নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার-রাজনৈতিক সমঝোতা অপরিহার্য
এটিএম শামসুল হুদা প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন ২০০৭ সালে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদের শুরুর দিকে। তার এবং কমিশনের অন্য সদস্যদের নিয়োগে ক্ষমতার দাবিদার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ছিল না। এ কমিশন ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে এবং নির্বাচনী ব্যবস্থায় বেশ কিছু সংস্কার সাধন করতে সক্ষম হয়।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান করতে পারা ছিল তাদের বড় সাফল্য। এরপর প্রায় তিন বছর কমিশন রাজনৈতিক দলীয় সরকারের আমলে দায়িত্ব পালন করে। সংবিধান অনুযায়ী কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংস্থা। কিন্তু রাজনৈতিক সরকারের আমলে এ সত্তা বজায় রাখা সহজ কাজ নয়। তবে বর্তমান কমিশন এ আমলেই জাতীয় সংসদের একাধিক আসনে উপনির্বাচন, দেশব্যাপী পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন এবং চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছে। এ কাজে প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সার্বিক সহায়তাও ছিল লক্ষণীয়। এখন কমিশন তার পাঁচ বছর মেয়াদের শেষ প্রান্তে উপনীত এবং এ সময়ের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তারা কিছু সংস্কার প্রস্তাব সরকারের কাছে উপস্থাপন করতে আগ্রহী। কমিশনের সম্ভাব্য প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে : সংসদ নির্বাচনের প্রচার কাজে দলগুলোকে সরকারি তহবিল থেকে অর্থ প্রদান, নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের ব্যবহার, সিইসি ও নির্বাচনী কমিশনার নিয়োগ আইন এবং নির্বাচনী আসনের সীমানা নির্ধারণে আইন ও বিধিমালার সংস্কার, নির্বাচনে জামানত ও ব্যয়সীমার অঙ্ক বাড়ানো প্রভৃতি। কমিশন তাদের প্রস্তাব চূড়ান্ত করার জন্য রাজনৈতিক দল এবং সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে। তবে তাদের জন্য সমস্যা হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আলোচনায় অংশ নিলেও সংস্কারের বিষয়ে কোনো লিখিত পরামর্শ কিংবা প্রস্তাব রাখেনি এবং বিএনপি আলোচনাতেই অংশ নেয়নি। অথচ সংস্কারের জন্য আইন প্রণয়ন হবে জাতীয় সংসদে এবং এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বাধীন মহাজোটের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তদুপরি বর্তমান জাতীয় সংসদ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুমোদনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিধান বাতিল করায় পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত না হলে সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান দুরূহ হবে এবং হলেও তার বিশ্বাসযোগ্য দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হবে। অন্যদিকে বিএনপির দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনর্বহাল এবং এ ইস্যুতে তারা রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয়। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রশ্নেও তারা সরকারকে একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে দিতে রাজি নয়। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব জাতীয় সংসদে অনুমোদন নিঃসন্দেহে বড় চ্যালেঞ্জ এবং তা অতিক্রমে রাজনৈতিক সমঝোতা অবশ্যই প্রধান শর্ত। বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হবে প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান। নির্বাচন কমিশনের সংস্কারের প্রতিটি প্রস্তাব সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। কোনো কোনোটি হয়তো ভবিষ্যতের জন্যও তোলা রাখা থাকবে। কিন্তু জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য সর্বোত্তম পরিবেশ সৃষ্টির এ উদ্যোগ প্রশংসনীয় এবং তাতে সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের ইতিবাচক সাড়া দিতেই হবে।
No comments