জেগে থাকবেন আমাদের অন্তরে by মতলুব আলী
বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনে নেমে এসেছে স্বজন হারানো শোকের কালো ছায়া। বাংলাদেশের শিল্প-আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ স্বনামধন্য ভাষাসংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক সংগঠক চিত্রশিল্পী ইমদাদ হোসেন আর নেই।গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস, ঢাকা থেকে পাঁচ বছরের শিক্ষা কোর্স সম্পন্ন করে ১৯৫৪ সালে চারুকলার চূড়ান্ত পরীক্ষায় সর্বমোট ১২ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়ে তৎকালীন শিল্পাঙ্গনের শিক্ষিত শিল্পীশ্রেণীতে নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেন। শিল্পী ইমদাদ হোসেন ছিলেন তাদেরই একজন।
পার্টিশনের অব্যবহিত পর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে (অপশন দিয়ে) কলকাতা থেকে পূর্ববঙ্গে আসা কয়েকজন শিল্পী-শিক্ষকের সক্রিয় ভূমিকায় এই মাটিতে মহাবিদ্যালয় পর্যায়ের উচ্চতর শিল্পশিক্ষার সূচনা ঘটেছিল। সদ্য প্রতিষ্ঠিত চারুকলা শিক্ষায়তনের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল '৪৮ সালের ১১ নভেম্বর, যেখানে তখন দুটি মাত্র বিভাগ চালু করা হয়েছিল_ একটির নাম ছিল 'ফাইন আর্ট ডিপার্টমেন্ট', আরেকটি হলো 'কমার্শিয়াল আর্ট ডিপার্টমেন্ট'। তৎকালে মুখে মুখে প্রচারিত আর্ট কলেজ নামে সুবিদিত ওই শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় বছরটিতে ইমদাদ হোসেন ভর্তি হয়েছিলেন এবং তার (বিভাগের) একমাত্র সহপাঠী জুনাবুল ইসলামের সঙ্গে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে চারুকলার শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করেছিলেন। বাংলাদেশের চারুকলা অঙ্গনের সঙ্গে সেই যে তার সম্পৃক্ততা, তার ব্যত্যয় ঘটেনি কখনও_ গতকাল সকালে যখন তিনি হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে চিরদিনের জন্য দু'চোখ বুজলেন (১৩ নভেম্বর, ২০১১), তখনও তিনি আমাদেরই একজন; কালও তিনি চোখের সামনে ছিলেন, বার্ধক্যজনিত অসুস্থাবস্থায় শয্যাশায়ী ছিলেন যদিও দীর্ঘদিন, তবু তো আমাদের মাঝেই ছিলেন; কিন্তু আজ স্মৃতির মণিকোঠায় ঠাঁই নিলেন যখন, তিনি নেই বলা গেল না_ কারণ আমাদের চেতনা ও উপলব্ধি বারংবার জাগ্রত করে দিয়ে গেল আমাদের তার মহিমাময় বাণী উচ্চারণে : 'তিনি আছেন_ চিরদিন আমাদের, মরমে প্রাণের মানুষ হয়ে তিনি থাকবেন।'
১৯২৬-এর ২১ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেছিলেন ইমদাদ হোসেন, বাবা মজিদ বক্স ওরফে ধনু মিয়া এবং মা সাবেদুন নেসার ঘরে। ছবি আঁকা জাতীয় কাজ এবং বিভিন্ন রকমের কারিগরিতায় তিনি ছোটবেলা থেকেই সিদ্ধহস্ত ছিলেন। শিল্পের প্রতি আকর্ষণেরও দিকটা তিনি পেয়েছিলেন পারিবারিক পরিবেশে। আর নবীন বয়সেই হাতের কাজ করে আয়-রোজগারের দিকে ঝুঁকতে হয়েছিল তাকে, কাশিপুর গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরিতে কাজও নিয়েছিলেন ১৮ বছর বয়সে। সমাজসেবামূলক কাজ ও শিক্ষা প্রসারে ভূমিকা পালন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সবসময় অগ্রণী ছিলেন কিশোর বয়স থেকেই। স্বেচ্ছাসেবী যুবকদের নিয়ে সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন, আনসার বাহিনী ছিল একধরনের_ তিনি ছিলেন তার কমান্ডার। এরপর শুরু করেন চারুকলার শিক্ষার্থী জীবন_ সতীর্থ হিসেবে যাদের পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন বশিরুল্লাহ (মুর্তজা বশির), কাইয়ুম চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, রশিদ চৌধুরী, জুনাবুল ইসলাম ও অন্য অনেকে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন ইমদাদ হোসেন। পাশাপাশি অন্যান্যের সঙ্গে মিলে অগ্রণী শিল্পী সংঘ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলেন_ সেই সংগঠনের অন্যতম গায়কও ছিলেন তিনি।
১৯৫৪ সালে চারুকলার শিক্ষা সমাপনী বছরেই সাংসারিক জীবনে পদার্পণ করেন ইমদাদ হোসেন। কর্মজীবনে সম্পৃক্ত ছিলেন ইউসিস, ইপস্কি এবং ডিজাইন সেন্টারসহ ইউএসএইড, সুইডিশ-পাক ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার প্রজেক্ট এবং তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে (চিফ ডিজাইনার হিসেবে, স্বাধীনতার পরও তিনি বিটিভিতে নিয়োজিত ছিলেন)। ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশের শিল্পীদের নিয়ে একটি সংগঠন গঠিত হয়েছিল_ সংগঠনের সভাপতি ছিলেন পটুয়া কামরুল হাসান এবং সাধারণ সম্পাদক শিল্পী ইমদাদ হোসেন। শিল্পী ইমদাদ হোসেনের চলে যাওয়া যেন একটি ইতিহাসের চলে যাওয়া। একজন চিরউদ্যমী, সৎসাহসী, গণমানুষের বন্ধু, যুক্তিবাদী, মানবপ্রেমী ও মেধাবী সৃজনশীল চেতনাবোধের স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে শিল্পী ইমদাদ হোসেন ছিলেন একজন বড়মাপের মানবতা ও প্রগতিবাদী দেশপ্রেমিক মানুষ। শিল্প ও সাহিত্যপ্রেমিক ছিলেন যেমন_ দেশের মাটি ও মানুষকেও ভালোবাসতেন অকৃত্রিম আত্মত্যাগী আদর্শিক নিষ্ঠায়। তিনি চলে গেলেও তাকে আমরা যেতে দেব না। তার প্রিয় শহীদ মিনারের পটভূমির লাল সূর্যটির মতো তিনি জ্বলজ্বলে সূর্য হয়ে জেগে থাকবেন বাংলার পথে-প্রান্তরে।
মতলুব আলী :ডিন, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯২৬-এর ২১ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেছিলেন ইমদাদ হোসেন, বাবা মজিদ বক্স ওরফে ধনু মিয়া এবং মা সাবেদুন নেসার ঘরে। ছবি আঁকা জাতীয় কাজ এবং বিভিন্ন রকমের কারিগরিতায় তিনি ছোটবেলা থেকেই সিদ্ধহস্ত ছিলেন। শিল্পের প্রতি আকর্ষণেরও দিকটা তিনি পেয়েছিলেন পারিবারিক পরিবেশে। আর নবীন বয়সেই হাতের কাজ করে আয়-রোজগারের দিকে ঝুঁকতে হয়েছিল তাকে, কাশিপুর গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরিতে কাজও নিয়েছিলেন ১৮ বছর বয়সে। সমাজসেবামূলক কাজ ও শিক্ষা প্রসারে ভূমিকা পালন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সবসময় অগ্রণী ছিলেন কিশোর বয়স থেকেই। স্বেচ্ছাসেবী যুবকদের নিয়ে সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন, আনসার বাহিনী ছিল একধরনের_ তিনি ছিলেন তার কমান্ডার। এরপর শুরু করেন চারুকলার শিক্ষার্থী জীবন_ সতীর্থ হিসেবে যাদের পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন বশিরুল্লাহ (মুর্তজা বশির), কাইয়ুম চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, রশিদ চৌধুরী, জুনাবুল ইসলাম ও অন্য অনেকে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন ইমদাদ হোসেন। পাশাপাশি অন্যান্যের সঙ্গে মিলে অগ্রণী শিল্পী সংঘ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলেন_ সেই সংগঠনের অন্যতম গায়কও ছিলেন তিনি।
১৯৫৪ সালে চারুকলার শিক্ষা সমাপনী বছরেই সাংসারিক জীবনে পদার্পণ করেন ইমদাদ হোসেন। কর্মজীবনে সম্পৃক্ত ছিলেন ইউসিস, ইপস্কি এবং ডিজাইন সেন্টারসহ ইউএসএইড, সুইডিশ-পাক ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার প্রজেক্ট এবং তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে (চিফ ডিজাইনার হিসেবে, স্বাধীনতার পরও তিনি বিটিভিতে নিয়োজিত ছিলেন)। ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশের শিল্পীদের নিয়ে একটি সংগঠন গঠিত হয়েছিল_ সংগঠনের সভাপতি ছিলেন পটুয়া কামরুল হাসান এবং সাধারণ সম্পাদক শিল্পী ইমদাদ হোসেন। শিল্পী ইমদাদ হোসেনের চলে যাওয়া যেন একটি ইতিহাসের চলে যাওয়া। একজন চিরউদ্যমী, সৎসাহসী, গণমানুষের বন্ধু, যুক্তিবাদী, মানবপ্রেমী ও মেধাবী সৃজনশীল চেতনাবোধের স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে শিল্পী ইমদাদ হোসেন ছিলেন একজন বড়মাপের মানবতা ও প্রগতিবাদী দেশপ্রেমিক মানুষ। শিল্প ও সাহিত্যপ্রেমিক ছিলেন যেমন_ দেশের মাটি ও মানুষকেও ভালোবাসতেন অকৃত্রিম আত্মত্যাগী আদর্শিক নিষ্ঠায়। তিনি চলে গেলেও তাকে আমরা যেতে দেব না। তার প্রিয় শহীদ মিনারের পটভূমির লাল সূর্যটির মতো তিনি জ্বলজ্বলে সূর্য হয়ে জেগে থাকবেন বাংলার পথে-প্রান্তরে।
মতলুব আলী :ডিন, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments