বিএনপির পাল্টাপাল্টি কমিটি ২০ জেলায় by মোশাররফ বাবলু
বিএনপির ৭৫টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে অধিকাংশ জেলায় অভ্যন্তরীণ কোন্দল চলছে। কোন্দলের কারণে দলের সাংগঠনিক অবস্থা খুবই দুর্বল হয়ে পড়ছে। ফলে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার হচ্ছে না। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে দলীয় হাইকমান্ড। গত পৌনে তিন বছরে কমিটি গঠনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে দলটি। অন্তত ২০টি জেলায় পাল্টাপাল্টি কমিটি রয়েছে।
জানা যায়, ঢাকা মহানগরী, ঢাকা জেলা, চট্টগ্রাম মহানগর, ময়মনসিংহ উত্তর, মানিকগঞ্জ, নেত্রকোনা, শেরপুর, পঞ্চগড় ও রংপুর জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে দলীয় হাইকমান্ড। ঢাকা মহানগরীর কমিটি নিয়েই রয়েছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। বর্তমান কমিটির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা হলেও এই কমিটির নির্দেশ মেনে নিতে পারছেন না মির্জা আব্বাসের অনুসারীরা। এ কারণে আন্দোলন জোরদার হচ্ছে না বলেও রয়েছে অভিযোগ। শুধু কমিটি গঠন নিয়েই নয়, দলের নেতৃত্ব নিয়েও চলছে
পাল্টাপাল্টি শক্তি প্রদর্শন। সম্প্রতি সিলেট ও রাজশাহী বিভাগ অভিমুখে রোডমার্চ এবং কয়েকটি জেলায় জনসভায় লোক সমাগম করতে গিয়ে বিভক্ত হয়েছেন স্থানীয় নেতারা। একে অপরের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগও তুলে ধরেন। সিলেট অভিমুখে রোডমার্চের সময়ও দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট জেলা বিএনপি সভাপতি এম ইলিয়াছ আলীর বিরুদ্ধে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকে কেন্দ্রের কাছে নানা অভিযোগ করা হয়েছে। রাজশাহী জেলা বিএনপি সভাপতি নাদিম মোস্তফা ও রাজশাহী মহানগরী বিএনপি সভাপতি মিজানুর রহমান মিনুর দ্বন্দ্বের কারণে শেষ পর্যন্ত রাজশাহী শহরে রোডমার্চ উত্তর জনসভা হয়নি।
২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বিএনপির শেষ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলের পর প্রায় তিন বছরে দফায় দফায় চেষ্টা করেও সব সাংগঠনিক জেলার কমিটি করতে পারেনি বিএনপি। গত ১৬ মার্চ সাবেক মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর ৬ এপ্রিল দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ওপর। তিনি বেশ কয়েকটি জেলা কমিটি গঠন করেন। এরপরও অনেক জেলায় কমিটি গঠন করা হয়নি। যেসব জেলায় কমিটি হয়নি সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মানিকগঞ্জ, ঢাকা মহানগরী, ঢাকা জেলা, পঞ্চগড়, রংপুর ও ময়মনসিংহ উত্তর। আংশিক কমিটি গঠন করা হয়েছে বগুড়া, পিরোজপুরসহ আরো কয়েকটি সাংগঠনিক জেলায়। আর কমিটি গঠন করা হলেও পাল্টা কমিটি থাকায় জামালপুর, চট্টগ্রাম মহানগর, কুমিল্লা দক্ষিণ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, কঙ্বাজার, পটুয়াখালী, ফরিদপুর, খুলনা, রংপুরসহ অন্তত ২০টি জেলার সাংগঠনিক কার্যক্রম অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কমিটি গঠনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে দলের হাইকমান্ড। আর কমিটি না থাকায় সাংগঠনিক জেলাগুলোর কার্যক্রমও ঝিমিয়ে পড়ে।
এক-এগারোর পর তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে দলের একটি বড় অংশ সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করে। মান্নান ভূঁইয়ার সঙ্গে বর্তমান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ১০৫ জন নেতা দলের সংস্কার প্রস্তাবের পক্ষে মত দেন। সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপনের কারণে বিএনপির মধ্যে বিভক্তি শুরু হয়। একপর্যায়ে খালেদা জিয়া ও তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমানসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা যৌথবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। সিনিয়র নেতারা গ্রেপ্তার হওয়ায় দলটি তখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মান্নান ভূঁইয়াসহ বেশ কয়েকজন নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও অধিকাংশ সংস্কারপন্থী বর্তমানে দলের বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর দলকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে তৃণমূল পর্যায়ে দলের কমিটি পুনর্গঠনের যে উদ্যোগ তিনি শুরু করেন তাতে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে ওঠে। কারণ সারা দেশে জেলা-উপজেলাসহ বিভিন্ন স্তরের তৃণমূল কমিটি গঠন নিয়ে নেতা-কর্মীরা দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়েন। এর ফলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে তৃণমূল পর্যায় থেকে ঘর গোছানোর কাজ শুরু করা হয় সে উদ্দেশ্য ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়। ২০০৯ সালের জুন মাসে কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন জেলার আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দেয় দলের হাইকমান্ড। কিন্তু এ আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আরো চাঙ্গা হয়ে উঠলে কাউন্সিলরদের ভোটে প্রথমে উপজেলা কমিটি এবং পরে অনুরূপভাবে জেলা কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন চেয়ারপারসন। এ পদ্ধতিতে ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসের মধ্যে সব জেলা কমিটি গঠনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এরপর ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলের আগে ৭৫টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মাত্র ২০টি জেলার কমিটি গঠিত হয়। এ পরিস্থিতিতে বাকি ৫৫টি জেলা থেকে জাতীয় কাউন্সিলের জন্য কাউন্সিলর ঠিক করে দেওয়া হয় কেন্দ্র থেকেই। কেন্দ্রের নির্দেশ অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। এ নিয়ে দলের তৃণমূল নেতাদের মধ্যে চরম ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। জাতীয় কাউন্সিলের পর আবারও দলের হাইকমান্ড জেলা কমিটি গঠনের কাজে হাত দেয়। ২০১০ সালের জুন মাসের মধ্যে কমিটি গঠনের কাজ শেষ করতে বলা হলেও একমাত্র অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে তা সম্ভব হয়নি। গত বছরের ৩১ জুলাই বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় দলের জেলা কমিটিগুলো না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জেলা নেতারা চরম ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেন। এ পরিস্থিতিতে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গত বছরের ৩০ আগস্টের মধ্যে সব জেলা কমিটি গঠনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন। কিন্তু এ সময়ের মধ্যেও সব জেলার কমিটি গঠিত হয়নি।
এ প্রসঙ্গে দলের স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, 'সারা দেশে ৭৫টি সাংগঠনিক জেলায় কখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা সম্ভব হবে না। কেন্দ্র থেকে কমিটি চাপিয়ে দেওয়ায় এটা সম্ভব হচ্ছে না। যখনই দলের যিনি মহাসচিব নিযুক্ত হন, তখনই তিনি তাঁর কাছের লোককে কমিটির নেতা করতে চান। এজন্যই দলের মধ্যে গ্রুপিং ও কোন্দল নিরসন হচ্ছে না।'
বড় দলে কিছু কোন্দল থাকতেই পারে : এ প্রসঙ্গে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে জানান, আন্দোলনের পাশাপাশি সারা দেশের জেলা কমিটি গঠনের কার্যক্রম চলছে। এরই মধ্যে বেশিরভাগ জেলায় কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিছু জেলায় বাকি আছে। তাও শিগগিরই হয়ে যাবে। পাল্টাপাল্টি কমিটি গঠন হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। বড় দলে নেতৃত্ব নিয়ে কিছুটা কোন্দল থাকতেই পারে। কিন্তু এটাকে কোন্দল ও গ্রুপিং বলা যাবে না। যেভাবে সরকারের বিরুদ্ধে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামছে, রোডমার্চ ও বিভিন্ন জেলায় জনসভায় যেভাবে মানুষের ঢল নামছে, তাতে দলের কোন্দল থাকবে না।'
আব্বাস-খোকা দ্বন্দ্ব ঢাকা মহানগরীতে : ঢাকা মহানগরী কমিটির নেতৃত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার মধ্যে। গত ১৪ মে মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে আহ্বায়ক এবং আবদুস সালামকে সদস্যসচিব করে কমিটি ঘোষণা করা হয়। আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর বিএনপির হাইকমান্ড থেকে বলা হয়েছিল, ছয় মাসের মধ্যে মহানগরীর সব ইউনিট কমিটি গঠনের কাজ শেষ করে মূল কমিটি করা হবে। কিন্তু এখনো অধিকাংশ ওয়ার্ড কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। তাই ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটি কবে হবে, তা বিএনপির সিনিয়র নেতারাও বলতে পারছেন না। এ কমিটির দুই নেতা সাদেক হোসেন খোকা বর্তমানে সৌদি আরবে এবং আবদুস সালাম যুক্তরাষ্ট্রে আছেন বলে দলের একটি সূত্র জানায়।
ঢাকা জেলা কমিটি নিয়ে প্রকাশ্যে বিক্ষোভ : এদিকে ঢাকা জেলা কমিটির বর্তমান সভাপতি হচ্ছেন এম এ মান্নান। সাধারণ সম্পাদক আমান উল্লাহ আমান। কিন্তু এ কমিটি কেউ মেনে নিতে পারছে না। কমিটি গঠনের পর দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এবং গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের সামনে পাল্টাপাল্টি শক্তি প্রদর্শন, বিক্ষোভ মিছিল করেন ঢাকা জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের সঙ্গে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা ও যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমানের দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। কেউ কারো নেতৃত্ব মেনে নিতে পারছেন না। এ কারণে ঢাকা জেলা কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব নিরসন হচ্ছে না বলে নেতা-কর্মীদের অভিযোগ।
এ প্রসঙ্গে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, 'এই মুহূর্তে আমি কোনো কমিটি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি না। দলের চেয়ারপারসন আমাকে যখন যে দায়িত্ব দেন, তাই আমি করে যাচ্ছি।'
'তারা' এখন অনেক দূরে : খুলনা বিএনপিতে ভেতরে ভেতরে কোন্দল চলছে। অতীতে আলী আসগর লবিকে ঘিরে গ্রপিং ছিল। বর্তমানে প্রকাশ্যে তেমন কোনো বিভেদ না থাকলেও ভেতরে ভেতরে সব কিছুই করছেন খুলনা মহানগরী বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু এমপি। লবির লোকজন আপাতত নীরব। তবে লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে লবি যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন বলেও জানা গেছে। বর্তমানে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের সঙ্গে মঞ্জুর যোগাযোগ ভালো থাকায় অধ্যাপক মাজেদুল ইসলাম ও আজিজুল বারী হেলাল তাঁর সঙ্গেই যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন।
এ প্রসঙ্গে নজরুল ইসলাম মঞ্জু কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের মধ্যে কোনো ধরনের গ্রুপিং ও কোন্দল নেই।' লবির সঙ্গে কোন্দল আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'তারা এখন অনেক দূরে।'
সরোয়ার-কামাল দ্বন্দ্ব বরিশালে : বরিশাল জেলায় দীর্ঘদিন ধরে এমপি মজিবর রহমান সরোয়ারের সঙ্গে বিএনপির কেন্দ্রীয় মৎস্যবিষয়ক সম্পাদক ও বরিশাল জেলা (দক্ষিণ) শাখার সভাপতি আহসান হাবীব কামালের কোন্দল চলছে। খালেদা জিয়ার নির্দেশ সত্ত্বেও কোন্দল থামেনি। মজিবর রহমান সরোয়ার একক ক্ষমতা ও দাপট বহাল রাখতে বিভিন্ন তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে কামালের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে সরোয়ার বলেছেন, যে কমিটি হয়েছে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। এজন্যই স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীরা কমিটি মেনে নিতে পারছেন না। তিনি বলেন, 'ওয়ান-ইলেভেনের সময় আমিসহ দলের মাত্র কয়েকজন নেতা দলের পক্ষে কাজ করেছি। যারা সংস্কারপন্থী ও ওয়ান-ইলেভেনের পক্ষে কাজ করেছে, তারাই মূলত আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটাচ্ছে।'
অন্যদিকে আহসান হাবীব কামাল বলেন, বরিশালে এখন বিএনপি ও বিভিন্ন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের সাধারণ নেতা-কর্মীরা যতটা না ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি হামলা-নির্যাতন করা হচ্ছে এমপি সরোয়ারের অনুসারীদের পক্ষ থেকে।
রংপুর বিভাগে আটটি জেলা। খোদ রংপুর জেলায় কমিটি গঠন করা হয়নি। জেলা বিএনপি সভাপতি রহিমউদ্দিন ভরসা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তাঁর পরিবর্তে অন্য কাউকে জেলা সভাপতি করা হতে পারে। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে রংপুরে দলের মধ্যে কোন্দল ও গ্রুপিং চলছে।
পাল্টাপাল্টি শক্তি প্রদর্শন। সম্প্রতি সিলেট ও রাজশাহী বিভাগ অভিমুখে রোডমার্চ এবং কয়েকটি জেলায় জনসভায় লোক সমাগম করতে গিয়ে বিভক্ত হয়েছেন স্থানীয় নেতারা। একে অপরের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগও তুলে ধরেন। সিলেট অভিমুখে রোডমার্চের সময়ও দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট জেলা বিএনপি সভাপতি এম ইলিয়াছ আলীর বিরুদ্ধে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকে কেন্দ্রের কাছে নানা অভিযোগ করা হয়েছে। রাজশাহী জেলা বিএনপি সভাপতি নাদিম মোস্তফা ও রাজশাহী মহানগরী বিএনপি সভাপতি মিজানুর রহমান মিনুর দ্বন্দ্বের কারণে শেষ পর্যন্ত রাজশাহী শহরে রোডমার্চ উত্তর জনসভা হয়নি।
২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বিএনপির শেষ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলের পর প্রায় তিন বছরে দফায় দফায় চেষ্টা করেও সব সাংগঠনিক জেলার কমিটি করতে পারেনি বিএনপি। গত ১৬ মার্চ সাবেক মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর ৬ এপ্রিল দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ওপর। তিনি বেশ কয়েকটি জেলা কমিটি গঠন করেন। এরপরও অনেক জেলায় কমিটি গঠন করা হয়নি। যেসব জেলায় কমিটি হয়নি সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মানিকগঞ্জ, ঢাকা মহানগরী, ঢাকা জেলা, পঞ্চগড়, রংপুর ও ময়মনসিংহ উত্তর। আংশিক কমিটি গঠন করা হয়েছে বগুড়া, পিরোজপুরসহ আরো কয়েকটি সাংগঠনিক জেলায়। আর কমিটি গঠন করা হলেও পাল্টা কমিটি থাকায় জামালপুর, চট্টগ্রাম মহানগর, কুমিল্লা দক্ষিণ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, কঙ্বাজার, পটুয়াখালী, ফরিদপুর, খুলনা, রংপুরসহ অন্তত ২০টি জেলার সাংগঠনিক কার্যক্রম অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কমিটি গঠনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে দলের হাইকমান্ড। আর কমিটি না থাকায় সাংগঠনিক জেলাগুলোর কার্যক্রমও ঝিমিয়ে পড়ে।
এক-এগারোর পর তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে দলের একটি বড় অংশ সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করে। মান্নান ভূঁইয়ার সঙ্গে বর্তমান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ১০৫ জন নেতা দলের সংস্কার প্রস্তাবের পক্ষে মত দেন। সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপনের কারণে বিএনপির মধ্যে বিভক্তি শুরু হয়। একপর্যায়ে খালেদা জিয়া ও তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমানসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা যৌথবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। সিনিয়র নেতারা গ্রেপ্তার হওয়ায় দলটি তখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মান্নান ভূঁইয়াসহ বেশ কয়েকজন নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও অধিকাংশ সংস্কারপন্থী বর্তমানে দলের বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর দলকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে তৃণমূল পর্যায়ে দলের কমিটি পুনর্গঠনের যে উদ্যোগ তিনি শুরু করেন তাতে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে ওঠে। কারণ সারা দেশে জেলা-উপজেলাসহ বিভিন্ন স্তরের তৃণমূল কমিটি গঠন নিয়ে নেতা-কর্মীরা দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়েন। এর ফলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে তৃণমূল পর্যায় থেকে ঘর গোছানোর কাজ শুরু করা হয় সে উদ্দেশ্য ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়। ২০০৯ সালের জুন মাসে কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন জেলার আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দেয় দলের হাইকমান্ড। কিন্তু এ আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আরো চাঙ্গা হয়ে উঠলে কাউন্সিলরদের ভোটে প্রথমে উপজেলা কমিটি এবং পরে অনুরূপভাবে জেলা কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন চেয়ারপারসন। এ পদ্ধতিতে ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসের মধ্যে সব জেলা কমিটি গঠনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এরপর ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলের আগে ৭৫টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মাত্র ২০টি জেলার কমিটি গঠিত হয়। এ পরিস্থিতিতে বাকি ৫৫টি জেলা থেকে জাতীয় কাউন্সিলের জন্য কাউন্সিলর ঠিক করে দেওয়া হয় কেন্দ্র থেকেই। কেন্দ্রের নির্দেশ অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। এ নিয়ে দলের তৃণমূল নেতাদের মধ্যে চরম ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। জাতীয় কাউন্সিলের পর আবারও দলের হাইকমান্ড জেলা কমিটি গঠনের কাজে হাত দেয়। ২০১০ সালের জুন মাসের মধ্যে কমিটি গঠনের কাজ শেষ করতে বলা হলেও একমাত্র অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে তা সম্ভব হয়নি। গত বছরের ৩১ জুলাই বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় দলের জেলা কমিটিগুলো না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জেলা নেতারা চরম ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেন। এ পরিস্থিতিতে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গত বছরের ৩০ আগস্টের মধ্যে সব জেলা কমিটি গঠনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন। কিন্তু এ সময়ের মধ্যেও সব জেলার কমিটি গঠিত হয়নি।
এ প্রসঙ্গে দলের স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, 'সারা দেশে ৭৫টি সাংগঠনিক জেলায় কখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা সম্ভব হবে না। কেন্দ্র থেকে কমিটি চাপিয়ে দেওয়ায় এটা সম্ভব হচ্ছে না। যখনই দলের যিনি মহাসচিব নিযুক্ত হন, তখনই তিনি তাঁর কাছের লোককে কমিটির নেতা করতে চান। এজন্যই দলের মধ্যে গ্রুপিং ও কোন্দল নিরসন হচ্ছে না।'
বড় দলে কিছু কোন্দল থাকতেই পারে : এ প্রসঙ্গে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে জানান, আন্দোলনের পাশাপাশি সারা দেশের জেলা কমিটি গঠনের কার্যক্রম চলছে। এরই মধ্যে বেশিরভাগ জেলায় কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিছু জেলায় বাকি আছে। তাও শিগগিরই হয়ে যাবে। পাল্টাপাল্টি কমিটি গঠন হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। বড় দলে নেতৃত্ব নিয়ে কিছুটা কোন্দল থাকতেই পারে। কিন্তু এটাকে কোন্দল ও গ্রুপিং বলা যাবে না। যেভাবে সরকারের বিরুদ্ধে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামছে, রোডমার্চ ও বিভিন্ন জেলায় জনসভায় যেভাবে মানুষের ঢল নামছে, তাতে দলের কোন্দল থাকবে না।'
আব্বাস-খোকা দ্বন্দ্ব ঢাকা মহানগরীতে : ঢাকা মহানগরী কমিটির নেতৃত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার মধ্যে। গত ১৪ মে মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে আহ্বায়ক এবং আবদুস সালামকে সদস্যসচিব করে কমিটি ঘোষণা করা হয়। আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর বিএনপির হাইকমান্ড থেকে বলা হয়েছিল, ছয় মাসের মধ্যে মহানগরীর সব ইউনিট কমিটি গঠনের কাজ শেষ করে মূল কমিটি করা হবে। কিন্তু এখনো অধিকাংশ ওয়ার্ড কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। তাই ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটি কবে হবে, তা বিএনপির সিনিয়র নেতারাও বলতে পারছেন না। এ কমিটির দুই নেতা সাদেক হোসেন খোকা বর্তমানে সৌদি আরবে এবং আবদুস সালাম যুক্তরাষ্ট্রে আছেন বলে দলের একটি সূত্র জানায়।
ঢাকা জেলা কমিটি নিয়ে প্রকাশ্যে বিক্ষোভ : এদিকে ঢাকা জেলা কমিটির বর্তমান সভাপতি হচ্ছেন এম এ মান্নান। সাধারণ সম্পাদক আমান উল্লাহ আমান। কিন্তু এ কমিটি কেউ মেনে নিতে পারছে না। কমিটি গঠনের পর দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এবং গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের সামনে পাল্টাপাল্টি শক্তি প্রদর্শন, বিক্ষোভ মিছিল করেন ঢাকা জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের সঙ্গে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা ও যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমানের দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। কেউ কারো নেতৃত্ব মেনে নিতে পারছেন না। এ কারণে ঢাকা জেলা কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব নিরসন হচ্ছে না বলে নেতা-কর্মীদের অভিযোগ।
এ প্রসঙ্গে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, 'এই মুহূর্তে আমি কোনো কমিটি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি না। দলের চেয়ারপারসন আমাকে যখন যে দায়িত্ব দেন, তাই আমি করে যাচ্ছি।'
'তারা' এখন অনেক দূরে : খুলনা বিএনপিতে ভেতরে ভেতরে কোন্দল চলছে। অতীতে আলী আসগর লবিকে ঘিরে গ্রপিং ছিল। বর্তমানে প্রকাশ্যে তেমন কোনো বিভেদ না থাকলেও ভেতরে ভেতরে সব কিছুই করছেন খুলনা মহানগরী বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু এমপি। লবির লোকজন আপাতত নীরব। তবে লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে লবি যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন বলেও জানা গেছে। বর্তমানে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের সঙ্গে মঞ্জুর যোগাযোগ ভালো থাকায় অধ্যাপক মাজেদুল ইসলাম ও আজিজুল বারী হেলাল তাঁর সঙ্গেই যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন।
এ প্রসঙ্গে নজরুল ইসলাম মঞ্জু কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের মধ্যে কোনো ধরনের গ্রুপিং ও কোন্দল নেই।' লবির সঙ্গে কোন্দল আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'তারা এখন অনেক দূরে।'
সরোয়ার-কামাল দ্বন্দ্ব বরিশালে : বরিশাল জেলায় দীর্ঘদিন ধরে এমপি মজিবর রহমান সরোয়ারের সঙ্গে বিএনপির কেন্দ্রীয় মৎস্যবিষয়ক সম্পাদক ও বরিশাল জেলা (দক্ষিণ) শাখার সভাপতি আহসান হাবীব কামালের কোন্দল চলছে। খালেদা জিয়ার নির্দেশ সত্ত্বেও কোন্দল থামেনি। মজিবর রহমান সরোয়ার একক ক্ষমতা ও দাপট বহাল রাখতে বিভিন্ন তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে কামালের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে সরোয়ার বলেছেন, যে কমিটি হয়েছে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। এজন্যই স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীরা কমিটি মেনে নিতে পারছেন না। তিনি বলেন, 'ওয়ান-ইলেভেনের সময় আমিসহ দলের মাত্র কয়েকজন নেতা দলের পক্ষে কাজ করেছি। যারা সংস্কারপন্থী ও ওয়ান-ইলেভেনের পক্ষে কাজ করেছে, তারাই মূলত আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটাচ্ছে।'
অন্যদিকে আহসান হাবীব কামাল বলেন, বরিশালে এখন বিএনপি ও বিভিন্ন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের সাধারণ নেতা-কর্মীরা যতটা না ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি হামলা-নির্যাতন করা হচ্ছে এমপি সরোয়ারের অনুসারীদের পক্ষ থেকে।
রংপুর বিভাগে আটটি জেলা। খোদ রংপুর জেলায় কমিটি গঠন করা হয়নি। জেলা বিএনপি সভাপতি রহিমউদ্দিন ভরসা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তাঁর পরিবর্তে অন্য কাউকে জেলা সভাপতি করা হতে পারে। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে রংপুরে দলের মধ্যে কোন্দল ও গ্রুপিং চলছে।
No comments