নিত্যজাতম্-ভর্তুকির মধ্যেও ভূত আছে by মহসিন হাবিব

দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে, বিশেষ করে ক্রয় ও আমদানির ক্ষেত্রে যখনই একটি নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, দেখা যায়, তার আগেই একটি চক্র ব্লটিং পেপারের মতো অর্থ শুষে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। এক সময় মনে হয়, ওই চক্রটিকে লাভবান করার জন্যই সরকার ভর্তুকি দিয়ে আমদানি বা ক্রয় করতে বিভিন্ন চুক্তি সম্পন্ন করেছে। বহুবার বহু আমদানি বাণিজ্যে আমরা সরকারকে অন্যায়ভাবে, চোখ-মুখ বন্ধ রেখে দেশের অর্থ লোকসান করতে দেখেছি।


অল্প মূল্যে কোটেশন দেওয়া কম্পানিকে কাজ না দিয়ে অধিক মূল্যে অন্য কম্পানিকে ছাড় দেওয়া, বাজারমূল্যের চেয়ে বহু কোটি টাকা বেশি দিয়ে পণ্য-দ্রব্য আমদানি করা যেন বাংলাদেশের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি দেশের সরকারের ভর্তুকি দেওয়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক নয়। উন্নত বিশ্ব সেবাখাতসহ নানা খাতে ভর্তুকি দিয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে কী ধরনের ভর্তুকি সরকারকে কাঁধে বইতে হচ্ছে, তা মাত্র দু-একটি উদাহরণ থেকেই বোঝা যাবে। সার আমদানির কথাই ধরুন। সরকার ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সারের মূল্য সহনশীলভাবে বৃদ্ধি করার পরও তিন হাজার কোটি টাকার অধিক ভর্তুকি দিচ্ছে। দেশে জ্বালানির অভাবে সঠিকভাবে সার উৎপাদন ও সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে না। এ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ যে বাড়বে তা অনুমেয়। যা হোক, মূল কথা ভর্তুকির অর্থ নিয়ে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বহুলপঠিত ইংরেজি পত্রিকা উইকলি বি্লৎস-এ একটি রিপোর্ট পড়ে রীতিমতো গা শিউরে উঠেছে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, বিএনপির নেতৃত্বে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন ইউরিয়া সার আমদানি করে টনপ্রতি ৪৫০ থেকে ৫৫০ মার্কিন ডলার মূল্যে। এর অধিকাংশই আমদানি করা হয় ইউক্রেন থেকে। কিন্তু তখন ইউক্রেনের বাজারে ইউরিয়া সারের মূল্য ছিল মাত্র ১১২ মার্কিন ডলার। পত্রিকাটি বলেছে, তাদের নিজস্ব অনুসন্ধানে জানতে পেরেছে, বিশ্বব্যাপী এতসব দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির পরও এখন ইউক্রেনেই ইউরিয়া সারের মূল্য প্রতি টন ১৫০ ডলার এবং চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দর পর্যন্ত তা পেঁৗছতে কোনোক্রমেই ২১০ ডলারের বেশি খরচ হবে না। এখন প্রশ্ন হলো, ভর্তুকি নামের ওই বিশাল অঙ্কের টাকা গেল কোথায়? এখনো যে অন্যায্য মূল্যে সার কেনা হচ্ছে, তা যাচ্ছে কোথায়? অবশ্য ওই তথ্যবহুল রিপোর্টটিতে মন্তব্য করা হয়েছে,‘It is learnt that, a particular syndicate is successfully getting business contracts for supplying urea to BCIC at a price secretly fixed by the syndicate and some of the influential officials of BCIC and the ministry concerned.’
যথার্থই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ এম এম শওকত আলী গতকালের কালের কণ্ঠে প্রকাশিত নিবন্ধে একটি বিষয় উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, '২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সালে সারের আপৎকালীন মজুদ, রক্ষণাবেক্ষণ ও বিতরণের দায়িত্ব অনেকটা জোর করেই বিসিআইসিকে দেওয়া হয়!' বর্তমান সরকারও সার উৎপাদন-আমদানি_সর্বক্ষেত্রে ভর্তুকি দিচ্ছে। কিন্তু যথারীতি ভর্তুকির মধ্যে বড়বড় পেটুক ভূত বসে আছে, যেদিকটিতে সংশ্লিষ্ট মহল সঠিকভাবে নজর দিতে পারছে না, অথবা দিচ্ছে না।
অসংগতির কোনো শেষ নেই। পিডিবি ভাড়া করা বিদ্যুৎকেন্দ্রে তেল ও গ্যাস সরবরাহ করে থাকে। দৃঢ়তার অভাবে এই বিদ্যুৎ খাতে সরকারকে কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে। এই খাতে সরকারের অর্থ 'আসতে কাটছে, যেতে কাটছে' অবস্থা। একদিকে সরকার উচিত দামের চেয়ে অধিক মূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয় করছে প্রাইভেট সেক্টর থেকে, অন্যদিকে তাদের ভর্তুকি মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি সরবরাহ করতে হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এর কুফল বোঝেন না? নিশ্চয়ই বোঝেন। হয় তাঁদের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই, অথবা ভিন্ন কারণে চুপ হয়ে আছেন। বহু প্ল্যান্টে দীর্ঘকাল ধরেই পুরনো মেশিন চালু থাকায় সেগুলোতে গ্যাস খরচ যতটুকু হওয়ার কথা, তার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে থাকে। তেলচালিত মেশিনে অধিক পরিমাণ তেল খরচ হয়। কিন্তু সেসব মেশিন রিপ্লেসমেন্টের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই! এসব কারণে বিদ্যুতের চাহিদা যেমন বাড়ছে তার সঙ্গে ভর্তুকিও বাড়ছে দ্বিগুণ। এ অবস্থায় কত দিনে রাজার গোলা খালি হয়, তা দেখার জন্য তাকিয়ে আছে অনেকে!
সবসময় যে সরকারের নীতি নির্ধারকরাই অসংগতিপূর্ণ চুক্তি বা পরিকল্পনা করে থাকেন তা কিন্তু নয়। এর পেছনে সিন্ডিকেট এবং আমলাতন্ত্রও বড় চক্রান্ত করে থাকে। তবে সরকারকে মনে রাখতে হবে, শেষপর্যন্ত নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের যাবতীয় দায় কিন্তু সরকারের।
কিছুদিন আগে স্টিল ও রি-রোলিং মিলস অ্যাসোসিয়েশন একটি অত্যন্ত যুক্তিসংগত প্রস্তাব রেখেছিল বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানের কাছে। তারা মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বলেছিল, দেশে চার শতাধিক রি-রোলিং মিল রয়েছে। এসব কারখানায় উৎপাদিত এমএস রড দেশের সম্পূর্ণ চাহিদা পূরণ করে থাকে। এ শিল্পে বছরে প্রায় ৩৫ লাখ টন কাঁচামালের প্রয়োজন হয়। এই কাঁচামালের ৮০ ভাগ আসে জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে। জাহাজ ভাঙা বন্ধ হওয়ায় স্ক্র্যাপের দাম যেমন বেড়েছে, তেমনি কাঁচামালের সংকট দেখা দিয়েছে। তারা জাহাজ ভাঙা শিল্পে এসব কারণে একটি স্থিতিশীলতা আনতে অনুরোধ করেছিল। বাণিজ্যমন্ত্রী উত্তরে বলেছিলেন, পরিবেশ সম্মতভাবে জাহাজ ভাঙা শিল্প গড়ে তুলতে নেদারল্যান্ডসের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। পরিবেশ ও উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্য রেখে জাহাজ ভাঙা শিল্প গড়ে তুলতে হবে।
এখন মজার বিষয়টি লক্ষ করুন। জাহাজ ভাঙা শিল্প বন্ধ থাকলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত মালিক ও শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আর ক্ষতিগ্রস্ত হবেন রি-রোলিং মিলের মালিকরা। কিন্তু যদি বিদেশি কোনো চক্র বাংলাদেশের বাজারে চড়া মূল্যে রড রপ্তানি করতে চায় তাহলে কিন্তু তাদের জন্য হবে পোয়াবারো। কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়? অর্থনীতির প্রায় সব ক্ষেত্রেই এখন এ রকম। এই যে সরকার জ্বালানির মূল্য বাড়িয়েছে, এর পেছনে যুক্তি যেমন আছে তেমনি আশঙ্কাও আছে প্রবল। এ মূল্যবৃদ্ধির ফলে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বাংলাদেশের মহামূল্যবান গার্মেন্ট সেক্টরসহ শিল্প উৎপাদন।
এবার প্রাসঙ্গিক একটি বিষয়ে কথা না বলে পারছি না। জাহাজ ভাঙা শিল্পকে ঘিরে পরিবেশ দূষণের নামে চিৎকার করছেন বেশ কিছু ব্যক্তি এবং সংগঠন। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের আগে কেউ না কেউ, কোনো না কোনো দেশ কিন্তু জাহাজ ভাঙা শিল্পে কাজ করত। এখনো নিঃসন্দেহে এ শিল্পকে কুক্ষিগত করার জন্য কেউ না কেউ মুখিয়ে আছে। সুতরাং কে যে পরিবেশ রক্ষার নামে কার হয়ে কাজ করে তা কিন্তু বলা মুশকিল!
ক্ষমাপ্রার্থী। আমি পরিবেশ দূষণের বিষয়টিকে মোটেই খাটো করে দেখছি না। পরিবেশ পুরোপুরি দূষিত হয়ে উঠলে কোনো অর্থনীতিই, কোনো উন্নতিই এই অপূর্ব সুন্দর ধরিত্রীর মানুষ নামক সভ্য প্রাণীটিকে টিকিয়ে রাখতে পারবে না। এটা পরিবেশবিদ না হয়েও মোটা দাগে বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু হাবভাবে মনে হচ্ছে, পরিবেশ রক্ষার সব দায়িত্বই আমার! ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র একটি প্রদেশ বা রাজ্য বছরে যে পরিমাণ পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছে, বাংলাদেশ এখনো তার অর্ধেক পরিমাণ দূষণের জন্যও দায়ী নয়। কিছুদিন আগে মেঙ্েিকা উপকূলে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামের বিস্ফোরণে সমুদ্রে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা আগামী ১০০ বছর বাংলাদেশের জাহাজ শিল্প নিয়ন্ত্রণহীন কর্মকাণ্ড চালালেও করতে পারবে না! এই শিল্প বাংলাদেশের একটি অন্যতম আশার স্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনি সময় পরিবেশ রক্ষাকারী সংগঠনগুলোর নজর যেন প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই পড়েছে। তার পরও কথা আছে। জাহাজ ভাঙা শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের কিন্তু এখন যথেষ্ট বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো আরো নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা হবে। কিন্তু সব মহলের মনে রাখা উচিত, এ শিল্পও বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
নিজেদের অর্থনীতিকে আরো অধিক শক্তিশালী করতে পৃথিবীর বিভিন্ন ভদ্র দেশ কী করছে আমরা কিন্তু জানি। পরিবেশ রক্ষার চিন্তা তো বাদই দিলাম, অনেক দেশে ঘরের মেয়েদের সরকারি উদ্যোগে টেনে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে পর্যটকদের পকেটের পয়সা রেখে দেওয়ার জন্য। আর যত দোষ হয়ে গেছে জাহাজ ভাঙা শিল্পের?

mohshinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.