গণজাগরণই নিয়ামক শক্তি-যুদ্ধাপরাধীদের বিচার by মোনায়েম সরকার
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানি ঘাতক বাহিনীর সহযোগী হয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে নেতৃত্ব দিয়েছিল তাদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ যার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি, সেই জামায়াত নেতা গোলাম আযমকে এখনও গ্রেফতার না করায় অনেকের প্রশ্ন ও হতাশা আছে। তাকে গ্রেফতার করা হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে যাদের মনে সন্দেহ-সংশয় রয়েছে, তারও কিছুটা নিরসন হতে পারে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সহজ ব্যাপার নয়। এর রয়েছে জাতীয়-আন্তর্জাতিক এবং সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ও তার দেশীয় সহচরদের যেমন বিদেশি সমর্থক আমেরিকা ও চীনের মতো শক্তিশালী দেশ ও সরকার ছিল, এখনও তেমনি ঘাতক-দালালদের রক্ষা করার মতো আন্তর্জাতিক শক্তি রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে মধ্যপ্রাচ্যের মনোভাব কী সেটা না জেনে-বুঝে সরকার হুট করে কিছু করতে পারবে না। তবে সরকার যদি দক্ষতার সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে পারে, তাহলে একাত্তরে যেমন কারও বিরোধিতা আমাদের বিজয় ঠেকাতে পারেনি, তেমনি এখনও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজও আটকাতে পারবে না। শত্রুকে কখনোই দুর্বল ভাবতে নেই। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজে হাত দেওয়ার আগে সরকার সবদিক ভেবেচিন্তে দেখেছে কি-না সে প্রশ্ন কারও কারও মনে আছে। সরকার কি যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শেষ করার লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছে, নাকি এটাকেও রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে?
সরকার কি এই মেয়াদকালের মধ্যেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শেষ করতে পারবে, নাকি এটা কিছুদূর এগিয়ে নিয়ে তারপর নির্বাচনের আগে দেশের মানুষের কাছে বলা হবে যে, আমরা বিচার কাজ ঠিকই শুরু করেছি কিন্তু এটা শেষ করার জন্য আমাদের আরও সময় এবং সুযোগ প্রয়োজন। কাজেই আরেকবার নির্বাচিত করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শেষ করার সুযোগ দিন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে বিএনপি শুরুর দিকে কিছুটা কৌশলের আশ্রয় নিলেও সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রকাশ্যেই নিজামী-মুজাহিদদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এবং কার্যত তিনি বিচারেরও বিরোধিতা করেছেন। সরকার ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এটা বলা হয়ে থাকে যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ বানচাল করাই বিএনপি তথা খালেদা জিয়ার আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। প্রথমে মানুষ এটা সেভাবে বিশ্বাস না করলেও এখন বিভিন্ন সমাবেশে বেগম জিয়ার প্রকাশ্য বক্তব্যের পর মানুষের কাছে তার অবস্থান ও মনোভাব স্পষ্ট হয়েছে। বিএনপি এবং জামায়াত কেউ কাউকে ছেড়ে যাবে না এবং বিএনপি এখন মূলত জামায়াতনির্ভর দলে পরিণত হচ্ছে। সিলেট, বগুড়া ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সমাবেশে জামায়াতের শক্তি প্রদর্শন এটাই প্রমাণ করে। বিএনপিতে যারা নিজেদের 'মুক্তিযোদ্ধা' বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বলে দাবি করেন, তারা কি বেগম জিয়ার এই দাবির সঙ্গে একমত যে, নিজামী-মুজাহিদরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী নয়? গোলাম আযম-নিজামী-মুজাহিদরা একাত্তরে কোন্ পক্ষ অবলম্বন করে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন করে কাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল? সেটা বেগম জিয়া ভুলে যেতে পারেন, কিন্তু স্বজনহারা কোটি কোটি বাঙালির পক্ষে কি তা ভুলে যাওয়া বা ভুলে থাকা সম্ভব? একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় প্রবলভাবে সোচ্চার হওয়ার পেছনে খালেদা জিয়ার একটি একান্ত ব্যক্তিগত কারণও কাজ করে থাকতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মেজর জিয়া তাকে পাকিস্তানের আশ্রয় ছেড়ে মুজিবনগরে চলে আসতে একাধিকবার লোক পাঠিয়েছিলেন। খালেদা জিয়াকে নিরাপদে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে নিয়ে আসার জন্য তিনি কয়েকজন তরুণ প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাকেও তার কাছে পাঠিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া ঢাকা ছাড়তে রাজি হননি।
যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়ে বিএনপি কেবল সরকারের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে বলে মনে করলে ভুল করা হবে। বিএনপি বস্তুত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকেই চ্যালেঞ্জ করেছে। তারা বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চায়। কারণ, তাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদেরও বাঁচানো সম্ভব হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এবং সরকার কি বিএনপির এই চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করবে, নাকি এটাকে মামুলি বিষয় বলে উপেক্ষা করবে? আমাদের মনে হয়, বিএনপির এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না করার কোনো বিকল্প বর্তমান সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির মধ্যে নেই। সরকারের মধ্যে যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে কোনো দ্বিধা বা দোদুল্যমানতা থাকে, তাহলে তা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে হবে এবং একই সঙ্গে সরকার যে দ্বিধা ও দোদুল্যমানতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে, সেটা দেশের মানুষের সামনে স্পষ্ট করে তুলতে হবে।
সরকারকে কালবিলম্ব না করে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পদক্ষেপগুলো হলো_ ক. যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান নেতা গোলাম আযমকে দ্রুত গ্রেফতার করতে হবে; খ. যাদের ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের বিচার কাজ দ্রুত শুরু করতে হবে। অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবীরা কৌশলে কালক্ষেপণ করতে চাইবেন। রাষ্ট্রপক্ষের উচিত হবে না তাদের ফাঁদে পা দেওয়া; গ. বিচার সংক্রান্ত যে কোনো দুর্বলতা দ্রুত দূর করতে হবে। প্রসিকিউশনের দায়িত্ব যাদের দেওয়া হয়েছে তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। খোঁড়া ঘোড়া দিয়ে রেসে জেতা যায় না_ এটা মনে রাখতে হবে। তাই আইনি লড়াইয়ে যাদের ওপর নির্ভর করা যায়, সে রকম অভিজ্ঞ আইনজীবীদের এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কারও ব্যক্তিগত রাগ-অনুরাগের বিষয় যেন কোনোভাবেই বৃহত্তর স্বার্থের ঊধর্ে্ব স্থান না পায়; ঘ. আইনি লড়াই পরিচালনার জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেওয়ার পাশাপাশি বিচারের পক্ষে রাজনৈতিক উদ্যোগটাও দৃশ্যমান করে তুলতে হবে। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভূমিকা মানুষের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। আওয়ামী লীগকে দেশব্যাপী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে যেমন দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাবেশ ঘটাতে হবে, তেমনি মহাজোটের শরিক রাজনৈতিক দলগুলোকেও এ বিষয়ে সক্রিয় হতে হবে; ঙ. খালেদা জিয়া যখন ঘাতক-দালালদের পক্ষে কথা বলছেন তখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি নীরবতা পালন করছে কেন? ঘাতক-দালাল এবং তাদের রক্ষাকারীদের বিরুদ্ধে কেন দেশবাসীর প্রবল গণরোষ সৃষ্টি হচ্ছে না? মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কী ভূমিকা পালন করছে? সব রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে সক্রিয় হলে গণবিরোধী অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের কালপর্বে দেশের মানুষের মধ্যে যে অভূতপূর্ব ঐক্য ও জাগরণ তৈরি হয়েছিল; ছাত্র-শিক্ষক-কৃষক-শ্রমিক-নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের দুর্জয় ঐক্যের সামনে দেশি-বিদেশি কোনো ষড়যন্ত্রই মাথা তুলতে পারেনি। সম্মিলিত গণশক্তির উত্থান যে কোনো চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার মোক্ষম অস্ত্র। আমরা চলি্লশ বছর যাবৎ ২৬ মার্চ, ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর, ১৪ ডিসেম্বর ও ১৬ ডিসেম্বর পালন করছি। আজ শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে ঘাতকদের আঘাত করার সময় এসেছে। জনতার শক্তির কাছে অন্য সবকিছু পরাভব মানে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নেও আজ কেবল সরকারের দিকে চেয়ে না থেকে সবাই যদি নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সোচ্চার হয়ে উঠি, তাহলে সরকারও দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারবে সহজেই। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন যেমন সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, প্রজন্ম একাত্তরসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও গোলাম আযমের গ্রেফতার দাবিতে রাজধানীসহ সারাদেশে যদি লাখ লাখ মানুষ রাজপথে নেমে আসে, তাহলে সেই প্রবল জনস্রোত রোখার ক্ষমতা কারও থাকবে না। একাত্তরের মতো জাগরণ তৈরির ক্ষমতা আমাদের আছে কি-না সেটাই হলো বড় প্রশ্ন।
মোনায়েম সরকার :মহাপরিচালক বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর
ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ
সরকার কি এই মেয়াদকালের মধ্যেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শেষ করতে পারবে, নাকি এটা কিছুদূর এগিয়ে নিয়ে তারপর নির্বাচনের আগে দেশের মানুষের কাছে বলা হবে যে, আমরা বিচার কাজ ঠিকই শুরু করেছি কিন্তু এটা শেষ করার জন্য আমাদের আরও সময় এবং সুযোগ প্রয়োজন। কাজেই আরেকবার নির্বাচিত করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শেষ করার সুযোগ দিন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে বিএনপি শুরুর দিকে কিছুটা কৌশলের আশ্রয় নিলেও সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রকাশ্যেই নিজামী-মুজাহিদদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এবং কার্যত তিনি বিচারেরও বিরোধিতা করেছেন। সরকার ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এটা বলা হয়ে থাকে যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ বানচাল করাই বিএনপি তথা খালেদা জিয়ার আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। প্রথমে মানুষ এটা সেভাবে বিশ্বাস না করলেও এখন বিভিন্ন সমাবেশে বেগম জিয়ার প্রকাশ্য বক্তব্যের পর মানুষের কাছে তার অবস্থান ও মনোভাব স্পষ্ট হয়েছে। বিএনপি এবং জামায়াত কেউ কাউকে ছেড়ে যাবে না এবং বিএনপি এখন মূলত জামায়াতনির্ভর দলে পরিণত হচ্ছে। সিলেট, বগুড়া ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সমাবেশে জামায়াতের শক্তি প্রদর্শন এটাই প্রমাণ করে। বিএনপিতে যারা নিজেদের 'মুক্তিযোদ্ধা' বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বলে দাবি করেন, তারা কি বেগম জিয়ার এই দাবির সঙ্গে একমত যে, নিজামী-মুজাহিদরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী নয়? গোলাম আযম-নিজামী-মুজাহিদরা একাত্তরে কোন্ পক্ষ অবলম্বন করে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন করে কাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল? সেটা বেগম জিয়া ভুলে যেতে পারেন, কিন্তু স্বজনহারা কোটি কোটি বাঙালির পক্ষে কি তা ভুলে যাওয়া বা ভুলে থাকা সম্ভব? একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় প্রবলভাবে সোচ্চার হওয়ার পেছনে খালেদা জিয়ার একটি একান্ত ব্যক্তিগত কারণও কাজ করে থাকতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মেজর জিয়া তাকে পাকিস্তানের আশ্রয় ছেড়ে মুজিবনগরে চলে আসতে একাধিকবার লোক পাঠিয়েছিলেন। খালেদা জিয়াকে নিরাপদে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে নিয়ে আসার জন্য তিনি কয়েকজন তরুণ প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাকেও তার কাছে পাঠিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া ঢাকা ছাড়তে রাজি হননি।
যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়ে বিএনপি কেবল সরকারের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে বলে মনে করলে ভুল করা হবে। বিএনপি বস্তুত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকেই চ্যালেঞ্জ করেছে। তারা বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চায়। কারণ, তাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদেরও বাঁচানো সম্ভব হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এবং সরকার কি বিএনপির এই চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করবে, নাকি এটাকে মামুলি বিষয় বলে উপেক্ষা করবে? আমাদের মনে হয়, বিএনপির এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না করার কোনো বিকল্প বর্তমান সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির মধ্যে নেই। সরকারের মধ্যে যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে কোনো দ্বিধা বা দোদুল্যমানতা থাকে, তাহলে তা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে হবে এবং একই সঙ্গে সরকার যে দ্বিধা ও দোদুল্যমানতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে, সেটা দেশের মানুষের সামনে স্পষ্ট করে তুলতে হবে।
সরকারকে কালবিলম্ব না করে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পদক্ষেপগুলো হলো_ ক. যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান নেতা গোলাম আযমকে দ্রুত গ্রেফতার করতে হবে; খ. যাদের ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের বিচার কাজ দ্রুত শুরু করতে হবে। অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবীরা কৌশলে কালক্ষেপণ করতে চাইবেন। রাষ্ট্রপক্ষের উচিত হবে না তাদের ফাঁদে পা দেওয়া; গ. বিচার সংক্রান্ত যে কোনো দুর্বলতা দ্রুত দূর করতে হবে। প্রসিকিউশনের দায়িত্ব যাদের দেওয়া হয়েছে তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। খোঁড়া ঘোড়া দিয়ে রেসে জেতা যায় না_ এটা মনে রাখতে হবে। তাই আইনি লড়াইয়ে যাদের ওপর নির্ভর করা যায়, সে রকম অভিজ্ঞ আইনজীবীদের এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কারও ব্যক্তিগত রাগ-অনুরাগের বিষয় যেন কোনোভাবেই বৃহত্তর স্বার্থের ঊধর্ে্ব স্থান না পায়; ঘ. আইনি লড়াই পরিচালনার জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেওয়ার পাশাপাশি বিচারের পক্ষে রাজনৈতিক উদ্যোগটাও দৃশ্যমান করে তুলতে হবে। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভূমিকা মানুষের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। আওয়ামী লীগকে দেশব্যাপী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে যেমন দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাবেশ ঘটাতে হবে, তেমনি মহাজোটের শরিক রাজনৈতিক দলগুলোকেও এ বিষয়ে সক্রিয় হতে হবে; ঙ. খালেদা জিয়া যখন ঘাতক-দালালদের পক্ষে কথা বলছেন তখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি নীরবতা পালন করছে কেন? ঘাতক-দালাল এবং তাদের রক্ষাকারীদের বিরুদ্ধে কেন দেশবাসীর প্রবল গণরোষ সৃষ্টি হচ্ছে না? মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কী ভূমিকা পালন করছে? সব রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে সক্রিয় হলে গণবিরোধী অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের কালপর্বে দেশের মানুষের মধ্যে যে অভূতপূর্ব ঐক্য ও জাগরণ তৈরি হয়েছিল; ছাত্র-শিক্ষক-কৃষক-শ্রমিক-নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের দুর্জয় ঐক্যের সামনে দেশি-বিদেশি কোনো ষড়যন্ত্রই মাথা তুলতে পারেনি। সম্মিলিত গণশক্তির উত্থান যে কোনো চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার মোক্ষম অস্ত্র। আমরা চলি্লশ বছর যাবৎ ২৬ মার্চ, ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর, ১৪ ডিসেম্বর ও ১৬ ডিসেম্বর পালন করছি। আজ শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে ঘাতকদের আঘাত করার সময় এসেছে। জনতার শক্তির কাছে অন্য সবকিছু পরাভব মানে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নেও আজ কেবল সরকারের দিকে চেয়ে না থেকে সবাই যদি নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সোচ্চার হয়ে উঠি, তাহলে সরকারও দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারবে সহজেই। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন যেমন সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, প্রজন্ম একাত্তরসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও গোলাম আযমের গ্রেফতার দাবিতে রাজধানীসহ সারাদেশে যদি লাখ লাখ মানুষ রাজপথে নেমে আসে, তাহলে সেই প্রবল জনস্রোত রোখার ক্ষমতা কারও থাকবে না। একাত্তরের মতো জাগরণ তৈরির ক্ষমতা আমাদের আছে কি-না সেটাই হলো বড় প্রশ্ন।
মোনায়েম সরকার :মহাপরিচালক বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর
ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ
No comments