকই, কিন্তু রোগীকে ইনসুলিন দেওয়া হয় কেবল হাসপাতালে ভর্তি হলেই, বহির্বিভাগের রোগীকে কখনোই ইনসুলিন দেওয়া হয় না। দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ অধিবাসী যে পল্লী অঞ্চলে বাস করে, সেখানে ইনসুলিন পাওয়া যায় না। ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিষ্ঠানিক কার্যক্রম ও উদ্যোগ শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নয়, গোটা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনে তথা সুনাম অর্জনে সক্ষম।
লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান। বর্তমানে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির
চিফ কো-অর্ডিনেটর
বস্তুত, বিগত শতাব্দীর শেষার্ধে সংক্রামক ব্যাধিনিচয়ের নিয়ন্ত্রণে গোটা বিশ্বে সবাই উঠেপড়ে লাগলেও এবং গুটিবসন্ত, কলেরা, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়ার মতো মহামারি নির্মূলে সফল হতে সক্ষম হলেও মানুষের সুন্দর-সাবলীল জীবন যাপনের পথে নীরবে তার সর্ব কর্মক্ষমতা হরণকারী অসংক্রামক ব্যাধি ডায়াবেটিসের বিস্তার রোধে ও নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিসচেতনতার অনিবার্যতা এবং এর জন্য সুপরিকল্পিত সার্বজনীন উদ্যোগ গ্রহণে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণের আবশ্যকতা যথা_মনোযোগ ও চেতনার চৌহদ্দিতে আনা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান সমস্যা ও সীমাবদ্ধতাগুলোর প্রতি বিশ্বদৃষ্টি আকর্ষণ এবং সব সরকার ও জনগণের তরফে সংহত এবং সমন্বিত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে ঐকমত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস) জাতিসংঘকে প্রস্তাব গ্রহণের আহ্বান জানায়। মূলত, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির হয়ে বাংলাদেশ সরকারের আহ্বানে এবং যৌক্তিকতার প্রচারণা-প্রয়াসে ১৪ নভেম্বরকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে জাতিসংঘ ২০০৭ সালে ৬১/২২৫ নম্বর প্রস্তাব গ্রহণ করে। সেই থেকে জাতিসংঘের সব সদস্য দেশে, বিশ্ব ডায়াবেটিক ফেডারেশনের ২০০-এরও বেশি সদস্য সংগঠনে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সংস্থা কম্পানি পেশাজীবী সংগঠন ও ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবস নানা প্রাসঙ্গিক প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে উদ্যাপিত হচ্ছে। ২০০৭ সালেই জাতিসংঘের গৃহীত প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে (ব্লু) বা নীল সার্কেল লোগোটিও নির্বাচিত হয়। নীল বৃত্ত জীবন ও স্বাস্থ্যের ধনাত্মক প্রতীক, নীলাকাশ সব জাতিনিচয়কে সংঘবদ্ধ করেছে এবং এ কারণে জাতিসংঘের পতাকার রংও নীল। নীল বৃত্ত বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিক মহামারিকে নিয়ন্ত্রণ ও জয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের প্রতীক। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (২০০৯-২০১৩) মূল প্রতিপাদ্য হলো ডায়াবেটিসকে জানা এবং নিয়ন্ত্রণ। এটি (ক) ডায়াবেটিস রোগীদের শিক্ষার মাধ্যমে ক্ষমতায়নের, (খ) সরকারগুলোকে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে ও প্রতিরোধমূলক উপযুক্ত ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি মোকাবিলার, (গ) স্বাস্থ্যকর্মী পেশাজীবী সম্প্রদায়কে অধিকতর গবেষণা ও বাস্তব কৌশল উদ্ভাবনের দ্বারা উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগে যত্নশীল হতে এবং (ঘ) সব সাধারণ জনগণকে ডায়াবেটিসের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিভাবে এর থেকে দূরে থাকা বা প্রতিরোধ করা সম্ভব, সে সম্পর্কে সচেতন হওয়ার তাগিদ দেয়।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে ব্যক্তির সজ্ঞান ও আন্তরিক আগ্রহ আবশ্যক, তবে তাকে উদ্বুদ্ধকরণ, সার্বিক সহায়তা প্রদান, চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি এবং উপায়-উপকরণ সরবরাহ তথা পরিবেশ নির্মাণে অবিসংবাদিত ভূমিকা রয়েছে সরকার এবং সমাজের। সুস্থ জনশক্তি বা নাগরিকের সুস্বাস্থ্য সব রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার অন্যতম অবলম্বন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে ২০০০ সালে ভিত্তি বছরে বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা যেখানে প্রায় ১৭ কোটি (বিশ্ব জনসংখ্যার শতকরা প্রায় তিন ভাগ) ছিল, তাদের আশঙ্কা ২০৩০ সালে সে সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হয়ে যাবে। প্রাদুর্ভাবের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, উন্নত বিশ্বে টাইপ-২ অর্থাৎ ইনসুলিন নিরপেক্ষ রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোয় সবচেয়ে বেশি ১৮০%, এরপর আফ্রিকা মহাদেশে ১৬০%, তারপর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ১৫৫% হারাহারিমতে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতায় রয়েছে। বিশ্বে গড় বিস্তার যেখানে ১১৪%, আমাদের বাংলাদেশে সেই বিস্তারের হার ১৪৯%, যা যথেষ্ট আশঙ্কাজনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষামতে নগরায়ণ, ওয়েস্টার্ন ফুড আর সার্বিক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতায় এই রোগের বিস্তারকে করছে বেগবান। বিশ্ব রোগ নিরাময় কেন্দ্রের মতে, এই শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পেঁৗছার আগেই এটি মানবভাগ্যে মারাত্মক মহামারিরূপে উদ্ভাসিত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ডায়াবেটিক তথ্য নিকাশ কেন্দ্রের হিসাব মতে, খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই এই ঘাতকব্যাধি বছরে ১৩২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিসাধন করে জাতীয় অর্থনীতির। ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয়। বেশি মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়_এ ধারণা ঠিক নয়। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা এবং ওষুধ এ রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায়। গুণগত মানের দিকে নজর রেখে পরিমাণ মতো খাদ্য নিয়মিতভাবে গ্রহণ, জীবনের সব ক্ষেত্রে নিয়ম-কানুন বা শৃঙ্খলা মেনে অর্থাৎ কাজেকর্মে, আহারে-বিহারে, চলাফেরায়, এমনকি বিশ্রামে ও নিদ্রায় শৃঙ্খলা মেনে চলা দরকার। নিয়ম-শৃঙ্খলাই ডায়াবেটিস রোগীর জীবনকাঠি। ডায়াবেটিস রোগীকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণ এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মতো খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়। রোগ সম্বন্ধে ব্যাপক শিক্ষা ছাড়া ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের চিকিৎসায় আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। তবে ডায়াবেটিস বিষয়ে শিক্ষা কেবল রোগীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, একই সঙ্গে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব এবং ডাক্তার ও নার্সদের শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। রোগী যদি চিকিৎসকের সঙ্গে সহযোগিতা করে, তার উপদেশ ও নির্দেশ ভালোভাবে মেনে চলে এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা যথাযথভাবে গ্রহণ করে, তবে সুখী, কর্মঠ ও দীর্ঘজীবন লাভ করতে পারে। ডায়াবেটিস মেলাইটাস সংক্রামক রোগ না হওয়ার কারণে এখনো পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সব দেশের স্বাস্থ্য কার্যক্রমের অগ্রাধিকার তালিকায় সংক্রামক রোগের তুলনায় এর স্থান অনেক নিচে। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও সংক্রামক যোজকে তাদের আঞ্চলিক অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। সুতরাং ডায়াবেটিস স্বাস্থ্য পরিচর্যা কর্মসূচি এসব দেশে সন্তোষজনকভাবে গড়ে ওঠেনি। সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনা মূল্যে চিকিৎসা করা হয় ঠিকই, কিন্তু রোগীকে ইনসুলিন দেওয়া হয় কেবল হাসপাতালে ভর্তি হলেই, বহির্বিভাগের রোগীকে কখনোই ইনসুলিন দেওয়া হয় না। দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ অধিবাসী যে পল্লী অঞ্চলে বাস করে, সেখানে ইনসুলিন পাওয়া যায় না। ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিষ্ঠানিক কার্যক্রম ও উদ্যোগ শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নয়, গোটা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনে তথা সুনাম অর্জনে সক্ষম।
লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান। বর্তমানে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির
চিফ কো-অর্ডিনেটর
No comments