আলোকিত মানুষ তৈরির নেতা by হাশেম খান

বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের তথা চিত্রকলা ভাস্কর্য বিষয়ে প্রথমদিকে সেই চলি্লশের দশকের শেষ ভাগে (১৯৪৮) যেসব তরুণ শিল্পকলা চর্চায় এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁরা ছিলেন একেকজন শিল্প আন্দোলনের যোদ্ধা। জয়নুল, কামরুল, শফিউদ্দিন তাঁরাও বিরাট এক অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার জন্য ১৯৪৮ সালে যে শিল্প আন্দোলন শুরু করেছিলেন বর্তমান চারু ও কারুকলা অনুষদের সেই সময় নাম ছিল গভর্নমেন্ট আর্ট ইনস্টিটিউট। সেখানে ছাত্র পাওয়া আজকের মতো এত স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না।


৬০ বছর পর ভাবতে অবাক লাগে, শুরুতে যাঁরা ছাত্র হয়েছিলেন তাঁরা নিজেদের জীবনযাপন সম্পর্কে কতটা সচেতন ও উদাসীন ছিলেন! আসলে তাঁদের সামনে কোনো ভবিষ্যৎ ছিল না। পাঁচ বছর লেখাপড়া করে বাঁচার কোনো পথ ছিল না। ছবির বাজার ছিল না তখন। শিল্পীদের জন্য কোনো চাকরি ছিল না। জীবনধারণের কোনো উপায় ছিল না। এমন কি যেসব শিক্ষক ছিলেন, তাঁদের বেতনও ছিল এতই কম যে তাঁদের চলা কঠিন ছিল। বাইরে থেকে কোনো রোজগারের পথও ছিল না। প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন ১২ জন। আমিনুল ইসলামও তাঁদের মধ্যে ছিলেন। দ্বিতীয় বর্ষে এসে ভর্তি হন ১৩ জন। তার মধ্যে একজন ছিলেন ইমদাদ হোসেন। আজকে শিল্পকলার ইতিহাসের ক্রমবিকাশ যদি পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব, প্রথম চার-পাঁচ বছর যাঁরা ভর্তি হয়েছিলেন, তাঁরা সত্যি সত্যি ছিলেন লড়াকু শিল্পী। তাঁরা ছবি আঁকা শিখেছেন শিক্ষকদের কাছ থেকে; এই সমাজকে বুঝিয়েছেন চিত্রকলার প্রয়োজন আছে। সুস্থ এবং রুচিশীল জীবনযাপনে, এমনকি বিভিন্ন অর্থকরী পেশায় শিল্পকলা যে কতখানি প্রয়োজন, তা তঁাঁরা সমাজকে ওই সময় বুঝিয়েছেন বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে। এসব আন্দোলন চারুকলার ছাত্র-শিক্ষকরা শুরু করলেও তাঁরা আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন সে সময়ের লেখক-শিক্ষক-রাজনীতিবিদদের। তাই শিল্পকলা আন্দোলনের শুরুটা এতই শক্তিশালী ও উজ্জ্বল ছিল যে আজকে ৬০ বছর পর যে অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও যে সমৃদ্ধি আমরা দেখছি, তার পেছনে এই চারুকলার প্রথমদিকের শিক্ষক এবং ছাত্রদের ভূমিকাই ছিল বেশি শক্তিশালী। আর এই আন্দোলনগুলোর নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন নিষ্ঠাবান, তাঁদের মধ্যে ভাষাসৈনিক ইমদাদ হোসেন প্রধানতম একজন। তাঁর অন্য সঙ্গীরা হলেন আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, কাইয়ুম চৌধুরী, দেবদাশ চক্রবর্তী, আবদুর রাজ্জাক, রশীদ চৌধুরী প্রমুখ। তাঁরা নিজেরা যেমন শিল্পী হিসেবে নিজেদের তৈরি করেছেন সেই সঙ্গে তাঁদের পরিবার, সমাজ ও দেশের মানুষকেও বুঝিয়েছেন শিল্পকলার প্রয়োজন কত বেশি। ব্যবহারিক জীবনেও যে শিল্পকলা গুরুত্বপূর্ণ তা কখনো কায়িক পরিশ্রম দিয়ে, কখনো অর্থমূল্য না নিয়ে পত্রিকার জন্য শিল্পী প্রয়োজন, সিনেমার জন্য, বিজ্ঞাপনের জন্য প্রয়োজন, সরকারের প্রচার কাজে শিল্পীদের প্রয়োজন, তৈজসপত্রের ডিজাইন থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন তৈরি পর্যন্ত শিল্পীদের প্রয়োজন। আমাদের শিল্পমেলা, জাতীয় মেলায় আমাদের শিল্পীদের প্রয়োজন। একই সঙ্গে বুঝিয়েছেন, আমাদের লোকশিল্পের জন্যও প্রয়োজন, তাও বুঝিয়েছেন। তাই চারুকলায় আমরা দেখছি নিজেদের আঁকা শিল্পকর্মের প্রদর্শনী হচ্ছে, পাশাপাশি লোকশিল্পের মেলা-প্রদর্শনী হচ্ছে। তাঁদের শহরে নিয়ে এসেছেন ৪০ ও ৫০ দশকের শিল্পীরা। চিন্তা-চেতনায় সবসময় সাহস জুগিয়েছেন জয়নুল-কামরুল প্রমুখ। উল্লেখ্য, শিল্পীরা (শিক্ষক) প্রগতিশীল আমিনুল ইসলামও অসাম্প্রদায়িক তেমনি ইমদাদ হোসেনের মতো প্রথমদিকের ছাত্রশিল্পীরা তৈরি হয়েছেন দেশপ্রেমিক, প্রগতিশীল সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক হিসেবে। তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ দেখি ১৯৭১ সালে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই ভয়ে পড়ে হোক, লোভে পড়ে হোক, কিংবা অসৎ মানসিকতায় হোক স্বাধীনতাবিরোধী হয়েছিল। আলবদর-রাজাকারদের খাতায় নাম লিখিয়েছিল। কিন্তু একজন শিল্পী কিংবা একজন ছাত্রশিল্পীকেও স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে দেখতে পাইনি। কারণ আমাদের শুরুটাই ছিল প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মানসিকতা থেকে।
বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে ইমদাদ হোসেন ছিলেন চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে তাঁরই নেতৃত্বে ছাত্র-শিক্ষক সবাই অংশ নিয়েছিলেন। সেই আলোকচিত্র এখনো সাক্ষ্য দেয়, আর্ট কলেজের ছাত্ররা মিছিল করছেন। তার পুরোভাগে আছেন ইমদাদ হোসেন। বরকতের বুকে যখন গুলি লাগে তাঁর কাছাকাছি ছিলেন মুর্তজা বশীর। বরকতের রক্তাক্ত জামা তুলে নিয়ে এসে ছাত্র আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। সেই সময় মুর্তজা বশীর, বিজন চৌধুরী অনেক ড্রয়িং ও স্কেচ করেছিলেন। এই যে ভাষা আন্দোলনে শিল্পীরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তা অব্যাহত থাকে আমরণ। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন এবং পরবর্তীকালে '৫০-এর দশক, '৬০-এর দশক এবং মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত শিল্পী ইমদাদ হোসেন শুধু শিল্পকলা নিয়েই নেতৃত্ব দিয়েছেন তা নয়, প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনেও এই অকুতোভয় সাহসী মানুষটি সবসময় ছিলেন সক্রিয় এবং নেতৃত্বদানকারী। সরকারি চাকরি করা সত্ত্বেও তিনি চাকরি হারানো কিংবা জেলের ভয়ে কখনো থেমে থাকেননি। ফলে তাঁকে সারা জীবনই অনেকবার চাকরি বদল করতে হয়েছে। আজকে যে নবান্ন উৎসব হয়, পহেলা বৈশাখের যে উৎসব হয় এবং এই উৎসবগুলোর শুরুর নেতৃত্বের অন্যতম ইমদাদ হোসেন। আমাদের দেশে যে শিল্পমেলাগুলো বিভিন্ন সময় হয়েছে স্টল-গেট ইত্যাদি মাধ্যমে রুচিশীল প্রদর্শনী করার ক্ষেত্রে তরুণদের নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। টেলিভিশনের চাকরির ক্ষেত্রে তাঁর পেশাগত দায়িত্বে প্রতিটি সেট নির্মাণের ক্ষেত্রে রুচিশীল কাজে নিয়োজিত ছিলেন এবং তরুণ শিল্পী সমাজকেও তৈরি করে গেছেন। বিসিকে চাকরিকালীন পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমাদের গ্রামীণ কুটির ও লোকশিল্পশিল্পীদের সম্মানিত করা, লোকশিল্পকে উজ্জীবিত ও উৎকর্ষ সাধনে বিশাল ভূমিকা রেখেছেন ইমদাদ হোসেন। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বিসিকের যে মেলাগুলো হয় শুরুতে পরিকল্পনা ও মেলা অনুষ্ঠানে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।
আরেকটি অবদানের কথা জাতি মনে রাখবে। শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে শিল্পীদের ছবি আঁকার যে আন্দোলন, তাতেও নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। শহীদ মিনারে প্রদর্শনী মিছিল ('৬৬, '৬৭, '৬৯) আমরা আল্পনা আঁকতাম সেই কাজে তিনি ছিলেন নেতৃত্বদানকারীদের অন্যতম এবং পরিকল্পনাকারী। স্বাধীনতার পর পর শহীদ মিনার যখন আবার তৈরি হলো, তখন শহীদ মিনারকে বৈপ্লবিক সাজে সাজানোর পরিকল্পনায় তাঁরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
বিশেষ করে শহীদ মিনারের পেছনে যে লাল সূর্য পাকিস্তান আমলে তা ছিল না। আমাদের স্বাধীনতার পেছনে যে রক্তদান তাও তিনি বিজয়ের শক্তিকে ২১ ফেব্রুয়ারিতে নিয়ে এসেছেন। এই সূর্যের পরিকল্পনার পেছনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে ইমদাদ হোসেনের ভূমিকা ছিল প্রধান। সঙ্গে আমরা কয়েকজন ছিলাম, যেমন শাহাদাৎ চৌধুরী, নিতুন কুণ্ডু, মুস্তাফা মনোয়ার প্রমুখ। আমি নিজেও ছিলাম।
এসব ছাড়া ইমদাদ হোসেন তাঁর গ্রাম রোহিতপুর অঞ্চলে একজন পরোপকারী সমাজসেবী ও সবার কাছে শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব। গ্রাম উন্নয়নে ও শিক্ষা সম্প্রসারণে সারাজীবন অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ওই অঞ্চলে পরিবেশ সংরক্ষণে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। পাখির অভয়ারণ্য তিনি তৈরি করেছেন। যে কারণে পাখির প্রতি একটি গুলতিও কেউ ছোড়ে না। ইমদাদ হোসেনের অবদান বলে শেষ করা যাবে না। এক জীবনে শিল্পী ইমদাদ হোসেন বিভিন্নমুখী এত কাজ করেছেন, যা হয়তো গবেষণা করে লিখতে হবে।
অনেক দেরিতে হলেও জাতীয়ভাবে তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন। তাঁর কর্মযজ্ঞের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো শিল্পী সমাজের এবং প্রগতিশীল সমাজের অনেক মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। আমরা একজন আলোকিত মানুষ তৈরির নেতাকে হারিয়েছি। এই অভাব পূরণ হওয়ার নয়। তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা।

লেখক : শিল্পী, অধ্যাপক

No comments

Powered by Blogger.