চরাচর-পহেলা বৈশাখে জেগে ওঠা এক গ্রামের শোকগাথা
ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়তে না পড়তে প্রতিদিনের মতো ব্যস্ত হয়ে ওঠে গ্রামগুলো। একে অপরকে হাঁক পাড়তে পাড়তে যে যার মতো কাজে নেমে পড়ে আইনুদ্দি বাছুর খাঁরা। কিন্তু আজ কয়েক দিন হলো বাকেরগঞ্জ জেলার নবাবপুরের (উজিরপুর) একেক গ্রামের দৃশ্যপটে যেন ভিন্ন আদল এসেছে। নিতাইদের কাঁধে চেপে সরু আর লম্বা কুচকুচে কালো নৌকোগুলো জায়গা করে নিচ্ছে বাড়ির উঠোনগুলোয়।
গ্রামের বয়সী থেকে শুরু করে ওই ছোট শিশুদেরও এখন শুধু মুখভরা বাইচের গল্প। আর এ নিয়ে আইনুদ্দিদের গ্রাম নিতাইদের গ্রামকে সুযোগ বুঝে এক হাত দেখে নেবে বলেও জানিয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে নিজেদের প্রমাণ করবে বলে উঠে-পড়ে লেগেছে নিতাইরাও। শুধু টান টান উত্তেজনাই নয়, নিজেদের মধ্যে হাসিঠাট্টায়ও মজে আছে গ্রামগুলো। কাদের নৌকোর জোর কতখানি এখন ঘুরেফিরে সেটাই আসল বিষয়। এই তো কয়েক মাস বাদেই পয়লা বৈশাখের মৃদঙ্গ ধ্বনি বেজে উঠবে গ্রামে গ্রামে। তারই তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে প্রতিটি বাড়িতে। বাংলার ১২৯৩, ১৮৮৬ সাল। নবাবপুর বাজারে নাগরদোলার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ জানান দিল বৈশাখি মেলার। মাটির হাঁড়ি-মালসা, পুতুল আর নানা বেসাতি নিয়ে হাট সেজে বসেছে পণ্যপসারিরা। দোকানগুলোতেও চলছে হালখাতার প্রস্তুতি। এদিকে মাহার ইচলাদি থেকে উত্তরে কইকোটার গ্রামে কুড়ি-পঁচিশখানি নৌকা নিয়ে বাইচের প্রস্তুতি সেরে নিল আইনুদ্দি ও নিতাইরা। হাতে ধরে থাকা কাপড়ের টুকরোখানি ফেলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজার থেকে এক মাইল দূরে জোরসে পানি কাটতে শুরু করে দিল সার সার দাঁড়িয়ে থাকা সরু-হালকা ছিপগুলো। অমনি পানির ছপাৎ ছপাৎ শব্দ আর মাঝিদের হল্লায় সরগরম হয়ে উঠল নদীর দুই তীর। এর মধ্যে নৌকার খোলে বসে কাঁসর বাজিয়ে মাঝিদের শক্তি জুগিয়ে যাচ্ছিল বাছির খাঁ। সব শক্তি জড়ো করে সাঁই সাঁই করে কখনো সামনের নৌকাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে পেছনের ডিঙি, আবার কখনো বা পেছনেরটি সামনে। বাইচকে ঘিরে চাপা উত্তেজনা তুঙ্গে উঠেছে সবার মধ্যে। ছিপ-ডিঙিগুলোর বাইচের কেরামতি দেখতে হাঁটাপথ ধরে ছুটে এসেছে দূর গ্রামের বাসিন্দারাও। মানুষের ভিড়ে ভেঙে পড়তে চাইছে যেন নদীর দুই তীর। এমনকি নদীর ওপর ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের কাঠের পুলটিতেও তিলধারণের জায়গা নেই। ভিড়কে পাশ কাটিয়ে মুখ গলিয়ে দেখে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে দশনার্থীদের মধ্যে। কিন্তু মানুষের সোৎ-উল্লাসধ্বনি আর তাল সামলাতে দিল না কাঠের পুলটিকে। কাজেই কিছু বুঝে ওঠার আগেই মড় মড় শব্দ সব আনন্দ-উচ্ছ্বাসকে রূপ দিল শোকের মাতমে। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল অনেক আগ থেকে একটু একটু করে ক্ষয়ে যাওয়া পুলের মাঝের অংশটি। হকচকিয়ে গেল দুই তীরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোও। চোখের নিমেষেই অগুনতি মানুষ ছিটকে পড়ল কুড়ি হাত নিচে নদীর পানিতে। অমনি বাইচের বৈঠা ফেলে আইনুদ্দিরা ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীতে। সঙ্গে দুই তীরের লোকগুলোও। পাড়ে উঠিয়ে নিয়ে আসল অনেককে। কেউ কেউ আবার সাঁতরে পাড়ে উঠে আসতে পারল। বাতাসের তোড় সেই খবর ছড়িয়ে নিয়ে গেল গ্রামে গ্রামে।
কান্না আর আর্তচিৎকারে ভেঙে পড়তে চাইল গ্রামের প্রতিটি পথপ্রান্তর। দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসা স্বজনরা সূর্য পাটে নেমে গেলেও পাড় থেকে সরে যাওয়ার নামগন্ধও করল না। হদিস মিলল না ঠিক কতজন লোক হারিয়ে গেছে নদীর গর্ভে। একটানা দু-তিন দিন পর্যন্ত তিন-চার মাইল দূরে ফুলে ফেঁপে ওঠা লাশগুলো ভেসে আসতে দেখল অনেকে। স্তম্ভিত হয়ে গেল নবাবপুরবাসী। যদিও সময়ের ফেরে গড়িয়ে গেছে অনেকখানি সময়। কিন্তু ভয়বহ এ ঘটনা এখনো দুঃসহ স্মৃতি হয়েই রইল যেন নবাবপুরকে ঘিরে।
শাপলা বড়ুয়া
কান্না আর আর্তচিৎকারে ভেঙে পড়তে চাইল গ্রামের প্রতিটি পথপ্রান্তর। দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসা স্বজনরা সূর্য পাটে নেমে গেলেও পাড় থেকে সরে যাওয়ার নামগন্ধও করল না। হদিস মিলল না ঠিক কতজন লোক হারিয়ে গেছে নদীর গর্ভে। একটানা দু-তিন দিন পর্যন্ত তিন-চার মাইল দূরে ফুলে ফেঁপে ওঠা লাশগুলো ভেসে আসতে দেখল অনেকে। স্তম্ভিত হয়ে গেল নবাবপুরবাসী। যদিও সময়ের ফেরে গড়িয়ে গেছে অনেকখানি সময়। কিন্তু ভয়বহ এ ঘটনা এখনো দুঃসহ স্মৃতি হয়েই রইল যেন নবাবপুরকে ঘিরে।
শাপলা বড়ুয়া
No comments